সবে নভেম্বরে যোগদান করেছি। সরকার পোষিত একটি বিদ্যালয়ে ইংরেজি শিক্ষক হিসেবে প্রথম। বয়েস ও মানসিকতা কোনোটাই পাকে নি বলেই বোধ হয় ছাত্রদের বেশ প্রিয় হয়ে উঠতে এক মাসের বেশি লাগেনি। জীবনে প্রথম ইংরেজি-র মৌখিক পরীক্ষা নিচ্ছি... দশম শ্রেণির।
- নেইক্সট…
- হ্যোয়ট ইজ ইয়োর নেইম?
- শোহরাব হুসেন।
- হ্যোয় জু ইউ লিভ?
- ক…কি স্যার…আর একবার বলবেন?
- হোয়ার ডু ইইউ লিভ?
- ওকে স্যার…গ্রীন…
- …লিভ…নট লিঈঈভস…
- ওকে অনলি ওয়ান…ইয়েস স্যার…ইয়েল্লো।
- ও গড! ইয়ে তো লে লিয়া…ওকে টেল মিঈ ইয়র ফাদার’স নেইম…
- স্যার, এটা কেমন প্রশ্ন?
- হোয়াই!! সিম্পল কোয়েশ্চন…টেল মিঈঈ ইয়র ফাদার’স নেইম প্লিজ…
- (মুখ নামিয়ে অত্যন্ত লজ্জাবনত মুখে) কি যে বলেন স্যার...আমার আবার
ক'টা বাবা হবে...ওনলি ওয়ান...একটাই....অনেক বাবা হলে তো সকলের নাম বলব...
-এর মানে কি? হোয়ট জ্যু ইয়্যু মীন…!!!
- ওই যে স্যার… জিজ্ঞেস করলেন তো… ‘ফাদারস নেম’…তা আমার অনেক বাবা নেই স্যার…।একজনই…লিয়াকত হোসেন…
উত্তেজনায় গা থরথর করে কাঁপছে....হাত নিশপিশ করছে গালের ওপর সপাটে
একটা লাগিয়ে দিতে। কিন্তু মারব কি, ওই জিমে যাওয়া পেশিবহুল ষণ্ডা ছেলেকে মারতে গিয়ে
আমার-ই হাত ভেঙে যাবে। গত সপ্তাহতেই প্যারেডের লাইনে ডাইনে বলতে বাঁয়ে মুড়ে যাওয়ায়
দু-দুগাছা গাছের ডাল ভেঙে মারতে মারতে আখের ছিবড়ের মত হয়ে গেল, তবু শোহরাবের কোনো হেলদোল
নেই, মাথা নামিয়েই আছে।
-ফাদার এর পর মাথায় যে একটা আপোস্ট্রফি আছে…সেটা খেয়াল আছে?
-ট্রফি…কবে স্যার? আমাকে তো কেউ বলে নি…কি করে মাথায় থাকবে… কবে খেলা? ওই ট্রফি আমাদের…জিতে আনব স্যার…
-উফফ! তোকে নিয়ে আর পারি না রে! এই ট্রফি সেই ট্রফি নয়, আপোস্ট্রফি…।মানে শব্দের মাথায় কমা…এই দ্যাখ…
বলে একটি কাগজে লিখে দেখালাম।
-স্যার লেখাপড়া কম জানি বলে আমাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করবেন না, খুব লজ্জা লাগে…কমা আবার ওরকম শব্দের মাথায় থাকে না কি…! আমার তো জানা নেই…
আমি হাল ছেড়ে দিলাম…বললাম
-তুই যা…তোকে নিয়ে ঠাট্টা করব কেন, শেখানোর চেষ্টা করছিলাম
সিনিয়র টিচার ওর সামনেই বললেন,
- তোমার বাপু বেশি বেশি...পরীক্ষা নেওয়ার সময়ে আবার কেউ পড়ায় তা
তো ফাদার’স এর জন্মে শুনি নি!!! গাধা পিটিয়ে কি আর ঘোড়া হয়!
- যার বাকি সব দিকে অত বুদ্ধি, সে কখনো পড়াশোনায় খারাপ হতে পারে
না! আমরাই ওর আগ্রহ তৈরী করতে পারছি না।
- তাই নাকি হে ছোকরা? তা এত শিখিয়েও তো নিজের বাপের নামটাও বলাতে
পারলে না ওরাল পরীক্ষায়...কত নম্বর দিলে?
-দশে ছয়...
- অ্যাঁ…! বল কি হে দশে ছয়…? কেন দিলে?
- কারণ ও কোন পরিবেশে ফিরত যায়, কি করে সংসার চালানোর জন্য, সেগুলো
ভাবতে হবে...আর এই তুচ্ছাতিতুচ্ছ স্কুলের পরিচয় ওর হাত দিয়ে, গতবার আমাদের স্কুল ওর
জন্যই জেলার সেরা ফুটবল টিম হিসেবে উঠে এসেছে। নাহলে কেউ জানত এই স্কুলের নাম?
- তাতে মাথা কিনে নিয়েচে নাকি!
- না ঠিক তা নয়, তা কেন হবে! মাধ্যমিক স্তরে তো খেলার আলাদা করে
কোনো গুরুত্ব নেই, না হয় দু' নম্বর বেশি-ই দিলাম ওকে সেজন্য, কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ
হল তাতে?
- ওই জন্যই আজকাল মাধ্যমিক পাশের কোনো দাম থাকছে না, তোমাদের জন্য...quality বলে কিছু রাকলে না হে!
- সেটা অবশ্য সত্যি, পড়া না পারলে আপনার মত জামা খুলে quality education এর নামে শাস্তি হিসেবে ক্লাসরুমে সারা গা মাসাজ করাই না যে...বা ক্লাস কামাই
করে ব্যাকরণ বই-ও লিখি না! অথবা ফ্রি পিরিয়ডে ফাঁকতালে আশেপাশে টিঊশন পড়িয়ে আসি না।
- কি বললে !!! এত বড় আসপদ্দা তোমার যে আমাকে অপমান!! ম্যানেজিং কমিটির
মেম্বার আমি, দেকাচ্ছি মজা তোর...
-আপনি যেখানকার যা-ই হোন না কেন, আপনি এই বিদ্যালয়ের
শিক্ষক…সরকারি চাকরী আপনিও করেন, আমিও
করি…আর সব থেকে বড় কথা হল ফাঁকি আপনি…
আমি আরও কিছু বলতে যাব, শোহরাব আলতো করে কাঁধে হাত রেখে আমাকে আটকালো।
- দরদ একে বলে...ছাত্রের ইশারায় শিক্ষক ওঠে বসে! ঘেন্না ধরে গেল,
ম্যা গো...হেডমাস্টারও কিছু বলে না।
চক্কোত্তিবাবু আস্ফালণ করতে করতে চলে গেলেন।
পরদিন বিদ্যালয়ে আসার পথে নাকি রাস্তায় সাইকেলের ধাক্কায় পা ভেঙে
গেল ওনার। তিনমাস বিছানায় শয্যাশায়ী। তার পরেও লেংচে হাঁটেন আর ছড়ি ছাড়া সিঁড়ি ভাঙতে
পারেন না।বুঝতে দেরী হয় নি কাজটা কার।ডাকলাম।
-এটা কি হল?
-কিসের কি হল?
-চক্কোত্তি স্যার কে এভাবে কেন আঘাত করলি?
-স্যার উনার কপাল খারাপ তাই এরকম হল…যেমন কর্ম, তেমনি ফল…উনি নিজেই বলেন…
-এক চড়ে গাল ভেঙে দেব…খুব চ্যাটাং চ্যাটাং কথা হয়েছে তো তোর…
-সে আপনি আমাকে ভালবাসেন, তাই শাসন করার অধিকার আপনার আছে…মারার আগে ভালবাসতে হয় স্যার, তবে বুজা যায় কি ওটা শাসন না কি অত্যাচার…আপনাদের মত মানুষগুলো যারা আমাদের মত ছেলেদের ভালোবাসে, আমি তাদের জন্য জান দিয়ে দিব স্যার…আপনি কুছু করতে পারবেন না…
সত্যি-ই আমি কিছু করতে পারি নি সেদিন। ভ্যাবলার মত চেয়ে থেকেছি। একে যদি প্রশ্রয় দেওয়া বলেন, আমি সে দোষে দুষ্ট…কিন্তু বুঝে পাই নি কি করা উচিত, ঠিক…স্কুল-কে জানাতে পারতাম। তখন স্কুলছুটদের নিয়ে এত মাথাব্যাথা ছিল না। তাড়িয়ে দিত ওকে স্কুল থেকে, এক কথায়। সেটা আমি পারি নি। কিন্তু শোহরাবের স্কুল ছেড়ে চলে যাওয়া আমি আটকাতে পারি নি।
একদিন ক্লাস নিচ্ছি। হঠাথ পিলখানা থেকে অনেক লোক স্কুলে চলে এল
শোহরাব শোর মাচিয়েছে, পাড়ায়। এক পড়শি, তার বন্ধুর
বাবা রোজ রাতে মদে চুর হয়ে তার বন্ধুকে আর মা-কে পেটাতো। গতরাত্রে বাড়ি থেকে লাথি মেরে
বের করে দিয়েছিল বন্ধুর মা-কে, আর মায়ের রোজগারের টাকা কেড়ে নিয়ে বন্ধুকে বলেছিল মদ
আনতে।বন্ধু মদ নিয়ে ফিরতে শোহরাব থাকতে না পেরে ওই ব্যক্তির গায়ে মদ ঢেলে জ্বলন্ত দেশলাই
কাঠি ফেলে দিয়েছে।তিনি ওখানেই পুড়ে মারা গিয়েছেন। কেউ বাঁচাতে আসে নি। বন্ধুর মা একবার
এগিয়ে এসেছিলেন স্বামী কে বাঁচাবেন বলে,শোহরাব নাকি তাঁকে টেনে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে শিকল
তুলে দিয়েছে। অনেকে দেখেছে।
সকাল হতেই ও স্কুলে পালিয়ে এসেছে। কাউকে কিছু বুঝতেও দেয় নি। ওর পাড়ার এক বন্ধুর কাছ থেকে জানা গেল।
- কেন করলি তুই এটা?
হেডমাস্টারমশাই জিজ্ঞেস করলেন।
-ইতিহাস স্যার শিখিয়েছেন।
বজ্রপাত!
তলব করা হল শীতাংশু বাবু কে। সকলে আশ্চর্য যে যাঁর আর তিন বছর মাত্র
অবসর নিতে বাকি, তিনি এমন ভয়ংকর বুদ্ধি কি করে দিতে পারেন সন্তানতুল্য ছাত্রকে!
- আমি তোকে এ সব বলেছি? বলেছি যে গিয়ে মানুষ মেরে দে...! কি সাংঘাতিক স্যার! ওর জন্য যে আমায় জেলে যেতে হবে দেখছি!
- হ্যাঁ স্যার, আবনি-ই তো লাস্ট দিনে কেলাসে বললেন যে স্বাধীনতার আগে আমাদের স্বাধীনতা সংগামীরা
অন্যায়ের বিরূদ্ধে পতিবাদ কত্তে গিয়ে নিউম আইন সব ভেঙে দিছিলেন। আমিও তাই শিকেচি
--অন্যায়ের পতিবাদ কত্তে। আবনারা আমাকে যকুন মারেন বকেন, কুনো ভাল কারণ থাকে, আমি জানি, বুঝিও। কিন্তু
জানেন, বিবিজান উই হারামজাদা-কে, যাকে আমি জ্বালিয়ে দিছি, উকে রোজ দু বেলা রান্না করে খাওয়াতো, যত্ন কোত্তো, নিজে
রোজগার কোত্তো। আর তার বদুলে রোজ খালি মার মার মার। আমার দোস্তের গায়ে জোর নাহি আচে।
তাই আমি ওর কামটা করে দিলাম স্যার।
- চুপ ব্যাটা...তা বলে আমি তোকে খুন কত্তে শিখিয়েছি?
- না স্যার, সত্যির দানা ভরে দিয়েচেন ভিতরে, বের কত্তে পারছি
না।"
- এ স্যার পাগল ছেলে...আমি ওকে কিচ্ছু শেখাইনি স্যার, বিশ্বাস
করুন, আমি নির্দোষ!...আমার আর তিন বছর মাত্তর বাকি সার্ভিসের...বোঝেন ই তো।"
পিল্খানা থেকে আসা জনগণের দাদা বলে উঠলেন...
- হ্যাঁ সবই বুঝি। বুঝছি বই কি!!! ইস্কুল-টার এমনিতেই বদনাম। এখন
দেখছি ঠিকই, যত্ত ক্রিমিন্যালের আড্ডা। তাতে আবার মাস্টার-রা উস্কানি দেয়।
আমি বলতে গেলাম,
- কি বলছেন দাদা! আমরা শিক্ষক, আমাদের কাজ ছেলেমেয়েদের ভ্যালু এডুকেশন
দেওয়া, ঠিক-ভুলের বিচার করতে শেখানো, পিছিয়ে পড়াদের এগিয়ে আনা....
আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হেসে নিজের টাকের চুল
পরিপাটি করতে করতে বললেন,
- ...এমন মূল্যবোধের গুঁতো যে ছাত্র
সে মূল্য চোকাতে নাবালক অবস্তাতেই মানুষ মেরে দিচ্চে...!!! হ্যা হ্যা হ্যা....!! সমাজ এগুচ্চে,
তাই না স্যার!
- আপনি বাজে কথা বলছেন।
- শুনেন স্যার, আপনি শিক্ষক। শিক্ষা দিয়ে যাবেন।
সমাজ টমাজ বদলানোর কম্ম আপনার নয়…ও সবের জন্য অন্য লোক আছে…নেতাদের ভোট দিয়েছেন, সমাজ সেবার জন্য…তারা তাহলে কি করবে…!!! আপনি কি করবেন? শুধু পড়াবেন, আর মাস গেলে মাইনে গুনে নিয়ে বাড়ি যাবেন। ব্যাস।
আমি আরো জোরালো ভাবে প্রতিবাদ করতে গেলাম, কালীবাবু আমার হাত টেনে
ধরে স্টাফরুমে এনে এক দাবড়ানি দিয়ে বললেন,
- চুপ...একদম চুপ...ওর সঙ্গে তর্ক না করলেই নয়্!
- তা বলে যা ইচ্ছে তাই....
- বলবে, বেশ করবে বলবে...কিছু ক্ষেত্র আছে, তড়বড়ানি না দেখিয়ে শান্ত
হয়ে শুনতে শেখ...তাতে স্নায়ুর জোর বাড়ে, লড়ার শক্তি বাড়ে...যেখানে হাত দিয়েছ, তা খুব
কঠিন, অনেক সইতে হবে! এ তোমার বাবার আমল নয়, যে শিক্ষক বলে সবাই তোমাকে সম্মান করে
ঢিপ ঢিপ করে পেন্নাম ঠুকবে! সে সব দিন অনেক আগে চলে গ্যাচে। মানুষের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে সরকারী বাংলা মিডিয়ামের টিচার-রা কিস্যু করে না...শুধু বসে বসে মাইনে গোনে...আমরা এখন সাধারণ মানুষের হিংসার পাত্র। তাই চুপ করে এঁটে বস দি'নি দেকি!
বসলাম। চুপ করে, একেবারে চুপ করে....
বুক ফেটে কান্না পাচ্ছিল, এর নাম শিক্ষকতা? কে, কাকে, কি শেখাচ্ছে? মূল্যবোধের নামে?

No comments:
Post a Comment