Saturday, 18 May 2024

ককপিটে কেলেঙ্কারী:

***গল্পের চরিত্ররা কাল্পনিক | কারও ব্যক্তিগত জীবনের সাথে মিল থাকলে তা নেহাতই কাকতালীয় |



গণেশদা প্লেনে চড়ে আমেরিকায় মেয়ের কাছে গিয়ে আবার স্বদেশী আড্ডার টানে পোড়া বঙ্গদেশের মাটিতে পা রেখেছে যে, তাতেই আমরা যারপরনাই খুশি। অন্তত: মাঝপথে কোথাও প্লেন থেকে নেমে যায় নি। আমরা খুব আশঙ্কায় ছিলাম যে, বাস‌-ট্রাম-ট্রেনের মত প্লেন থামিয়ে মাঝ-আকাশেই ভদ্রলোক প্লেন থেকে নেমে না যান! যা ছটফটে! তা আমাদের মত জাত-শত্তুরদের মুখে ছাই দিয়ে, গণেশদা পুরো ক্যারেকটার সার্টিফিকেট-টাই বদলে দিল এখন তো লেখাই যায় যে,

টু হুম দিস মে কনসার্ণ:

গণেশ ঘোষ হ্যাজ কোয়ালিফায়েড হিমসেল্ফ টু বি আ বোনা-ফাইদে প্যাক্স উইথ হিজ স্যাটিসফ্যাক্টরী অ্যান্ড কন্টিনিউয়াস জার্নি |"

শুধু দেখা গেছে যে ওনার আশে পাশে যে দু-চারজন সহযাত্রী হিসেবে ফ্লাইটে ছিলেন, নামার সময় তাঁদের আচরণে অস্বাভাবিকত্ত্ব পরিলক্ষিত হয়েছে এবং আমেরিকান ইমিগ্রেশন অথরিটি তাঁদের সন্দেহভাজন বলে ডিটেইন করেছে | আরও আশ্চর্যজনক হল যে সেই ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন ফ্লাইট থেকে নেমেই তাঁর রেজিগণেশন জমা দিয়েছেন |

অনুসন্ধান করে দেখা গেছে যে গণেশদা নিজে নামতে না চা ইলেও ওনাকে মাঝরাস্তায় প্লেন থেকে নামিয়ে দেওয়ার খাপ হয়েছিল বটে! গণেশদার সঙ্গে ক্যাপ্টেনের মিনিট পনেরো সাক্ষাতের পরে তাঁর হৃদযন্ত্রে গোলযোগ দেখা দেয় | সেই থেকে দায়িত্ব সামলান কো-পাইলট | ঘটনাসূত্রে জানা যাচ্ছে যে প্লেনটি যখন টারবুল্যান্সে পড়েছিল তখন নাকি গণেশদা অত্যন্ত ছেলেমানুষের মতো বায়না করে, খুব জোরাজুরি করে স্পেশাল পারমিশন নিয়ে ককপিটে ঢুকে ক্যাপ্টেনের কানের কাছে ফিজিক্সের থিওরি এবং কিভাবে টারবুল্যান্স কে সামলে ঘন মেঘের মধ্যে দিয়ে উড়ে যেতে হয়, সেই নিয়ে মিনিট পনেরো ধরে একটি লেকচার দিয়েছিলেন এবং তারপরেই ক্যাপটেনের হৃদযন্ত্রে গোলযোগ দেখা দেয়। ফ্লাইটের ব্ল্যাক বক্স থেকে যা পাওয়া গিয়েছে তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিচে দেওয়া হল।

গণেশদা ক্যাপ্টেনকে বলছেন:

-- কিস্যুই জানেন না দেকচি! এদিকে বোয়িং ওড়াচ্ছেন ! কে আপনাকে পাইলটের চাকরি দিল ! আপনি বরং কাল থেকে প্লেনের চাকার নাটবল্টু টাইট করবেন | আমার পাশের বাড়ির পচা ক্লাস সেভেনে পড়ে | ও আপনার থেকে অনেক বেশি ভাল প্লেন ওড়াতে পারে... সিম্যুলেশনে পাকা হাত |

-- সিম্যুলেশন আর রিয়েলিটি আলাদা |

-- ঠিক বলেছেন , রিয়ালিটিতে কোনো সমস্যাই নেই | অটো পাইলট মোডে অন মেরে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়! ব্যাস |

-- অ্যাঁ

-- অ্যাঁ, নয় হ্যাঁ... সিম্যুলেশনে দু'দণ্ড এদিক ওদিক ঝাড়ি মেরে হোস্টেস্দের সঙ্গে কান এঁটো করা হাসি মেরে যে গপ্প করবেন তার যো নেই। অন্য দিকে তাকালেই গেল, সোজা ক্র্যাশ... ইমারজেন্সি এক্সিটের বা ইজেকশনের সময়ও পাবেন না |

-- কটা ফ্লাইট উড়িয়েছেন আপনি?

-- ভাগ্যিস ওড়াইনি ... নইলে আপনাদের মত আন্ডার কোয়ালিটি মালেদের দলে ঢুকে যেতাম |

-- তাহলে এই টারবুল্যান্স থেকে বেরোনোর উপায় বলুন |

-- প্লেনের নাকটা তিরিশ ডিগ্রী ওপরে করলেই কয়েক মিনিটের মধ্যে ট্রপোস্ফিয়ারের নেক্সট লেভেলে চলে যাবেন | ক্লাউড লেভেলের আর এই হ্যাপাই থাকবে না।

-- একস্ট্রা ফ্যুয়েল পুড়বে অনেকটা...

-- টারবুল্যান্সের ফ্রিকশন রেসিসটেন্স ওভারকাম করে স্পিড মেনটেইন করতে তার থেকে অনেক বেশি ফ্যুয়েল পুড়ছে |

-- আপনি আমাকে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট শেখাচ্ছেন?

-- ও সব ক্রাইসিস ম্যানেজ্মেন্ট ট্যানেজমেন্ট আমাদের পাড়ার ইলেক্ট্রিশিয়ান লালু-ও আপনার থেকে ভাল জানে। লোডশেডিং হলে যখন ফেজ চেন্জ করে না, সে দেখার মত শিল্প। আপনি ভাই শিক্ষিত মানুষ, তাই একটু বেসিক ফিজিক্স শেখাচ্ছিলাম, এমনিতে ছাত্র-টাত্র আজকাল আর আমার কাছে আসে না তো, কারণ আমি সিলেবাস পড়াই না যে, আর পয়সাও নিই না। বিনি পয়সার জ্ঞান বিতরণের যুগ পার হয়ে গ্যাচে | তাই আপনাকে যখন পেইচি, আর ছাড়্ছি না!!

-- বাজে না বকে আপনি আপনার সিটে গিয়ে বসুন।

-- এ তো আমি আপনাকে বলব, আপনি এখন স্টুডেন্ট আর আমি টিচার।

-- আপনি কি পাগল?

-- না না পাগলামী আপনি করছেন, ইচ্ছে করে এতগুলো যাত্রীর টেনশন তৈরী করছেন, অকারণে... আপনার হাতে অপশান আছে কিন্তু আপনি সে সব করছেন না... মাথা খারাপ একদম!

-- আ য়্যু টেলিং মি দ্যাট আ অ্যাম ক্রেজি?

-- মধ্যবিত্ত বাঙালীর এই এক দোষ...একটু চটে গেলেই মাথায় ইংলিশ বলার বায়ু চড়ে যায়। হয়েছেন পাইলট, কিন্তু মজ্জায় মজ্জায় মধ্যবিত্ত বাঙালীর ছাপ...মেটাতে পারেন নি।

-- হ্যোয়জু য়্যু মিন্!!!

-- আরে মিন মিন করে না বলে বুক ঠুকে বলুন যে আপনি, চক্কোত্তি... এত ইংরিজি বুঝি না..!!! আর হ্যাঁ, আপনি যে পাগল তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই ।

-- মানে? কি করে বুঝলেন্?

-- মাইরি!!! এই পাগলা আদ্দামড়া-কে আর কত শেখাব রে!

আরে, একমাত্র পাগলরাই ঠিক বুঝতে পারে না সে পাগল, আর এটা জিজ্ঞাসা করে যে 'আমি কি পাগল?'

ক্যাপ্টেনের সহকর্মীরা সবাই বিস্ফারিত নেত্রে গণেশদার দিকে তাকিয়ে। তাঁদের কারোর বিশ্বাস হচ্ছে না, যে এটা কেউ করতে পারে। এ সব দেখে গণেশদা নিজেই বলে উঠল,

-- আরে হাঁ করে দেখছেন কি? একে সরান, যত সব আন্ডারকোয়ালিফায়েড লোক জনকে এই সব গুরুদায়িত্ব দিয়ে দিয়েছে। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি, কি করে প্লেন-কে বিপদ থেকে মুক্ত করতে হয়!

ক্যাপ্টেন সেই যে নিজের বুকের বাঁ দিক চেপে ধরে বসে পড়েছিলেন, ফ্লাইট ল্যাণ্ড না করা অব্দি আর কর্মক্ষম হয়ে ওঠেন নি।

সেকেণ্ড ক্যাপ্টেন দেখলেন যে পরিস্থিতি বিপদসীমার ওপরে। বললেন,

-- মি: গোশ, ঊই হ্যাভ আন্ডারস্টুড ওয়েল, দ্যাট ইউ আ অ্যান এক্স্পার্ট ইন দিস...অ্যান্ড নাঊ আ'ল বি ফ্লাইং দিস বোয়িং....নো ওয়োরিজ...জাস্ট চিল...

-- তুই ব্যাটা চিল না চড়াই, কোন পাখি, সেটাই তো কথা... আমি কি সিটে বসে বসে তোদের সার্কাস দেখব না কি!

-- প্লিজ ওবে মাই কমান্ড্, এল্স, য়্যু'ল বি অ্যারেস্টেড ইন আ ফরেন ল্যান্ড! আ হোপ য়্যু রিয়ালাইজ দ্য এক্সটেন্ট অফ সিরিয়াসনেস ইন ইট!

-- থ্রেট কচ্চেন?

-- দিস ইজ মাই মোস্ট হাম্ব্ল এফোর্ট টু রিটেইন মাই হাই লেভেল অফ পার্সিভ্যারেন্স। আ অ্যাম প্রোভাইডিং ইউ অপশানস উইথ অ্যাম্পল ওয়র্ণিং।

-- ছোকরার ইংরিজিতে দখলটা বেশ ভালই। বেশ তরতর করে ভাল শব্দ দিয়ে ভাষাটা বলতে শিকেচে। আচ্ছ বাবা! যা ভাল বোঝ কর তোমরা! আমি একটু গড়িয়ে নিই। তবে প্লেনের মধ্যে এই ট্রেনের মত দুলুনিটা কিন্তু খাসা! একটু শুধু ছন্দের অভাব আছে। মনে হচ্ছে টার্বুল্যান্স থেকে বেরোতে বেরোতে আমি এই দুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়ব। কি বলেন?

ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে বললেন গণেশদা।

এতক্ষণ বুকের যন্ত্রণায় ধরাশায়ী ক্যাপ্টেন যাও বা তাকিয়ে ছিলেন, এবারে সংজ্ঞাহীন হলেন।

গণেশ-দা বিপদ বুঝে কেটে পড়ে নিজের সিটে বসে চক্ষু মুদিলেন। পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে শোনা গেল,

-- এনি ডক্টর অন বোর্ড? ঊই নীড ইয়োর ইমিজিয়েট অ্যাসিসট্যান্স....

ফ্লাইট তখন এমন এয়ার পকেট আর টার্বুল্যান্স পেরোচ্ছে যে যেন যাত্রীরা সব বিমানে নয়, ঘোড়ার পিঠে বসে।

গণেশদার সে সবে কোনো বিকার নেই। ওই তালপাতার মত চেহারায় অচিরেই এমন গভীর নিদ্রায় নাক ডাকতে আরম্ভ করল যে, সে গর্জনেই প্লেন-টা যেন বার-বার কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল।

প্লেন থেকে নামতেই গণেশদাকে সে দেশের পুলিশ ঘিরে ধরে এসকর্ট করে অন্য গাড়িতে বসিয়ে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ার করে মেয়ের কাছে পৌঁছে দিল, লাগেজ সমেত |

অফিসার ইন-চার্জ মেয়েকে বললেন

-- হু ইজ হি?

-- মাই ফাদার...

-- ইন্টারেস্টিং ম্যান! বাট হি নিডস সাইকোলজিকাল কনসালটেশন?

-- হোয়াই?

-- হি ইজ ব্যাডলি সাফারিং ফ্রম এ-ডি-এইচ- ডি.... অ্যাটেনশান ডেফিসিয়েন্সি অ্যান্ড হাইপার অ্যাকটিভিটি সিনড্রোম... ইট হ্যাপেন্স হোয়েন সামওয়ান ইজ টু অ্যালোন টু একজার্ট ওয়ান'স ফিলিংস অ্যান্ড নলেজ |

মেয়ে গণেশদা কে বলল

-- বাবা তুমি না জাস্ট ইনকরিজিবল!!!

গণেশদা বলল

-- দেখলি কেমন দিলুম!! আমাকে একপাও হাঁটতে তো হলই না... উল্টে লাগেজটা পজ্জন্ত কালেক্ট কত্তে হল না!

(শেষ)

 


No comments: