মাঝে মাঝেই বেশ কিছু জিনিস বাড়িতে বেরিয়ে পড়ে, গোছাতে গিয়ে, যে সবের সঙ্গে শুধু নস্টালজিয়া নয়, জড়িয়ে আছে পুরো একটা যুগ।
ঈডিপাস ও ইলেক্ট্রা কম্পলেক্স -- নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই অনেকেই। বলে দেবেন যে মনস্তত্বের অবিসংবাদিত পিতৃপুরুষ সিগমান্ড ফ্রয়েডের হাত ধরেই জন্ম এই দু'টি অতি মূল্যবান কথার, যা আমাদের আদিম রিপু 'লিবিডো'-র সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। নারী-পুরুষ বয়স ও সম্পর্ক নির্বিশেষে কি ভাবে একে অপরের চিরন্তন পরিপুরক এবং সৃষ্টিগত দিক থেকে একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট তা প্রমাণ করে গিয়েছেন ফ্রয়েড। কিন্তু ফ্রয়েডের গবেষণার প্রথম পাঠ কিন্তু শুরু হয় সেই গ্রীক ট্যাজেডির যুগ থেকে। ঈডিপাস ও ইলেক্ট্রা, দু'টি নামই কিন্তু সেই ক্লাসিক গ্রীক ট্র্যাজেডি থেকে তুলে আনা।
সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে কম চর্চা হচ্ছে না। কম সমস্যা নেই, সে সব নিয়ে। মনোজ মিত্রের কথা খুব মনে পড়ে যাচ্ছেঃ "গল্পটা কিন্তু বলে যেতে হবে। একজন হলেও, তার জন্যেই বলে যেতে হবে। কে বলতে পারে, সেটাই হয়ত মাস্টার-পিস!" অসাধারণ কথা! যাঁরা সত্যি সত্যিই আদি সময় থেকে সৃষ্টি করে চলেছেন, গল্প বলে চলেছেন, তাঁদের মধ্যে প্রথমেই রয়ে গিয়েছেন তাই, প্রাচীন গ্রীক নাট্যকার, সোফোল্কেস, যাঁর হাত ধরে পৃথিবী প্রথম চিনল 'ট্র্যাজেডি' কারে কয়। ঈডিপাস আর ঈলেক্ট্রা আর কেউ নন। সোফোক্লেস-এর লেখা সেই গ্রীক ট্র্যাজেডির নায়ক ও নায়িকা। আর সেই নাটকের গল্প এমন জটিল আর ট্র্যাজিক যে আমাদের আধুনিক ওয়েব সিরিজ-ও তার কাছে শিশু, আজও।
আমি, সত্যি বলতে, এত জানতাম না। মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর যে তিনমাস আমাদের বিশেষ কিছু করণীয় ছিল না, সেই সময়ে ফরাসী ভাষা শিখতে কিছু দিনের জন্য ভর্তি হয়েছিলাম পার্ক ম্যানসনের ল্য'লিয়স ফ্রাঁসেজ দ্য কাল্ক্যুতা- তে। জায়গাটাই এমন, যে যাতায়াতের পথেই অনেক কিছু শেখার। সঙ্গে গান শোনার নেশা থাকায় এম বিশ্বাস সিম্ফনী তে কাটাতাম অনেকটা সময়। কেনার সামর্থ না থাকলেও দেখা ও শেখার সামর্থ তো ছিল। সেখানে হাতে পড়ল একটা ক্যাসেটের সেট -- রাজা অয়দিপাউস। এর আগে অমিতাভ বচ্চনের 'শোলে'-র ক্যাসেট ছাড়া অন্য কোনো কিছুর আদ্যোপান্ত ডায়ালগ শোনার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। তাই ইচ্ছে হল, দেখি নাটকের ডায়ালগ কেমন হয়। এক মাসের বাসভাড়া আর টিফিনের পয়সা জমিয়ে কিনে ফেললাম 'রাজা অয়দিপাউস'-এর ক্যাসেটের সেট। বাড়ি তে এসে আমি আর বাবা আমাদের টেপ রেকর্ডারে যখন চালালাম, চুলোয় উঠল সব কাজ কর্ম। জানলাম আমার বাবার কাছ থেকে যে বাংলা নাটকের প্রাণপুরুষ হলেন শম্ভু মিত্র নামে এক ব্যাক্তি। তাঁর স্ত্রী তৃপ্তি মিত্রও একই মাপের। কন্যা শাঁওলী মিত্র-ও কিছু কম যান না।
একটাই প্রশ্ন জাগল মনে, কে এই শম্ভু মিত্র? 'আপনাকে তো কালটিভেট কত্তে হবে ময়াই!' মনের মধ্যে অনুরণন ঘটল। পড়লাম তাঁর সম্পর্কে জানতে, শিখতে।
এতক্ষণ ওনার সম্পর্কে ভূমিকাতেই এত শব্দ খরচ করে ফেলেছি। যখন এখন লেখার সময় এল, তখন কিন্তু ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না কোথা থেকে শুরু করব। ওনার জন্মদিন গতকাল ছিল। ওনাকে নিয়ে না কিছু লিখলে আমার বিবেক আমাকে ক্ষমা করবে না। তাই এত কথা কাল সারাদিন ধরে ভিড় জমাল আমার মাথায়।
কালটিভেট করতে গিয়ে জানলাম, যে নাটকের জগতে তিনি নিবেদিত প্রাণ, আর সব তর্ক বিতর্কের ঊর্ধ্বে। নিজের হাতে তৈরি দল 'বহুরূপী' থেকে বিতাড়িত হয়েছেন, যখন তাঁর স্ত্রী তৃপ্তি মিত্র 'বহুরূপী'-র প্রেসিডেন্ট। তাঁর মেয়ে শাঁওলী মিত্র-ও তখন সেই দলে কাজ করছেন। কিছু বলার সাধ্য নেই তাঁর। জীবনে কোনোদিন নাটকের সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের সমস্যা-কে জড়ান নি। তৃপ্তি মিত্র-র সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের পরেও দাপটে অভিনয় করে গিয়েছেন একসঙ্গে দু'জনে। নাটক-কে শিল্প হিসেবে সবসময়ে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে চেয়েছেন, যদিও তাঁর নাটক রাজনৈতিক বার্তাবহ ছিল। কিন্তু সেই বার্তা রাজতন্ত্র আর গণতন্ত্র - দুই প্রতিষ্ঠানেরই ভাল-মন্দ কে তুলে ধরার জন্য। মানুষকে দেখানোর জন্য যে দুই প্রতিষ্ঠানই কেমন হিপোক্রেসি নিয়ে জগতজুড়ে চলে আর 'করাস' (chorus), আম জনতা হয় তার সব থেকে বড় শিকার। তখনকার বামপন্থী সরকারও তাঁর প্রতি ঔদার্য দেখায় নি, খুব একটা। 'নবান্ন' পেয়েছিল কয়েকটি হাতে গোনা শো। অনেক বলে ক'য়েও ওরকম একটা দারুণ নাটকের জন্য টিকিট কাউন্টার পর্যন্ত দিতে রাজী হয়নি তৎকালীন সরকার, থিয়েটার হল তো দূর। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল 'নবান্নের' শো। ইণ্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে তাঁর চলেছিল লাগাতার মতবিরোধ। উৎপল দত্ত-ও সেখানে করেছেন বিরূদ্ধাচরণ, তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি কঠোরভাবে সৎ থাকতে। কিন্তু তিনি নিঃশব্দে কাজ করে গিয়েছেন। কাউকে অসম্মান না করে, কারো প্রতি বিরূপ মন্তব্য না করে। পিছু হঠেছেন বারে বারে। অসম্ভব মানসিক জোর কে সম্বল করে, করে গিয়েছেন কাজ, স্টেজে আর স্টেজের বাইরেও। বোধ হয় খুব রাজনৈতিক সচেতনতা ও মূল্যবোধের কারণেই কোনো ভারতীয় রাজনৈতিক দলের ভাবধারার সঙ্গে একাত্ম হতে পারেন নি। কিন্তু নাটকের মাধ্যমে চালিয়ে গিয়েছেন, অবিরাম, রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনা ও বোধ উদ্রেক করার প্রয়াস। ‘বৌ ঠাকুরানীর হাট’ তার এর এক দলিল।
'রক্তকরবী' পড়েছেন অনেকেই। কিন্তু শম্ভু মিত্র সেটিকে স্টজে যে উচ্চতায় পৌঁছে দিলেন তার ওপরে কাউকে পোঁছাতে অনেক শতাব্দী পেরোতে হবে মনে হয়। 'চাঁদ বণিকের পালা'-ও তাই-ই। একটি সাধারণ মঙ্গলকাব্যের আখ্যান কোন মহিমায় উদ্ভাসিত হতে পারে, মানুষ ও ঈশ্বর কোন বন্ধনে আবদ্ধ এবং তাঁরা মানুষের কত কাছাকাছি, কিভাবে একজন মানুষ ঈশ্বরকে ছাপিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন, সে সব প্রশ্নের জবাব তিনি দিয়েছেন এই নাটকের মাধ্যমে। ক্লাসিকস তাঁকে বার বার টেনেছে।
ইবসেন-এর 'Doll's House' কে 'পুতুলখেলা' করে যখন স্টেজে নামালেন, বাংলার তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়াল রা ভেবে পেলেন না, ক'দিন আগে বালিগঞ্জ গভর্ন্মেন্ট ইস্কুল থেকে পাশ করা, কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্সের স্নাতক এই আন্তর্জাতিক অন্তরদৃষ্টি পেলেন কোথা থেকে!
মৃত্যুশয্যায় নিজের সন্তান কে বলে গিয়েছিলেন, তাঁর মৃতুতে কোনো আতিশয্য যেন না থাকে। বেশি লোক জানাজানি হওয়ার আগেই যেন তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। মুখাগ্নি, শ্রাদ্ধানুষ্ঠাণ এসবের-ও কোনো প্রয়োজন নেই বলে ইচ্ছা প্রকাশ করে গিয়েছিলেন তিনি। শাঁওলী মিত্র যোগ্য সন্তান। পিতার শেষ ইচ্ছা রেখেছিলেন, সব দিক থেকে।
আমরা ছোটবেলায় যে সিনেমা হল তিনটিতে মূলত বিদেশি ছবি দেখতে যেতাম সেগুলি ছিল, লাইট হাউস, নিউ এম্পায়ার ও গ্লোব। কিন্তু তার আগে যে লাইট হাউস ও নিউ এম্পায়ারে রীতিমতো নাটক ও হত তা জানলাম শম্ভু মিত্র মহাশয়ের নিজের লেখা 'অয়দিপাউস' - বই টির মুখবন্ধ থেকে। বইটির প্রকাশক এম সি সরকার এন্ড সন্স। চোখের সামনে তখন আর স্ক্রীন ভাসে না...ভেসে ওঠে দৃশ্য...আর সেই কন্ঠ...মনে হয় বাস্তব জীবনে আধুনিক গ্রীক ট্র্যাজেডির সব থেকে বড় নায়ক ছিলেন তিনিই।
জানতেন বোধ হয় তাঁর মৃত্যু বাংলা থিয়েটার আর স্টেজ থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলতে পারবে না কোনোভাবেই...ক্লাসিক্যাল ট্র্যাজিক হিরোদের মতই অবিনশ্বর তিনি।তাই গল্পের নায়কের থেকেও আরও অনেক বড় বাস্তবের নায়ক হয়েই রয়ে গিয়েছেন তিনি, বাংলা নাটকের প্রবাদপ্রতীম চরিত্র হিসেবে।
‘দশচক্র’ বাংলা নাটকের এই প্রাণপুরুষ-কে ‘ভূত’ করে দিতে পারল কই!
