Tuesday, 24 January 2023

সরস্বতী বন্দনা ... বন্ধ না

সরস্বতী পুজো... কথাটা শুনলেই শিহরণ...! আমি যে সময়ে বড় হয়েছি, মানে শৈশব থেকে কৈশোর পেরিয়ে যুবক হয়েছি, মানে ফ্রয়েড সাহেব তাঁর কর্তৃত্ব নিয়ে ডারউইনিজমের চিরকালিন তত্ত্বকে শুধু এক তথ্য হিসেবে ধরা দিয়েছেন, মানে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন কে ছিলেন - তা জানার থেকে সে সময়ে অনেক বেশি জানতে চাইতাম যাঁকে ভালবাসতাম, তাঁকে...

কোনোদিনই সাইকেল নিয়ে বিভিন্ন গার্লস স্কুলে কার্ড বিলি করার মধ্যে রোমাঞ্চ বা বীরত্ব - কোনোটাই খুঁজে পাইনি৷ আমার সাইকেলে হাত ভাল এই অজুহাতে সুখেন বাবু যখন  জোর করেই সাইকেলে কার্ড বিলির দলে ঢোকাতেন,  বেশ বিরক্ত হতাম ৷ নিজেকে খুব সস্তা লাগত ৷ 

নিজের স্কুল জীবনে সরস্বতী পুজোয় যে অভিজ্ঞতা হয় নি, তা প্রথম শিখলাম ১৯৯৮ সালের সরস্বতী পুজোয়, যে স্কুলে চাকরি পেলাম, সেখানে৷ 

হাওড়ার বুকে এই বিদ্যালয় সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে চিরকালই হাস্যাস্পদ, মানে তখনও সবাই হাসাহাসি করতেন এখনও করেন ৷ কিন্তু আমি কোনোদিন এই স্কুলকে নিয়ে হাসির মত কিছু দেখিনি ৷ আমি সেখানকার শিক্ষক বলে নয়, একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ হিসেবে, যা ভারতবর্ষের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ০.০৫ % মাত্র। শিক্ষার সুযোগের সামান্যতম রশ্মিকে আমার একটা আস্ত সূর্য মনে হত৷ 

করুণা হত/ হয় তাঁদের অন্ধত্বের প্রতি যাঁদের হাতে শিক্ষাব্যবস্থার হাল সঁপে দেওয়া হয়েছে৷ যাঁরা সব দেখেও দেখতে পান নি /পান না ৷ তাঁরা শুধু মস্করা করেন৷ অনেক পরে বুঝেছি যে এই হাসির আসল কারণ তাঁদের অপদার্থতা ৷ এবং তার কারণ, শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতির জমজমাট বাজারের মূলে তাঁদের বিকিকিনি৷ গড়ার তো ক্ষমতা নেই, কিন্তু গড়া জিনিষ কে ভাঙায় তাঁরা সিদ্ধহস্ত ৷

তাই আমি গর্বিত বোধ করি আমার নগণ্যতায়, যে আমি আমার জীবনে এই বিদ্যালয়ের ২৫ বছরের চাকরী জীবনে শিক্ষক হিসেবে একজন পলিটিক্যাল ফেলিওর ৷ আমার সমসাময়িকদের কোরিয়ার গ্রাফ আরও অনেক উন্নত এবং তাদের অনেক ক্ষমতা ও সোর্স আছে ৷ আমি আরও গর্বিত যে একজনকেও স্টার পাওয়াতে না পারলেও অন্ততঃ আজ পর্যন্ত প্রায় সমাজ থেকে ব্রাত্য এরকম মাত্র ৮০০ জনের কিছু বেশি সংখ্যক ছাত্রকে মাধ্যমিক নামক বৈতরণী উতরে দিতে পেরেছি, গরুর লেজ না ধরিয়েও ৷ 

এই সব ছাত্রেরা কারা? অন্য সব বড় বড় নামকরা স্কুল থেকে মাঝরাস্তায় খেদিয়ে দেওয়া প্রান্তিক৷ তাদের পরিবারের ৯৫% দিন আনে দিন খায় ৷ একটি মাত্র ঘরে ৫ থেকে ১২ জনের বাস ৷ অনেকেই শিশু শ্রমিক ৷ তারা বেশির ভাগই সারারাত কাজ করে স্কুলে রেস্ট নিতে আসে ৷ মিড ডে মিল তো হালফিলের ঘটনা। তখন অনেককে নিজেদের পকেট থেকে খাবার বই খাতা পেন্সিল কিনে দিয়ে বলেছি,

-কিছু ভাবতে হবে না যতদূর পারিস যতদূর পড়ে যা ৷ যখন একেবারেই আর পারবি না তখন দেখা যাবে। 

আমার গর্ব বোধ হয় তেলা মাথায় তেল দিয়ে 'অমুক আমার ছাত্র' বলে লোক দেখাতে পারি নি বলে ৷ কারণ দেখানোর বা বলার মত কিছু নেই ৷ রসাতলে তলিয়ে যাওয়ার শেষ মুহূর্তে এরা আমাদের এই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসা বিদালয়ে শিক্ষার সহানুভূতি ও সমানুভূতির স্পর্শে নবজীবন পেয়েছে ৷ আমি তাদের কাছে তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার তুলে দিতে পেরেছি, সেই বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে ৷ এদের বেশিরভাগই আজ স্বাবলম্বী সাধারণ নাগরিক যাদের ভিক্ষে করে বা দুর্বৃত্তি কে সম্বল করে পরিবারের দেখভাল করতে হয় না ৷ 

সেই সব প্রায় অন্ধকারে তালিয়ে যাওয়া ছেলেদের নিয়ে ছাতাপড়া স্কুলে সরস্বতী পুজো ৷ ওদের ইচ্ছে, ওরা পুজোও করবে, আবার সেই উপলক্ষ্যে কবজি ডুবিয়ে খাবেও - কিন্তু পুজোর দায়িত্ব নেওয়ার মত সংখ্যক হিন্দু ছাত্রই তো নেই স্কুলে! বেশিরভাগই মুসলিম সম্প্রদায়ের... কি হবে ? 

আশ্চর্য হয়ে দেখলাম স্বাধীন ভারতে পরাধীন ভারতের সেই অসাধারণ, অনন্য মানববন্ধনের দুষ্প্রাপ্য চিত্র - যা শেখাতে সংবিধান লিখতে হয় না (কারণ লিখলেও বোঝে কজন, আর বুঝলেও মানে ক'জন) অথবা  'মিলে সুর মেরা তুমহারা ' বলে গান প্রচার করে একটা গোটা প্রজন্মের মনে শুধু দূরদর্শন টিভি -চ্যানেল কে চিরকালের জন্য গেঁথে দিতে হয় না।

মুসলিম ছেলেরাই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গঠন করল সরস্বতী পুজো কমিটি। মূর্তি কিনল, বাজার করল, পুরোহিত ডাকল, বিসর্জন দিল, খাওয়ার আয়োজন করল ৷ খাওয়ার দিন অনেকের সাথে উপস্থিত হল নিষ্পাপ কিছু ছোট ছোট মুখ - দু-চারটে লুচি আলুরদম আর এক হাতা বোঁদের আশায়। আমাদের স্কুলের ছাত্র নয় তারা ৷ কিন্তু আমরা তাদের তাড়িয়ে দিতে পারি নি ৷ আমাদের স্কুল থেকে  কিছু চেয়ে কেউ কোনোদিন খালি হাতে ফিরে যায় নি ৷ 

আমার জীবদ্দশায় এই ভারত আবার দেখতে পাব সে  আশা আর রাখি না৷ মা সরস্বতীর গায়ের রং ধর্মের ব্ল্যাক ক্যাট কমান্ডোদের Z ক্যাটেগোরির সুরক্ষার দরুন বেনিআসহকলায় রূপান্তরিত ৷ তিনিও মণ্ডপে নানা সাজে যেন গিরগিটি - সবুজ গোলাপী লাল গেরুয়া৷ আশঙ্কা হয়, দেবীর হাতের বীনাখান কেড়ে নিয়ে ভোট পাওয়ার জন্য কোনদিন না মাইক্রোফোন ধরিয়ে দেন আমাদের দেশের রক্ষাকর্তারা।

আমাদের এই বিদ্যালয় নিশিহ্ন হওয়ার মুখে ৷ আর ক' বছর এখানে থাকতে পারব জানি না, কিন্তু আপনাদের সকলকে এ বছরে পুজোর দিন বিদ্যালয়ের ছাত্রদের তরফ থেকে নেমন্তন্ন রইল।

No comments: