আমি যে সরকার পোষিত বিদ্যালয়ে কর্মরত, সেখানে এখন ছাত্র-সংখ্যা মাত্র তিন-এ এসে ঠেকেছে। ১৯৯৭ সালে আমি যখন সেখানে যোগদান করি, ছাত্রসংখ্যা নয় নয় করে আড়াই-শো’র কাছাকাছি।এরকম নয় যে আমরা সবাই খুব খারাপ পড়াই বা আমরা অযোগ্য। নেহাত দুর্ভাগ্যের ফেরে আমরা এখানে পড়ে আছি। মন্ত্রি-আমলা-আধিকারিক-জেলা পরিদর্শক-করনিক-গ্রুপ ডি স্টাফ সবাই সত্যটা জানেন। কিন্তু যাঁর কাছেই শিক্ষার উন্নয়ণ বা বিদ্যালয়ের উন্নয়ণের জন্য গিয়ে দাঁড়াব, তাঁদের বেশিরভাগের কাছেই সম্ভ্রম তো দূর, পাওনা জোটে সরাসরি বা ঘুরিয়ে অনেকটা অবমাননা। ভাবটা যেন, আমরা এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যই আজ এই দূরবস্থা। তাঁদের কারোর কোনোদিন কোনো দায় ছিল না, বা আজও নেই। আজ পর্যন্ত যাঁরা এত তড়বড়িয়ে আমাদের সকল্কে অপমান অরে এসেছেন, বা অনুকম্পার পাত্র করে মেলে ধরেছেন সর্ব স্তরে তাঁরা শিক্ষকদের ওপর দায় চাপিয়েছেন, আজও চাপান। কিন্তু এই তেইশ বছরে কোনো স্তর থেকে কোনো কেউ এক জন শিক্ষার্থী এই বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে উপকার করেন নি।
আমরা এভাবে কাজ করতে চাই
না। তাই লুফে নিয়েছিলাম আমাদের যখন নিজের ইচ্ছে মত অপশান দিয়ে অনত্র কোথাও চলে যেতে
বলা হল, বছর পাঁচেক আগে। নজিরবিহীন ভাবে এক ডি-আই সাহেব শিক্ষক বা ম্যানেজিং কমিটির
তোয়াক্কা না করে, সকলের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিদ্যালয়ের গেট লাথি মেরে ভেঙে দু-দুটো
সরকারী অফিস জোর করে বসিয়ে দিলেন স্কুলের ঘর দখল করে। যে ক’টি ছাত্র ছিল, তাদের বলে দেওয়া হল বিদ্যালয় উঠে গিয়েছে। তারা বিদ্যালয়
প্রাঙ্গন শূন্য করে বিদায় নিল। অন্যান্য ছাত্র-ক্ষুধার্ত বিদ্যালয় তাদের লুফে নিল।
আমাদের মান-সম্মান-পরিচিতি স্থানীয় অঞ্চলে আরও বহুগুণে উলঙ্গ হল। সবাই সেই অপমান তারিয়ে
তারিয়ে উপভোগ করল – যেমনটা হয় আর কি। সাধারণ মানুষ আর কতটা জানেন, যে
এই লোকেশনে পোস্টিং পেতে গেলে এস-এস-সি-র মত কঠিন পরীক্ষায় প্রথম দশের মধ্যে থাকতে
হয় বা একটা র্যাঙ্কের ফারাকে পোস্টিং হয়ে যেতে পারে হাওড়া ময়দানের বদলে পাঁচলা বা
বাগনান বা উদয়নারায়ণপুর? সুতরাং যাঁরা এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় রত ও ব্রতী তাঁরা যে
কোনো দিন যে কোনো সময়ে আন্তর্জাতিক মানের। প্রথমেই যাঁদের কথা বলেছি, তাঁরা সব্বাই এটা
জানেন,এবং এই বেদনা কে উপভোগ করেন। সাধারন
মানুষের চোখে আমাদের স্কুল-টি দাগী আসামীর মত, মিডিয়া ট্রায়ালে নয়, খোদ সরকারী উদ্যোগেই
হুইসপারিং ক্যাম্পেনের শিকার, যার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই।
আচ্ছা বেশ,স্কুল তুলে আমাদের
অন্যত্র পাঠানোর কি হল? না স্কুলের পুরো ফাইলটাই হারিয়ে গেল। শেষবারের কথা অনুযায়ী
-ওসব ফাইল টাইল বাদ দিন।থেকেই
বা কি হত। এখন আর অপশন অনুযায়ী কিছু হচ্ছে না। ক’টা ছাত্র
ভর্তি করার চেষ্টা করুন। না হলে আপনাদের মত স্কুলের স্টাফেদের কোথায় পোস্টিং হবে সে
গ্যারান্টি নেই।
- কিন্তু আমাদের যে ছাত্রস্বল্পতার
দোহাই দিয়ে স্কুল তুলে দেওয়ার চিঠি দেওয়া হয়েছিল, তার কি হবে?
-এখনও যখন ওই স্কুল থকেই
মাইনে পাচ্ছেন, তাহলে উঠে নিশ্চয়ই যায় নি।
- আর আমরা যে হিন্দি মিডিয়াম পাওয়ার জন্য আবেদন করলাম তার কি হবে? এই অঞ্চলে বাঙালী নেই, কোথা থেকে ছাত্র পাব?
- হাওড়া জেলা ইস্কুল ছাত্র
পায় কি করে?
-জেলা ইস্কুল লোকাল স্কুল
নয়। আপনাদের সাহায্য ছাড়া এগোনো যাবে না। প্লিজ হেল্প।
- তিন জন ছাত্রের জন্য
আট জন শিক্ষক…আর কি চাইছেন বলুন তো?
-এই অনুপাত টা স্বাভাবিক
করতে।
- ছাত্র ধরে আনা কি ডি-আই
এর কাজ নাকি…!!!!
- স্যার, কিছু মনে করবেন
না, আমরাও শিক্ষকতার পেশায় এসেছি, শিক্ষকতা করতে। জানতাম না যে ছাত্র ধরাটা আমাদের
জব প্রোফাইলের মধ্যে পড়ে। আর স্কুলে প্রত্যেক বিষয়ের শিক্ষক না থাকলে আজকের যুগে কোনো
পড়ুয়া কি ভর্তি হবে আমাদের মত সাধারোন মানের স্কুলে? সবাই জেলা স্কুলেই ভিড় জমাবে।
-আচ্ছা দেখছি কি করা যায়!
-আম্ফানে স্কুলের ক্লাসরুমের
ছাদ উড়ে চলে গিয়েছে। আরো অনেক আনুষঙ্গিক ক্ষতি।একটু যদি টাকা অনুমোদন করে দেন।
-কি করবেন আর বিল্ডিং সাজিয়ে?
ওই তো ক’টা ছাত্র…যাক গে…আপনি বরং অমিতাভ বাবুর সঙ্গে কথা বলুন।
অমিতাভ বাবুর সঙ্গে বহু
বছরের আলাপ।উনি আপার ডিভিশন ক্লার্ক। খুব অভিজ্ঞ মানুষ। যে ডি-আই সায়েব-ই হাওড়ায় আসেন,মোটামুটি
অনেকটাই অমিতাভ বাবুর চোখ দিয়ে দেখেন। আর চারপাশে যখন আরও কিছু শিক্ষক উপস্থিত হন,
স্বাভাবিকভাবেই ভার বেড়ে যায় তাই আরো অনেকটা। অনেক বছরের আলাপ থাকা সত্ত্বেও তখন ‘তুমি’ থেকে ‘আপনি’-তে উত্তরণ ঘটাই, সম্বোধন কে, যাতে ওনার মান ও ঠাট
বজায় থাকে।এই মান ও ঠাট বজায় রাখার জন্য উনি রোজ জুতো পালিশ করে আসেন, বাংলা ভাষার
উন্নয়ণের স্বার্থে গর্ব করে দিদিমনিদের সামনে জাহির করেন যে “কিছু মনে করবেন না, আপনি যখন ফোন করেছিলেন আমি পায়খানায় ছিলাম। আমি আবার পায়খানাকে পায়খানা বলি, আপনাদের মত ‘পটি’-ফটি বলা আমার ঠিক ধাতে আসে না।" তাই সকলে একটু সম্ভ্রম
করে চলেন আর কি! আর উনিও বেশ সর্বসমক্ষে তা উপভোগ করেন।
-অমিতাভবাবু, ভাল আছেন?
এই কথা অনেককে টপকে বলে
ওনার চশমার কাচ দিয়ে একটা কৌণিক দৃষ্টিগোচর হওয়াটাই কঠিন। তারপর আরো দু-মিনিট পরে…
-কি দাদা, ভাল আছেন তো?
পাত্তা না দিয়ে এক অন্য
ভদ্রলোক-কে কাছে ডেকে কানে কানে কি সব বললেন। এবং ভদ্রলোক বললেন,
-রাতে ফোন করব।
উনি চলে যেতেই অমিতাভ বাবু
বললেন,
-হেডমাস্টার হয়েছে! কি
করে যে ইস্কুল চালায়!
আর একজন বললেন,
-আপনি রিটায়ার করলে যে
কত ইস্কুলের কি দশা হবে।
আমি জোরে বললাম, উনি থাকতেই
আমাদের যা দশা আর বলবেন না, উনিই শেষ ভরসা।
এইবার দেবতা কৃপা করে তাকিয়ে
বললেন
-কি সমস্যা, আপনার।
- এই ডি-আই স্যার পাঠালেন।
স্কুল বিল্ডিংটার বড্ড ক্ষতি হয়ে গিয়েছে আম্ফানে। যদি একটু দেখেন…মোবাইলে ছবি তোলা আছে।
-ও সব দেখা আছে।পুরোনো
সব ব্যাপার এই সুযোগে আম্ফান বলে চালিয়ে বেশ খানিকটা টাকা হাতানোর চেষ্টা…তা ডি-আই অফিস কি টাকা দেওয়ার ভাঁড়ার খুলে বসে আছে? যে চাইলেই পাওয়া
যাবে? পদ্ধতি আছে…
-বেশ পদ্ধতি টা কি?
-কাউকে দিয়ে এস্টিমেট করিয়ে
জমা দিন।
-আচ্ছা।
চেনা-পরিচিতির মধ্যে এক-ভদ্রলোক-কে
ধরে এস্টিমেট নিয়ে রীতিমত তাঁর লেটারহেডে সব তথ্য ও ছবি সমেত জমা দিতে গেলাম এক দিনের
মধ্যে।
-কি করছিলেন এতদিন, ঘুমোচ্ছিলেন?
ডেট তো কবে পেরিয়ে গিয়েছে।
-সে কি আগের দিন তো তা
বললেন না!
-আজ বলছি।
একটা ফোন এল ওনার মোবাইলে,
উনি উঠে গেলেন একপাশে। আমি ভগ্নহৃদয়ে শুনতে শুনতে বেরিয়ে এলাম চাপা গলায় উনি কাউকে
বলছেন,
-আরে লাখ তিনেক তো পেয়েই
যাবেন, তাড়াতাড়ি ব্যাকডেটে জমা করে দিন, প্লিজ! রিসিভিং এ যাবেন না, আমার কাছে আসবেন
সরাসরি।
আজকাল শ্বাপদ দেখলে আর
ভয় নয়, হাসি পায়। কারণ জানি এরকম মানুষদের বিষদাঁত সব ভাঙা।আর শিরদাঁড়াও। তাই তাদের হিংসে, যাদেরটা সোজা আছে তাদের
প্রতিনিয়ত ছোট করে তাদেরটাও যদি ভাঙা যায়।
তাই, গত দশ বছরে আমাদের
বিদ্যালয়ে কোনো গণিত শিক্ষক নেই।
তাই, হিন্দি/ইংরেজী মিডিয়াম
চেয়েও পাওয়া যায় না।
তাই, স্কুলের খাতে গ্রান্ট
হওয়া কম্পিউটারের টাকা ডি-আই ভয় দেখিয়ে অন্য বিদ্যালয়-কে দিয়ে দেন।
তাই, ইস্কুলে ছাত্রদের
জলের সাপ্লাই নেই। সেখানে জোর করে ঢোকানো অফিসে বসে যায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র।
তাই, আমাদের মাননীয় প্রেসিডেন্ট
নিচের তলায় আমাদের আশ্রিত দরবারে বসে, একবার ওপরে এসে জিজ্ঞেস করেন না, যে স্কুলটির
উন্নয়নের জন ঠিক কি কি করা উচিত বলে আমরা মনে করি।
তাই, দরকারী ফাইল হারিয়ে
যায়।
তাই, ট্রান্সফারের ফাইল-ও
হারিয়ে যায়, যাতে শিক্ষকদের চোখ রাঙানো যায়।
শিক্ষকদের ছোট করার মধ্যে
যে অভিনব মানসিক তৃপ্তি, তার ফলে দিনে দিনে হাড়-পাঁজরা বেরিয়ে পড়ছে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার।
যে জাতি শিক্ষকদের সম্মান
করতে জানে না, তাদের অগ্রসর হওয়া অসম্ভব।
ভাববেন না যে আমরা একা
এরকম পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে আছি। পড়ুয়াহীন বা পড়ুয়ার অভাবে ভুগছে খান বত্রিশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান,
শুধু হাওড়া জেলার বুকে।
তাবড় শিক্ষক-রা যাঁদের
রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল এবং আছে, তাঁরা ব্যক্তিগত প্রোফাইল-এর উন্নতি ঘটানো বা ‘জাতীয় শিক্ষক’-এর সম্মানে ভূষিত হওয়ার লোভে চিরকালই আত্মবিস্মৃত
হয়ে থেকেছেন।
তাই, সবটাই ওই পালিশ করা
জুতোর তলায়…না কি ‘পায়খানায়’?
সরকারী ভাবে…?
…আর হোয়াটস-অ্যাপ গ্যালারী ভরে উঠুক “Happy
Teachers’ Day”
– এর প্রত্যাশায়…


No comments:
Post a Comment