Sunday, 19 May 2024

ঝাউতলার গল্প: পর্ব ৬

 গল্প: হেমামালিনীর ঠাণ্ডা জল


আজকাল যে সমস্যাটা খুব বেড়ে গিয়েছে তা হল, সুদীপ-কে আজকাল রাগালেও রাগছে না। এই যে কিছুদিন আগে ওর বাড়িতে নতুন ফ্রিজ কেনা হয়েছে বলে লোকে জানিয়েছে, তা নিয়ে উত্তেজিত তো হলই না, উল্টে রোজ আমাদের সকলের জন্য নতুন ফ্রিজের ঠান্ডা জল বয়ে নিয়ে আসে। এ কি সেই একই সুদীপ?.... যাকে মেজদা ওর নতুন গাড়ি কেনার পরে লেগ পুল করার জন্য বলেছিলেন,

- ওই গাড়ি আবার কেউ কেনে নাকি? দেশলাই এর খোল..আর সঙ্গে যে মিউজিক সিস্টেম-টা লাগানো থাকে সেটা চালালে গঙ্গার ঘাটের গায়ের সেলুনগুলোর রেডিও বলে মনে হয়!

এ কথা শুনে সুদীপ রাগে-দু:খে-অভিমানে ঝাউতলার রজনী সংঘে আসাই ছেড়ে দিয়েছিল।

মানভঞ্জনের পরে যেদিন নামল, সেদিন ও এক বদলে যাওয়া মানুষ ।

আমাদের ডি-এস-পি (একজনের ডাকনাম) সুদীপকে একটি ওয়েল্-কাম্-ব্যাক বিড়ি দিয়ে স্বাগত জানাতে গিয়ে বিনিময়ে পেল দুর্বাসা মুনি-মার্কা ঝলসে দেওয়া দৃষ্টি। আমি সরিয়ে না নিলে একশ দশ-কেজির নধর শরীরটা তক্ষুনি স্যাট করে দশ গ্রামের ছাই-এ পরিণত হত। বেশ ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম,

- কি রে কি হল, বেড়াল বলে মাছ খাব না/ভাত ছোঁব না/ কাশী যাব...! কি ব্যাপার?
- ইয়ার্কি মেরো না...আমি ও সব ছেড়ে দিয়েছি...
- ‘ও সব’ মানে? তুই আবার ‘ও সব’ কবে থেকে ধরেছিলি, যে ছেড়ে দিবি?
- মানে?
- ‘ও সব’ মানে জান না চাঁদু?
- কি ‘ও সব’ মানে?
আকাশ বলল, 
- মদ আর মহিলা...সামাজিক ভাবে সাধারণ মানুষ যেগুলোকে ‘পাপ’ বলে মনে করে...
- মদ আজকাল সবাই খায়, তাতে পাপের কি আছে?
পবন বলল্,
- হ্যাঁ সেই তো, তোমার মত হোমিওপ্যাথির ড্র্পারে করে মদ খেলে আর পাপের কি আছে!! ও তো ওষুধ মাত্র....
মেজদা জিগ্গেস করলেন সুদীপকে
- এক্জ্যাক্টলি কি বলতে চাইছ বল তো? তুমি কি ছেড়েছ্?
জলদ্গম্ভীর স্বরে সুদীপ নামক ব্র্যাণ্ডের সাউন্ডবক্স থেকে একটা এমন শব্দ এমন ডেসিবেল-এ বেরোল যে তার অনুরণনে সবার বুক ক্ষণিকের জন্য কেঁপে উঠল –
- স্মোকিং.....
ভয়েই হোক বা শোকে,এক মিনিটের নীরবতা প্রায় । আর সেটা ভাঙল, আলোকময় --
- কদ্দিনের জন্য বাবা!
- ফর এভার...বরাবরের জন্য...
- বেশ পরের বার থেকে চাইলে আর দেব না।
- ছো:!! তুই দিবি সিগারেট!!! সূর্য পশ্চিমে উঠবে সেদিন। তোর তো নিজেরই প্রায় আমার থেকে চেয়ে চিন্তে চলে...
জগত-দা বললেন,
***(মানে আমাদের মধ্যে একজন আছেন, যিনি খুব কম কথা বলেন, আর শোনেন ও দ্যাখেন বেশি। আমার স্থির বিশ্বাস যে উনি জগত শেঠের বংশধর।)
- আসলে ব্যাপারটা বোঝার আছে, কারণ ব্যাপারটা তো উল্টো...আলোকের সাপ্লায়ার যদি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেয়, তাহলে মুস্কিলটা কার?
সবাই হেসে উঠল।
আমি সুদীপের পাশেই বসেছিলাম। একটা সিগারেট ধরিয়ে সুখ্টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তেই সুদীপ খুব ঘৃণার ভঙ্গীতে হাতের তালু দিয়ে পাখার মত সেই ধোঁয়া কে দুর্গন্ধ সরানোর মত ভাব করে বলে উঠল্,
- ঊঁহ্: !!!!!

ঐ পর্যন্ত ঠিক ছিল। বোঝা যাচ্ছে, যে সিগারেট খাওয়ার মত গর্হিত অপরাধকে ও ঘেন্না করে। কিন্তু তার পরে যেটা করল, তা সকলের কাছেই অপ্রত্যাশিত ছিল:
নিজের চেয়ারটা তুলে নিয়ে আমাদের আড্ডার নিত্যদিনের গোলাকার ছকটি ভেঙে প্রায় ছ'হাত দূরে গিয়ে বসল।
- কি রে কি হল, আবার?
- তোরা এক একটা স্টীম ইঞ্জিন ভাই, যা ধোঁয়া ছাড়িস তাতে এয়ার কোয়ালিটি ইণডেকস বেড়ে যায়। তোদের সাবধান হওয়া উচিত যে তোদের বদভ্যাসের জন্য অন্য নিরীহ মানুষরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
 
বোঝাই গেল যে ও প্যাসিভ স্মোকার হতে চায় না। সে ও না-ই চাইতেই পারে। রজনী সংঘের অনেক সদস্যই আছেন্, যাঁরা স্মোক করেন না। কিন্তু স্মোকারদের এভাবে একজন প্রাক্তনীর কাছ থেকে অপমান!!! ঠিক সহ্য হল না। পরদিন থেকে ও এলেই আমরা ওর চারপাশে কিঞ্চিত নিবিড় হয়ে বসতাম।

তাতে একদিন ও ভীষণ রাগারগি করে আবার পনেরো দিনের জন্য উধাও।

আবার নবরূপে প্রত্যাগমণ। ঠোঁটের একপাশে সিগারেটটা ফেলুদা স্টাইলে ঝুলছে। আমরা সবাই স্বস্তির নি:স্বাস ফেললাম। আলোকময় তো বটেই।

কিন্তু ওকে স্বস্তিতে টিঁকতে দিতে আমাদের ভাল লাগে না।

অনন্ত কবে নাকি জানলা দিয়ে অকারণে ঊঁকি দিতে গিয়ে দেখে একটা আলমারীর সাইজের ফ্রিজ নামছে। ব্যাস আর যাবি কোথায়!! বাঙালীর রক্তে ঘোঁটবাজি। যতই ফেসবুক্, ইন্সটা, এক্স্, হাঁকাক না,সে সব ঘোলের স্বাদ; আসল দুধের স্বাদ পাওয়া যায় পাড়াতুতো পাশের বাড়ির ঘোঁটে। আমাদের মধ্যে একজন, নাম বলতে মানা, পাখি দেখার ছলে দূরবীন কিনে এর ওর তার জানলা তাক করছেন, আজকাল। তা যাই হোক শেষে জানা গেল যে, ওটা কার বাড়ির সদস্য হল। আর, পড়বি পড় মালির ঘাড়ে/যে ছিল গাছের আড়ে....নাম হি কাফি হ্যায় – সুদীপ।

মহাভারতে খাণ্ডব দহনে যে গতিতে দাবানল ছড়িয়ে পড়েছিল, তার থেকেও দ্রুতগতিতে সে খবর যোগ্য লোকেদের হাতে গিয়ে পৌঁছাল। ফল স্বরূপ আমরা রাতে পেলাম, ‘হেমামলিনীর ফ্রিজের ঠাণ্ডা জল’।
না... সুদীপের সঙ্গে হেমামালিনীর কোনো মিল নেই। আমি ঐ শব্দবন্ধ শোনার পর থেকে সুদীপকে বিভিন্ন কোণ থেকে নিরীক্ষণ করে দেখেছি, কোনো মিল পাই নি ওই অল টাইম সিল্ভার্-স্ক্রিন সুপারস্টারের সঙ্গে। শেষে জানলাম যে, যে ব্র্যাণ্ডের ফ্রিজ্, হেমামালিনী তার ব্রাণ্ড-অ্যামবাসাডর।
সেদিন কলকাতার তাপমাত্রা বিয়াল্লিশ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছাড়িয়েছে। রাজস্থানে চৌত্রিশ। হেমামালিনীর ফ্রিজের ঠান্ডা জল আমাদের প্রাণে নতুন উদ্দমের সঞ্চার ঘটাল। আমার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে আমরা সবাই (প্রায় জন বারো) সুদীপের আনা সাবড়ে দেওয়া ঠাণ্ডা জলের ফাঁকা বোতলগুলোকে সসম্মানে প্যারেড করে সুদীপের বা‌ড়ির লিফট পর্য্ন্ত পৌঁছে দিয়ে সেগুলোকে সুদীপের হাতে তুলে দিলাম। সঙ্গে জানালাম যে আমরা সবাই একদিন ওর এই নতুন বৌ-এর , না, মানে, নতুন ফ্রিজের মুখ দেখতে যাব। সেদিন গেলাম না, ফ্রিজ আমাদের কি মনে করবে সে কথা ভেবে। আর মুখ দেখতে গেলে কি আর খালি হাতে যাওয়া যায়!!

এর পর থেকে সুদীপ নিয়মিত আমাদের জন্য রোজ হেমামালিনীর ঠাণ্ডা জল আনে। কে আবার খুব দুষ্টুমি করে বোতলের কাগজের লেবেলের গায়ে নখ দিয়ে আঁক কেটে ওর নামের প্রথম অক্ষর ‘সু’ এর বাংলাদেশী সমস্বর লিখে দিয়েছিল, যাতে নাকি ওটা হারিয়ে না যায়। তবুও আমরা আজকাল চাত্কের মত তাকিয়ে থাকি হেমামালিনীর জলের জন্য। এক্দিন ও আসেনি বলে রেগে গিয়ে মেজদা সুদীপ্-কে ‘ভিস্তিওলা’ বলে অপমান করার পরেও সুদীপের প্রাণে কোনো রাগ নেই। শোনা যাচ্ছে, ওই জলে কে এক্জন লুকিয়ে হাত ধুয়েছিল। সে হাত থেকে সুদীপের ফ্রিজের জলের সুগন্ধ সাবান দিয়ে ঘষেও তোলা যাচ্ছে না। তার বক্তব্য অনুসারে, ওটা “হেমা-র গায়ের গন্ধ”। আরো এক্জন ঐ গরমে আলুর চপ খেয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে ছিলেন। উনি ঝাউতলায় এসে হেমামালিনীর ঠাণ্ডা জল খেয়ে বেলা-বেলিপুরো চাঙ্গা।

কিছুদিনের মধ্যে-ই আমার স্থির বিশ্বাস সুদীপের ফ্রিজের ‘হেমামালিনীর ঠাণ্ডা জল’ গুণগত মানের দিক থেকে পৃথিবী বিখ্যাত সর্ব-রোগ্-বিপদ্-হর ‘জমজমের জল’ কে ছাপিয়ে যাবে। তাই যদ্দিন ফ্রি তে ঝাউতলায় রাত এগারোটা থেকে বারোটা পর্যন্ত পাচ্ছেন, সেবন করে যান।

আর ভয় পাবেন না, কারণ এ পরীক্ষিত সত্য এবং বাস্তব, যে সুদীপ পুরো পাল্টে যাওয়া এক মানুষে পরিণত হয়েছে। ও আর কোনো কিছুতেই রাগ করে না।

অনেক চেষ্টা করে দেখা গিয়েছে। আমরা রাগাতে সফল হই নি। শুধু খুব কিছু বললে আজকাল পরমহংস স্টাইলে মিষ্টি হেসে বলে,

- শালা....!!

বলার সময় উচ্চারণে 'ল' টাকে হাল্কা করে কুঁচকে দিতে ছাড়ে না।


(শেষ)

পুনশ্চঃ
আমার খুব ইচ্ছে ছিল যে আমরা সবাই একদিন নতুন ফ্রিজের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলব, বিয়ে বাড়িতে যেমন হয় আর কি! কিন্তু সে সুযোগ আসতে আসতে হনিমুন ফেজ টা ওভার হয়ে যাবে। তাই আর তর সইল না, এ-আই এর ওপরে ভরসা করে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটালাম |

Saturday, 18 May 2024

পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ visionary রা চিরকালই বামপন্থী। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। উদাহরণ খুঁজলে ভুরি ভুরি বেরোবে... সে রবীন্দ্রনাথ-ই বলুন বা শেক্সপীয়র। এমনকি যে সব উন্নত দেশে রাজতন্ত্র বহাল, তাঁরাও বেস্ট পাব্লিক সার্ভিস দেওয়ার জন্য বামপন্থী মডেল-ই ফলো করেন।

বর্তমান ভারতে কেন্দ্রে বা রাজ্যে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে যে পরিস্থিতি, তাতে আর এক বামের কথা ধার করি:

"দেখ ভাল যে সে রইল ভাঙা ঘরে? মন্দ যে সে সিংহাসনে চড়ে"...
জ্য়োতি বোসু স্যারের মানসকন্যা যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় -- এ নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। দ্বিমত নেই এ নিয়েও যে জ্যোতিবাবু নিজেই চান নি, যে ওনার পরে পশ্চিমবঙ্গে অন্য কোনো বাম নেতা সফল ভাবে রাজত্ব করুক। আবার এখনকার আম জনতার একটা বড় অংশ খুব ভাল করেই জানে, যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরে গেলেই তাঁর পরের প্রজন্ম, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় 'রাজনৈতিক চাল' বলে মানুষকে বুঝিয়ে আসলে স্বার্থ চরিতার্থ করতে বিজেপি-র সঙ্গে হাত মেলাতে সামান্য সঙ্কোচ-ও করবেন না। কেউ অবাক হবেন না, যদি উনি বিজেপি-তে যোগদান ও করে নেন, তখন।

পরমানু শক্তির ব্যবহারের অগ্রসরে ও প্রসারের মুলে থাকা আব্দুল কালাম স্যর, আর তাতে সই করার মত দম, অটল বিহারী বাজপেয়ির মত বিজেপি, ইন্দিরা গান্ধীর মত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, রাজীব গান্ধীর মত ভারতকে টেলিকমে এগিয়ে নিয়ে যাবার মত মত মানুষ, ড: প্রণব মুখার্জীর মত কূটনৈতিক বর্তমান ভারতে দুষ্প্রাপ্য, যাঁরা পদে থাকালীন সরকার ও দলের পার্থক্য বুঝতেন, কারণ তাঁদের সেই শিক্ষা ও প্রতিভার ব্যাপ্তি ছিল।
পশ্চিমবঙ্গে আসলে কিন্তু বিজেপি নেই। স্ট্যন্ডিং সরকার বিরোধী তৈরী করে পাবলিক নাচাচ্ছে। আসলে সবাই নিজের অস্তিত্ব সংকটে দলীয় পতাকা নিয়ে ঘোরে বটে, তাতে চাকরী না জুটুক, মন ভরানো মিথ্যে আশ্বাস তো জুটবে। আর, যে বামপন্থীরা দল বদলে রাতারাতি বেটার বামপন্থী হয়েছিলেন, তাঁরা সবাই নতুন যুগের স্বপ্ন দেখেছিলেন। দোষ তাঁদের নয়। দোষ অবশ্যই তাঁদের, যাঁরা মানুষকে ভরসা দিয়ে 'বেটার বামপন্থা'- র নামে তার থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছেন। এ প্রথমত: ছলনা ও দ্বিতীয়ত: প্রতারণার নামান্তর।

চাকরীর সংস্থান নেই। দোকানদার, ব্যবসায়ী, রিক্সা-টোটওয়ালা -- কোনো একজন সাধারণ মানুষ --কেউ খুশি নন, আলাদা করে। কিন্তু তাগিদে ক্ষমতানসীনদের ঝান্ডা বয়ে বেড়ান। বেড়াতে বাধ্য হন। সংসার আছে, সন্তান আছে, চাকরী আছে। কি করবেন! সাধারণ মানুষ তো!!! ক্ষমতা বলতে একখান ভোট মাত্র, যেটা পড়ে গেলেই, কেল্লা ফতে। তারপর সবাই জানে কি হবে -- কিছুই হবে না। শেষ কয়েকমাস 'মানুষের জন্য কাজ করতে আসা' নেতা-নেত্রীরা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসবেন। সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে দেবেন, "চেয়ারে থাকলে কি কি করা যায়!"
তাই সাধারণের কপালে, হাতে থাকবে সেই 'পেনসিল' -- তুমুল ফ্রাস্ট্রেশন!





ককপিটে কেলেঙ্কারী:

***গল্পের চরিত্ররা কাল্পনিক | কারও ব্যক্তিগত জীবনের সাথে মিল থাকলে তা নেহাতই কাকতালীয় |



গণেশদা প্লেনে চড়ে আমেরিকায় মেয়ের কাছে গিয়ে আবার স্বদেশী আড্ডার টানে পোড়া বঙ্গদেশের মাটিতে পা রেখেছে যে, তাতেই আমরা যারপরনাই খুশি। অন্তত: মাঝপথে কোথাও প্লেন থেকে নেমে যায় নি। আমরা খুব আশঙ্কায় ছিলাম যে, বাস‌-ট্রাম-ট্রেনের মত প্লেন থামিয়ে মাঝ-আকাশেই ভদ্রলোক প্লেন থেকে নেমে না যান! যা ছটফটে! তা আমাদের মত জাত-শত্তুরদের মুখে ছাই দিয়ে, গণেশদা পুরো ক্যারেকটার সার্টিফিকেট-টাই বদলে দিল এখন তো লেখাই যায় যে,

টু হুম দিস মে কনসার্ণ:

গণেশ ঘোষ হ্যাজ কোয়ালিফায়েড হিমসেল্ফ টু বি আ বোনা-ফাইদে প্যাক্স উইথ হিজ স্যাটিসফ্যাক্টরী অ্যান্ড কন্টিনিউয়াস জার্নি |"

শুধু দেখা গেছে যে ওনার আশে পাশে যে দু-চারজন সহযাত্রী হিসেবে ফ্লাইটে ছিলেন, নামার সময় তাঁদের আচরণে অস্বাভাবিকত্ত্ব পরিলক্ষিত হয়েছে এবং আমেরিকান ইমিগ্রেশন অথরিটি তাঁদের সন্দেহভাজন বলে ডিটেইন করেছে | আরও আশ্চর্যজনক হল যে সেই ফ্লাইটের ক্যাপ্টেন ফ্লাইট থেকে নেমেই তাঁর রেজিগণেশন জমা দিয়েছেন |

অনুসন্ধান করে দেখা গেছে যে গণেশদা নিজে নামতে না চা ইলেও ওনাকে মাঝরাস্তায় প্লেন থেকে নামিয়ে দেওয়ার খাপ হয়েছিল বটে! গণেশদার সঙ্গে ক্যাপ্টেনের মিনিট পনেরো সাক্ষাতের পরে তাঁর হৃদযন্ত্রে গোলযোগ দেখা দেয় | সেই থেকে দায়িত্ব সামলান কো-পাইলট | ঘটনাসূত্রে জানা যাচ্ছে যে প্লেনটি যখন টারবুল্যান্সে পড়েছিল তখন নাকি গণেশদা অত্যন্ত ছেলেমানুষের মতো বায়না করে, খুব জোরাজুরি করে স্পেশাল পারমিশন নিয়ে ককপিটে ঢুকে ক্যাপ্টেনের কানের কাছে ফিজিক্সের থিওরি এবং কিভাবে টারবুল্যান্স কে সামলে ঘন মেঘের মধ্যে দিয়ে উড়ে যেতে হয়, সেই নিয়ে মিনিট পনেরো ধরে একটি লেকচার দিয়েছিলেন এবং তারপরেই ক্যাপটেনের হৃদযন্ত্রে গোলযোগ দেখা দেয়। ফ্লাইটের ব্ল্যাক বক্স থেকে যা পাওয়া গিয়েছে তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিচে দেওয়া হল।

গণেশদা ক্যাপ্টেনকে বলছেন:

-- কিস্যুই জানেন না দেকচি! এদিকে বোয়িং ওড়াচ্ছেন ! কে আপনাকে পাইলটের চাকরি দিল ! আপনি বরং কাল থেকে প্লেনের চাকার নাটবল্টু টাইট করবেন | আমার পাশের বাড়ির পচা ক্লাস সেভেনে পড়ে | ও আপনার থেকে অনেক বেশি ভাল প্লেন ওড়াতে পারে... সিম্যুলেশনে পাকা হাত |

-- সিম্যুলেশন আর রিয়েলিটি আলাদা |

-- ঠিক বলেছেন , রিয়ালিটিতে কোনো সমস্যাই নেই | অটো পাইলট মোডে অন মেরে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়! ব্যাস |

-- অ্যাঁ

-- অ্যাঁ, নয় হ্যাঁ... সিম্যুলেশনে দু'দণ্ড এদিক ওদিক ঝাড়ি মেরে হোস্টেস্দের সঙ্গে কান এঁটো করা হাসি মেরে যে গপ্প করবেন তার যো নেই। অন্য দিকে তাকালেই গেল, সোজা ক্র্যাশ... ইমারজেন্সি এক্সিটের বা ইজেকশনের সময়ও পাবেন না |

-- কটা ফ্লাইট উড়িয়েছেন আপনি?

-- ভাগ্যিস ওড়াইনি ... নইলে আপনাদের মত আন্ডার কোয়ালিটি মালেদের দলে ঢুকে যেতাম |

-- তাহলে এই টারবুল্যান্স থেকে বেরোনোর উপায় বলুন |

-- প্লেনের নাকটা তিরিশ ডিগ্রী ওপরে করলেই কয়েক মিনিটের মধ্যে ট্রপোস্ফিয়ারের নেক্সট লেভেলে চলে যাবেন | ক্লাউড লেভেলের আর এই হ্যাপাই থাকবে না।

-- একস্ট্রা ফ্যুয়েল পুড়বে অনেকটা...

-- টারবুল্যান্সের ফ্রিকশন রেসিসটেন্স ওভারকাম করে স্পিড মেনটেইন করতে তার থেকে অনেক বেশি ফ্যুয়েল পুড়ছে |

-- আপনি আমাকে ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট শেখাচ্ছেন?

-- ও সব ক্রাইসিস ম্যানেজ্মেন্ট ট্যানেজমেন্ট আমাদের পাড়ার ইলেক্ট্রিশিয়ান লালু-ও আপনার থেকে ভাল জানে। লোডশেডিং হলে যখন ফেজ চেন্জ করে না, সে দেখার মত শিল্প। আপনি ভাই শিক্ষিত মানুষ, তাই একটু বেসিক ফিজিক্স শেখাচ্ছিলাম, এমনিতে ছাত্র-টাত্র আজকাল আর আমার কাছে আসে না তো, কারণ আমি সিলেবাস পড়াই না যে, আর পয়সাও নিই না। বিনি পয়সার জ্ঞান বিতরণের যুগ পার হয়ে গ্যাচে | তাই আপনাকে যখন পেইচি, আর ছাড়্ছি না!!

-- বাজে না বকে আপনি আপনার সিটে গিয়ে বসুন।

-- এ তো আমি আপনাকে বলব, আপনি এখন স্টুডেন্ট আর আমি টিচার।

-- আপনি কি পাগল?

-- না না পাগলামী আপনি করছেন, ইচ্ছে করে এতগুলো যাত্রীর টেনশন তৈরী করছেন, অকারণে... আপনার হাতে অপশান আছে কিন্তু আপনি সে সব করছেন না... মাথা খারাপ একদম!

-- আ য়্যু টেলিং মি দ্যাট আ অ্যাম ক্রেজি?

-- মধ্যবিত্ত বাঙালীর এই এক দোষ...একটু চটে গেলেই মাথায় ইংলিশ বলার বায়ু চড়ে যায়। হয়েছেন পাইলট, কিন্তু মজ্জায় মজ্জায় মধ্যবিত্ত বাঙালীর ছাপ...মেটাতে পারেন নি।

-- হ্যোয়জু য়্যু মিন্!!!

-- আরে মিন মিন করে না বলে বুক ঠুকে বলুন যে আপনি, চক্কোত্তি... এত ইংরিজি বুঝি না..!!! আর হ্যাঁ, আপনি যে পাগল তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই ।

-- মানে? কি করে বুঝলেন্?

-- মাইরি!!! এই পাগলা আদ্দামড়া-কে আর কত শেখাব রে!

আরে, একমাত্র পাগলরাই ঠিক বুঝতে পারে না সে পাগল, আর এটা জিজ্ঞাসা করে যে 'আমি কি পাগল?'

ক্যাপ্টেনের সহকর্মীরা সবাই বিস্ফারিত নেত্রে গণেশদার দিকে তাকিয়ে। তাঁদের কারোর বিশ্বাস হচ্ছে না, যে এটা কেউ করতে পারে। এ সব দেখে গণেশদা নিজেই বলে উঠল,

-- আরে হাঁ করে দেখছেন কি? একে সরান, যত সব আন্ডারকোয়ালিফায়েড লোক জনকে এই সব গুরুদায়িত্ব দিয়ে দিয়েছে। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি, কি করে প্লেন-কে বিপদ থেকে মুক্ত করতে হয়!

ক্যাপ্টেন সেই যে নিজের বুকের বাঁ দিক চেপে ধরে বসে পড়েছিলেন, ফ্লাইট ল্যাণ্ড না করা অব্দি আর কর্মক্ষম হয়ে ওঠেন নি।

সেকেণ্ড ক্যাপ্টেন দেখলেন যে পরিস্থিতি বিপদসীমার ওপরে। বললেন,

-- মি: গোশ, ঊই হ্যাভ আন্ডারস্টুড ওয়েল, দ্যাট ইউ আ অ্যান এক্স্পার্ট ইন দিস...অ্যান্ড নাঊ আ'ল বি ফ্লাইং দিস বোয়িং....নো ওয়োরিজ...জাস্ট চিল...

-- তুই ব্যাটা চিল না চড়াই, কোন পাখি, সেটাই তো কথা... আমি কি সিটে বসে বসে তোদের সার্কাস দেখব না কি!

-- প্লিজ ওবে মাই কমান্ড্, এল্স, য়্যু'ল বি অ্যারেস্টেড ইন আ ফরেন ল্যান্ড! আ হোপ য়্যু রিয়ালাইজ দ্য এক্সটেন্ট অফ সিরিয়াসনেস ইন ইট!

-- থ্রেট কচ্চেন?

-- দিস ইজ মাই মোস্ট হাম্ব্ল এফোর্ট টু রিটেইন মাই হাই লেভেল অফ পার্সিভ্যারেন্স। আ অ্যাম প্রোভাইডিং ইউ অপশানস উইথ অ্যাম্পল ওয়র্ণিং।

-- ছোকরার ইংরিজিতে দখলটা বেশ ভালই। বেশ তরতর করে ভাল শব্দ দিয়ে ভাষাটা বলতে শিকেচে। আচ্ছ বাবা! যা ভাল বোঝ কর তোমরা! আমি একটু গড়িয়ে নিই। তবে প্লেনের মধ্যে এই ট্রেনের মত দুলুনিটা কিন্তু খাসা! একটু শুধু ছন্দের অভাব আছে। মনে হচ্ছে টার্বুল্যান্স থেকে বেরোতে বেরোতে আমি এই দুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়ব। কি বলেন?

ক্যাপ্টেনের দিকে তাকিয়ে বললেন গণেশদা।

এতক্ষণ বুকের যন্ত্রণায় ধরাশায়ী ক্যাপ্টেন যাও বা তাকিয়ে ছিলেন, এবারে সংজ্ঞাহীন হলেন।

গণেশ-দা বিপদ বুঝে কেটে পড়ে নিজের সিটে বসে চক্ষু মুদিলেন। পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে শোনা গেল,

-- এনি ডক্টর অন বোর্ড? ঊই নীড ইয়োর ইমিজিয়েট অ্যাসিসট্যান্স....

ফ্লাইট তখন এমন এয়ার পকেট আর টার্বুল্যান্স পেরোচ্ছে যে যেন যাত্রীরা সব বিমানে নয়, ঘোড়ার পিঠে বসে।

গণেশদার সে সবে কোনো বিকার নেই। ওই তালপাতার মত চেহারায় অচিরেই এমন গভীর নিদ্রায় নাক ডাকতে আরম্ভ করল যে, সে গর্জনেই প্লেন-টা যেন বার-বার কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল।

প্লেন থেকে নামতেই গণেশদাকে সে দেশের পুলিশ ঘিরে ধরে এসকর্ট করে অন্য গাড়িতে বসিয়ে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ার করে মেয়ের কাছে পৌঁছে দিল, লাগেজ সমেত |

অফিসার ইন-চার্জ মেয়েকে বললেন

-- হু ইজ হি?

-- মাই ফাদার...

-- ইন্টারেস্টিং ম্যান! বাট হি নিডস সাইকোলজিকাল কনসালটেশন?

-- হোয়াই?

-- হি ইজ ব্যাডলি সাফারিং ফ্রম এ-ডি-এইচ- ডি.... অ্যাটেনশান ডেফিসিয়েন্সি অ্যান্ড হাইপার অ্যাকটিভিটি সিনড্রোম... ইট হ্যাপেন্স হোয়েন সামওয়ান ইজ টু অ্যালোন টু একজার্ট ওয়ান'স ফিলিংস অ্যান্ড নলেজ |

মেয়ে গণেশদা কে বলল

-- বাবা তুমি না জাস্ট ইনকরিজিবল!!!

গণেশদা বলল

-- দেখলি কেমন দিলুম!! আমাকে একপাও হাঁটতে তো হলই না... উল্টে লাগেজটা পজ্জন্ত কালেক্ট কত্তে হল না!

(শেষ)