Tuesday, 10 November 2020

গড় শালবনীতে একদিন


আমরা যখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ি, আমার বহুদিনের বন্ধু প্রত্যুষ (বোস) আমাদের বাংলা পাঠ্য বই এ 'আরণ্যক' উপন্যাস থেকে গৃহীত অংশ বিশেষ গুলে খেয়েছিল। শিক্ষকরা তা থেকে প্রশ্ন করলে, উদ্ধৃত অংশ পাতার নম্বর সমেত কোন অনুচ্ছেদে আছে অনায়াসে বলে দিতে পারত। আমরা সবাই জানতাম যে 'দব্রু পান্না বীরবর্দি' বা 'টাঁরবাড়ো' সম্পর্কে না ওর থেকে বেশি কেউ জানে, না ওর থেকে ভাল লেখার কারো ক্ষমতা আছে। বিভূতিভুষণের লেখা পড়ে মনে যে দৃশ্যকল্প তৈরী হয়েছিল, তা এত বছর পরে হলেও মেলানোর সুযোগ পেলাম।


এই প্রথম গেলাম সেখানে...বন্ধু সঞ্জীব (মণ্ডল) ঝাড়গ্রামের ভূমিপুত্র...আর বিধান (তুঙ্গ) বেড়াতে নিজে যায় আর অন্যদের হুড়ো দেয়...এই দুজনের পরামর্শে ও আয়োজনে আমাদের পা পড়ল লাল মাটির সরাণে....অনবদ্য অভিজ্ঞতা...সব জায়গার নামের শেষে '-শুলি' উপসর্গ যুক্ত...আর তারপর আমরা একটা জায়গার ওপর দিয়ে এলাম যার নাম 'শুষণি'...আমরা অপভ্রংশে 'শুস নি' করে নিলাম আর খুব হাসলামঃ সব জায়গায় 'শুলি' 'শুলি' বলে অতিষ্ঠ করে দিয়ে লোভ বাড়িয়ে তুলে শেষমেশ বলে কিনা,'শুস নি!' 😡 এ কেমন অত্যাচার!!!...



যেখানে ছিলাম সেখানকার নাম 'আরণ্যক হোটেল এন্ড রিসর্ট'...কলকাতা থেকে প্রায় ১৭০ কিমি...দারুণ রাস্তা...সাড়ে তিনঘন্টার পথ...যোগাযোগ ±919734346666... @ Aranyak Hotel & Resort. দৈনিক খরচ থাকা-খাওয়া নিয়ে INR 5000-6500. Breakfast Complimentary.

"ছায়া ঘনাইছে বনে বনে..."(পরের লাইনটা কিন্তু প্রযোজ্য নয়) গড় শালবনী বেয়ে রেসোর্টে যাওয়ার পথে ধীরে ধীরে আমরা যে ধানক্ষেত থেকে বনাঞ্চলে প্রবেশ করছি, তা মালুম হচ্ছিল। অসাধারণ রাস্তা। হোটেল-কে বুড়ি ছুঁয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম, একবস্ত্রে। প্রকৃতিই যেন মহুয়া! এমন নেশা ধরানো যে আমরা লোভ সামলাতে পারলাম না। একটা চিত্তাকর্ষক জায়গায় থামতেই হল। বিশাল বিশাল শালের বন, লাল মাটি। সঙ্গে সেখানে পিকনিক করছে উই পোকারা। অনেক উইঢিপিই তার প্রমান। শুরু হল ফটো শেষণ। চলল ভি-লগ বা ভ্লগিং এর বাইটস নেওয়া। আকাশচুম্বী শাল গাছের বন কে মাঝখান থেকে ফেঁড়ে দিয়ে চলে গিয়েছে কালো পিচের রাস্তা। আমরা সেই মায়াময় রাস্তা ধরে গিয়ে পৌঁছালাম ঝাড়্গ্রাম রাজবাড়ি-তে।

সেই ইতিহাসে এখন আর গেলাম না। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে এখন এই রাজবাড়ির অত্যন্ত ভালভাবে পরিচর্যা হয়। এমনকি সাধারণ মানুষ এখানে থাকতেও পারেন। তবে রাজবাড়ির অন্দরমহলে সকলের যাওয়ার অনুমতি নেই। ফটকেই আটক । শুধু যাঁরা থাকার জন্য বুকিং করে এসেছেন, তাঁরা-ই একমাত্র প্রবেশাধিকার প্রাপ্ত। তাই বাইরে থেকে রাজবাড়ি দেখে চোখ সার্থক করে আমরা চললাম কনক দুর্গার মন্দিরের পথে।
আবারও সুন্দর পথ। কখনও জঙ্গল আর কখনও ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। জনবসতি সে ভাবে নেই।

মাঝে মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গ্রাম। একটি গ্রামে তো দেখলাম সব মাটির বাড়ি। দু'তলা মাটির বাড়িও আছে। নিটোল, নিকোনো দেওয়াল। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ন্ত্রণে শীতাতপ(এই বানান-টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক শিক্ষিত মানুষও ভুল জানেন। কথাটা প্রচলিত 'শীততাপ' হিসেবে, যেন 'শীত' ও 'তাপ' এর সমন্বয়ে গঠিত। এটা ভুল। আসল কথাটি হল - শীত+আতপ= শীতাতপ, 'আতপ' মানে উষ্ণ যা থেকে 'আতপ চাল'। তাই পরের বার থেকে 'এয়ার কণ্ডিশানিং মেশিন' এর বাংলা 'শীতাতপ যন্ত্র' সেটা জানতে ও জানাতে ভুলবেন না।)অনুকূল এই সব মাটির বাড়ি। তবে প্রত্যন্ত জায়গা হলেও কিন্তু বিদ্যুৎ ও আন্তর্জাল দু'ই ই বেশ রমরমিয়ে আছে।

কনক দুর্গার মন্দিরে পৌঁছাতে গেলে প্রায় পাঁচশো মিটার মত পথ পায়ে হেঁটে যেতে হয়, পার্কিং থেকে। সেই পথ জঙ্গল কেটে বানানো।এখানে আবার জঙ্গল একেবারেই অন্য ধাঁচের। লম্বা বড় বৃক্ষ নয়, গুল্ম গাছের ঝাড়। বিভিন্ন রকমের সেই সব গুল্ম কিন্ত বেশ মোটা আর প্যাঁচালো। শালবনের মধ্যে দিয়ে যেমন হেঁটে চলে যাওয়া যায়, এই জঙ্গলে কিন্তু এক পা-ও এগিয়ে চলা খুব কঠিন। এই জঙ্গলের নাম ‘কনক অরণ্য’।

তারের জাল দিয়ে ঘেরা পিচ-ঢালা রাস্তা চলে গিয়েছে কনক দুর্গার মন্দিরে। জালের আসেপাশে যে সমস্ত গাছ-গাছালি আছে, তাদের গায়ে নাম সমেত বোর্ড সাঁটানো। সব গুল্মের মধ্যে এক জাতীয় গুল্মের নাম দেখলাম ‘রক্তপিতা’। এর অর্থ কি আমি জানি না।ব্যাসবাক্যে ভাঙলে দাঁড়ায় অনেক রকমঃ ১।রক্ত ও পিতা, ২।রক্ত রূপ পিতা বা ৩। রক্ত পিতা যাহার। কিন্ত কোনোটাতেই আমি কিছু আগা-পাশ-তলা খুঁজে পেলাম না। যাই হোক না কেন, এই ‘রক্তপিতা’-র অজগর-সম রূপ কিন্তু আমার মনের কাছে এক যুক্তিহীন ব্যাসবাক্য নিয়ে হাজির হল – ‘রক্ত পান করে যে’ (‘পে’ ধাতু ধরলে, যেমন হিন্দি-তে আছে – “আপকে পিতা ক্যেয়া পিতা?” – সে রকম আর কি)। দুর্গা মন্দিরে গিয়ে দেখলাম বিরাট ঝাঁ চকচকে মন্দির একটা। পুজো চলছে।

অনেক হনুমান সেখানে। পাশে একটা পোড়ো মন্দির। সেটা দেখলে শিহরিত হতে হয়। পুরোনো মন্দিরটির সামনে একটি বড় বৃক্ষ। তার গায়ে অনেক মানসিকের সুতো বাঁধা। পুরোনো মন্দির আর প্রবেশযোগ্য নেই। প্রধান দ্বারের কড়া মানসিকের সুতো দিয়ে বেঁধে বন্ধ করা আছে। পিসার হেলানো গির্জার মত একটু একদিকে হেলে গিয়েছে মন্দিরটি আর একদম মাঝ বরাবর আপাদমস্তক কেক কাটার মত একটা বিশাল ফাটল পুরো মন্দিরকে দু ভাগে চিরে ভাগ করে দিয়েছে। আমি এরকম আগে কখনো দেখি নি।

আমার যদ্দূর মনে হয়, পুরোনো মন্দির-টিই আসল দুর্গামন্দির। তার এরকম দুর্দশা হওয়ার ফলে নতুম মন্দিরটি তৈরী করা হয়েছে। এমনকি প্রবেশ দ্বারের অভিমুখ-ও পরিবর্তিত হয়েছে।

হনুমানদের পরিবারের কার্যকলাপ দেখতে দেখতে আমরা যখন মশগুল,আমার বন্ধু অরিন্দম পুরোনো মন্দিরের পিছনে একটা বাঁধানো রাস্তা ধরে নেমে গেল। এক ভদ্রমহিলার ব্যাগের মধ্যে বোধহয় মিষ্টি রাখা ছিল। ব্যাগ তাঁর কাঁধে। এক অতি হ্যাংলা কিন্তু সাহসী হনুমান দিব্যি সেই ব্যাগের মধ্যে থেকে মিষ্টি টেনে বের করে খেতে লাগল। তবে সেই ভদ্রমহিলারও অসীম সাহস। ব্যাগ হাতছাড়া করলেন না। না কোনো চিৎকার। শুধু, “কি করছে দ্যাখো!!!” বলে মৃদু প্রতিবাদ করে উঠলেন। কিন্তু তাতে কি আর কাজ হয়। আটকাতে গেলে কি করতে কি হয়। তাই পুরো মিষ্টির প্যাকেট সমেতই হনুমান ভায়া কে দান করলেন। হনুমানভায়া-ও শান্তিপ্রিয় এবং নন-ভায়োলেন্ট। এই দৃশ্য দেখার পর আমাদের সঙ্গে থাকা স্ত্রী-লোকেরা ওই ভদ্রমহিলাকে সাহসীকতার জন্য একটি নোবেল দেওয়া উচিত বলে আলোচনায় রত হলেন এবং ঐ স্থান যত তাড়াতাড়ি ত্যাগ করা যায়, সেই পরিকল্পনায় ব্যাগ্র হলেন। আমি যদিও নোবেল সংক্রান্ত বিষয়ে একমত হলেও ওই জায়গা ছেড়ে যেতে রাজী হলাম না, তখনই। মন্দিরের সেই পিছনের পথ ধরে নামতে লাগলাম। সেখানে হনুমানদের হট্টমেলা। কিন্তু ওরা নিজেদের উন্নততর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। উত্তরসূরী মনুষ্যপ্রজাতি কে অকারণে বিরক্ত করে না। অনেকটাই নির্লিপ্ত।
বেশি নয়,এক’শো মিটার মত যাওয়ার পরেই বিস্ময়। একটা স্রোতস্বিনী নদী নিঃশব্দে বয়ে চলেছে। শরতের শেষে কোমর-জল হবে। অনেকটা দূরে ডানদিকে ও বাঁ দিকে দেখা গেল একদিকে পুরুষ ও আর একদিকে মহিলারা স্নান করছেন। তাঁরা সবাই স্থানীয়।

ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলতে সংকোচ হচ্ছিল, কারণ মহিলাদের দিকে লাজ-লজ্জার বালাই কম। তাঁদের ছবি না তুললেও যদি আমরা কি সব কুকীর্তি করছি বলে আক্রান্ত হই…! ভয় পাচ্ছিলাম। আমাদের বাঁচাল, আমাদের দলে থাকা মহিলা বর্গ। তারাও এসে জুটলো আমাদের সঙ্গে। আমরা এবারে মনের আনন্দে ছবি তুলতে লাগলাম। আমাদের সন্তানদের সঙ্গে এমনিতেই প্রকৃতির যোগ কম।ওরা বিশ্বাস-ই করতে পারছিল না যে, যেখানে ওরা দাঁড়িয়ে আছে, তা আসলে ‘রিভার বেড’। ভূমিরূপ দেখিয়ে ওদের বোঝালাম। বর্ষায় এই নদীর জল কতটা ওপরে ওঠে। ওরা প্রথমে অবাক তারপর বেশ কিছু যুক্তিযুক্ত প্রশ্ন ও তারও পরে ছবি তুলতে আর সেলফি নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ঘড়িতে তখন দুপুর আড়াইটে ছুঁইছুঁই। হোটেলে তখনো আমরা ঢুকিই নি। শুধু কোনো রকমে লাগেজ রিসেপশনে রেখে, লাঞ্চের অর্ডার দিয়ে চরতে বেরিয়ে পড়েছি। খাওয়ার কোনো তাগিদ নেই, কারোর। শুধুমাত্র যেন খাবারটা বলা আছে বলে আর ঠিক অন্য কোনো ভাল খাবার জায়গা নেই বলে, আমাদের ফিরতেই হবে, না চাইলেও। তাই আপাততঃ ব্যাক টু হোটেল।

No comments: