Sunday, 19 May 2024

ঝাউতলার গল্প: পর্ব ৬

 গল্প: হেমামালিনীর ঠাণ্ডা জল


আজকাল যে সমস্যাটা খুব বেড়ে গিয়েছে তা হল, সুদীপ-কে আজকাল রাগালেও রাগছে না। এই যে কিছুদিন আগে ওর বাড়িতে নতুন ফ্রিজ কেনা হয়েছে বলে লোকে জানিয়েছে, তা নিয়ে উত্তেজিত তো হলই না, উল্টে রোজ আমাদের সকলের জন্য নতুন ফ্রিজের ঠান্ডা জল বয়ে নিয়ে আসে। এ কি সেই একই সুদীপ?.... যাকে মেজদা ওর নতুন গাড়ি কেনার পরে লেগ পুল করার জন্য বলেছিলেন,

- ওই গাড়ি আবার কেউ কেনে নাকি? দেশলাই এর খোল..আর সঙ্গে যে মিউজিক সিস্টেম-টা লাগানো থাকে সেটা চালালে গঙ্গার ঘাটের গায়ের সেলুনগুলোর রেডিও বলে মনে হয়!

এ কথা শুনে সুদীপ রাগে-দু:খে-অভিমানে ঝাউতলার রজনী সংঘে আসাই ছেড়ে দিয়েছিল।

মানভঞ্জনের পরে যেদিন নামল, সেদিন ও এক বদলে যাওয়া মানুষ ।

আমাদের ডি-এস-পি (একজনের ডাকনাম) সুদীপকে একটি ওয়েল্-কাম্-ব্যাক বিড়ি দিয়ে স্বাগত জানাতে গিয়ে বিনিময়ে পেল দুর্বাসা মুনি-মার্কা ঝলসে দেওয়া দৃষ্টি। আমি সরিয়ে না নিলে একশ দশ-কেজির নধর শরীরটা তক্ষুনি স্যাট করে দশ গ্রামের ছাই-এ পরিণত হত। বেশ ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম,

- কি রে কি হল, বেড়াল বলে মাছ খাব না/ভাত ছোঁব না/ কাশী যাব...! কি ব্যাপার?
- ইয়ার্কি মেরো না...আমি ও সব ছেড়ে দিয়েছি...
- ‘ও সব’ মানে? তুই আবার ‘ও সব’ কবে থেকে ধরেছিলি, যে ছেড়ে দিবি?
- মানে?
- ‘ও সব’ মানে জান না চাঁদু?
- কি ‘ও সব’ মানে?
আকাশ বলল, 
- মদ আর মহিলা...সামাজিক ভাবে সাধারণ মানুষ যেগুলোকে ‘পাপ’ বলে মনে করে...
- মদ আজকাল সবাই খায়, তাতে পাপের কি আছে?
পবন বলল্,
- হ্যাঁ সেই তো, তোমার মত হোমিওপ্যাথির ড্র্পারে করে মদ খেলে আর পাপের কি আছে!! ও তো ওষুধ মাত্র....
মেজদা জিগ্গেস করলেন সুদীপকে
- এক্জ্যাক্টলি কি বলতে চাইছ বল তো? তুমি কি ছেড়েছ্?
জলদ্গম্ভীর স্বরে সুদীপ নামক ব্র্যাণ্ডের সাউন্ডবক্স থেকে একটা এমন শব্দ এমন ডেসিবেল-এ বেরোল যে তার অনুরণনে সবার বুক ক্ষণিকের জন্য কেঁপে উঠল –
- স্মোকিং.....
ভয়েই হোক বা শোকে,এক মিনিটের নীরবতা প্রায় । আর সেটা ভাঙল, আলোকময় --
- কদ্দিনের জন্য বাবা!
- ফর এভার...বরাবরের জন্য...
- বেশ পরের বার থেকে চাইলে আর দেব না।
- ছো:!! তুই দিবি সিগারেট!!! সূর্য পশ্চিমে উঠবে সেদিন। তোর তো নিজেরই প্রায় আমার থেকে চেয়ে চিন্তে চলে...
জগত-দা বললেন,
***(মানে আমাদের মধ্যে একজন আছেন, যিনি খুব কম কথা বলেন, আর শোনেন ও দ্যাখেন বেশি। আমার স্থির বিশ্বাস যে উনি জগত শেঠের বংশধর।)
- আসলে ব্যাপারটা বোঝার আছে, কারণ ব্যাপারটা তো উল্টো...আলোকের সাপ্লায়ার যদি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেয়, তাহলে মুস্কিলটা কার?
সবাই হেসে উঠল।
আমি সুদীপের পাশেই বসেছিলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে সুখ্টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তেই সুদীপ খুব ঘৃণার ভঙ্গীতে হাতের তালু দিয়ে পাখার মত সেই ধোঁয়া কে দুর্গন্ধ সরানোর মত ভাব করে বলে উঠল্,
- ঊঁহ্: !!!!!

ঐ পর্যন্ত ঠিক ছিল। বোঝা যাচ্ছে, যে সিগারেট খাওয়ার মত গর্হিত অপরাধকে ও ঘেন্না করে। কিন্তু তার পরে যেটা করল, তা সকলের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল:
নিজের চেয়ারটা তুলে নিয়ে আমাদের আড্ডার নিত্যদিনের গোলাকার ছকটি ভেঙে প্রায় ছ'হাত দূরে গিয়ে বসল।
- কি রে কি হল, আবার?
- তোরা এক একটা স্টীম ইঞ্জিন ভাই, যা ধোঁয়া ছাড়িস তাতে এয়ার কোয়ালিটি ইণডেকস বেড়ে যায়। তোদের সাবধান হওয়া উচিত যে তোদের বদভ্যাসের জন্য অন্য নিরীহ মানুষরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
 
বোঝাই গেল যে ও প্যাসিভ স্মোকার হতে চায় না। সে ও না-ই চাইতেই পারে। রজনী সংঘের অনেক সদস্যই আছেন্, যাঁরা স্মোক করেন না। কিন্তু স্মোকারদের এভাবে একজন প্রাক্তনীর কাছ থেকে অপমান!!! ঠিক সহ্য হল না। পরদিন থেকে ও এলেই আমরা ওর চারপাশে কিঞ্চিত নিবিড় হয়ে বসতাম।

তাতে একদিন ও ভীষণ রাগারগি করে আবার পনেরো দিনের জন্য উধাও।

আবার নবরূপে প্রত্যাগমণ। ঠোঁটের একপাশে সিগারেটটা ফেলুদা স্টাইলে ঝুলছে। আমরা সবাই স্বস্তির নি:স্বাস ফেললাম। আলোকময় তো বটেই।

কিন্তু ওকে স্বস্তিতে টিঁকতে দিতে আমাদের ভাল লাগে না।

অনন্ত কবে নাকি জানলা দিয়ে অকারণে ঊঁকি দিতে গিয়ে দেখে একটা আলমারীর সাইজের ফ্রিজ নামছে। ব্যাস আর যাবি কোথায়!! বাঙালীর রক্তে ঘোঁটবাজি। যতই ফেসবুক্, ইন্সটা, এক্স্, হাঁকাক না,সে সব ঘোলের স্বাদ; আসল দুধের স্বাদ পাওয়া যায় পাড়াতুতো পাশের বাড়ির ঘোঁটে। আমাদের মধ্যে একজন, নাম বলতে মানা, পাখি দেখার ছলে দূরবীন কিনে এর ওর তার জানলা তাক করছেন, আজকাল। তা যাই হোক শেষে জানা গেল যে, ওটা কার বাড়ির সদস্য হল। আর, পড়বি পড় মালির ঘাড়ে/যে ছিল গাছের আড়ে....নাম হি কাফি হ্যায় – সুদীপ।

মহাভারতে খাণ্ডব দহনে যে গতিতে দাবানল ছড়িয়ে পড়েছিল, তার থেকেও দ্রুতগতিতে সে খবর যোগ্য লোকেদের হাতে গিয়ে পৌঁছাল। ফল স্বরূপ আমরা রাতে পেলাম, ‘হেমামলিনীর ফ্রিজের ঠাণ্ডা জল’।
না... সুদীপের সঙ্গে হেমামালিনীর কোনো মিল নেই। আমি ঐ শব্দবন্ধ শোনার পর থেকে সুদীপকে বিভিন্ন কোণ থেকে নিরীক্ষণ করে দেখেছি, কোনো মিল পাই নি ওই অল টাইম সিল্ভার্-স্ক্রিন সুপারস্টারের সঙ্গে। শেষে জানলাম যে, যে ব্র্যাণ্ডের ফ্রিজ্, হেমামালিনী তার ব্রাণ্ড-অ্যামবাসাডর।
সেদিন কলকাতার তাপমাত্রা বিয়াল্লিশ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। রাজস্থানে চৌত্রিশ। হেমামালিনীর ফ্রিজের ঠান্ডা জল আমাদের প্রাণে নতুন উদ্দমের সঞ্চার ঘটাল। আমার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে আমরা সবাই (প্রায় জন বারো) সুদীপের আনা সাবড়ে দেওয়া ঠাণ্ডা জলের ফাঁকা বোতলগুলোকে সসম্মানে প্যারেড করে সুদীপের বা‌ড়ির লিফট পর্য্ন্ত পৌঁছে দিয়ে সেগুলোকে সুদীপের হাতে তুলে দিলাম। সঙ্গে জানালাম যে আমরা সবাই একদিন ওর এই নতুন বৌ-এর , না, মানে, নতুন ফ্রিজের মুখ দেখতে যাব। সেদিন গেলাম না, ফ্রিজ আমাদের কি মনে করবে সে কথা ভেবে। আর মুখ দেখতে গেলে কি আর খালি হাতে যাওয়া যায়!!

এর পর থেকে সুদীপ নিয়মিত আমাদের জন্য রোজ হেমামালিনীর ঠাণ্ডা জল আনে। কে আবার খুব দুষ্টুমি করে বোতলের কাগজের লেবেলের গায়ে নখ দিয়ে আঁক কেটে ওর নামের প্রথম অক্ষর ‘সু’ এর বাংলাদেশী সমস্বর লিখে দিয়েছিল, যাতে নাকি ওটা হারিয়ে না যায়। তবুও আমরা আজকাল চাত্কের মত তাকিয়ে থাকি হেমামালিনীর জলের জন্য। এক্দিন ও আসেনি বলে রেগে গিয়ে মেজদা সুদীপ্-কে ‘ভিস্তিওলা’ বলে অপমান করার পরেও সুদীপের প্রাণে কোনো রাগ নেই। শোনা যাচ্ছে, ওই জলে কে এক্জন লুকিয়ে হাত ধুয়েছিল। সে হাত থেকে সুদীপের ফ্রিজের জলের সুগন্ধ সাবান দিয়ে ঘষেও তোলা যাচ্ছে না। তার বক্তব্য অনুসারে, ওটা “হেমা-র গায়ের গন্ধ”। আরো এক্জন ঐ গরমে আলুর চপ খেয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে ছিলেন। উনি ঝাউতলায় এসে হেমামালিনীর ঠাণ্ডা জল খেয়ে বেলা-বেলিপুরো চাঙ্গা।

কিছুদিনের মধ্যে-ই আমার স্থির বিশ্বাস সুদীপের ফ্রিজের ‘হেমামালিনীর ঠাণ্ডা জল’ গুণগত মানের দিক থেকে পৃথিবী বিখ্যাত সর্ব-রোগ্-বিপদ্-হর ‘জমজমের জল’ কে ছাপিয়ে যাবে। তাই যদ্দিন ফ্রি তে ঝাউতলায় রাত এগারোটা থেকে বারোটা পর্যন্ত পাচ্ছেন, সেবন করে যান।

আর ভয় পাবেন না, কারণ এ পরীক্ষিত সত্য এবং বাস্তব, যে সুদীপ পুরো পাল্টে যাওয়া এক মানুষে পরিণত হয়েছে। ও আর কোনো কিছুতেই রাগ করে না।

অনেক চেষ্টা করে দেখা গিয়েছে। আমরা রাগাতে সফল হই নি। শুধু খুব কিছু বললে আজকাল পরমহংস স্টাইলে মিষ্টি হেসে বলে,

- শালা....!!

বলার সময় উচ্চারণে 'ল' টাকে হাল্কা করে কুঁচকে দিতে ছাড়ে না।


(শেষ)

পুনশ্চঃ
আমার খুব ইচ্ছে ছিল যে আমরা সবাই একদিন নতুন ফ্রিজের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলব, বিয়ে বাড়িতে যেমন হয় আর কি! কিন্তু সে সুযোগ আসতে আসতে হনিমুন ফেজ টা ওভার হয়ে যাবে। তাই আর তর সইল না, এ-আই এর ওপরে ভরসা করে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটালাম |

No comments: