Wednesday, 11 June 2025

অঙ্ক কি, কঠিন?

আমি একটা কসমোপলিটন শহরে মানুষ| তাও আবার হাওড়ার মতো লোহা-লক্কড়ের জায়গায়। কলকেতার লোকে বলে, হাওড়ার না আছে কোন কালচার না আছে কিছু। 


তার ওপর আবার যখন সরকারী প্রাইমারীতে পড়তাম, আমার পাড়ার বন্ধুদের মধ্যে অনেকে ছিল  হিন্দিভাষী। তাদের কাছ থেকে আমরা, মানে বাঙালীরা হিন্দি শিখতাম, শুনে শুনে, আর ওরা আমাদের শুনে শুনে বাংলা। পরে বড় হয়ে যখন ভাষা-শিক্ষার বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে গিয়েছি, তখন বুঝতে পেরেছি যে একজন শিশু শব্দ ব্যবহার করে তার পরিবেশ থেকে শিখে। তার জন্য কোনো পুঁথিগত বিদ্যার প্রয়োজন হয় না। পরিবেশ থেকে সেসব শব্দের ব্যবহার অর্থ না জেনেই একজন শিশু ব্যবহার করতে থাকে। সব শব্দ যে আবার ঠিক করে রপ্ত করে ব্যবহার করে, তা নয়।

সে ক্ষেত্রে অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী হয়ে ওঠে।  


আমিও এই পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলাম। বন্ধুদের সাথে খেলতে গিয়ে, একদিন আমাদের থেকে বড় এক দাদা ক্রিকেটে এক্জন দাপুটে ব্যাট্সম্যান-কে আউট করে দিতে ই আমার পিঠ চাপড়ে বলল,

"তু তো উসকা পুরা বলাৎকার কর দিয়া, বে!"

 শিখলাম  বলাৎকার। ভাবলাম চমৎকারের কোনো ভাল হিন্দি হবে বোধ হয়। 

ব্যাস পরের দিন-ই তার প্রয়োগে কোনো কসুর করি নি। 

বাবা পড়াচ্ছেন। সাত-আট জন ছাত্র-ছাত্রী। তারা সবাই সেবারে মাধ্যমিক দেবে। আমি উঠব ক্লাস ফ়াইভে। আমি ওই ঘরেই পড়তে বসতাম। শুনে শুনে সবই প্রা‍য় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। আমার সাথে দেবব্রত-দা একটু ঠাট্টা করত, বয়সানুপাতে। একটা সমাস, খুব কঠিন ছিল, তার ব্যাসবাক্য। দেবব্রত-দা সেটা অনায়াসে ভেঙে দিতেই আমি সবার সামনে উত্তেজিত হয়ে প্রশংসায় ʼবলাৎকার বলাৎকারʼ বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। 

ঘরের সবাই হঠাৎ পুরো চুপ। তারপরে মুখ টিপে হাসি। 

আমি আগা-পাশ-তলা কিছূ না বুঝে কেমন সিঁটিয়ে গেলাম। 

বাবা আজীবন আমার গা‍য়ে কোনোদিন হাত তোলেন নি। উনি রেগে গেলে, কান লাল হয়ে যেত। 

এক্ষেতেও তাই হল। ভীষণ রেগে গেলেন, বুঝলাম। শুধু বললেন, 

- তুমি অন্য ঘরে যাও। 

আমি তো বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে করলাম টা কি রে ভাই! 

পরে বুঝলাম,  আমার ভাষা সম্পর্কে ওই বয়সে এমনই পাণ্ডিত যে আমিও শব্দটিকে বাড়িতে এসে অনেক রকম ভাবে নিজের চেনা শব্দগুলো দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। তার প্রথম স্তরে ছিল, 

ʼচমৎকারʼ-এর সাথে মিল। 

দ্বিতীয় অপভ্রংশ তৈরি করেছিলাম, ʼবলদ কারʼ।  

কিন্তু যে পরিস্থিতিতেই শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল তার সাথে সাজুজ্য না থাকায় এর একটা তৃতীয় অপভ্রংশ তৈরি হলো নিজের মনে মনে। 

বলদ car  মানে ʼগরুতে টানা গাড়িʼ তখন কি আর bullock cart-টার্ট  জানতাম?  ʼকুমোর পাড়ার গরুর গাড়িʼ পর্যন্তই বিদ্যা ছিল। ভাবলাম বুঝি বাংলা ইংরেজি সব মিলে মিশে হিন্দিতে হয়তো এইরকম একটা শব্দ তৈরি হয়েছে। 

হিন্দিতে অনেক পপুলার গানও ছিল, যে সব গানের শব্দের উচ্চারণ ও অর্থ না জেনেই গেয়ে যেতাম বাথরুমে। 

যেমন সব থেকে বড় উদাহরণ হচ্ছে়, ʼমেরা সা‍য়াʼ। 

আরে ভাই, আর গান বানানোর সাব্জেক্ট পেলি না, মেয়েদের সায়া-ব্লাউজ় নিয়ে গান বাঁধতে হল! ভয়ে এই গান টা বাথরুমে গাইতাম না, adult গান ভেবে! 

এবার আসি বিষয় বস্তুতে। 

বিষ‍য় একটি ছবি - অংক কি কঠিন। এই নামে চন্দ্রবিন্দুর গান আছে, বটে। কিন্তু আপাতত কথা বলছি সৌরভ পালোধীর তৈরি করা সিনেমাটা নিয়ে। 

একটু আগে নন্দনে দেখে এলাম। খুব বেশি হল-টল পায়নি, সিনেমাটা।  

কেন পাইনি সেটা ছবিটা দেখে বুঝলাম। 

ওরকম ছাড়া সিনেমা জুড়ে যদি কেউ পাড়ার মোড়ে চায়ের দোকানে, তাস খেলার আড্ডায় এই ২০২৫ সালেও সিপিএমের পতাকা পত পত করিয়ে উড়িয়ে রাখে, তাহলে আর সেই সিনেমা কি করে হল পাবে? ও যতই শিশু-টিশু নিয়ে সিনেমা করা হোক না কেন।  

শব্দের অপভ্রংশ সিনেমাটির পিওর হিউমরের  অন্যতম লাইফ়লাইন। 

শিশু মনে শুনে শুনে গেঁথে গেছে, সিলিন্ডারের বদলে সিন্ডিকেট। 

আবার স্টেথোস্কোপের বদলে টেথোস্কোপ। 

আবার সেটাও টেলিস্কোপের সাথে গুলিয়ে ফেলায় বেশ মজাই হচ্ছিল। 

সব থেকে আনন্দ পেলাম এই অংশটা দেখে যে একটা সরকারি স্কুলের কি বেহাল দশা হতে পারে এবং সেই নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই, সেটা দেখানোয়। সে স্কুল উঠে গেলেও কারো কিছু যায় আসে না। (অথচ আমাদের প্রজন্মের (আমার বয়স ৫১) ৯০ শতাংশ ছেলেমেয়েরা ওই সমস্ত স্কুল নাম না জানা সরকারী স্কুল থেকেই পাস করে বাজারে কিছু করে খাচ্ছে। যদি এরকম উদাহরণ চান যে সেই সময়ে ইংরেজি মিডিয়াম থেকে পাশ করা কত শতাংশ বিদেশে আছে আর কত শতাংশ এ দেশে এবং তাদের সাকসেস রেট কেমন, তাহলে কিন্তু বাংলা মাধ্যম-ই অনেক অনেক বেশি এগিয়ে থাকবে। ) 

যাই হোক, আমার ছোটবেলায় সব থেকে বড় স্বপ্ন ছিল যে আমি বাসের কন্ডাক্টর হব। এখন বাবা-রা শেখান ছেলেমেয়েদের যে নিজের টার্গেট যদি খুব নিচু রাখা হয় তাহলে কোনদিনই আর এচিভ করা যাবে না।

 

সেটাও হয়ত বা ঠিক। বিতর্কের অবকাশ রাখে বৈ কি! তবে ইতিহাস সে কথা বলে না। পৃথিবীর সমস্ত ম্হান মানুষের জীবনী থেকে এটা উপলব্ধ হয় যে, টার্গেট সেট করে সেভাবে কিছু হ্য় না। বরং ভলবেসে কিছু করলে তবেই জঈবনে কিছু করে ওঠা যায়। 


ভুল ঠিক সময় বলবে। তবে বিশাল,বিরাট মানুষ হওয়া আর নিজের ইচ্ছামত শুধু মানুষ হওয়া এই দুটোর আকাশ-পাতাল পার্থক্য -এ নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।


আমি বাসের কন্ডাক্টর হতে চেয়েছিলাম একটাই কারণে যে আমি তাদের রিয়েল লাইফ় হিরো।ওইটুকু সময়ের মধ্যে একটা লোক সকলের কাছ থেকে টিকিট কেটে তাদেরকে আবার পয়সা ফেরত দিয়ে প্রত্যেকটি প্যাসেঞ্জারকে তার নির্দিষ্ট বাসস্টপে নামিয়ে দিচ্ছে। আবার লোক তুল্ছে। টিকিট কাটতে কাটতে জানলার ফাঁক দিয়ে এক পলক দেখে বলে দিচ্ছে যে পরের কোন স্টপ আসতে চলেছে। নামার জন্য কাদের কাদের তৈরি হতে হবে। এক বিরাট বড় মানবিক দায়িত্ব। একজন মানুষ কি অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই দায়িত্বটুকু সারাদিন ধরে নিখুঁত ভাবে পালন করে যান। তবুও তাকে দু'চারটে বাজে কথা শুনিয়ে দেন, প্যাসেঞ্জাররা। তখন যাঁরা কন্ডাক্টরকে বল্ছেন তাঁদের ভদ্রলোক মনে হত না। বরং কন্ডাক্টরকাকুকে কি হিরো লাগত। 


বাসের ফুটবোর্ডে পা রাখার জায়গা নেই। এত ভিড়। কন্ডাক্টারদেরই একমাত্র দেখেছি কোন প্যাসেঞ্জারের যাতে আঘাত না লাগে, যাতে তাঁরা যাতে আস্তে আস্তে ভেতরে প্রবেশ করতে পারেন, সে জন্য নিজে বিপজ্জ্নক ভাবে ঝুলে নিজের দেহটিকে এগিয়ে দিতে। এভাবে সবাইকে সুরক্ষিত করার চেষ্টা করে চলেন। তেল না দেওয়া চুল, হাওয়ায় ওড়ে। ঘোড়ার বুক ঠুকে আরো তেজিয়ান করার মত বাসের গা চাপড়ে চিৎকার করেন, ʼহেই, হঠকে়!!!!ʼ


কোথায় লাগে হলিউড সিলভাস্টার স্ট্যালোন, টম ক্রুজ! হাওড়ার নাম জানা ক্ন্ডাক্টর কাকুরা সেরা। 


হ্যাঁ, প্রশ্ন উঠতেই পারে, যে কেন? এই ধরনের তো আরো অনেক বেটার প্রফেশন ছিল, জাহাজের ক্যাপ্টেন, এরোপ্লেনের পাইলট, কিংবা দেশের সৈন্য হওয়া, তার বদলে বাসের কন্ডাক্টর কেন? 

ঠিক, কারণ, বাকিদের আমি দেখিনি রোজের জীবনে এত কাছ থেকে। যাদের সরাসসি দেখিনি, তাদের নিয়ে আমি খামোখা মাথা ঘামাতে যাব কেন?  তাই নিজের বাস্তব জীবন নিয়ে শৈশব থেকে কোনদিন কোন অলীক স্বপ্ন দেখিনি । তাই মাটি কামড়ে অনেক প্রলোভন-হাতছানির পাশ কাটিয়ে একটা ছাপোষা স্কুল মাস্টার এসে উপনীত হয়েছি।


যে বাচ্চাদের গল্প সৌরভ পালধি আজকে আমাদের সামনে তুলে ধরলেন তার সিনেমার গল্পের মাধ্যমে, সেই গল্পগুলো আমাদের মত মানুষদের শৈশবের সকালবেলাগুলোর সঙ্গে কোন না কোন ভাবে মিলে যায়। সেখানেই অংক আর কঠিন থাকে না একদম চশমায় বাষ্প হয়ে ধরা দেয়। সেই বাষ্প মনে জমাট বাঁধে। তারপরই তো ম্যাজিকের মত হাতে অন্তত: কিছু থেকে যায়। 


সৌরভ পালধি বহুদিন ধরে স্টেজে অভিনয় করছেন এবং আমার অন্যতম ফেভারিট অভিনেতাদের মধ্যে একজন বিশেষত ʼফ়্যাতাড়ুʼ-তে উনি যে পুরন্দর ভাটের চরিত্রে অভিনয়টা করে থাকেন সেটাকে নকল করার সাধ্য, আমার বিশ্বাস দ্বিতীয় কোন অভিনেতার আছে বলে আমার মনে হয় না। 

সুতরাং তাঁর সিনেমায় নাটকের কিছু ছাপ যে থেকে যাবে এটাতো বলাই বাহুল্য! 

শংকর দেবনাথ সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। অত্যুক্তি করে বলছি না, শংকর দেবনাথদের মত অভিনেতাদের যে কোন দিন একটি একাদেমী আওয়ার্ড দেওয়া যেতেই পারে। 

পার্নো মিত্র-কে এই ধরনের আন্ডারটেটেড রোলে অভিনয় করতে দেখে ভালই লাগলো। উনি ওনার অকারণ উন্নাসিকতা ভেঙে যে অভিনয়ে মন দিয়েছেন, দেখে খুশি হলাম। নিঃসন্দেহে উনি অভিনয়টা ভালোই করেন।

পুরো সিনেমাটায় সব থেকে খারাপ অভিনেতা যদি কেউ থেকে থাকেন তিনি হচ্ছেন দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, মহাশয়। (আশা করি কিছু মনে করবেন না উনি) ওইটুকু স্থানে তিনি যে ছাপটা রাখতে পারতেন, তার ধারপাশ দিয়েও উনি গেলেন না। কেন, সে উত্তর আমার জানা নেই। 


যাক গে! সবাই যখন হাততালি দিচ্ছে আমার একটা হাততালি না পেলে ওনার কিছু যাবে আসবে না। উল্টে আমি ট্রোলড হব। 


তাই বাবা হাতে যতক্ষণ পেন্সিল-টা আছে, কেটে পড়ি। 

নইলে অঙ্ক কঠিন-ই হয়ে যাবে, অকারণে।



No comments: