রাসের বাঁশি
ঘুম ভাঙতেই মনটা একটা বিষাদে ভরে গেল বিল্টুর। রাসবাড়িতে সেদিন থেকে রাসমেলা। এই তো বছরে একবার মেলায় যায়। কিন্তু এবারে ধুম জ্বর। চশমা পরা শেয়াল পণ্ডিতের মত দেখতে বিশ্বনাথ ডাক্তার আবার তাঁর ওষুধের ফর্দে বার্লি আর সাগুর ওপর আলাদা করে জোর দিয়েছেন। নাক টিপে তাই খাওয়া চলছে। বমি বন্ধ হয় নি। খেলেই বমি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কাউকে বুঝিয়ে বলা যাচ্ছে না যে সাগু আর বার্লির স্বাদ-ই বমির কারণ। এই সব খেয়ে সুস্থ হতে হতে মেলা শেষ হয়ে না যায়। বরং একটু ঘুগনী বা আলু-পটকা খেলে শরীরে তাড়াতাড়ি বল ফিরে আসত। কিন্তু সে সব যুক্তির কথা শোনার মত মানুষের খুব অভাব।
রাসবাড়ি...বেলুড় মঠ থেকে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে বালিখালের দিকে যেতে, লালবাবা কলেজ পেরিয়েই ডান হাতে। গঙ্গার ধারে রাধারমন জিঊ-এর ছবির মত মন্দির। ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দে জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত দাঁ পরিবারের শিবকৃষ দাঁ-এর বড় ছেলে পূর্ণচন্দ্র দাঁ আটচল্লিশ ফুট উঁচু এই নবরত্ন (ন’টা চূড়া বিশিষ্ট) অপূর্ব এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া আছে ছয় শিবের মন্দির, নাটমঞ্চ। আর সবের মাঝে রাসবাড়ি। গোল একটা সাদা রঙের বাড়ি। তাতে বারোটি খিলেনে বারো রাধা-মাধবের মূর্তি।
আছে ঘড়িস্তম্ভ বা ক্লক টাওয়ার। তাতে এক সময়ে ঘন্টা বাজত। রাসবাড়ির ঘাটে নদীর মধ্যে লোহার গেট। খোলা-বন্ধ করা যায় এখনো।একসময়ে মন্দির ও দেবতার সম্পদকে জলদস্যুদের হাত থেকে বাঁচাতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। পুরো ব্যাপারটা যখন বিল্টু দেখত, তার মন পাড়ি দিত দেবী চৌধুরানী-র মত সময়ে। সেই ছিপ নৌকা, বজরা, ডাকাতের দল...তবে এই ঘাটে স্নান করে মজা নেই। কেমন যেন সব চারিদিক বন্ধ। আবদ্ধ। নদীতে অবগাহন স্নানের গুরুত্ব বোঝা যায় না। নদীর জলে ডুব দিয়ে ওঠার পর চোখ খুললেই নিজের অস্তিত্বের যে বিশাল উন্মুক্ত ও পবিত্র একটা ব্যাপার আছে, তা উপলব্ধি করা যায় না এই ঘাটে। তবে ঘাটের গায়ে যে বসার জায়গার সারি, সেখানে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা অনায়াসে কাটিয়ে দেওয়া যায়। বিল্টু মনে মনে ছবি আঁকে। রাসবাড়ির ঘাটের বসার জায়গায় পা তুলে বসে সে আড়বাঁশি-তে সুর তুলছে, মন্দিরের রাধারমনকে শুনিয়ে শুনিয়ে। চারিদিকে আর কেউ নেই। ছয় শিবমন্দিরে ধ্যানস্থ অবস্থা থেকে টলে যাচ্ছেন দেবাদিদেব, স্বয়ং, বিল্টুর বাঁশির মূর্ছনায়।
রাসের সময়ে অবশ্য ছবিটা বদলে যায়। ফাঁকা জায়গাটাতে তিল ধারণের স্থান থাকে না বিকেল থেকে। দূরদর্শনে কথা বলা পুতুল (পরে জানা গেল, এটা একটা আর্ট ফর্ম যাকে নাকি ‘ভেন্ট্রিলোক্যুইজম’ বলে। ইংল্যাণ্ডে পারফর্মিং আর্ট ও বিনোদন হিসেবে ১৭৫৪ থেকে ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।) মাইকেলের পরে বিল্টু সেই প্রথম চাক্ষুষ দেখে কথা বলা পুতুল। সেখানেই প্রথম ইলেক্ট্রিক নাগরদোলায় চড়েছিল সে। শহর-কে অত উঁচু থেকে আগে তো কোনোদিন দেখে নি।
নিচের মানুষরা এই লিলিপুটিয়ান বা আবার এই ব্রবডিংনাজিয়ান। নামার সময়ে শরীর পালকের থেকেও হালকা, যেন ভর-ভার বিহীন। পাখিরা বোধ হয় এভাবেই ওড়ে। চিৎকার করত বিল্টু, ‘জোরে জোরে আরো জোরে’। হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা থাকত সামনের লক করা লোহার রড-টা। মনে করত স্টার ট্রেকের স্পেস শিপে বসে আছে সে।
সেই থেকে নিয়ম করে চলে আসছে সব কিছু। রাসের মেলা মানেই ফি বছরে একবার স্বপ্নের জগতে ভ্রমণ।
যে সব স্বপ্নের জিনিস কেনা হত রাসমেলা থেকে তার ফিরিস্তি বেশ লম্বা। এর মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাঁশের বাঁশি। প্রত্যেক বছর একটি করে আমদানি হতই। একটা মোটা বাঁশের মাথায় অনেক কাঠি গোঁজা থাকত। তার প্রত্যেকটিতে লাগানো থাকত একটি করে বাঁশি। বাঁশির আবার অনেক রকমফের ছিল। আড়বাঁশি ছিল এক রকম। আবার সোজা চাইনিজ বাঁশি ছিল আর একরকম। আড়বাঁশিতে ফুঁ দেওয়া খুব কঠিন কাজ। আর ওটাই নাকি আসল বাঁশি। প্রথমে বিল্টু এমনি সোজা চাইনিজ বাঁশি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলো। সব বাঁশিতে মোট ছ’টি করে ছিদ্র, আর মাথাটা কালির কলমের নিবের মত করে কাটা, ফুঁ দেওয়ার জন্য। ছ’টি সুরের সেই ছিদ্রগুলো আঙুলের মাথা দিয়ে চেপে ধরলে কোনখান থেকে কিরকম সুর বের হয় তাই নিয়েই বিল্টুর অবসর সময় কাটতো।
দারুণ ব্যাপার। এই ভাবেই নাড়াচাড়া করতে করতে বিল্টু ঐ সোজা চাইনিজ বাঁশি দিব্যি বাজাতে শিখে গেল। বছর তিনেকের মধ্যে প্রায় খান পাঁচেক বিভিন্ন সাইজের সোজা বাঁশির কালেকশন করে ফেলল বিল্টু। মেলার বাঁশি তো। তাই সঙ্গীতের শুদ্ধ সুর বা স্কেল ভাল নয়। এইসব নিয়ে কিন্তু বিল্টু বিশেষ কিছু বুঝত না। তবে এরকম ভাবেই না বুঝতে বুঝতে বিল্টু শিখে গেল কিভাবে কোন ফুটো বা ফুটোগুলো কতটা চেপে ধরলে কিরকম সুর বেরোতে পারে। একটা বিজ্ঞান লুকিয়ে আছে। সেটা হাতেনাতে রপ্ত করে ফেলল। খানিকটা রপ্ত করার পরে, বিল্টু যখন কয়েক লাইন গুপিগায়েনের ‘এক যে ছিল রাজা’-র কয়েক লাইন বাজাতে পারল, মোটামুটি, তার মন গিয়ে পড়ল হার্ডার লেভেলে। পরের বারের মেলায় বিল্টুর নজর গিয়ে পড়ল আড়বাঁশিতে। বিল্টুকে অনেক বুঝিয়েছেন ওর বাবা যে,
ওরে আড়বাঁশি বাজানো কিন্তু অত সহজ নয়। তুই ফুঁ দিয়ে শব্দই বের করতে পারবি না।
এসব তোয়াক্কা না করে বিল্টু রাধা-মাধবের নাম করে কিনে ফেলল আড়বাঁশি। কিন্তু কিছুতেই আর ফুঁ বসে না। বাঁশিওয়ালা তো এই বাঁশিটাতেই 'দেখা হ্যায় পহেলী বার/ সাজন কি আঁখোঁ মে পেয়ার' দিব্বি অনায়াসে বাজিয়ে পরীক্ষা করে তবেই না বিল্টু-কে দিয়েছেন। এখন ওর ফুঁ-টা ঠিকমত পড়লেই হয়ে যায়। কিন্তু বিল্টুর ফুঁ দেওয়াই সার। যতই ফুঁ দিক কিন্তু বাঁশি থেকে একটুও সুর বের হয়না। শুধু হসহসে শব্দ বের হতে থাকে। বিল্টু আরো তেড়ে ফুঁ দেয়। তাতে নিশ্বাসে টান প'ড়ে। হাঁপিয়ে যায়।
বিল্টুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। বাড়িতে অনেক ফাঁকা হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশি ছিল সেইগুলোতে ছিপি খোলা অবস্থায় সোজা লম্বালম্বি ঠোঁটের নিচে চেপে ধরে যদি ফুঁ দেওয়া যায়, তাহলে তা থেকে মিষ্টি বাঁশির মত শব্দ বের হয়। এটা সে এমনি খেলতে খেলতে আবিষ্কার করেছিল। এখন সেই আবিষ্কার কাজে লেগে যাবে বলে মনে হয়। শিশি থেকে একটাই সুর, বেরোয় হুইসিলের মত। শিশি যত বড়, তত জোরে ফুঁ লাগে।
বিল্টুর সমস্ত মন জুড়ে বাঁশি বাঁশি আর বাঁশি। কিছুতেই পড়ায় তার মন বসছে না। একবার, শুধু একবার, যদি ওই বাঁশি থেকে একটু সুর সে বের করতে পারে, রাধারমনের দিব্যি, সে আবার পড়ায় মন দেবে। কিন্তু বাঁশির আগে রয়েছে হোমিওপ্যাথি শিশি। খুব সিরিয়াসলি প্রাক্টিস চলল।
লুকিয়ে লুকিয়ে। এ সবের অনেক হ্যাপা, কারণ, এ বাড়িতে পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছু করা ঘোর অন্যায়। তার ওপর আবার এটা করতে গেলে আওয়াজ বের হয়। পড়ার বইএর ফাঁকে লুকিয়ে লুকিয়ে অমর চিত্র কথা বা ইন্দ্রজাল কমিকস হামেশাই পড়ে। ধরাও পড়ে না, কারণ নিঃশব্দে করা যায়। কিন্তু একটু হোমিওপ্যাথি-র শিশি-তে যে একটু লুকিয়ে ফুঁ দেবে, তার জো নেই। বাড়ির বড়রা চারিদিক থেকে খামচে ধরবে। আর মায়ের কানে যদি একবার যায়, তবে তো আর রক্ষে নেই। ভাল ও বড় কিছু করতে গেলে ঝুঁকি তো নিতেই হয়! তাই যাই হোক না কেন বিল্টু এটা করেই ছাড়বে, একদিন না একদিন। একবার আড়বাঁশি থেকে সুর বের হলেই আর পড়াশোনায় এভাবে ফাঁকি দেবে না। বাঁশি-টা থেকে থেকে শব্দ বের হবেই,বিল্টুর মনের মধ্যে স্থির বিশ্বাস। ওই বাঁশিওয়ালা-টা পড়াশোনা জানে না। কারোর কাছে বাঁশি বাজাতে শেখে নি। কত কষ্ট করে রোজগার করে। সে যদি অত সুন্দর বাঁশি বাজাতে পারে, বিল্টু নিজে স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করে, এত বুদ্ধি নিয়ে একটা সামান্য সাতটি ছিদ্রওয়ালা বাঁশি আড়াআড়ি ধরে বাজাতে পারবে না! ও হ্যাঁ, আড় বাঁশিতে মোট সাতটা ফুটো। ছ’টা এমনি বাঁশির মত সুর বের করার জন্য। আর মাথার কাছে আরো একটা -- ফুঁ দেওয়ার জন্য।
স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন ছিল রবিবার। সকালে বাবার সঙ্গে দোকানে গিয়ে কচি পাঁঠার মাংস কাটিয়ে আনা হয়েছিল। আড়বাঁশি কিনে আনার পরে অন্তত চার-পাঁচ দিন কেটে গেছে। কিন্তু বিল্টুর বাঁশি নিয়ে মোহ কাটেনি। সারাক্ষণ শিশিতে ফুঁ দিয়ে দিয়ে নীচের ঠোঁটটা আরও পুরু ও ভারী হয়েছে বিল্টুর। আর অপেক্ষা করতে পারছে না, বিল্টু। যে আড়বাঁশিটা কিনে এনেছে, সেটা এক ফুট মত লম্বা হবে। ছ'টা ফুটোর ব্যবধান বিল্টুর কচি আঙুলের ব্যবধানের অনুপাতে একটু বেশিই। তবুও বেশ ম্যানেজ করে ছটা ফুটো চেপে ধরল।বাঁশির মাথার কাছে ফুঁ দেওয়ার সপ্তম ছিদ্র-কে ঠোঁটের নিচে হোমিওপ্যাথির শিশির খোলা মুখের অবস্থানে রাখল বিল্টু। বিল্টুর চোখ বন্ধ। একটা গভীর শ্বাস নিয়ে একানে’ ফুটতে হালকা একটা ফুঁ। বেজে উঠল বাঁশের আড়বাঁশি, একবারেই। চোখ বন্ধ রেখেই এরপরে একটা একটা করে আঙ্গুল ছাড়তে লাগল বিল্টু, আর আর বাঁশি থেকে সুরেলা শব্দ বেরোতে লাগলো। স-র-গ-ম-প-ধ-নি। বিল্টুর বন্ধ হওয়া চোখের কোন দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ছে। আনন্দ আর ধরে না। তার মনে শ্রীকৃষ্ণের সম্মোহন -- সঙ্গে যে যায় বংশীবদন...
দীঘল চোখের রাধারমণের মূর্তিকে স্মরণ করে সুর তুলল বিল্টু তার প্রিয় গানেরঃ
“আমায় ডুবাইলি রে/ আমায় ভাসাইলি রে/ অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে…”
আর কি চাই! কালথেকে নিশ্চয়ই পঞ্চাশ-টা করে যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগ করে ফেলবে বিল্টু।
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে জ্বরের মুখেও সেই বাঁশিটা বের করে বালিশের পাশে রাখল। রাসমেলায় তো আর যাওয়া হবে না। দুধের স্বাদ ঘোলেই মিটুক।
ছবি ও তথ্য সৌজন্যেঃ
রাজীব পোদ্দার
কিঞ্জল বোস
উইকিপিডিয়া






No comments:
Post a Comment