Wednesday, 24 November 2021

মন্দারঃ ্ম্যাকবেথীয় বাংলা মাইলস্টোন ক্লাসিক


হলিউডি 'ট্রাজেডি অফ ম্যাকবেথ' -এর রিলিজ ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২১ তারিখে। প্রায় আধা পৃথিবী, এই গল্পের আগা-পাশ-তলা সব জানা সত্ত্বেও আবার দেখার জন্য অধীর অপেক্ষায় রয়েছে। কেন? আসলে বিষয় 'ট্রাজেডি'। তাও আবার শেক্সপিয়ারের। হলিনশেডের ক্রনিকলস যখন নিতান্ত গরীব শেক্সপিয়ারের হাতে গিয়ে পড়ল, উনি কি করলেন? -- ওই জানা গল্পগুলোকে এমন কমার্শিয়াল করে পেশ করলেন যে লোকে আর না দেখে থাকতে পারলো না। সাধারণ প্রচলিত গল্প-কে এমন উচ্চতায় তুললেন, যাতে এক এমোঘ চৌম্বকীয় আকর্ষণ তৈরী হয় সেই জানা গল্পের  অভূতপূর্ব প্রেজেন্টেশনের দিকে। শেক্সপীয়রের নাটক লেখার উদ্দেশ্য কিন্তু খুব বড় একজন সাহিত্যিক বা নাট্যকার হওয়া ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল রুজি-রোজগার করে নিজের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখা। আর তা করতে গিয়ে মানুষের মন, দর্শক কি চায়, কি করলে, কিভাবে করলে, মানুষ নিজের জীবনের সঙ্গে নাটক-কে মিলিয়ে নিতে পারবে, কি করলে মনে হবে, আরে এ তো আমারই গল্প, কেমনে ব্যাটা পেরেছে সেটা জানতে"। খাওয়া-পরার রেস্ত জোগাতে শেক্সপিয়ারের রচনা করলেন একের পর এক নাটক। এমন ডায়লগ দিলেন, এমন বাঁক এনে দিলেন ঘটনায়, এমন মোচড় ছোঁয়ালেন চরিত্রে, এমন অভ্যন্তরীন ও আভ্যন্তরীন মানসিক জটিলতার প্রকাশ ঘটালেন যে তা আজও লোকেরা চেটেপুটে খায়। সঙ্গে আছে ব্র্যাণ্ড। শেখ্যপীর --পীর ই বটে। কারণ এই সব পথ দেখানো তাঁর-ই হাত ধরে। আর সময়ের হাত ধরে সে সব চিরন্তন ফর্মূলা আর নাটকে আটকে থাকে নি। এমনই উনিভার্সাল সে সবের আপীল যে চলচ্চিত্রকাররাও এখনো সেই ছায়াকে কাটিয়ে উঠতে পারেন নি। শুধু সময়ের নিরিখে সে সবের বদল ঘটেছে। কিন্তু ব্র্যাণ্ড সেই একই জায়গায় ধ্রুবতারার মত স্থির ও চিরন্তন।

হলিনশেডের ক্রনিকল-কে যেভাবে দেখেছেন শেক্সপিয়র, শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ-কে প্রায় একই রকম ভাবে দেখেছেন অনির্বান ভট্টাচার্য। মাথায় এসেছে মন্দার। নামিয়ে দিয়েছেন, স্থান-কাল-পাত্র-সংস্কৃতি-ভাষা ভেদে, শেক্সপিরিয়াণ ব্র্যাণ্ড ভাঙিয়ে, যাতে লোকে খায়। ব্র্যাণ্ডের কথা যখন এলই, কিছুদিন বাদেই আমরা দেখব অনীক দত্ত পরিচালিত সত্যজিত রায়ের বায়পিক অপরাজিত রে। 

শেক্সপিয়র-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-সত্যজিৎ রায় এই সমস্ত নাম যেভাবে আজও বাজারে কাটে তাতে সেই মহান ব্যক্তিরা আর নেহাত সাহিত্যিক বা চিত্রপরিচালকের স্তরে নেই। এরা উন্নীত হয়েছেন ব্র্যাণ্ডে। এনাদের নেমট্যাগ-ই অর্ধেক ব্র্যাণ্ডিং এর কাজ করে। সঙ্গে হাতে থাকে পরিচালক, ক্যামেরাম্যান, ও শুরু থেকে শেষ, বড় থেকে ছোট সব অভিনেতাদের অভিনয়। আসলে হয়েছে কি, শেক্সপিয়র থেকে সত্যজিৎ যা করে গেছেন সেই ছায়ার বাইরে গিয়ে কোন কিছু সৃষ্টি করা বেশ অসম্ভব কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনো পর্যন্ত তাঁদের ছায়াকে ফেলে দিয়ে নতুন কিছু তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। বলাই বাহুল্য, এরকম চিরকালীন সত্যের মুখে দাঁড় করিয়ে দেওয়া্র শুরুই হয়েছিল শেক্সপিয়রের হাত ধরে। যে কোনো গল্প, যে কোনো জীবন, শেক্সপিয়রের প্রভাবমুক্ত হতে আরে না। প্রকট বা প্রচ্ছন্নভাবে মিল রয়েই যায়। আর সেটাই অনির্বাণের 'মন্দার'-এর ব্যাঙের আধুলি।


 'হইচই' ওটিটি প্ল্যাটফর্মে মন্দার-এর জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। অনির্বাণ ভট্টাচার্য করেছেন এই দুঃসাহসিক কাজ। কেন এই অপেক্ষা? আমরা সবাই তো জানি ট্রাজিক হিরো কে, তার পতন কি ভাবে হবে, তার ট্র্যাজিক ফ্ল-টা ঠিক কি ছিল -- সব জানা সত্ত্বেও আমরা অপেক্ষায় থাকি সেই দুঃখ কষ্ট বেদনা যন্ত্রণা হতাশা যা কিছু আমাদের জীবনের চিরসঙ্গী সে গুলোকে বারবার দেখতে যাওয়ার, চেটেপুটে খাওয়ার। এই নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই অনির্বাণের মত একজন দুর্দান্ত অভিনেতা কে প্রথম আমরা সিরিজ-পরিচালক হিসেবে পাচ্ছি এবং দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিঞ্জ করতে করতে একটাই উপলব্ধি হলো -- অনির্বাণ ভট্টাচার্য উঠে এসেছেন স্টেজ থেকে। শেষ দু'বার বার ওনার দাপট স্টেজে দেখেছি উৎপল দত্তের তিতুমীর' আর পঞ্চম বৈদিকের 'কারুবাসনা'য়।সেই সব অভিজ্ঞতা অনবদ্যভাবে স্ক্রিনে মিশিয়েছেন নাটক থেকে তুলে এনে। স্টেজের ভিজুয়ালসকে চলচ্চিত্রে ভর করে দেখিয়ে দিয়েছেন কি করে তা বৃহত্তর বিশালত্বে ধরা যায়। দেখলেই বুঝতে পারা যায় যে এটা অনির্বাণের স্বপ্নের কাজ, যেখানে অভিনয় এবং ক্যামেরা-অ্যাঙ্গেল সবথেকে বেশি জরুরী হয়ে ওঠে। একটা চেনা গল্পকে ভিন্ন মোড়কে সাধারণ মানুষের কাছে রুদ্ধশ্বাস করে তোলা কিন্তু সহজ কাজ নয়। যেমন 'ফেলুদা', যেমন, 'ব্যোমকেশ'। মানুষের মধ্যে গেঁথে যাওয়া চরিত্র ও গল্প নিয়ে কাজ করা খুব বিপজ্জনক। মুষ্টিমেয় কিছু দুর্দান্ত মানুষ ছাড়া সে ঝুঁকি কেউ নিতে চান না। অনির্বাণ যে কাজ টা করলেন, যা নিয়ে করলেন, তা তাঁকে এক লাফে অনেকটা মাইল পার করে এগিয়ে দিল। তবে সিনেমা হোক বা থিয়েটার, সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ গল্পের বাঁধন আর অভিনয়। শেক্সপিয়রকে বুদ্ধি দিয়ে আত্মসাৎ করে অনুসরণ ও অনুকরণ করলে গল্পের বাঁধন নিয়ে চিন্তার কিছু থাকে না। তখন পড়ে থাকে অভিনয়শৈলী ও কিভাবে তা তুলে ধরা হচ্ছে দর্শকদের কাছে, সে টুকুই। ঘটনাপ্রবাহ এইরকম নয় যে শেক্সপিয়ারের 'ম্যাকবেথ' এর সঙ্গে ‘মন্দার’-এর হুবহু বা খুব মিল আছে। আসলে অনির্বাণ দেখাতে চেয়েছেন যে স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে আমাদের জীবনের গল্পগুলো আমাদের মত করে চলতে থাকে বটে। তবে তার মাস্টার স্ট্রোক সেই কোন কালে এমন ভাবে শেক্সপিয়র হিট করে গিয়েছেন যে জীবনের গতি তাঁর পূর্বনির্ধারিত পথেই কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো ভাবে পরিচালিত হয়। আমাদের জীবনের আশেপাশে বাস্তবে যতগুলো চরিত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে, সবার সাথেই কোনো-না-কোনোভাবে শেক্সপিয়ারের তৈরি করার কোনো না কোনো চরিত্রের কিছু না কিছু মিল পাওয়া যায়। সেখানে দেশ-কাল-ভাষা-সংস্কৃতির পার্থক্য সব ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। পড়ে থাকে শুধু নির্মম ও বাস্তব সত্য গুলো।

মন্দার'-এর আসল বিষয়বস্তু কি? শেক্সপিয়ারের চারটে সবথেকে বিখ্যাত ট্র্যাজিক হিরো-র মধ্যে ম্যাকবেথের ট্রাজিক ফ্ল ছিল অ্যামবিশন বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা -- যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার পতনের কারণ। সে প্রথমে কখনই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলই না। তার মনের মধ্যে ছিলই না এসব। দিব্বি চলছিল সব।


হটাৎ ঝড়ের মত পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং নারী চরিত্রের উস্কানি সেই সুপ্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে জাগিয়ে তুলল এবং তা ধরে রাখতে গিয়েই জন্ম নিল ভয়। সেই ভয়ই তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। আমরা 'ভয়' নয়, 'উচ্চাকাঙ্ক্ষা-কে দায়ী করি কারণ এই ভয়ের মূলে আছে উচ্চাকাঙ্ক্ষা। শেক্সপিয়রদেখিয়ে গিয়েছেন তাঁর নাটকের ডাইনিরা যা বলছে তার ওপর নির্ভর করে ম্যাকবেথ দেখতে পাচ্ছে তার ভবিষ্যৎ এবং সেই ভবিষ্যতের উচ্চাকাঙ্ক্ষার সাথে নিজের বাস্তব জীবনকে মিলিয়ে দেওয়ার অন্ধ তাগিদ তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ডাইনিরা তার মনের মধ্যে পুঁতে দিচ্ছে হারানোর ভয়ের বীজ। কিন্তু সে তো আর হারতে চায় না। যাদের কাছে হেরে যাওয়ার ভয়, নিজের পাপের প্রকাশ পেয়ে যাওয়ার ভয়, একের পর এক নির্দ্বিধায় সরিয়ে দিচ্ছে তাদের। একটি পাপ ঢাকতে তৈরী হচ্ছে একের পর এক পাপের বোঝা।

অনির্বাণের বক্তব্য, ম্যাকবেথ না হয় রয়্যাল, রাজকীয়। কিন্তু এরকম চরিত্র পৃথিবীতে অনেক আছে, যেমন মন্দার। সাধারণের সঙ্গে রয়্যাল -- কোথাও গিয়ে মিলে যাচ্ছে, একই রকম ভাবে। প্যারালাল নয়,কনভার্জিং।  দুটো গল্পেই কিন্তু দেখানো হচ্ছে ভবিষ্যৎবাণী বাস্তবে মোটেই সত্যি হয় না। তাহলে ভবিষ্যৎ-বাণী অনুসারে ম্যাকবেথ মারা যাওয়ার পরে যার রাজা হওয়ার কথা ছিল, সে রাজা হতো। কিন্তু হল না। মন্দার-এও হল না।

শেক্সপিয়ারের ম্যাকবেথ-এ যা ছিল না তা হল সেই লিবিডো । মন্দারের গল্পের খাপে খাপে সেক্স আপীল, যৌন ঈর্ষা, চাহিদা, মর্ষকাম, ধর্ষকাম - এসবের ছড়াছড়ি মনে হলেও সেই সমস্ত প্রাইমর্ডিয়াল ভাইসকে খুব সূক্ষ্মভাবে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছেন পরিচালক। লেডি ম্যাকবেথ শেক্সপিয়ারের নাটকের গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন বটে কিন্তু মন্দার-এ যেভাবে লাইলি-কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে ততটা নয়। গল্পের নাম ‘মন্দার’ হলেও কোথাও কোথাও মনে হয়েছে যে গল্পে যেন মন্দারের থেকে লাইলির ভাগটাই বেশি। তার হাতেই সবকিছুর চাবিকাঠি। মন্দার সেখানে একটি ক্যাটালিস্ট মাত্র, যাকে দিয়ে শুধু করিয়ে নেওয়া হয়। গল্পের শুরু ও শেষ ম্যাকবেথের ধাঁচে হলেও মাঝে যা ঘটে যায় সেখানে লাইলি নজরকাড়া -- সে তার শরীরের ভরন্ত উথলে-পড়া যৌবনই হোক বা তার মনের মধ্যে সুপ্ত যৌন ইচ্ছেই হোক বা ্সন্তান পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাই হোক অথবা পাপবোধ থেকে মানসিক রোগী তে পরিণত হওয়াই হোক। মন্দারের গল্পের আসল সুতো টেনে ধরা আছে এই নারী চরিত্রে। মন্দারের কনফ্লিক্ট আপাত। তার স্ত্রী-এর কনফ্লিক্ট অনেক বেশি জটিল ও গভীর এবং সে জন্য অনেক বেশি উপভোগ্য। এক নারীই আর এক নারীর পরম শত্রু - এটা ম্যাকবেথে ছিল না। ডব্লিউ ভাইয়ের স্ত্রী এর সঙ্গে লাইলির কনফ্লিক্ট ও রাইভ্যালরি -- মন্দারে তা সুচারু রূপে ধরেছেন অনির্বাণ এবং সেই অভূতপূর্ব দিক টিকে আসল গল্পের টেক্সচারে এমন ভাবে মিশিয়েছেন যে আলাদা করে ধরাই যায় না যে মন্দারের থেকে লাইলি কিন্তু ধীরে ধীরে অজগরের মত গিলে নিচ্ছে নায়ক মন্দারের ফুটেজ।

আগেই বলেছি অনির্বাণের উত্থান স্টেজ থেকে এবং তাঁর মাথায় যে ক্রিয়েটিভ জিনিয়াস আছে, তা স্টেজমুক্ত হতে পারেনি স্ক্রীনে এসে। মন্দারের যত্রতত্র ছড়িয়ে রেখেছেন সিম্বলিজম। সে প্রথম দ্শ্যে ছটফটানো মাছকে বল্লমে গেঁথে পুরো গল্পটা তিন মিনিটে বলে দেওয়াই হোক বা মন্দারের লাল রোদচশমা কিনে পরে ফেলে দেখিয়ে দেওয়াই হোক যে তার ইনার সেলফ রক্তরঞ্জিত, রক্তাক্ত। আর, কালো বেড়ালের আদ্যোপান্ত ওমিনাস আপিল ভোলার নয়। আর  অবশ্যই এই ওমিনাস আপিল জোরালো হয়েছে ব্যাকগ্রাউণ্ড স্কোরের হাত ধরে। নাহলে এই অস্বাভাবিক দিকটা ঠিক উচ্চতা পেত না।

অভিনয়ের দিক থেকে ডব্লু-ভাই-এর ভূমিকায় দেবেশ রায় চৌধুরী এবং এবং লাইলি-র ভূমিকায় সোহিনী সরকার রীতিমতো একাডেমি অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। বাকি সবাই দুর্দান্ত হলেও আমার চোখে এনারা সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছেন। দুর্ভাগ্য আমাদের ইন্টারন্যাশনাল এক্সপোজার-টা নেই এবং এটি সিনেমা নয়, সিরিজ। তবে, পুরো সিরিজ-টা একনাগাড়ে দেখতে দেখতে মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে ড্রোন-শট এর আধিক্য না থাকলেই হয়তো ভাল হত। আসলে বাকিটা ম্যাকবেথ-- এর মত এতটাই রুদ্ধশ্বাস, যে সে সব ভুলে শেষ পর্যন্ত শুধু দেখে যেতে হয়, একটানা। মাঝখানে ছাড়লে মন দিয়ে কাজ-কম্মো করা মুশকিলের, কারণ মন পড়ে থাকবে সেখানেই, দেখে শেষ না করা পর্যন্ত। জানা গল্প, তবু এই টান। এটা কিন্তু এক্কেবারে শেক্সপিরিয়ান ম্যাজিক আর অনির্বাণের তা নিজের মত ফলো করার কৌশলের সার্থক ফল।

বাংলা থিয়েটারে ম্যাকবেথের শেষ অভিনয় দেখেছি কৌশিক সেনের স্বপ্নসন্ধানীর। বাংলা সিনেমার জগতে এই ম্যাগনামিটি নিয়ে ম্যাকবেথের ছায়ায় কিছু আদৌ আছে কিনা আমার জানা নেই। ‘হইচই’ আর অনির্বাণ ভট্টাচার্যের কাছ থেকে দর্শকদের আশা অনেকটাই বেড়ে গেল বৈ কি।


বিতর্ক উস্কে দিয়ে লেখা শেষ করি, তাহলে লেখা হিট করবে বেশি -- তাহলে রক্ষণশীল বাঙালীদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন যাঁরা মন্দার ওয়েব সিরিজ দেখতে দেখতে চোখ-কান খোলা রাখবেন বটে, কিন্তু ভান করবেন যে, গেল রে, সব গেল!! কালচার বলে কিছু রইল না...এটা কি!!! সকলের সঙ্গে বসে দেখা যায়!!! ম্যাকবেথ নিয়ে ছেলেখেলা!! সফট-পর্ণ বানিয়ে ছেড়ে দিল, ছি ছিঃ!!! চোখে কানে ছেটানোর জন্য গঙ্গাজল খুঁজতেই পারেন। আর একান্ত না পেলে ক্ষতি নেই, অন্তরশুদ্ধির মন্ত্র তো আছেই -- ওই যেটা সব পুষ্পাঞ্জলীর আগে আওড়াতে হয় -- মনে করানোর জন্য প্রথম ক’টি শব্দ বলে দিই, বাকিটা ফ্লো তে নেমে যাবে ওঁ অপবিত্র পবিত্রবা (মেয়েরা 'ওঁ' এর বদলে 'নমঃ' বলবেন) মুখে এসব যা-ই বলেন না কেন মনের মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষা  'মন্দার'-এর বাকিটা লুকিয়ে দেখা। আর সেটা দেখতে হলে মোবাইলে নিয়ে নিন হইচই ওটিটি...অফার চলছে, সবার জন্য...গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, আপনার জীবনে এই অভিজ্ঞতা পাথেয় হতে পারে, কিন্তু ট্রাজিক ফ্ল হবে না।

 --আর্য চ্যাটার্জী

 


Sunday, 21 November 2021

বিল্টুর বায়োগ্রাফিঃ পর্ব ১

 রাসের বাঁশি


ঘুম ভাঙতেই মনটা একটা বিষাদে ভরে গেল বিল্টুর। রাসবাড়িতে সেদিন থেকে রাসমেলা। এই তো বছরে একবার মেলায় যায়।  কিন্তু এবারে ধুম জ্বর। চশমা পরা শেয়াল পণ্ডিতের মত দেখতে বিশ্বনাথ ডাক্তার আবার তাঁর ওষুধের ফর্দে বার্লি আর সাগুর ওপর আলাদা করে জোর দিয়েছেন। নাক টিপে তাই খাওয়া চলছে। বমি বন্ধ হয় নি। খেলেই বমি হয়ে যাচ্ছে।  কিন্তু কাউকে বুঝিয়ে বলা যাচ্ছে না যে সাগু আর বার্লির স্বাদ-ই বমির কারণ। এই সব খেয়ে সুস্থ হতে হতে মেলা শেষ হয়ে না যায়। বরং একটু ঘুগনী বা আলু-পটকা খেলে শরীরে তাড়াতাড়ি বল ফিরে আসত। কিন্তু সে সব যুক্তির কথা শোনার মত মানুষের খুব অভাব। 


রাসমেলার মত বড়সড় মেলা-টেলা আর হয় কোথায়! হলেও সে সব অনেক দূরের ব্যাপার। মামারবাড়িতে গাজনের যে মেলা হত, তা উঠে গেছে। কারণ যে মাঠে মেলাটা হত, সেটা নাকি কে একটা কিনে নিয়েছে। ছিল ধানজমি। সেখানে নাকি চানাচুরের ইয়াবড় কারখানা হবে। তাই আর সং-সাজা দেখা হয় না। চড়ক-গাছ থেকে ঝুলন্ত মহাদেবের চেলার ছোঁড়া বাতাসা আর কুড়োনো হয় না। সেই বাতাসার স্বাদ ই আলাদা। বাড়িতে হরলিক্স-এর শিশিতে রাখা বাতাসার থেকে অনেক বেশি সুস্বাদু। কারণ, এ ভিড়ের মধ্যে লড়াই করে নিজে জিতে আনা বাতাসা। বঁটি, লোহার কাঁটার বিছানায় বা আগুনের ওপর চারতলা সমান উঁচু থেকে "বাবা তারকনাথের চরণে সেবা লাগে, মহাদেএএএএব!!! " ডাক ছেড়ে 'ঝাঁপ' দেখা বন্ধ হয়েছে। হ্যাঁ তবে কোনো কোনো বছর বালিতে (হাওড়া জেলা) দেওয়ানগাজী-র  ('দাওনাগাজী' হল প্রচলিত নাম) মাঠে 'ঝাঁপ' দেখতে যায় বটে, কিন্তু তাতে আশ মেটে না। সব এখন গিয়ে ঠেকেছে ওই রাসবাড়ির রাসমেলায়। 


রাসবাড়ি...বেলুড় মঠ থেকে গ্র‍্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে বালিখালের দিকে যেতে, লালবাবা কলেজ পেরিয়েই ডান হাতে। গঙ্গার ধারে রাধারমন জিঊ-এর ছবির মত মন্দির। ১৮৯০ খ্রীষ্টাব্দে জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত দাঁ পরিবারের শিবকৃষ দাঁ-এর বড় ছেলে পূর্ণচন্দ্র দাঁ আটচল্লিশ ফুট উঁচু এই নবরত্ন (ন’টা চূড়া বিশিষ্ট) অপূর্ব এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া আছে ছয় শিবের মন্দির, নাটমঞ্চ। আর সবের মাঝে রাসবাড়ি। গোল একটা সাদা রঙের বাড়ি। তাতে বারোটি খিলেনে বারো রাধা-মাধবের মূর্তি।



আছে ঘড়িস্তম্ভ বা ক্লক টাওয়ার। তাতে এক সময়ে ঘন্টা বাজত। রাসবাড়ির ঘাটে নদীর মধ্যে লোহার গেট। খোলা-বন্ধ করা যায় এখনো।একসময়ে মন্দির ও দেবতার সম্পদকে  জলদস্যুদের হাত থেকে বাঁচাতে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। পুরো ব্যাপারটা যখন বিল্টু দেখত, তার মন পাড়ি দিত দেবী চৌধুরানী-র মত সময়ে। সেই ছিপ নৌকা, বজরা, ডাকাতের দল...তবে এই ঘাটে স্নান করে মজা নেই। কেমন যেন সব চারিদিক বন্ধ। আবদ্ধ। নদীতে অবগাহন স্নানের গুরুত্ব বোঝা যায় না। নদীর জলে ডুব দিয়ে ওঠার পর চোখ খুললেই নিজের অস্তিত্বের যে বিশাল উন্মুক্ত ও পবিত্র একটা ব্যাপার আছে, তা উপলব্ধি করা যায় না এই ঘাটে। তবে ঘাটের গায়ে যে বসার জায়গার সারি, সেখানে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা অনায়াসে কাটিয়ে দেওয়া যায়। বিল্টু মনে মনে ছবি আঁকে। রাসবাড়ির ঘাটের বসার জায়গায় পা তুলে বসে সে আড়বাঁশি-তে সুর তুলছে, মন্দিরের রাধারমনকে শুনিয়ে শুনিয়ে। চারিদিকে আর কেউ নেই। ছয় শিবমন্দিরে ধ্যানস্থ অবস্থা থেকে টলে যাচ্ছেন দেবাদিদেব, স্বয়ং, বিল্টুর বাঁশির মূর্ছনায়। 


রাসের সময়ে অবশ্য ছবিটা বদলে যায়। ফাঁকা জায়গাটাতে তিল ধারণের স্থান থাকে না বিকেল থেকে।  দূরদর্শনে কথা বলা পুতুল (পরে জানা গেল, এটা একটা আর্ট ফর্ম যাকে নাকি ‘ভেন্ট্রিলোক্যুইজম’ বলে। ইংল্যাণ্ডে পারফর্মিং আর্ট ও বিনোদন হিসেবে ১৭৫৪ থেকে ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।) মাইকেলের পরে বিল্টু সেই প্রথম চাক্ষুষ দেখে কথা বলা পুতুল। সেখানেই প্রথম ইলেক্ট্রিক নাগরদোলায় চড়েছিল সে। শহর-কে অত উঁচু থেকে আগে তো কোনোদিন দেখে নি।
নিচের মানুষরা এই লিলিপুটিয়ান বা আবার এই ব্রবডিংনাজিয়ান। নামার সময়ে শরীর পালকের থেকেও হালকা, যেন ভর-ভার বিহীন। পাখিরা বোধ হয় এভাবেই ওড়ে। চিৎকার করত বিল্টু, ‘জোরে জোরে আরো জোরে’। হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা থাকত সামনের লক করা লোহার রড-টা। মনে করত স্টার ট্রেকের স্পেস শিপে বসে আছে সে। 


সেই থেকে নিয়ম করে চলে আসছে সব কিছু। রাসের মেলা মানেই ফি বছরে একবার স্বপ্নের জগতে ভ্রমণ।


যে সব স্বপ্নের জিনিস কেনা হত রাসমেলা থেকে তার ফিরিস্তি বেশ লম্বা। এর মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাঁশের বাঁশি। প্রত্যেক বছর একটি করে আমদানি হতই। একটা মোটা বাঁশের মাথায় অনেক কাঠি গোঁজা থাকত। তার প্রত্যেকটিতে লাগানো থাকত একটি করে বাঁশি। বাঁশির আবার অনেক রকমফের ছিল। আড়বাঁশি ছিল এক রকম। আবার সোজা চাইনিজ বাঁশি ছিল আর একরকম। আড়বাঁশিতে ফুঁ দেওয়া খুব কঠিন কাজ। আর ওটাই নাকি আসল বাঁশি। প্রথমে বিল্টু এমনি সোজা চাইনিজ বাঁশি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করলো। সব বাঁশিতে মোট ছ’টি করে ছিদ্র, আর মাথাটা কালির কলমের নিবের মত করে কাটা, ফুঁ দেওয়ার জন্য। ছ’টি সুরের সেই ছিদ্রগুলো আঙুলের মাথা দিয়ে চেপে ধরলে কোনখান থেকে কিরকম সুর বের হয় তাই নিয়েই বিল্টুর অবসর সময় কাটতো।


দারুণ ব্যাপার। এই ভাবেই নাড়াচাড়া করতে করতে বিল্টু ঐ সোজা চাইনিজ বাঁশি দিব্যি বাজাতে শিখে গেল। বছর তিনেকের মধ্যে প্রায় খান পাঁচেক বিভিন্ন সাইজের সোজা বাঁশির কালেকশন করে ফেলল বিল্টু। মেলার বাঁশি তো। তাই সঙ্গীতের শুদ্ধ সুর বা স্কেল ভাল নয়। এইসব নিয়ে কিন্তু বিল্টু বিশেষ কিছু বুঝত না। তবে  এরকম ভাবেই না বুঝতে বুঝতে বিল্টু শিখে গেল কিভাবে কোন ফুটো বা ফুটোগুলো কতটা চেপে ধরলে কিরকম সুর বেরোতে পারে। একটা বিজ্ঞান লুকিয়ে আছে। সেটা হাতেনাতে রপ্ত করে ফেলল। খানিকটা  রপ্ত করার পরে, বিল্টু যখন কয়েক লাইন গুপিগায়েনের ‘এক যে ছিল রাজা’-র কয়েক লাইন বাজাতে পারল, মোটামুটি, তার মন গিয়ে পড়ল হার্ডার লেভেলে। পরের বারের মেলায় বিল্টুর নজর গিয়ে পড়ল আড়বাঁশিতে।  বিল্টুকে অনেক বুঝিয়েছেন ওর বাবা যে,  


  • ওরে আড়বাঁশি বাজানো কিন্তু অত সহজ নয়। তুই ফুঁ দিয়ে শব্দই বের করতে পারবি না।


এসব তোয়াক্কা না করে বিল্টু রাধা-মাধবের নাম করে কিনে ফেলল আড়বাঁশি। কিন্তু কিছুতেই আর ফুঁ বসে না। বাঁশিওয়ালা তো এই বাঁশিটাতেই 'দেখা হ্যায় পহেলী বার/ সাজন কি আঁখোঁ মে পেয়ার' দিব্বি অনায়াসে বাজিয়ে পরীক্ষা করে তবেই না বিল্টু-কে দিয়েছেন। এখন ওর  ফুঁ-টা ঠিকমত পড়লেই হয়ে যায়। কিন্তু বিল্টুর ফুঁ দেওয়াই সার। যতই ফুঁ দিক কিন্তু বাঁশি থেকে একটুও সুর বের হয়না। শুধু হসহসে শব্দ বের হতে থাকে। বিল্টু আরো তেড়ে ফুঁ দেয়। তাতে নিশ্বাসে টান প'ড়ে। হাঁপিয়ে যায়। 


বিল্টুর মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। বাড়িতে অনেক ফাঁকা হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশি ছিল সেইগুলোতে ছিপি খোলা অবস্থায় সোজা লম্বালম্বি ঠোঁটের নিচে চেপে ধরে যদি ফুঁ দেওয়া যায়,  তাহলে তা থেকে মিষ্টি বাঁশির মত শব্দ বের হয়। এটা সে এমনি খেলতে খেলতে আবিষ্কার করেছিল। এখন সেই আবিষ্কার কাজে লেগে যাবে বলে মনে হয়। শিশি থেকে একটাই সুর, বেরোয় হুইসিলের মত। শিশি যত বড়, তত জোরে ফুঁ লাগে। 


বিল্টুর সমস্ত মন জুড়ে বাঁশি বাঁশি আর বাঁশি। কিছুতেই পড়ায় তার মন বসছে না। একবার, শুধু একবার, যদি ওই বাঁশি থেকে একটু সুর সে বের করতে পারে, রাধারমনের দিব্যি, সে আবার পড়ায় মন দেবে। কিন্তু বাঁশির আগে রয়েছে হোমিওপ্যাথি শিশি।  খুব সিরিয়াসলি প্রাক্টিস চলল।


লুকিয়ে লুকিয়ে। এ সবের অনেক হ্যাপা, কারণ, এ বাড়িতে পড়াশোনা ছাড়া অন্য কিছু করা ঘোর অন্যায়। তার ওপর আবার এটা করতে গেলে আওয়াজ বের হয়। পড়ার বইএর ফাঁকে লুকিয়ে লুকিয়ে অমর চিত্র কথা বা ইন্দ্রজাল কমিকস হামেশাই পড়ে। ধরাও পড়ে না, কারণ নিঃশব্দে করা যায়। কিন্তু একটু হোমিওপ্যাথি-র শিশি-তে যে একটু লুকিয়ে ফুঁ দেবে, তার জো নেই। বাড়ির বড়রা চারিদিক থেকে খামচে ধরবে। আর মায়ের কানে যদি একবার যায়, তবে তো আর রক্ষে নেই। ভাল ও বড় কিছু করতে গেলে ঝুঁকি তো নিতেই হয়! তাই যাই হোক না কেন বিল্টু এটা করেই ছাড়বে, একদিন না একদিন। একবার আড়বাঁশি থেকে সুর বের হলেই আর পড়াশোনায় এভাবে ফাঁকি দেবে না। বাঁশি-টা থেকে থেকে শব্দ বের হবেই,বিল্টুর  মনের মধ্যে স্থির বিশ্বাস। ওই বাঁশিওয়ালা-টা পড়াশোনা জানে না। কারোর কাছে বাঁশি বাজাতে শেখে নি। কত কষ্ট করে রোজগার করে। সে যদি অত সুন্দর বাঁশি বাজাতে পারে, বিল্টু নিজে স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করে, এত বুদ্ধি নিয়ে একটা সামান্য সাতটি ছিদ্রওয়ালা বাঁশি আড়াআড়ি ধরে বাজাতে পারবে না! ও হ্যাঁ, আড় বাঁশিতে মোট সাতটা ফুটো। ছ’টা এমনি বাঁশির মত সুর বের করার জন্য। আর মাথার কাছে আরো একটা -- ফুঁ দেওয়ার জন্য।


স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন ছিল রবিবার। সকালে বাবার সঙ্গে দোকানে গিয়ে কচি পাঁঠার মাংস কাটিয়ে আনা হয়েছিল। আড়বাঁশি কিনে আনার পরে অন্তত চার-পাঁচ দিন কেটে গেছে। কিন্তু বিল্টুর বাঁশি নিয়ে মোহ কাটেনি। সারাক্ষণ শিশিতে ফুঁ দিয়ে দিয়ে নীচের ঠোঁটটা আরও পুরু ও ভারী হয়েছে বিল্টুর। আর অপেক্ষা করতে পারছে না, বিল্টু। যে আড়বাঁশিটা কিনে এনেছে, সেটা এক ফুট মত লম্বা হবে। ছ'টা ফুটোর ব্যবধান বিল্টুর কচি আঙুলের ব্যবধানের অনুপাতে একটু বেশিই। তবুও বেশ ম্যানেজ করে ছটা ফুটো চেপে ধরল।বাঁশির মাথার কাছে ফুঁ দেওয়ার সপ্তম ছিদ্র-কে ঠোঁটের নিচে হোমিওপ্যাথির শিশির খোলা মুখের অবস্থানে রাখল বিল্টু।  বিল্টুর চোখ বন্ধ। একটা গভীর শ্বাস নিয়ে একানে’ ফুটতে হালকা একটা ফুঁ। বেজে উঠল বাঁশের আড়বাঁশি, একবারেই। চোখ বন্ধ রেখেই এরপরে একটা একটা করে আঙ্গুল ছাড়তে লাগল বিল্টু, আর আর বাঁশি থেকে সুরেলা শব্দ বেরোতে লাগলো। স-র-গ-ম-প-ধ-নি। বিল্টুর বন্ধ হওয়া চোখের কোন দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়িয়ে পড়ছে। আনন্দ আর ধরে না। তার মনে শ্রীকৃষ্ণের সম্মোহন -- সঙ্গে যে যায় বংশীবদন... 


দীঘল চোখের রাধারমণের মূর্তিকে স্মরণ করে সুর তুলল বিল্টু তার প্রিয় গানেরঃ 


“আমায় ডুবাইলি রে/ আমায় ভাসাইলি রে/ অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে…”


আর কি চাই! কালথেকে নিশ্চয়ই পঞ্চাশ-টা করে যোগ-বিয়োগ-গুন-ভাগ করে ফেলবে বিল্টু। 


এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে জ্বরের মুখেও সেই বাঁশিটা বের করে বালিশের পাশে রাখল। রাসমেলায় তো আর যাওয়া হবে না। দুধের স্বাদ ঘোলেই মিটুক।


ছবি ও তথ্য সৌজন্যেঃ 

রাজীব পোদ্দার

কিঞ্জল বোস

উইকিপিডিয়া


Wednesday, 17 November 2021

কাঁচা তর্পণঃ

  

অযুত-লক্ষ-নিযুত-কোটি আয়না

রামধনু হয়ে নেমেছিল সে রাতে

না কি শিলাবৃষ্টির বিষাক্ত এক ছোবলে

চোখের উইন্ডস্ক্রীনে শিকড়ের মত ফাটল

ওদের ছিল না ভাত, শুধু টুকরো কাঁচা মাংস ছিল পাতে

 

অন্ধকারে উজ্জ্বল উদ্ভাসিত আকাশ

সরলরেখার মার্জিনে অতিবৃত্ত সে চন্দ্রিমা

না কি কবিসেঁকা ঝলসানো দ্রোহ রুটি

পকেটে শুধু মৃত্যু-মিছিল আধুলি

ভালবাসা কিনতে কে আর না চায়, প্রতিহিংসা যখন ক্ষমা

 

আকাশ গঙ্গা কত পাপ বয়

অতলান্তিক মাপের চেয়েও বেশি

না কি মৈনাক স্থবীর অনুড়ুক্কু পাণ্ডুলিপি

ভারের মেটাফিসিক্সে দোলকে ক্যালকুলাসে

গরীবের ক্ষিদের তল খুঁজে না পেয়ে শেষে ধর্ষণে রেষারেষি

 

বলির পাঁঠার জারণ কাঁচা মশলায়

আমিষ হচ্ছে ভোগের পিণ্ড ভাগ

না কি গাছ পাঁঠা ভেবে অক্সিজেনের উপোষ

পাঁজির ক্ষণের বেড়ার অপারে খড়্গ হস্তে ধর্ম মিথুন

তিলে তিলে গঙ্গাজলের যোনিতে অনামিকা তোলে কুশের দাগ

 


***মনকথা-কে ধন্যবাদ

 


Thursday, 4 November 2021

কালীপুজো ২০২১

আমরা যখন ছোট ছিলাম সে সময়টা বেশ আলাদা রকমের ছিল। তা অবিশ্যি সকলেরই থাকে। আর ভাল খারাপের কথাও বলছি না।আলাদা ছিল এই পর্যন্ত। আমার কাছে আরও-ই আলাদা রকমের তার কারণ শৈশব ও কৈশোর খুব মসৃণ ছিল না। নব্বই এর দশকের আমার প্রজন্মের মানুষদের মধ্যে অনেক লেখক লেখিকা আমার থেকে অনেক ভাল ভাবে সেই সময়কে তাঁদের কলমের মাধ্যমে ধরেছেন এবং ধরে চলেছেন। ফেসবুকে দেখতে পাবেন এই সময়ের গ্রুপ ও পেজ আছে আলাদা করে, শুধু বাংলায় নয়, সারা জগৎ-জুড়ে। নব্বই এর দশকের এই আলাদা ব্যাপার কিন্তু আর অন্য কোনো প্রজন্মের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় না। আগের ও পরের গ্রুপ,পেজ বা লেখা সবই আছে, খুব গুরুত্বপূর্ণ ভাবেই আছে, কিন্তু সংখ্যায় সে সব নব্বই-এর দশক কে ছাপিয়ে যেতে পারে নি কোনোভাবেই।

সে সময়ে পুজোগুলো আমার কাছে নানা রং-রূপ নিয়ে আসত । আমার ছেলের কাছে যেমন দূর্গাপুজোর ওপরে কিছু নেই, আমার কাছে ওর বয়েসে আবার তা ছিল না। অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিশ্বকর্মা পুজো আর কালীপুজো।  

দূর্গাপূজোর দু-তিন রাত কাটত সেন্ট জন্স অ্যাম্বুলেন্স ব্রিগেডের নিঃস্বার্থ উৎসর্গীকৃত ক্যাডেট হিসেবে খাঁকি জামা টুপি আর হাফ প্যান্ট পরে কোনো এক খুব-ভিড়-হয় এমন মণ্ডপে।কিছু করার নেই। মিলিটারী ডিসিপ্লিনের মত। রক্তপাত, অ্যাক্সিডেন্ট, ছড়া, কাটা, ভাঙা এই সব নিয়ে চলত কারবার। আর যাতায়াতের পথে সাইকেল নিয়ে কয়েকটা ঠাকুর দেখে ফেলা। এর বাইরে খুব একটা আলাদা করে দুর্গাপুজো আমার কাছে গভীরভাবে অর্থবহ ছিল তা নয়। মাধ্যমিকের আগে ডিপ্লোমা শেষ করার পরে সময় করে উঠতে পারিনি আর, সেণ্ট জন্স এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে। সেক্ষেত্রে পূজাবার্ষিকী পড়তে পড়তেই কেটে যেত গোটা পুজো।

কালী পুজোয় ছিল আসল ধামাকা। কোন একটা বয়েস থেকে ফুলঝুরি জ্বালাচ্ছি, মনে নেই। পাড়ার দাদারা যখন দেদার শব্দবাজী ফাটিয়ে যেত, লোলুপ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতাম। সিগারেট খাওয়া যেমন বড় হয়েছি যে, তার কলকে ছিল, সেরকম ধানীলংকা, লংকা পটকা, আমড়া বোম চকোলেট বোম আর দোদোমা হাতে করে জ্বালিয়ে নির্ধারিত লক্ষ্যে ছুঁড়ে দেওয়ার মধ্যে এক বিরাট বীরত্ব ছিল। বাড়ি থেকে কিনে দিত না প্রথমে। দাদাদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে নিয়ে একটু একটু করে ফাটাতে শিখলাম। তারপর ক্লাস ফাইভ থেকে বুড়িমার দোকান থেকে বাজি কিনতে যাওয়া একটা ঘটনা ছিল। কি করে বাবার চোখ এড়িয়ে ফুলঝুরীর প্যাকেট কমিয়ে দিয়ে তার বদলে কয়েক বাক্স চকোলেট বোম পাওয়া যায় বা নিদেন পক্ষে লঙ্কাপটকা, সেই দিকে লক্ষ্য রাখা। সোজা কথায় বাজির ফর্দ ভায়োলেশন।

এর পরের লক্ষ্য হল, রোদ্দুর। যেন সুয্যিমামা একটু ঠিক্ঠাক ঊষ্ণতা দিয়ে সব স্যাঁতস্যাতে বাজিগুলোকে চাঙ্গা করে দেন! নাওয়া-খাওয়া ভুলে ছাদে খবরের কাগজের ওপর বিছিয়ে দেওয়া হত অস্ত্রসম্ভার। বেশি বিকেল হলে আবার যদি হিম পড়ে সেঁতিয়ে যায়, তাই সারাক্ষণ নজর করে ঠিক রাখা হত বাজি। সন্ধ্যেটা শুধু নামার অপেক্ষা।

তবে একা বাজি ফাটানোয় কোনো মজা নেই। আবার সবাই একসঙ্গে হলে আমার কেনা বাজি আগেভাগেই শেষ হয়ে যেতে পারে। মাপে মাপে কেনা। আমার মত করে মেপেজুপে হিসেব করে কি আর সবাই ফাটাবে! অনেকের বাবা-মায়ের অর্থনৈতিক অবস্থা আমাদের থেকে অনেক ভাল হওয়ার ফলে তাদের বাজির পরিমাণ অফুরান। আর তারা আমাদের মত ভাগ করে নেয় না, আবার আমাদের-টা পেলেও ছাড়ে না। খুব মুশকিল হত তাই সিদ্ধান্ত নিতে যে একাই ফাটাবো না কি নিজের মত করে। পরে ভেবে পন্থা নেওয়া যেল যে অল্প অল্প করে নিয়ে গিয়ে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে ফাটানোই ভাল। সবটা একবারে না নিয়ে গেলেই হল। কি আর হবে সবাই একটু একটু করে যদি নেয় ও বা। বাবা-মা বলেন, যে অন্যকে দেয়, নিঃস্বার্থভাবে, তার অভাব হয় না।মনকে দরাজ করতে হয়। শিশুমন খুব স্বার্থপর হলেও পরে তা মেনে নিয়েছিল, এবং ঠকে নি।রাত দশটার সময়ে সেদিনের মত যখন বাজি পোড়ানো শেষ হত, তখন দেখা যেত অনেকটা একস্ট্রা পড়ে আছে। পড়ে থাকার মধ্যে কি? না ফুলঝুরি আর সাপবাজি। এই সব বাজি পোড়ানোর মধ্যে কোনো উত্তেজনা আছে না কি!

কালীপুজোর পরের দিন-ই আমি আর মা পাড়ি দিতাম মামা-বাড়ির উদ্দেশ্যে। ভাইফোঁটার জন্য। সেখানে অপেক্ষা করে থাকত এক ধামা শব্দবাজি। মামারবাড়িতে নানা মানুষের আনাগোনা। ভালবেসে দিয়ে যেতেন অনেকেই, বাজি। সুতরাং, কালীপুজো is not over, though it seems over.

আমি তখন জানতাম যে বাজি যত পোড়াবে, অলক্ষ্মী দূর হবে, ভূত-প্রেত-রা মানুষের সঙ্গে সীমানা বজায় রেখে চলবে। প্রকৃতিতে যত বাজে পোকা-মাকড় সব ধোঁয়া, শব্দ আর আগুনের ঝলসানিতে মারা যাবে। সেই বিশ্বাস নিয়ে আমি যত পারতাম শব্দ, আগুন আর ধোঁয়া তৈরী করতাম।

আমি তখন জানতাম না, যে এই শব্দ আগুন আর ধোঁয়া কিভাবে মানুষ, জীব জগৎ ও প্রকৃতির ক্ষতিসাধন করে থাকে। দু-তিন দিনের দেদার বাজি পোড়ানো, সমস্ত আটমোস্ফিয়ারে কি পরিমাণ ফিয়ার বা আতঙ্কিত হওয়ার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, যেখানে সমস্ত প্রাকৃতিক অক্সিজেনটাই দুস্প্রাপ্য হয়ে যেতে পারে, বাতাস ভারী হয়ে ভরে উঠতে পারে সীসায়। সেই বিশ্বাস নিয়ে আমার ছেলে যতটা পারে শব্দ, আগুন আর ধোঁয়া কম তৈরী করে। গত কয়েক আগে কিছু চরকী আর ফুলঝুরী কিনে আনত। তারপর শুধু ফানুস। আর গত তিন বছর সেভাবে কিছু কেনাই হয় নি। বরং নানারকমের আলো কেনার দিকে মন দেব আমরা, আগামী বছর থেকে, এটাই ঠিক হয়েছে।



আর আমাদের বন্ধু সুনীল আগরওয়াল একবাক্স বাজী পাঠিয়েছেন।ওনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। সে সব দেখেই এত কথা মনে এল। এগুলো সব ফাটিয়ে শেষ করতে সময় লাগবে

ভাল থাকুন সবাই! জয় মা কালী!!!!