Saturday, 17 December 2022

শিক্ষার মান = ওয়াশিং পাউডার নিরমা :

কিছুদিন আগে আমর হাতে একটি বই এসে পড়ে : গত শতাব্দীর ষাটের দশকের মাধ্যমিক স্তরের বাংলা সহায়িকা। তার ভাষার রূপ দেখলে বিস্ময় জাগে।

এখন এ রকমের গভীরতা দুষ্প্রাপ্য। পিছিয়ে পড়া মানুষদের শিক্ষার আলো দেখাতে গিয়ে সাধারণ শিক্ষার মান যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, তা আমাদের আশাহত করে। 

বেশ কয়েক বছর আগে হাওড়া জেলার প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের চেয়ারম্যান মাননীয় স্মৃতীশ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়কে কিছু প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে চাকরী প্রার্থী তাঁরই টেবিলে রাখা কলিং বেল তুলে ছুঁড়ে এমন আঘাত করেন যে তাঁর মাথা ফেটে যায়৷ তাঁদের অভিযোগ ছিল যে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষার ফর্ম ফিল্-আপ করে জমা দেওয়া সত্ত্বেও পরীক্ষায় বসার জন্য অ্যাডমিট কার্ড তাঁরা পান নি। স্মৃতীশ বাবু জানান, প্রায় সাড়ে তিন হাজার অ্যাপলিকেশন ফর্ম বাতিল করা হয়েছে তার কারণ সেই সমস্ত হতে চাওয়া শিক্ষকরা অ্যাপলিকেশন ফর্মটুকুও ঠিক করে ভরার যোগ্যতা রাখেন না। নিজের নামের জায়গায় ঠিকানা, বা সেক্স এর জায়গায় বাবার নাম লেখার মত ক্ষমার অযোগ্য ভুল করেছেন ৷ যাঁরা ভবিষ্যতে শিক্ষক হতে চান তাঁদের কাছ থেকে এ ধরনের ভুল একেবারেই অনভিপ্রেত ৷ খুব সঙ্গত কারণেই সেই সব ফর্ম তাই বাতিল করা হয়েছে ৷ কিন্তু আবেদনকারীদের দাবী ছিল - পয়সা দিয়ে লাইন দিয়ে ফর্ম তুলেছেন যখন, ফর্মে যাই লেখা থাক না কেন, পরীক্ষায় বসতে দিতেই হবে ৷ ফর্ম বাতিল করা চলবে না ৷ শেষে ঝামেলা এড়াতে সবাইকে পরীক্ষায় বসানোর ব্যবস্থা করা হয়৷ শিক্ষাব্যবস্থার এহেন অবনমন দেখে স্মৃতীশ বাবু পদত্যাগ করেন ৷

সময় পেরিয়েছে। আপামর সাধারণ মানুষ সব দেখেশুনে নিজেদের অভিযোজিত করেছেন । এখন তাই শুধু পরীক্ষায় বসতে দেওয়া নয়, পরীক্ষা দিলেই পাশ করাও যে প্রাথমিক অধিকারের মধ্যে পড়ে তা রাষ্ট্ররক্ষার কাণ্ডারী রা, নিজেরাই , সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন ৷ হোক না খাতা ফাঁকা, পাশ কিন্তু করাতে হবেই। আর তার দায় কিন্তু শিক্ষকদেরই।

এনারা সবাই আসলে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডিগ্রীধারী মাত্র। আসল পড়াশোনার সঙ্গে কোনোদিন কোনো যোগাযোগ ছিল বলে মনে হয় না। অনেকে সব জেনেও পলিটিক্যাল ব্র্যান্ডিং এ যাতে আঁচ না লাগে তাই তর্ক করে যান -

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি বোকা, যে এমনি এমনি ডিগ্রী দিচ্ছে ! সেরকম গুণ আছে বলেই না দিচ্ছে !

মনে মনে খুব ভাল করেই জানেন এরকম দু একটা ডিগ্রী যদি ফ্রী তে দেওয়ার বিনিময়ে এই মাগ্গী গণ্ডার বাজারে কয়েক কোটি টাকা গ্রান্ট পাওয়া যায়, তাতে বৃহত্তর শিক্ষা-স্বার্থ রক্ষিত হয়।

কিন্তু যাঁরা পাচ্ছেন। তাঁদের তো সেই বিচার বিবেচনা নেই। তাঁরা সেই অমূল্য ডিগ্রী ফ্রী তে পেয়ে উদ্বাহু হয়ে মাইক্রোফোনে বলে দিচ্ছেন - রাষ্ট্র যখন কিছুই সেভাবে দিতে পারছে না, শিক্ষকদের হাতে থাকা নম্বর টা অন্ততঃ ঢালাও দিয়ে দিন। ওটা দিতে তো খরচা নেই ৷ ফ্রি তো ৷

তাই কি! সত্যি?

একটি শিশু ভারতবর্ষে জন্মালে আলো জল বাতাসের মত শিক্ষাও তার প্রাথমিক অধিকার ৷ প্রাথমিক স্তর থেকে স্নাতক, মানে, প্রাইমারী থেকে গ্র্যাজুয়েশন - এই স্তর অবদি একটি শিশু যদি পুরোপুরি সরকারী ছত্রছায়ায় থেকে সফলভাবে পড়াশোনা করে তাহলে সেই এক জনের জন্য রাষ্ট্রের ভর্তুকী বাবদ প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা খরচ হয়। এই টাকা আপনার আমার দেওয়া ট্যাক্স ৷

এই আপনার আমার রক্ত জল করা ট্যাক্সের টাকা নিয়ে রাষ্ট্র আপনাকে আমাকে শেখাচ্ছে যে আমাদের সন্তানদের দুধে ভাতে রাখার জন্য শিক্ষকরা তাদের ঢালাও নম্বর দিয়ে যান ৷ আসলে উদ্দেশ্য দুধে-ভাতে রাখা নয়, দুদু-ভাতু করে রাখা...যে নাগরিকের সারা জীবনের জন্য বিষদাঁত তুলে ফেলার অনন্য প্রক্রিয়া...

ক্লাস এইট পর্যন্ত পাশ ফেল নেই ৷ লক্ষ লক্ষ টাকার শ্রাদ্ধ করে যখন শিশুরা নবম শ্রেনির কিশোর, তখন তাদের ৭০ শতাংশ নিজের নাম ঠিকানা টুকুও লিখতে পারেনা । সব দায় কি সত্যি ই শিক্ষকদের? নাকি সম্মোহনী পলিসি মেকিং এর?

আমরা শিক্ষক ৷ রাষ্ট্র যদি স্থির করে ফেলে যে রাজনৈতীক টানাপোড়েন বাঁচিয়ে রাখতে, সমস্ত রাজনৈতীক দলে মারকুটে দাঙ্গাবাজ ক্যাডার তৈরী করতে একমাত্র পথ হল শিক্ষিত বেকার তৈরী করা - তবে তাইই হোক ! আমরা তো বাধ্য- আমাদের থেকে বহুগুনে উচ্চমানের আই-এ-এস আই -পি-এস দের মত। শিক্ষকরা আর রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের প্রোগ্রামার নন, প্রি লোডেড ডিভাইস রাষ্ট্রযন্ত্রের এন্ড-ইউজার মাত্র ৷

আর ভাববেন না আপনার পয়সা আছে বলে সন্তানদের প্রাইভেট স্কুলে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে বেশ পার পেয়ে যাবে তারা৷ আরে সেই শিক্ষিত সমাজই তো হবে এই অর্ধশিক্ষিত বেকার ক্যাডারদের হাতের পুতুল।

স্বাধীনতার পর এক শো বছরও পার হয় নি, তাতেই এই হাল.... মুসলিম শাসনের পাঁচশ বছর আর ইংরেজ শাসনের দুশো মোট সাতশ বছরে এই ভারতের কি দশা হবে, তা না ভেবে আমার হিসেবে স্বাধীনতা সেঞ্চুরীর প্রাক্কালে যা হবে, তা হল,

 

ভারতীয় শিক্ষা = ওয়াশিং পাউডার নিরমা ৷

....সব ধুয়ে মুছে সাফ্....

Related link to Anandabazar Patrika



 

No comments: