সবে
সারাদিনের খাটা-খাটুনির পরে বাড়ি ফিরেছি। এমন সময়ে আমাদের জুনিয়র ভাই বুম্বা বাড়িতে এসে হাজির।
- চল, তোকে ডাকছে…পুলিশ এসেছে…
- তুই এগো আমি আসছি…
- না তোকে নিয়ে যেতে বলেছে, নাহলে আমি ক্যালানি
খাব…
বাবা অত রাত্তিরে আমাকে বেরোতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, (আমি আমার বাবা-কে 'আপনি' বলে সম্বোধন করি)
-
কোথায় চললি এত রাত্রে?
-
আমার এক বন্ধু খুব বিপদের মধ্যে আছে, একটু যেতে
হবে। চিন্তা করবেন না। তবে ফিরতে একটু দেরি হতে পারে।
-
আচ্ছা, বড় হয়েছ, যা করবে সাবধানে।
হেসে বললাম,
-
নিশ্চিন্তে থাকুন।
পকেটে
ব্রহ্মাস্ত্র ভরে বেরোলাম। এই সময়টার অপেক্ষায় ছিলাম, উতরে গেলেই ‘অল ক্লিয়ার'।
যা ভাবছেন তা নয়। নকশালদের গল্প নয় এটা। প্রিয় বন্ধুর পাতি
পালিয়ে বিয়ে করে ফেলার গল্প, হিন্দি সিনেমার মত। আজ থেকে ঠিক পঁচিশ বছর আগে।
আমার বয়েস তখন তেইশ। বন্ধুরা মনের দিক থেকে আমাকে চল্লিশের
বুড়ো বলে ক্ষেপানোর চেষ্টা করত, কিন্তু আমি তাতে আনন্দ পেতাম, কারণ এর পিছনে লুকিয়ে
ছিল আমার প্রতি তাদের অনেকটা সম্মান ও সম্ভ্রম। যেকোনো ছোট-বড় সিরিয়াস বিষয়ে প্রত্যেকে
আমার শলা-পরামর্শ নেয়। তাতে আমার নিজেকে ওই ছোট পরিসরে বেশ বিজ্ঞ বলে মনে হত। সবে প্রেমে
জোরসে দাগা খাওয়া আমি, এই বন্ধুদের নির্ভেজাল উষ্ণতায়, সব কষ্ট ভুলেই গিয়েছিলাম।
আমাকে যিনি দাগা দিয়েছিলেন তাঁর -ই এক বন্ধুর সঙ্গে
আমাদের প্রিয় বন্ধুর প্রণয় ঘটিত সম্পর্ক স্থাপিত হল। সবটাই তলে-তলে। আমাদের কেউ কিছু
বুঝতে দেয় নি। যখন নিজেরা এসে স্বীকার করল, তখন গাড়ি অনেকদূর গড়িয়ে গিয়েছে। সোজা বিয়ের
প্ল্যান। কিন্তু বাড়ির দিক থেকে কোনো পক্ষই সম্মত হলেন না। আমরা বোঝাতে গিয়ে কাকু-কাকীমাদের
কাছে যার-পর-নাই অপমানিত হলাম। কিছুতেই কিছু হল না যখন, একমাত্র উপায় পড়ে রইল পালিয়ে
যাওয়া। শুনেই অনেক বন্ধুরা ধাঁ। কারণ কন্যের জেঠু সালকিয়ার পুরোনো আমলের তাবড় কংগ্রেস
নেতা। এক ডাকে বাঘে গরুতে জল খায়।
বারোয়ারীতলায় বটগাছের নিচে বসে আছি। জরুরী মিটীং। বন্ধু
ও তার প্রেমিকা, পোকে আর আমি।
- কি করবি বল?
আমি জিজ্ঞেস করলাম বন্ধুকে ও তার হবু-স্ত্রী কে।
সপাটে উত্তর,
- অনেক তো হল...কি আবার করব, পালাবো। অনেক আগেই বলেছিলাম,
তুই আমাকে বোঝালি। কিছু হল? উলটে চাড্ডিখানি জ্ঞানের কথা শুনে এলি তো…সম্মান টা কোথায়
রইল? বারণ করেছিলাম আমি…
-
আরে গুরুজনেরা ওরকম বলেন। আর ভেবে দেখ আজ থেকে ছ’মাস বাদে কিন্তু
কেউ তোদের দিকে আঙুল তুলতে পারবে না, যে তোরা না জানিয়ে সব করেছিস। কার সম্মান বাড়ল
তখন বুঝতে পারবি।
-
হ্যাঁ আর তুই ও জ্ঞান দিস না ভাই…মিঞা-বিবি রাজি/তো কা করেগা
কাজী!
- সেই…ঠিক কথা…তুই একা পালিয়ে কি করবি? দাঁড়া, বিবি
কে জিগাই…হ্যাঁ রে, নীতা, তুই বল...
- ও যা বলবে, তোরা যা বলবি, তাই হবে...
- বাব্বা! বিয়ের আগেই, এত ভক্তি…!!!
-
এই বাজে কথা বলিস না, মুড নেই শোনার, কাজের
কথা বল…
-
পুলিশ তোদের কুকুরের মত খুঁজবে, ধরা পড়লে, নিজের
মত বদলাবি না তো? তোর একটা হ্যাঁ বা না, আমাদের সকলের জীবন ধ্বসিয়ে দিতে পারে।
- বিয়ে হয়ে গেলে আবার কি রে! কেউ কিচ্ছু করতে পারবে
না।
বন্ধুটি বলল।
- আইনের খাপ বুঝিস? সব ওরকম গায়ের জোরে হয় না। ফাটা
বাঁশের মত। আর জানবি সব মেয়েদের দিকে ঝোলা আইন। একবার যদি ভুল করে কোনো দূর্বল মুহূর্তে
বলে বসে যে না ও স্বেচ্ছায় পালায় নি। তুই আর আমরা জোর করেছি। তাহলে সবার আগে তুই আর
তার পর আমরা, সবাই মিলে ডুবব।
- আর্য-দা, তোরা এত কথা বলছিস, এটা তো ভাবছিস না, যে
আমি যে তোদের বন্ধুর সঙ্গে পালাব, কোথায় থাকব, কতদিন কি ভাবে, সব তোদের হাতে ছেড়ে দিয়েছি,
তার পর যখন ফিরব, আমার নিজের সামাজিক সম্মান, আমার বাবা-মায়ের আত্মসম্মান কোথায় থাকবে,
সেখানে, আমি যদি সবাইকে ফাঁসাই?
-
রাগ করিস না। বোঝার চেষ্টা কর, তোর জেঠু এমনিতেই
আমাদের এই বন্ধুকে দু’চক্ষে দেখতে পারেন না। তারপর আবার এই ঘটনার পর কি হবে কেউ ভাবতেও
পারছিস না। পুলিশ ছেড়ে কথা বলবে না। ঊনি নিজের ভাই-ঝি কে উদ্ধার করতে কাউকে ছেড়ে কথা
বলবেন বলে মনে হয় তোর? সব ক্ষমতা উজাড় করে দেবেন।
-
তাহলে তুই বল কি করা যায়।
-
বিকেলের দিকে পালা…খবর হতে হতে রাত। একটা দিন
হাতে পাবি। সকালে ভোরের আগে বিয়ে যেন হয়ে যায়। সেটা পোকের দায়িত্ব।পুলিশ সকালে জেগে
কাজ করা শুরু করতে করতে গল্প অনেকটা গড়িয়ে যাবে। এই সব কেসে পুলিশ খুব একটা নড়ে বসত
না, যদি না জেঠু জ্যাঠামী করতেন…আর অবশ্যই তিনি করবেন ও…আমি ও নার জায়গায় থাকলে একই
কাজ করতাম।
-
অলরাইট। ঠিক ই বলছিস।
-
আলাদা আলাদা যাবি। আর নীতা, তোর আঠারো হয়ে গিয়েছে
তো? আমাদের বন্ধুর বয়েস যে একুশের বেশি সে নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। নীতা একটা চিঠি লেখ
থানার ওসি কে, সঙ্গে হায়ার সেকেন্ডারীর মার্কস শিট আর মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ড…দু-টোই
অ্যাটেস্টেড লাগবে। চিঠিতে ওই দিনের-ই তারিখ অবশ্যই দিবি। বয়ানে লিখবি, যা করছিস তা
স্বেচ্ছায় ও স্বজ্ঞানে, কারো কোনোরকম চাপ ছাড়া। আর এই ঘটনার দরুণ যেন কাউকে কোনোভাবে
হ্যারাস না করা হয়, কারণ, তোরা ফিরে আসবি।
পোকে বলল,
-
সে আমি লিখে দেব ‘খন, নীতা তুই শুধু সই করে
দিবি।
-
না অত কত্তে হবে না, তুই পুরোহিত মন্দির আর
বিয়ের আয়োজন আর ওদের থাকার জায়গা দেখ। এমন জায়গা দেখবি, যেখানে শকুন ও খোঁজ না পায়।
আর সেটা তোদের অন্য কাউকে, এমনকি আমাকে বলার-ও দরকার নেই। ব্যাক আপ জায়গা রাখবি থাকার,
যাতে বিপদ বুঝলে অন্য জায়গায় ওরা সটকে যেতে পারে। আমি একটা নম্বর দিচ্ছি (আমাদের বাড়িতে
তখন ফোন ছিল না)। পালানোর একদিন পরে সেখানে ফোন করবি, আমি না বলা পর্যন্ত ফিরবি না।
ওকে? আর নীতা নিজের চিঠিটা পুরোটা নিজের হাতে লিখবে। হ্যাঁ, বয়ান-টা তুই বলে দিতে পারিস।
যে পয়েন্টগুলো বললাম, একটাও যেন মিস না হয়।
-
সব বুঝলাম, সে চিঠি থানায় পৌঁছে দেবে কে? বেড়ালের
গলায় ঘন্টি-টা বাঁধবে কে শুনি? তাকে আইডেন্টিফাই করতে কতক্ষণ!!!
বন্ধু জিজ্ঞেস করল।
-
আমি যাব। নিশ্চিন্তে থাক।ওটা আমার ভাবনা। আর
দু-জন-কেই বলছি, কোনোভাবে ধরা পড়লে পালাবার চেষ্টা করবি না, কিন্তু বয়ানে যেন কারো
কোনো বদল না হয়। কারোর প্রতি কারোর বিশ্বাসের একচুল এদিক ওদিক হলে কিন্তু কিছু ধরে
রাখা যাবে না…সরল জিনিষ জটিল হয়ে যাবে। পোকে সব সেট করে জানা। বাকিটা সেই অনুযায়ী হবে।।
বেশিক্ষণ এখানে থাকিস না। আর নীতা, তুই কি কাউকে জানাবি, তোর দিকে?
-
না, দরকার নেই, আমি একাই কাফি…
***এই বাস্তব গল্পের বাস্তব নায়ক-নায়িকার অনুমতি নিয়ে তাদের ২৫ তম বিবাহবার্ষিকী-তে আমার আন্তরিক উপহার...।

No comments:
Post a Comment