আমরা যখন ছোট ছিলাম সে সময়টা বেশ আলাদা রকমের ছিল। তা অবিশ্যি সকলেরই থাকে। আর ভাল খারাপের কথাও বলছি না।আলাদা ছিল এই পর্যন্ত। আমার কাছে আরও-ই আলাদা রকমের তার কারণ শৈশব ও কৈশোর খুব মসৃণ ছিল না। নব্বই এর দশকের আমার প্রজন্মের মানুষদের মধ্যে অনেক লেখক লেখিকা আমার থেকে অনেক ভাল ভাবে সেই সময়কে তাঁদের কলমের মাধ্যমে ধরেছেন এবং ধরে চলেছেন। ফেসবুকে দেখতে পাবেন এই সময়ের গ্রুপ ও পেজ আছে আলাদা করে, শুধু বাংলায় নয়, সারা জগৎ-জুড়ে। নব্বই এর দশকের এই আলাদা ব্যাপার কিন্তু আর অন্য কোনো প্রজন্মের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। আগের ও পরের গ্রুপ,পেজ বা লেখা সবই আছে, খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবেই আছে, কিন্তু সংখ্যায় সে সব নব্বই-এর দশক কে ছাপিয়ে যেতে পারে নি কোনোভাবেই।
সে সময়ে পুজোগুলো আমার কাছে নানা রং-রূপ নিয়ে
আসত । আমার ছেলের কাছে যেমন দূর্গাপুজোর ওপরে কিছু নেই, আমার কাছে ওর বয়েসে আবার তা
ছিল না। অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিশ্বকর্মা পুজো আর কালীপুজো।
দূর্গাপূজোর দু-তিন রাত কাটত সেন্ট জন্স’ অ্যাম্বুলেন্স ব্রিগেডের নিঃস্বার্থ উৎসর্গীকৃত
ক্যাডেট হিসেবে খাঁকি জামা টুপি আর হাফ প্যান্ট পরে কোনো এক খুব-ভিড়-হয় এমন মণ্ডপে।কিছু
করার নেই। মিলিটারী ডিসিপ্লিনের মত। রক্তপাত, অ্যাক্সিডেন্ট, ছড়া, কাটা, ভাঙা এই সব
নিয়ে চলত কারবার। আর যাতায়াতের পথে সাইকেল নিয়ে কয়েকটা ঠাকুর দেখে ফেলা। এর বাইরে খুব
একটা আলাদা করে দুর্গাপুজো আমার কাছে গভীরভাবে অর্থবহ ছিল তা নয়। মাধ্যমিকের আগে ডিপ্লোমা
শেষ করার পরে সময় করে উঠতে পারিনি আর, সেণ্ট জন্স’ এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে। সেক্ষেত্রে পূজাবার্ষিকী পড়তে পড়তেই কেটে যেত গোটা
পুজো।
কালী পুজোয় ছিল আসল ধামাকা। কোন একটা বয়েস থেকে
ফুলঝুরি জ্বালাচ্ছি, মনে নেই। পাড়ার দাদারা যখন দেদার শব্দবাজী ফাটিয়ে যেত, লোলুপ দৃষ্টিতে
চেয়ে থাকতাম। সিগারেট খাওয়া যেমন ‘বড় হয়েছি’ যে, তার কলকে ছিল, সেরকম ধানীলংকা, লংকা পটকা, আমড়া বোম চকোলেট বোম আর দোদোমা
হাতে করে জ্বালিয়ে নির্ধারিত লক্ষ্যে ছুঁড়ে দেওয়ার মধ্যে এক বিরাট বীরত্ব ছিল। বাড়ি
থেকে কিনে দিত না প্রথমে। দাদাদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে নিয়ে একটু একটু করে ফাটাতে শিখলাম।
তারপর ক্লাস ফাইভ থেকে বুড়িমার দোকান থেকে বাজি কিনতে যাওয়া একটা ঘটনা ছিল। কি করে
বাবার চোখ এড়িয়ে ফুলঝুরীর প্যাকেট কমিয়ে দিয়ে তার বদলে কয়েক বাক্স চকোলেট বোম পাওয়া
যায় বা নিদেন পক্ষে লঙ্কাপটকা, সেই দিকে লক্ষ্য রাখা। সোজা কথায় বাজির ফর্দ ভায়োলেশন।
এর পরের লক্ষ্য হল, রোদ্দুর। যেন সুয্যিমামা
একটু ঠিক্ঠাক ঊষ্ণতা দিয়ে সব স্যাঁতস্যাতে বাজিগুলোকে চাঙ্গা করে দেন! নাওয়া-খাওয়া
ভুলে ছাদে খবরের কাগজের ওপর বিছিয়ে দেওয়া হত অস্ত্রসম্ভার। বেশি বিকেল হলে আবার যদি
হিম পড়ে সেঁতিয়ে যায়, তাই সারাক্ষণ নজর করে ঠিক রাখা হত বাজি। সন্ধ্যেটা শুধু নামার
অপেক্ষা।
তবে একা বাজি ফাটানোয় কোনো মজা নেই। আবার সবাই
একসঙ্গে হলে আমার কেনা বাজি আগেভাগেই শেষ হয়ে যেতে পারে। মাপে মাপে কেনা। আমার মত করে
মেপেজুপে হিসেব করে কি আর সবাই ফাটাবে! অনেকের বাবা-মায়ের অর্থনৈতিক অবস্থা আমাদের
থেকে অনেক ভাল হওয়ার ফলে তাদের বাজির পরিমাণ অফুরান। আর তারা আমাদের মত ভাগ করে নেয়
না, আবার আমাদের-টা পেলেও ছাড়ে না। খুব মুশকিল হত তাই সিদ্ধান্ত নিতে যে একাই ফাটাবো
না কি নিজের মত করে। পরে ভেবে পন্থা নেওয়া যেল যে অল্প অল্প করে নিয়ে গিয়ে সকলের সঙ্গে
মিলেমিশে ফাটানোই ভাল। সবটা একবারে না নিয়ে গেলেই হল। কি আর হবে সবাই একটু একটু করে
যদি নেয় ও বা। বাবা-মা বলেন, যে অন্যকে দেয়, নিঃস্বার্থভাবে, তার অভাব হয় না।মনকে দরাজ
করতে হয়। শিশুমন খুব স্বার্থপর হলেও পরে তা মেনে নিয়েছিল, এবং ঠকে নি।রাত দশটার সময়ে
সেদিনের মত যখন বাজি পোড়ানো শেষ হত, তখন দেখা যেত অনেকটা একস্ট্রা পড়ে আছে। পড়ে থাকার
মধ্যে কি? না ফুলঝুরি আর সাপবাজি। এই সব বাজি পোড়ানোর মধ্যে কোনো উত্তেজনা আছে না কি!
কালীপুজোর পরের দিন-ই আমি আর মা পাড়ি দিতাম
মামা-বাড়ির উদ্দেশ্যে। ভাইফোঁটার জন্য। সেখানে অপেক্ষা করে থাকত এক ধামা শব্দবাজি।
মামারবাড়িতে নানা মানুষের আনাগোনা। ভালবেসে দিয়ে যেতেন অনেকেই, বাজি। সুতরাং, কালীপুজো
is not over, though it
seems over.
আমি তখন জানতাম যে বাজি যত পোড়াবে, অলক্ষ্মী
দূর হবে, ভূত-প্রেত-রা মানুষের সঙ্গে সীমানা বজায় রেখে চলবে। প্রকৃতিতে যত বাজে পোকা-মাকড়
সব ধোঁয়া, শব্দ আর আগুনের ঝলসানিতে মারা যাবে। সেই বিশ্বাস নিয়ে আমি যত পারতাম শব্দ,
আগুন আর ধোঁয়া তৈরী করতাম।
আমি তখন জানতাম না, যে এই শব্দ আগুন আর ধোঁয়া
কিভাবে মানুষ, জীব জগৎ ও প্রকৃতির ক্ষতিসাধন করে থাকে। দু-তিন দিনের দেদার বাজি পোড়ানো,
সমস্ত আটমোস্ফিয়ারে কি পরিমাণ ফিয়ার বা আতঙ্কিত হওয়ার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে,
যেখানে সমস্ত প্রাকৃতিক অক্সিজেনটাই দুস্প্রাপ্য হয়ে যেতে পারে, বাতাস ভারী হয়ে ভরে
উঠতে পারে সীসায়। সেই বিশ্বাস নিয়ে আমার ছেলে যতটা পারে শব্দ, আগুন আর ধোঁয়া কম তৈরী
করে। গত কয়েক আগে কিছু চরকী আর ফুলঝুরী কিনে আনত। তারপর শুধু ফানুস। আর গত তিন বছর
সেভাবে কিছু কেনাই হয় নি। বরং নানারকমের আলো কেনার দিকে মন দেব আমরা, আগামী বছর থেকে,
এটাই ঠিক হয়েছে।
আর আমাদের বন্ধু সুনীল আগরওয়াল একবাক্স বাজী
পাঠিয়েছেন।ওনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। সে সব দেখেই এত কথা মনে এল। এগুলো সব ফাটিয়ে শেষ
করতে সময় লাগবে…
ভাল থাকুন সবাই! জয় মা কালী!!!!

1 comment:
চলুক এমন লেখা!
Post a Comment