Wednesday, 26 August 2020

বাংলা নাটকের 'অয়দিপাউস'...


মাঝে মাঝেই বেশ কিছু জিনিস বাড়িতে বেরিয়ে পড়ে, গোছাতে গিয়ে, যে সবের সঙ্গে শুধু নস্টালজিয়া নয়, জড়িয়ে আছে পুরো একটা যুগ। 


ঈডিপাস ও ইলেক্ট্রা কম্পলেক্স -- নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই অনেকেই। বলে দেবেন যে মনস্তত্বের অবিসংবাদিত পিতৃপুরুষ সিগমান্ড ফ্রয়েডের হাত ধরেই জন্ম এই দু'টি অতি মূল্যবান কথার, যা আমাদের আদিম রিপু 'লিবিডো'-র সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। নারী-পুরুষ বয়স ও সম্পর্ক নির্বিশেষে কি ভাবে একে অপরের চিরন্তন পরিপুরক এবং সৃষ্টিগত দিক থেকে একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট তা প্রমাণ করে গিয়েছেন ফ্রয়েড। কিন্তু ফ্রয়েডের গবেষণার প্রথম পাঠ কিন্তু শুরু হয় সেই গ্রীক ট্যাজেডির যুগ থেকে। ঈডিপাস ও ইলেক্ট্রা, দু'টি নামই কিন্তু সেই ক্লাসিক গ্রীক ট্র্যাজেডি থেকে তুলে আনা।

সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে কম চর্চা হচ্ছে না। কম সমস্যা নেই, সে সব নিয়ে। মনোজ মিত্রের কথা খুব মনে পড়ে যাচ্ছেঃ "গল্পটা কিন্তু বলে যেতে হবে। একজন হলেও, তার জন্যেই বলে যেতে হবে। কে বলতে পারে, সেটাই হয়ত মাস্টার-পিস!" অসাধারণ কথা! যাঁরা সত্যি সত্যিই আদি সময় থেকে সৃষ্টি করে চলেছেন, গল্প বলে চলেছেন, তাঁদের মধ্যে প্রথমেই রয়ে গিয়েছেন তাই, প্রাচীন গ্রীক নাট্যকার, সোফোল্কেস, যাঁর হাত ধরে পৃথিবী প্রথম চিনল 'ট্র্যাজেডি' কারে কয়। ঈডিপাস আর ঈলেক্ট্রা আর কেউ নন। সোফোক্লেস-এর লেখা সেই গ্রীক ট্র্যাজেডির নায়ক ও নায়িকা। আর সেই নাটকের গল্প এমন জটিল আর ট্র্যাজিক যে আমাদের আধুনিক ওয়েব সিরিজ-ও তার কাছে শিশু, আজও।


আমি, সত্যি বলতে, এত জানতাম না। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর যে তিনমাস আমাদের বিশেষ কিছু করণীয় ছিল না, সেই সময়ে ফরাসী ভাষা শিখতে কিছু দিনের জন্য ভর্তি হয়েছিলাম পার্ক ম্যানসনের ল্য'লিয়স ফ্রাঁসেজ দ্য কাল্ক্যুতা- তে। জায়গাটাই এমন, যে যাতায়াতের পথেই অনেক কিছু শেখার। সঙ্গে গান শোনার নেশা থাকায় এম বিশ্বাস সিম্ফনী তে কাটাতাম অনেকটা সময়। কেনার সামর্থ না থাকলেও দেখা ও শেখার সামর্থ তো ছিল। সেখানে হাতে পড়ল একটা ক্যাসেটের সেট -- রাজা অয়দিপাউস। এর আগে অমিতাভ বচ্চনের 'শোলে'-র ক্যাসেট ছাড়া অন্য কোনো কিছুর আদ্যোপান্ত ডায়ালগ শোনার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। তাই ইচ্ছে হল, দেখি নাটকের ডায়ালগ কেমন হয়। এক মাসের বাসভাড়া আর টিফিনের পয়সা জমিয়ে কিনে ফেললাম 'রাজা অয়দিপাউস'-এর ক্যাসেটের সেট। বাড়ি তে এসে আমি আর বাবা আমাদের টেপ রেকর্ডারে যখন চালালাম, চুলোয় উঠল সব কাজ কর্ম। জানলাম আমার বাবার কাছ থেকে যে বাংলা নাটকের প্রাণপুরুষ হলেন শম্ভু মিত্র নামে এক ব্যাক্তি। তাঁর স্ত্রী তৃপ্তি মিত্রও একই মাপের। কন্যা শাঁওলী মিত্র-ও কিছু কম যান না। 


একটাই প্রশ্ন জাগল মনে, কে এই শম্ভু মিত্র? 'আপনাকে তো কালটিভেট কত্তে হবে ময়াই!' মনের মধ্যে অনুরণন ঘটল। পড়লাম তাঁর সম্পর্কে জানতে, শিখতে। 


এতক্ষণ ওনার সম্পর্কে ভূমিকাতেই এত শব্দ খরচ করে ফেলেছি। যখন এখন লেখার সময় এল, তখন কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না কোথা থেকে শুরু করব। ওনার জন্মদিন গতকাল ছিল। ওনাকে নিয়ে না কিছু লিখলে আমার বিবেক আমাকে ক্ষমা করবে না। তাই এত কথা কাল সারাদিন ধরে ভিড় জমাল আমার মাথায়।  


কালটিভেট করতে গিয়ে জানলাম, যে নাটকের জগতে তিনি নিবেদিত প্রাণ, আর সব তর্ক বিতর্কের ঊর্ধ্বে। নিজের হাতে তৈরি দল 'বহুরূপী' থেকে বিতাড়িত হয়েছেন, যখন তাঁর স্ত্রী তৃপ্তি মিত্র 'বহুরূপী'-র প্রেসিডেন্ট। তাঁর মেয়ে শাঁওলী মিত্র-ও তখন সেই দলে কাজ করছেন। কিছু বলার সাধ্য নেই তাঁর। জীবনে কোনোদিন নাটকের সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যা-কে জড়ান নি। তৃপ্তি মিত্র-র সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পরেও দাপটে অভিনয় করে গিয়েছেন একসঙ্গে দু'জনে। নাটক-কে শিল্প হিসেবে সবসময়ে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে চেয়েছেন, যদিও তাঁর নাটক রাজনৈতিক বার্তাবহ ছিল। কিন্তু সেই বার্তা রাজতন্ত্র আর গণতন্ত্র - দুই প্রতিষ্ঠানেরই ভাল-মন্দ কে তুলে ধরার জন্য। মানুষকে দেখানোর জন্য যে দুই প্রতিষ্ঠানই কেমন হিপোক্রেসি নিয়ে জগতজুড়ে চলে আর 'করাস' (chorus), আম জনতা হয় তার সব থেকে বড় শিকার। তখনকার বামপন্থী সরকারও তাঁর প্রতি ঔদার্য দেখায় নি, খুব একটা। 'নবান্ন' পেয়েছিল কয়েকটি হাতে গোনা শো। অনেক বলে ক'য়েও ওরকম একটা দারুণ নাটকের জন্য টিকিট কাউন্টার পর্যন্ত দিতে রাজী হয়নি তৎকালীন সরকার, থিয়েটার হল তো দূর। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল 'নবান্নের' শো। ইণ্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে তাঁর চলেছিল লাগাতার মতবিরোধ। উৎপল দত্ত-ও সেখানে করেছেন বিরূদ্ধাচরণ, তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি কঠোরভাবে সৎ থাকতে। কিন্তু তিনি নিঃশব্দে কাজ করে গিয়েছেন। কাউকে অসম্মান না করে, কারো প্রতি বিরূপ মন্তব্য না করে। পিছু হঠেছেন বারে বারে। অসম্ভব মানসিক জোর কে সম্বল করে, করে গিয়েছেন কাজ, স্টেজে আর স্টেজের বাইরেও। বোধ হয় খুব রাজনৈতিক সচেতনতা ও মূল্যবোধের কারণেই কোনো ভারতীয় রাজনৈতিক দলের ভাবধারার সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন নি। কিন্তু নাটকের মাধ্যমে চালিয়ে গিয়েছেন, অবিরাম, রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনা ও বোধ উদ্রেক করার প্রয়াস। ‘বৌ ঠাকুরানীর হাট’ তার এর এক দলিল। 


'রক্তকরবী' পড়েছেন অনেকেই। কিন্তু শম্ভু মিত্র সেটিকে স্টজে যে উচ্চতায় পৌঁছে দিলেন তার ওপরে কাউকে পোঁছাতে অনেক শতাব্দী পেরোতে হবে মনে হয়। 'চাঁদ বণিকের পালা'-ও তাই-ই। একটি সাধারণ মঙ্গলকাব্যের আখ্যান কোন মহিমায় উদ্ভাসিত হতে পারে, মানুষ ও ঈশ্বর কোন বন্ধনে আবদ্ধ এবং তাঁরা মানুষের কত কাছাকাছি, কিভাবে একজন মানুষ ঈশ্বরকে ছাপিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন, সে সব প্রশ্নের জবাব তিনি দিয়েছেন এই নাটকের মাধ্যমে। ক্লাসিকস তাঁকে বার বার টেনেছে। 

ইবসেন-এর 'Doll's House' কে 'পুতুলখেলা' করে যখন স্টেজে নামালেন, বাংলার তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়াল রা ভেবে পেলেন না, ক'দিন আগে বালিগঞ্জ গভর্ন্মেন্ট ইস্কুল থেকে পাশ করা, কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্সের স্নাতক এই আন্তর্জাতিক অন্তরদৃষ্টি পেলেন কোথা থেকে! 


মৃত্যুশয্যায় নিজের সন্তান কে বলে গিয়েছিলেন, তাঁর মৃতুতে কোনো আতিশয্য যেন না থাকে। বেশি লোক জানাজানি হওয়ার আগেই যেন তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। মুখাগ্নি, শ্রাদ্ধানুষ্ঠাণ এসবের-ও কোনো প্রয়োজন নেই বলে ইচ্ছা প্রকাশ করে গিয়েছিলেন তিনি। শাঁওলী মিত্র যোগ্য সন্তান। পিতার শেষ ইচ্ছা রেখেছিলেন, সব দিক থেকে। 


আমরা ছোটবেলায় যে সিনেমা হল তিনটিতে মূলত বিদেশি ছবি দেখতে যেতাম সেগুলি ছিল, লাইট হাউস, নিউ এম্পায়ার ও গ্লোব। কিন্তু তার আগে যে লাইট হাউস ও নিউ এম্পায়ারে রীতিমতো নাটক ও হত তা জানলাম শম্ভু মিত্র মহাশয়ের নিজের লেখা 'অয়দিপাউস' - বই টির মুখবন্ধ থেকে। বইটির প্রকাশক এম সি সরকার এন্ড সন্স। চোখের সামনে তখন আর স্ক্রীন ভাসে না...ভেসে ওঠে দৃশ্য...আর সেই কন্ঠ...মনে হয় বাস্তব জীবনে আধুনিক গ্রীক ট্র্যাজেডির সব থেকে বড় নায়ক ছিলেন তিনিই।


জানতেন বোধ হয় তাঁর মৃত্যু বাংলা থিয়েটার আর স্টেজ থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলতে পারবে না কোনোভাবেই...ক্লাসিক্যাল ট্র্যাজিক হিরোদের মতই অবিনশ্বর তিনি।তাই গল্পের নায়কের থেকেও আরও অনেক বড় বাস্তবের নায়ক হয়েই রয়ে গিয়েছেন তিনি, বাংলা নাটকের প্রবাদপ্রতীম চরিত্র হিসেবে। 

‘দশচক্র’ বাংলা নাটকের এই প্রাণপুরুষ-কে ‘ভূত’ করে দিতে পারল কই!


Tuesday, 18 August 2020

২২ শে শ্রাবণঃ নায়ক রবীন্দ্রনাথ

আগের বার 'চারুকলা'-র মাননীয়া সম্পাদিকা কে বলেছিলাম যে একটু সময় পেলে ছড়ার বদলে আরো ভাল কিছু একটা দেওয়ার চেষ্টা করতাম। গতবারের বিষয় ছিল 'প্রকৃতি'। যা ইচ্ছে একটা দাঁড় করিয়ে দেওয়াই যায়। দিয়েওছিলাম। সে দিন লাঞ্চ সেরে পটাপট কতগুলো লাইন পরপর এমন ভর করল, যে দেখলাম একটা গুছিয়ে স্যাটায়ার হয়ে গিয়েছে। আলাদা করে কোনো রিসার্চ ওয়ার্ক করতে হয় নি। পাঁচ তারিখে দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশের পর জানতে চাইলাম, পরের সংখ্যা-র বিষয় কি। হোয়াটসঅ্যাপে ওনার ছোট্ট উত্তরঃ "রবীন্দ্রনাথ--২২ শে শ্রাবণ"। ব্যাস আমার আক্কেল গুড়ুম। প্রথম প্রতিবর্ত ক্রিয়া -- সেরেছে রে! কি লিখব! কিছুই তো সেভাবে জানি না। 


কিছু মানুষ আছেন যাঁদের সৃষ্টি নিয়ে চর্চা রোজ করা উচিত কিন্তু তাঁদের নিয়ে কিছু বলতে বা লিখতে গেলে আমার হাত পা কাঁপে। ব্রহ্মাণ্ড যেমন সীমা ও অন্তহীন, এঁরাও তাই। আর রবীন্দ্রনাথ যা করে গিয়েছেন, যে মাত্রায়, আর যে বিস্তারে, সে সম্পর্কে আলোচনা করতে যাওয়া মানেই এক বিসম প্রচেষ্টা। তবু কিছু কথা মাথায় এল। আপনাদের সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিই।


একটা সময় ছিল। প্রত্যেক ভ্যালেন্টাইন্স ডে তে 'চন্দ্রবিন্দু' নিজেদের স্টেজ শো করত। আর সেই শো গুলোতে চন্দ্রিল যথারীতি মানব জীবন-কে আরো কাছ থেকে দেখার বাসনায় প্রথমে হলের গেটে দাঁড়িয়ে টিকিট দেখে সবাইকে হলে ঢুকতে দিতেন। আর তারপরে পর্দা ওঠার আগে, এক মুখবন্ধ করে সকলকে এমন চমকে দিতেন, যে মনে হত, “বলে যান ভাই...পুরো পয়সা আপনাদের গান শোনার আগেই উসুল!” এমনিতেই দুর্ধর্ষ বক্তা উনি, ইউটিউবের দাক্ষিন্যে দেখেছেন সবাই নিশ্চয়ই। যখনকার কথা বলছি, তখন ওনাকে পাওয়া এত সহজ ছিল না। যাই হোক, ওনার চোখা চোখা স্ল্যাপস্টিক স্যাটায়ার মনের ওপর সপাসপ আঘাত হানলেও সে বেদনা অট্টহাসির আড়ালে সমাহিত। অপেক্ষা পরেরটার জন্য। উনি কিন্তু স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান নন। তক্ষুণি রান্না করা খোরাক পরিবেশন করেন। পুরো হাতে গরম, মনে-ও। দর্শক প্রশ্ন করতে পারতেন। তা একবার প্রশ্ন এল, “ আচ্ছা, যখন লেখেন, আপনাদের থিম টা কি থাকে? মানে কি ভেবে লেখেন?" চন্দ্রিল বললেন, গান লিখতে গিয়ে উনি একটা কথা বুঝেছেন "বাঙালী দু-টো জিনিস হেব্বি খায়। যে কোনো মোড়কে চোখ বন্ধ করে বেচে দেওয়া যায়...মারকাটারি হিট হবেই -- ব্যর্থ প্রেম আর সিপিএম"। আমি জানি না ঠিক, যে উনি সেদিন ‘ব্যর্থ’ শব্দটিকে ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়ে কমোন নিয়ে ব্যবহার করেছিলেন কি না। কিন্তু দেখুন, কি সহজে এই কথার অভিঘাত আমাদের মহান স্রষ্টাদের সৃষ্টিগুলোকে ব্যাখ্যা করে দেয়। রবীন্দ্রনাথ-ও বাদ যান না। ভাবুন না, আপনি '২২ শে শ্রাবণ' সিনেমা টি প্রথম বার দেখার পর জানতে পারেন যে, ওটা একটা মারাত্মক থ্রিলার, সিরিয়াল কিলিং নিয়ে। যা আশা করে গিয়েছিলেন, সেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিন্দুবিসর্গ সম্পর্কও নেই। অথচ জিনিষটা বেচা হল আদ্যন্ত রবি ঠাকুরের মোড়কে। কৌতূহল মানুষকে দেদার হল-মুখী করে দিল। শুধু নামেই আদ্ধেক বাজি মাত। আর " ওরা কাজ করে" কবিতা নিয়ে হায়ার সেকেণ্ডারী পড়ার সময়ে তো ভেবেই বসেছিলাম, রবীন্দ্রনাথের থেকে বড় বামপন্থী বোধ হয় পৃথিবীতে আর নেই। তখন কে মার্কস আর কে লেনিন...! কাউকেই চিনি না, জানি না। ‘বামপন্থা’ কি, তা খায় না গায়ে মাখে, তা আমাদের প্রজন্মের বাংলা মিডিয়ামে পড়া নব্বই শতাংশ ছাত্রছাত্রী প্রথম জেনেছিল, রবীন্দ্রনাথের 'ওরা কাজ করে'-র হাত ধরে, ভোটবাক্স আর ইস্কুল চত্তরে এস-এফ-আই এর অকারণ দখলদারীর চেষ্টা চাক্ষুষ করার বাইরে। বলে রাখি, এই আলোচনায় রাজনীতির ভ্যাপসা গন্ধ যদি খুঁজে পান কেউ, প্রচার বা অপপ্রচার বলে মনে যদি করেন কেউ, আজকের রাজনৈতিক বাতাবরণে, তাঁকে শতকোটি ধন্যবাদ কারণ তাঁর হাত ধরেই এ হেন সময়েও চন্দ্রিলের সেদিনের ভবিষ্যদ্বাণী কি নিদারুণ ভাবে ফলে যায়!  সি-পি-এম তাই না থেকেও থেকে যায়, যদিও এর সঙ্গে আসল ‘বামপন্থা’-র কোনো সম্বন্ধ নেই। পুরোমাত্রায় ‘আকাশের গায়ে না কি টক টক গন্ধ’-কেস।


এইবার আসি ব্যর্থ প্রেমে। ‘২২শে শ্রাবণ’ সিনেমাটির শেষ দৃশ্য, বলাই বাহুল্য, ক্লাইম্যাক্স-ও।  সুইসাইডে উদ্যত খলনায়ক আউড়ে চলেছেন ‘শেষের কবিতা’-র শেষ অংশ থেকে। দর্শক তাতেই জমে ক্ষীর। কারণ, প্রত্যেক মানুষের জীবনের শেষ মূহূর্তে ফুটে ওঠে তার মননে, যে সে তার আদ্যন্ত জীবদ্দশায় কি কি পারে নি। কি কি পেরেছে তা নিয়ে মানুষ নিজের মধ্যে কনফিডেন্স তৈরী করে বাঁচার জন্য। মৃত্যুকালে সেই কনফিডেন্সের প্রয়োজন ফুরোয়। তখন সে, যতই বেদনাদায়ক হোক না কেন, নিজের মধ্যে ব্যর্থতার এক চরম রোম্যান্টিক চিত্র আঁকতে শুরু করে নিজের কাছেই। কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই। মৃত্যু যে কোনো ব্যাখ্যা মানে না। তাই ব্যাখ্যা-বিহীন রোম্যান্সের গন্ধ নিয়ে মহাপ্রস্থানে দোষ কি! ব্যর্থতার ব্যাখ্যা ততক্ষণই, যতক্ষণ মানুষ সব ঠিক-ভুল জেনেও সেই ব্যর্থতার মধ্যেও আত্মপক্ষ সমর্থনে যুক্তি খোঁজে। ব্যর্থ প্রেমের সঠিক দলিল হিসেবে তাই ‘শেষের কবিতা’ চিরকালীন, অবিনশ্বর। 


শেক্সপিয়র প্রথম যখন নাটক-কে নিদারুন কমার্শিয়ালাইজ করতে ব্যস্ত, নিজের পেটের তাগিদে, তখন থেকে এই পীর বাবাজি একটা মারাত্মক জিনিস আবিষ্কার করেন – দর্শক কাঁদতে বড় ভালবাসে। ভাবলে বোঝা যায় যে সহজেই যে আমরা সবাই সাধারণভাবে একটু দুঃখবিলাসী বটে। সেই দুঃখ-কষ্ট কে যদি এমন করে পরিবেশন করা যায়, যে দর্শক সেখানে নিজেকে খুঁজে পাবে, তার যদি মনে হয় – আরে, এ তো আমার গল্প টাই বলছে, আমার দুঃখ-কষ্ট ঠিক এরকম-ই তো – তাহলে সেই পরিবেশন সুপার ডুপার হিট। শেক্সপীয়রের ট্র্যাজেডি তাই কমেডি গুলোর থেকে অনেক বেশি বিখ্যাত। প্রেম-ভালবাসা মানুষের কাছে তখনই সার্থক যখন তার মধ্যে হৃদয় নিংড়ানো বেদনা থাকে। ্সেই বেদনার অভিঘাত বড় মারাত্মক। বারংবার আমরা সেই গল্পে ফিরি, যেখানে প্রেমের বলি চড়িয়ে দিয়ে এক মারাত্মক দুঃখে নিমজ্জিত হওয়া যায়। এই বলি প্রদত্ত-তেই মানুষের মনে প্রেম থাকে শাশ্বত, চিরন্তন ও চিরনূতন। না আছে হাড়িকাঠ, না, রক্ত। শুধু আছে নিঃশব্দ অপার বেদনা। যেখানে প্রেমের বিনিময়ে, রক্তারক্তি, মৃত্যু, সেখানে প্রেমের জয়লাভ হয় বটে, কিন্তু তা কখনই মুক্ত হতে পারে না। পার্থিব বন্ধনে বাঁধা পড়ে যায়। আর ছাড়ানো যায় না। তাই বলি-ই এক পথ যার মাধ্যমে প্রেম স্বর্গীয় হয়ে ওঠে।আর নিজের বলিদানের মধ্যে এক দর্প না থাকলে ঠিক জমে না। রবীন্দ্রনাথও সেকথা দিব্বি বুঝেছিলেন, যে লোকে কি খাবে।প্রেমের বলি চড়ানোর বাইরেও আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা দের একটা সামাজিক আতসকাচের নিচে ফেলে দেখতে অভ্যস্ত। সঙ্গে একটা সামাজিক বাঁধন-ও আছে, যে ফরম্যাট থেকে বেরোলে আবার মুশকিল।ভেবে দেখুন। নারী স্বাধীনতার এই যুগে যদি কেউ রবীন্দ্রনাথের 'শেষের কবিতা' থেকে নিচের অংশ পড়ে বসে, আর তার মনে চিরন্তন প্রেমের উদ্রেক হবে কি? সে কি আর মন খুলে কোনো আধুনিকা-কে ভালবাসতে পারবে? 


যোগমায়া বললেন, "তুমি যখন তর্ক কর তখন বুঝতে পারি, তুমি অনেক বই পড়া মেয়ে, তোমার মত ভাবতেও পারি নে, কথা কইতেও পারি নে। শুধু তাই নয়, কাজের বেলাতেও এত শক্ত হতে পারিনে। কিন্তু তর্কের ফাঁকের মধ্যে দিয়েও যে তোমাকে দেখেছি, মা। সেদিন বারোটা রাত তখন হবে -- দেখলুম তোমার ঘরে আলো জ্বলছে। ঘরে গিয়ে দেখি তোমার টেবিলের ওপর নুয়ে পড়ে দুই হাতের মধ্যে মুখ রেখে তুমি কাঁদছ। এতো ফিলোজফি পড়া মেয়ে নয়। একবার ভাবলুম, সান্ত্বনা দিয়ে আসি; তারপরে ভাবলুম, সব মেয়েকেই কাঁদবার দিনে কেঁদে নিতে হবে, চাপা দিতে যাওয়া কিছু নয়। একথা খুব জানি, তুমি সৃষ্টি করতে চাও না, ভালবাসতে চাও। মন প্রাণ দিয়ে সেবা না করতে পারলে বাঁচবে কি করে। তাই তো বলি, ওকে কাছে না পেলে তোমার চলবে না। বিয়ে করব না বলে হঠাৎ পণ করে বোসো না। একবার তোমার মনে জেদ চাপলে তোমাকে সোজা করা যায় না, তাই ভয় করি।"


আধুনিকা কে পেতে হলে মনে রাখতে হবে যে প্রেম ব্যর্থ হতে পারে, কারণ, 

"তোমাকে দেখে আমার অনেকবার মনে হয়েছে, অনেক পড়ে অনেক ভেবে তোমাদের মন বেশি সূক্ষ্ম হয়ে গেছে; তোমরা ভিতরে ভিতরে যে-সব ভাব গড়ে তুলছ আমাদের সংসারটা তার উপযুক্ত নয়।... আমাদের আমলে মনের মোটা মোটা ভাবগুলো নিয়ে সংসারে সুখদুঃখ যথেষ্ট ছিল, সমস্যা কিছু কম ছিল না। আজ তোমরা এতই বাড়িয়ে তুলছ, কিছুই সহজ রাখলে না"।


তবে কি প্রেম এমন মানুষের সঙ্গেই হওয়া উচিত যাঁর অনুভূতি সুক্ষ্ম নয়? মোটেই নয়। অনুভূতি শিক্ষা মানে না, প্রেমের বিষয়ে, না মানে যুক্তি-তক্কো। তাই লাবণ্য উত্তরে বলে ওঠে সেই অমোঘ সত্যি, যা প্রেম তাকে এনে দিয়েছে-

"আজ হঠাৎ দেখলুম, আমি ও ভালবাসতে পারি। আমার জীবনে এমন অসম্ভব যে সম্ভব হল এই আমার ঢের হয়েছে। মনে হয়, এতদিন ছায়া ছিলুম, এখন সত্যি হয়েছি।এর চেয়ে আর কি চাই।"


প্রেম আমাদের সমাজে কি বয়ে আনে? এক সামাজিক আইডেন্টিটি। প্রেমের অদ্ভূত চরিত্র। একাধারে তা চায়, সব্বাই জানুক, আবার অন্যদিকে নিহিত থাকে তা নিয়ে সামাজিক লজ্জার একটা বড় আশঙ্কা। আমাদের সমাজ আজও একবিংশ শতকের এক কুড়ি পার করার পরেও মোবাইলে বিশ্বজয় করেছে বটে, কিন্তু 'প্রেম' বিষয়ে বিশেষ ঔদার্য্য দেখিয়ে উঠতে পারে নি। হত্যা ও প্রেম পৃথক ভাবে দুটোই ক্রাইম। দু’টোর ক্ষেত্রেই তাই আই-পি-সি নিয়ে কাটাছেঁড়া করা যায়, কাজটা বা অনুভূতিটা আইনি না বে-আইনি।আরে প্রেমের আবার আইনি বে-আইনি, বৈধ আর অবৈধ! ভালই তো বাসছে রে বাবা, মানুষ মানুষকে। অকারণে দেশের জিডিপি-র পঁচাত্তর শতাংশ ব্যয় করে মানুষ মারার কল তো ফাঁদছে না! সেই বজ্র-আঁটুনী, ফস্কা গেরোর কালো হাত থেকে রবীন্দ্রনাথের লাবণ্য নিজের প্রেম কে টিঁকিয়ে রাখতে চায়। সে তাই ছায়া থেকে সত্যিতে রূপান্তরীত হওয়ার পরেও প্রেম-কে সামাজিক স্বীকৃতীর নামে বিবাহের রূপ দিতে নারাজ। সে আকুতিভরে বলে ওঠে, "আমাকে বিয়ে করতে বোলো না, কর্তামা।" কারণ বিবাহ নিবিড় ও অসীম প্রেম-কে কোথাও বেঁধে ফেলে হত্যা করে। সে সামাজিক বন্ধন বড় অন্ধকার। আর "অন্ধকারের ভয়, অন্ধকারের দুঃখ, অসহ্য, কেন না অস্পষ্ট।"

বরং,

"প্রহরের পর প্রহর যায়, কেউ আসে না। ঠিক মনের কথাটি বলার লগ্ন যে উত্তীর্ণ হয়ে গেল! এর পর যখন কেউ আসবে, তখন কথা জুটবে না, তখন সংশয় আসবে মনে, তখন তান্ডবনৃত্যোন্মত্ত দেবতার মাভৈঃ-রব আকাশে মিলিয়ে যাবে। বৎসরের পর বৎসর নীরবে চলে যায়, তার মধ্যে বানী একদিন বিশেষ প্রহরে হঠাৎ মানুষের দ্বারে এসে আঘাত করে। সেই সময়ে দ্বার খোলবার চাবিটি যদি না পাওয়া গেল তবে কোনোদিনই ঠিক কথাটি অকুণ্ঠিত স্বরে বলবার দৈবশক্তি আর জোটে না। যে দিন সেই বানী আসে সে দিন সমস্ত পৃথিবীকে ডেকে খবর দিতে ইচ্ছে করে -- শোনো তোমরা, আমি ভালবাসি। আমি ভালবাসি এই কথাটি অপরিচিত-সিন্ধুপার-গামী পাখির মত কত দিন থেকে কত দূর থেকে আসছে। সেই কথাটির জন্যই আমার প্রাণে আমার ইষ্টদেবতা এতদিন অপেক্ষা করছিলেন। স্পর্শ করল আজ সেই কথাটি -- আমার সমস্ত জীবন, আমার সমস্ত জগৎ সত্য হয়ে উঠল। বালিশের মধ্যে মুখ লুকিয়ে লাবণ্য আজ কাকে এমন করে বলতে লাগল -- সত্য, সত্য, এত সত্য আর কিছু নেই।"



কিন্তু সেই প্রেমে ঔদার্যের কেন এত অভাব? সে প্রশ্নের উত্তর-ও লাবণ্য দিয়েছেঃ-

"দেখো মিতা, মেয়েদের ভাললাগা তার আদরের জিনিসকে আপন অন্দরমহলে একলা নিজেরই করে রাখে, ভিড়ের লোকের কোনো খবরই রাখে না। সে যত দাম দিতে পারে সব দিয়ে ফেলে, অন্য পাঁচজনের সঙ্গে মিলিয়ে বাজার যাচাই করতে তার মন নেই।" 


তবু কেন লাবণ্যর প্রেম সার্থক হল না?

'যে অঙ্কুরতা বড় হতে উঠতে পারত অথচ যেটাকে চেপে দিয়েছে, বাড়তে দেয় নি...এতদিনে সে ওর সমস্ত জীবনকে অধিকার করে সফল করতে পারত। কিন্তু সেদিন ওর ছিল জ্ঞানের গর্ব, বিদ্যার একনিষ্ঠ সাধনা, উদ্ধত স্বাতন্ত্র্যবোধ। সেদিন আপন বাপের মুগ্ধতা দেখে ভালবাসাকে দুর্বলতা বলে মনে মনে ধিককার দিয়েছে। ভালোবাসা আজ তার শোধ নিল, অভিমান হল ধূলিসাৎ।'


লাবণ্য তাই চায় নি যে একই মানুষ 'তাদের মধ্যে এক জন সৃষ্টিকর্তার আদরে তৈরী, আর একজন তোমার অনাদরে গড়া' - এই বিভেদ তৈরী হোক।তাই সে অনায়াসে বলে ফেলে অমিতর বুকে মাথা রেখে, বিদায় বেলায় বেদনার সকল মায়া কাটিয়ে নিজের প্রেম কে চিরন্তন নির্মোহ করে, "তোমার সঙ্গে আমার যে অন্তরের সম্বন্ধ তা নিয়ে তোমার লেশমাত্র দায় নেই। আমি রাগ করে বলছি নে, আমার সমস্ত ভালবাসা দিয়েই বলছি, আমাকে তুমি আঙটি দিও না, কোনো চিহ্ন রাখবার কিছু দরকার নেই। আমার প্রেম থাক নিরঞ্জন; বাইরের রেখা, বাইরের ছায়া তাতে পড়বে না।"


তবে বিবাহে কি ভালবাসা থাকেই না?

"রূপক দিয়েই বলতে হবে...কেতকীর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ভালবাসারই, কিন্তু সে যেন ঘড়ায় তোলা জল -- প্রতিদিন তুলব, প্রতিদিন ব্যবহার করব। আর লাবণ্যর সঙ্গে আমার যে ভালবাসা সে রইল দিঘি, সে ঘরে আনবার নয়। আমার মন তাতে সাঁতার দেবে।"


'২২শে শ্রাবণ' ছবিতে না আছেন রবি ঠাকুর না আছে শেষের কবিতার প্রেমের গল্প। কিন্তু আছে সেই চিরন্তন সত্যের জয়গান, যেখানে একজন অসম্ভব প্রতিভাবান মানুষ, মানুষের ভিড়ে মিশতে না পারার তাগিদে শেষে নিজেকে উৎসর্গ করে মহানির্বানের পথে যাত্রা করেন। বলি প্রদত্ত করেন নিজের চরম উন্নাসিকতা-কে, মেলাতে না পেরে। স্কেল-টা সহজ, বি-ফ্ল্যাট। ধরার চেষ্টা করুন, সেই মহাজাগতিক বিদায়ের স্তুতি-কে।


"কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও।

তারি রথ নিত্যই উধাও

জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদস্পন্দন, 

চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষফাটা তারার ক্রন্দন।

ওগো বন্ধু, সেই ধাবমান কাল

জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল --

তুলে নিল দ্রুতরথে

দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে

তোমা হতে বহু-দূরে।

মনে হয়, অজস্র মৃত্যুরে 

পার হয়ে আসিলাম

আজি নবপ্রভাতের শিখরচূড়ায়-

রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়

আমার পুরো নাম

ফিরিবার পথ নাহি; 

দূর হতে দেখ চাহি

পারিবে না চিনিতে আমায়।

হে বন্ধু, বিদায়।"



শেষ দৃশ্যে অত রক্ত আর নায়কের স্বতঃস্ফূর্ত বলিদান দেখে আমার কি মনে পড়ল বলুন তো!  বোলপুর থেকে খানিকটা গেলেই পীঠস্থান কঙ্কালীতলা। সেখানে একটা হাড়িকাঠ আছে দেখলেই হাড় হিম হয়ে আসে, মনে হয় কে যেন বলছেঃ

“রাজরক্ত চাই তোর দয়াময়ী; জগতপালিনী মাতা…রাজরক্ত আছে দেহে। এই রক্ত দিব…এই রক্তে শেষ মিটে যেন অনন্ত পিপাসা তোর, রক্ততৃষাতুরা…”।


তাই চন্দ্রিলের ‘ব্যর্থ প্রেম’-এর তত্ত্ব মিলুক বা না মিলুক, দিনের শেষে নায়ক কিন্তু রবীন্দ্রনাথ-ই রয়ে গেলেন। ‘ঠাকুর’-ই বটে, আমাদের সকলের মনের...



 


চিত্রগ্রহণ ও হাড়িকাঠ বিষয়ে উদ্ধৃতির সৌজন্যেঃ তিস্তা নাগ, বেঙ্গালুরু

তৃতীয় বিশ্ব

উলঙ্গ প্রায়, কবিতা মাখি গায়

কলঙ্ক শিরে হলেম আমি রাজা।

ঈদের চাঁদে আসন পেতে ধ্যানে,

বিসমিল্লা ত্রিশূল দিলেন মাজা...



রাত নেমেছে, ফোনের স্ক্রিনে

একটি ফোঁটা ডার্ক থিম

আঙুল দিলেই খুলছে দেখ 

পক্ষীরাজে সিম সিম....


শব্দ গোছানো সুন্দর, ছুরির মত কাটে

গোছানো শব্দ সুন্দর, কাটে ছুরির মত

রক্ত গোলাপ লাল, লাল গোলাপ রক্ত 

বিষ্ঠাতে পেয়ে সার, পাপড়ি ফোটে কত!


জন্মাষ্টমী

কৃষ্ণকলি কৃষ্ণ /- সাথে কেমন সই

দোদুল দোলায় দুলছে ঝুলন/ শ্মশানযাত্রা খই

নদী বিষায় নাগ কালীয়/ ফণার 'পরে নৃত্য

সূত্র কামে মঙ্গল সুধা/ মাধব মালঞ্চ ভৃত্য 


বাঁশির নলে বারুদ জমে/ক্ষাত্রধর্ম কামান

চিত্র বড় বিচিত্র বীর/ রঙ্গিলা আসমান

ব্রহ্মতেজে ক্ষমার আসর/ ফল সুরা নির্যাসে

আস্ফালনে পূর্বরাগ/ সর্বনাশ পোষ-মাসে


বরণ চরণ নড়ন চড়ণ/ভস্ম নিরবাণ

ত্রিনয়ণী বড় ধ্রূপদী তানে/ ত্যাজিলেন কুর্বাণ

আড়াই প্যাঁচে প্যাঁচার গলা/ স্কিতযোফ্রেনিক ব্লেড

জলখাবারে সালামি সেলাম/ স্রাব ঋতু কোড রেড


ময়ূর যখন পেখম মেলে/ পালক সহস্র যোণি

অভিশাপে দেবেন্দ্র হাসেন / বলয় যে পান শনি

মুকুট ছিল শূন্য খানিক/ ভার্মিলিয়ন সিঁথি

দেবাদিবেদ ফিরত গেলেন/ চিয়ার্স চরৈবেতি


Monday, 17 August 2020

শর্ট-ফিল্মে চতুষ্পদঃ #lockdownshortfilms

 

চলচ্চিত্রের দু’টো ফর্ম লকডাউনে দারুণ ট্রেন্ডিং। কারণ অকাজের বাজারে হাতে অনেক সময় আছে এরকম মানুষের অভাব নেই, টাকা-পয়সা-ব্যবসা-চাকরী না থাকলেও।বাড়িতে খাবার না থাকলেও, ডেটা প্যাক আছে। তাই এই সময়ে একটা নতুন মোড় নিয়েছে এন্টারটেইনমেন্ট। আমি সেটা ভাল না খারাপ সেই প্রশ্নে যাচ্ছি না। আমি নিজেই সিনেমা খুবই কম দেখেছি গত কয়েক মাসে। গিলেছি ওয়েব সিরিজ আর শর্ট ফিল্ম। বাংলা শর্ট ফিল্ম দেখার কারণ বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব চেনা-পরিচিতদের সেই বৃত্তে থাকার জন্য। বাকি আর খুব একটা কিছু দেখে উঠতে পারি নি। কারণ গত বেশ কয়েক বছর ধরে অনেকটা পড়াশোনা বাকি পড়ে গিয়েছিল বাস্তব দৌড়দৌড়ির চাপে।

করোনা পরিস্থিতিতে আবার শর্টফিল্ম-ও তার ধরণ বদলেছে। শুটিং-টাই বাড়িতে বসে। পুরোটা এডিটিং নির্ভর। সবার একা একা অভিনয়ের (একক অভিনয় নয় কিন্তু) মালা গেঁথে তৈরী হচ্ছে ছোট ছোট গোড়ের মালা।

আমি যখন বেলুড়ে থাকতাম, আমার থেকে কয়েকবছরের ছোট, কিন্তু মন-মানসিকতায় মেলে, এরকম একজন বন্ধুর নাম বলতে বললে ‘নানু’-র, যার পোশাকি নাম দেবনাথ চ্যাটার্জী, কথা মনে পড়েই যায়। অনেক বছর যোগাযোগ নেই। আমার ফেসবুকে প্রত্যাবর্তনের পর পরস্পর কে খুঁজে কথা বলে ফেললাম। যোগাযোগ না থাকলেও ও কি করে, কোথায় থাকে সবটাই খবর রাখতাম অন্যদের মাধ্যমে। বছর বারো আগে একবার মিনিবাসে দেখা হয়েছিল। তখনো কলকাতা ব্যাট্রারী চালিত স্কুটির কথা খুব একটা জানে না। কিন্তু নানু সেই বিষয়ে ছিল বিশেষজ্ঞ এবং একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কোম্পানী তে চাকরি করত। সঙ্গে অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছিল। বিদেশেও ঘুরে চলে এসেছে, ততদিনে, অভিনয়ের টানে। কিন্তু আজকালকার যুগে কেউ নাটক করবে বলে চাকরী ছাড়ে! নানু ছাড়ল। জানতে পেরে আমি আর কিছু না পারি, নানুর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা অবনত করলাম। কেন তা ব্যাখ্যা করে বোঝনো সম্ভব নয়।

আবার যোগাযোগ হওয়ার পর, করোনা পরিস্থিতিতে যখন মোটামুট সকলের নাভীশ্বাস উঠতে আরম্ভ করেছে চারিদিকে দেখলাম বহুল প্রচার চলল, ‘মাস্কবাদী’ বলে একটি শর্ট ফিল্মের। পরিচালক সুজন নীল মুখার্জী। নানু-ও তাতে আছে। নীল স্টেজে দারুণ। বহুবার দেখেছি। কিন্তু নীল-কে আমার ব্যক্তিগতভাবে অভিনেতার থেকে অনেক বেশি পছন্দ হয় পরিচালক হিসেবে। স্টেজে এমন এমন ভিস্যুয়ালস তৈরী করেন যা মনে দাগ কেটে যায়। তাই ‘মাস্কবাদী’ নিয়ে অনেকটা আশা তৈরী হল। পোস্টার-টাও দৃষ্টি কাড়ে। কোনো বলিউড সিনেমার থেকে কম নয়।

রিলিজের দিন, লিঙ্কের জন্য হাঁ করে বসে। পেলাম অবশেষে। দেখলাম এবং যারপরনাই আশাহত হলাম। স্যাটায়ার বানাতে গিয়ে গোটা একখান আয়রণি। পাঁচে মেরে কেটে দুই দেওয়া যায়। ডায়লগ অনেক হল, ঠিক গাঁথা হল না। সব কেমন ছড়িয়ে গেল।এত সিম্বলিজম আর ইনুএণ্ডো নিয়ে বড় চাপ।তালগোল পাকানো একটা পিণ্ড, হজম করতেই পারলাম না, এতটাই অ্যাবস্ট্র্যাকট। তারমধ্যে নানু-র অংশটুকু ভালই। সকলেরই। শুধু ওই - কিছুতেই মূলস্রোতে এসে মিশলোনা কেউ-ই, সবাই অববাহিকার পলিমাটি হয়েই রয়ে গেল।বিশেষ কিছু বললাম না। নানু-কে। মনে কষ্ট পাবে হয়ত, আর বলতেও পারবে না কাউকে। তাই। ক্ষেত্রবিশেষে চেপে যাওয়াই ভাল। সত্যি বলার অনেক বিপত্তি।  তার পর হঠাৎ একদিন একটা লিঙ্ক পাঠালো। কিসের বলল না, শুধু বলল ‘দেখিস’। দেখতে গিয়ে বুঝলাম বাড়িতে তৈরী করা শর্ট ফিল্ম আর তাতে যা ডায়ালগ, সোজা-সাপটা, গভীর। কেটে কেটে নুন দিয়ে দিচ্ছে ক্ষত-য়। জুলিয়াস সীজারে অ্যান্টনীর স্পিচ-এর মত। গল্প পরিস্থিতি-প্রেক্ষিত সব আলাদা হওয়া সত্ত্বেও একই মান ও উচ্চতায় পৌঁছে দিল আমার অনুভূতিগুলোকে। শেষ যখন হল, মনে মনে বললাম, ‘শাবাশ বন্ধু, শাবাশ!দারুণ হয়েছে চাটুজ্জে’। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, নানু তেমন নামকরা কেউকেটা নয়। তাই এ-টার না আছে প্রচার, না পায় কলকে।

আপনারা দেখে বলুন, আমি কি কিছু বাড়িয়ে বলছি, নাকিঃ

লিঙ্কঃ  https://youtu.be/og3tr47zNWQ

 

এর পর আবার অপেক্ষা করে রইলাম আর একটা হেভি ওয়েট শর্ট-ফিল্ম রিলিজের জন্য। সৌজন্যে আমার বহু পুরোনো বন্ধু তাজু (দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত) ও ভ্রার্তৃপ্রতিম দেবাঞ্জন বসু। এটার নাম আর পোস্টার দেখেই বোঝা যাবে হাই-কমেডি। নাম- ‘অজ্ঞাতবাঁশ’। পরিচালক হলেন আমার অত্যন্ত প্রিয় নাট্যকর্মী ও দাপুটে অভিনেতা সোহন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়। এটা আবার এমনি নয়, রীতিমত টিকিট কেটে দেখতে হবে, mycinemahall app থেকে। খুব খুশি হলাম এই ব্যবস্থায়। মানুষ সবই যদি ফ্রি তে পায়, একটা ইন্ডাস্ট্রির বড় ক্ষতি। amazon prime বা অন্যান্য জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মে তো কত ছবি আর সিরিজ রিলিজড হচ্ছে। তা দেখতে গিয়ে আমরা নেহাত কম পয়সা দিচ্ছি না। তবে আমাদের টলিউড আর বাঙলা থিয়েটার কি দোষ করল! আরো খুশি হলাম দেখে, যে mycinemahall থেকে যে অর্থ আয় হবে সবটাই সাহায্য হিসেবে দেওয়া হবে কলেজ স্ট্রিটে যাঁদের বই-ব্যবসা আম্ফান-ঝড় উড়িয়ে নিয়ে চলে গিয়েছে। খানিকটা স্ব-উদ্যোগেই প্রচার চালিয়ে গেলাম।

তারপর একদিন আমি আর আমার ছেলে খুব সাজিয়ে গুছিয়ে দেখতে বসলাম, ‘অজ্ঞাতবাঁশ’। আধুনিক মোড়কে পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদীর কাণ্ডকারখানা। হিউমর আর স্যাটায়ার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। টেনে আলাদা করা যাচ্ছে না। সকলের অভিনয় বাড়িতে বসেই, দারুণ। কিন্তু গোল পাকল সেখানেই, যে সোহন বাবুর ব্র্যাণ্ড অনুযায়ী উচ্চতা ছুঁল না। কিছু কিছু জায়গায় এতটাই সস্তা ঠেকল, যে মনে হল, এটার কি খুব দরকার ছিল? একশ টাকার বিনিময়ে যা দেখলাম, তাতে আমার ছেলে বলল, ঠিক আছে, কিন্তু এটা ঠিক একশ টাকা দেওয়ার মত ছিল না! আমার ছেলেদের জেনারেশনের একটা সুবিধা/অসুবিধা আছে -- যা মনে আসে, সপাটে বলে দেয়। তা শুনে কার কেমন লাগল, খুব একটা তোয়াক্কা করে না (যদিও আমার এই অনুভূতি একান্তই ব্যক্তিগত এবং ভুল ও হতে পারে)। আমি সেইজন্য আজকাল এই প্রজন্মের দৃষ্টিকোন থেকে অনেক কিছু দেখার চেষ্টা করে থাকি এবং অনেক ক্ষেত্রে উপকৃত হই। তাই ‘অজ্ঞাতবাঁশ’ কে পাঁচের মধ্যে দুই-এর বেশি দেওয়া গেল না।

 

আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। ইংরেজী সাহিত্য-সিনেমা-গান আমাকে আস্তে আস্তে গিলছে। আলাপ হল বাবার বিদেশ থেকে সদ্য দেশে ফেরা বন্ধুর ছেলে সঞ্জীব (মিত্র)-এর সঙ্গে। আমার থেকে বছর দু-একের বড়। সালকিয়ায় বাবুডাঙ্গার মোড়ের কাছেই বিশাল বাড়ি। সঙ্গে সিনেমা আর গানের অসাধারণ কালেকশন। বন্ধুত্ব গভীরতা লাভ করল অচিরেই। ওদের বাড়িতে প্রথম খেলাম স্যান্ডউইচ, পর্ক। শিখলাম কেক বানাতে। বার-বি-কিউ কেমন হয়, তা উপলব্ধি করতে করতে একটা ভিন্ন বন্ধু-বৃত্ত তৈরী হল যেখানে আমি-ই একমাত্র বাংলা মিডিয়াম। বেশির ভাগ-ই ডন বস্কো। তাতে আমার বা বাকি সবার বয়েই গেল। দারুণ বন্ধু হলাম আমরা সবাই। সঞ্জীব দের বাড়িতে আড্ডা-আলোচনা-গান-ডাম্ব শারাদ-ফুটো হওয়া ডার্ট বোর্ড-স্পেক্ট্রাম ১২৮কে মেমব্রেন কমপিউটারে ম্যানিক মাইনার বা প্যাকম্যান খেলা -হুজ লাইন ইস ঈট এনিওয়ে, আরক্যুল পোয়ারো, শার্লক হোম সিরিজ আরো অনেক কিছুর বাইরে দু’টো জিনিস আমাদের কাছে আলাদা মানে রাখত, এক, কাকুর বকুনির আড়ালে ভালবাসা, আর দুই, কাকীমার হাতে রান্না নানা রকম পদ। আমি জানি না আজও কোনো বাড়িতে অতগুলো ছেলের রোজ হুজ্জুতি পাকানোর অপার-অসীম অধিকার ওই বয়সে থাকবে কি না, নিত্যনতুন খাবার সমেত। খাবার মানে কিন্তু চা-বিস্কুট নয়। রীতিমত তরিজুত করে খাবারের ব্যবস্থা। এরকম নয়, যে ওনারা খুব বড়লোক ছিলেন, আমাদের মতই সাদামাটা।কিন্তু অত বড় মনের মানুষ আমি জীবনে খুব কম দেখেছি। এক দিনও যায় নি, যে দশ মিনিটের জন্য ওই বাড়িতে গিয়েছি, অথচ কাকীমা আমাদের কিছু খেতে দেন নি। তাই সবাই ভিড় করতাম সেখানে। আলাপ হল সঞ্জীবের মাধ্যমে নীলাঞ্জন, পিয়াস, স্বয়ম্ভূ, দীপক, জাগতার, সৌমেন, আরও অনেকের সঙ্গে। শিখতে থাকলাম রোজ, সবার কাছ থেকে, অনেক কিছু। তারপর বাস্তবের স্রোতে অনেকে অনেক দিকে চলে গেল। জীবনের প্রাইওরিটিজ বদলে গেল। সঞ্জীব আর পিয়াসের সঙ্গে সবকিছু পেরিয়ে যোগাযোগ থেকেই গেল, কোনো না কোনো ভাবে।

গত দু-সপ্তাহ আগে, পিয়াসের প্রোফাইলে দেখতে পেলাম তার লেখা স্ক্রিপ্ট-এ একটা লক ডাউন শর্টফিল্ম রিলিজ হতে চলেছে - “টাইম”। দেখলাম। আঠাশ মিনিটের এই শর্টফিল্ম। কিন্তু আমার ‘টাইম’ হাই প্রোফাইল ‘মাস্কবাদী’ বা 'অজ্ঞাতবাঁশ' এর থেকে বেশিই ভাল লাগল। কারণ, এই ছোট গল্প অনেক-টা বাংলার বনফুল (বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়) বা ইংরেজীর এডগার এলেন পো-এর ছায়ায় বাঁধা। প্রথম তিন মিনিটের টাইটেল স্কোর-এ সিনিয়র আর জুনিয়র দেশিকন, দুই সঙ্গীত শিল্পী মিলে, যা করলেন, তাতেই ফিল্ম-টার একটা আলাদা উচ্চতা বাঁধা হয়ে গেল। যে যার বাড়িতে বসে, হাওড়া-পুনে-আমস্টারডাম সব জায়গা থেকে স্কুল-ফ্রেণ্ডস কি তা বুঝিয়ে দিলেন বাকিটাতে। ডায়ালগ কিছু কিছু জায়গায় একঘেয়ে হয়ে উঠছিল, আর প্রফেসর পিয়াসের চা-গুলতে গুলতে ফিলোজফাইজ করা, একটু বেশি ক্যামেরা- কনসাস হয়ে গিয়েছে। ডন বস্কো স্কুলের শেষ ছোঁয়া টুকু আমার মনে হয়েছে সিম্বল মাত্র – প্যান স্কুল-লাইফ-নস্ট্যালজিয়া। এই গল্পটার বাস্তব মাত্রানুসারে বা পরিপ্রেক্ষিতে তফাত থাকতেই পারে, কিন্তু স্কুলের বন্ধুত্বের জায়গা থেকে বেশ চিরকালীন। করোনার থাবা জীবনে অনেকটা ক্ষতের আঁচড় কাটলেও, স্কুলের বন্ধুত্বের উষ্ণতা সেটা পেরিয়ে একটা কসমিক রেডিয়েশনের মত। এই সুরক্ষা বলয় মনের মধ্যে এক অদ্ভূত মানসিক প্রশান্তি নিশ্চিত করে বৈ কি! ধন্যবাদ সৌগত মজুমদার কে, পরিচালক হিসেবে এমন একটি অনুভূতি কে স্ক্রিনস্থ করে পরিচালনা করার জন্য। অনেক আশীর্বাদ আর ফুল মার্কস ক্ষুদে দেশিকন-কে। পাঁচে সব ভুলচুক মিলিয়ে, নিজের ব্যক্তিগত অনুভূতিকে পাশে সরিয়ে, স্বঘোষিত বিচারক হিসেবে ‘টাইম’-কে পাঁচে সাড়ে তিন দিলে কিন্তু আমার দিকে ভার্চুয়ালী পচা ডিম ছুঁড়বেন না, প্লিজ!

লিঙ্কঃ https://www.youtube.com/watch?v=siTb1rt3qjY