Tuesday, 17 August 2021

টাইটেল – অপরাজিত স্বাধীনতা

 

#apu #oporajito #ray #styajitray #freedom75

(সাবটাইটেলঃ না পড়লেও চলে! ছবি নেই যে! ঝট করে লাইক করার মত!)

 - মা আমিও স্কুলে যাব!

সর্বজয়ার কোলের মধ্যে মাথা গুঁজে অপু বলল।
....
- পয়সা কে দেবে?
- কেন তোমার কাছে নেই পয়সা? পয়সা নেই তোমার কাছে?


সর্বজয়া চুপ। দুই ভুরুর সংযোগস্থলে সেই 'পথের পাঁচালী' থেকে পরিচিত ভাঁজ আরো গভীর হয়েছে, বয়স ও অভিনয়শৈলী আরও পরিণত হওয়ার নিরিখে। সেই ভাঁজ অনটনের লাজ ঢাকতে হাসিতে পরিবর্তিত হয়।
সন্তানের লেখাপড়ার জন্য মায়ের কাছে পয়সা নেই, এ কি হতে পারে না কি!

লক্ষ্য করলাম, চিরন্তন সত্যের বীজগুলিকে। পরতে পরতে নিহিত সামাজিক পরিকাঠামোর সমস্যাগুলিকে। আজ না হয় শিক্ষাক্ষেত্রে ক্লাস এইট অব্দি ফ্রি-এডুকেশন দেওয়া হয়, উপরি আছে মিড ডে মিল কিন্তু অপুর যুগের মত সেই পেটের তাগিদে ড্রপ আউট চলছেই, শিশুশ্রম বে-আইনি হওয়া সত্ত্বেও, মিড-ডে মিল দেওয়া সত্ত্বেও
ওয়েব সিরিজে পাওয়া যায় সেই ছক, যেখানে পরিবারে যত বেশি পুরুষ সন্তানের জন্ম হবে তত বেশি রোজগারের নিশ্চয়তা। শুধু শিক্ষার্থীর পেট ভরালে হবে না। সবার খাওয়া-পরার নিশ্চয়তা চাই। সেখানে আবার মেয়েরা অপাংক্তেয়। তারা অভুক্ত থাকলে খুব কিছু ক্ষতি হয় না সমাজের। তাই সে যুগেও দূর্গা ছিল ফেলনা আর খুব অনটনের সংসারেও বাজার হত অপুর ছোট ছোট আবদার অনুযায়ী।

ভারতের বিভিন্ন গ্রামের কথা বাদ দিলাম। শহরেও আজকাল খুব শোনা যায়, আধুনিক প্রজন্ম না কি তাদের বাপ-মায়েদের দেখে না। সল্টলেক ধীরে ধীরে বৃদ্ধদের শহর হয়ে উঠছে, ইত্যাদি প্রভৃতি...

'অপরাজিত'-র অপু কি তবে অতি-আধুনিক ছিল? সে তো তবু কাল্পনিক উপন্যাসের চরিত্র। কিন্তু বিদ্যাসাগর?!!! তিনি তো বাস্তব। সে হেন ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর বীরসিংহে ফেলে আসা মাতৃভক্তি একবারই সেই মিথিক্যাল দামোদর সাঁতরে পার করে মেক আপ দিয়েছিলেন কি না, বা একবারই গ্রামের গরীবদের শীতবস্ত্র বিতরণে থমকে গিয়েছিল কি না, তা আমরা জানি না। তাঁর কর্মকাণ্ডের বেশিরভাগই শহরকেন্দ্রিক কারণ তিনি বুঝেছিলেন, ভূ-কম্পনের কেন্দ্র কোথায় নিহিত।

সত্যি এটাই, যে সন্তান সাবালক হলে, তাকে তার মত উড়তে দেওয়াই সঠিক জৈবিক নিয়ম। সেখানে তার জীবনে বাধ না সাধাই শ্রেয়। তাই নিজের সন্তানের বিধবা-বিবাহ দেওয়ার পর ঈশ্বরচন্দ্র আর কোনোদিন আজীবন বীরসিংহের মাটিতে পা রাখেন না। ঠিক একই কারণে তাই সর্বজয়া নিজের মৃত্যু আসন্ন জেনেও অপুর উদ্দেশ্যে চিঠি লিখতে দেয় না। কারণ, অপুর পরীক্ষা। আর সেই আধুনিক মননের অপু জীবনের পরীক্ষা অনায়াসে উতরে যায়, সামাজিক কিছু বাহ্যিক অহেতুক রীতিকে অবলীলায় সরিয়ে রেখে।

-কোতায়চললে?
-কলকাতা।
-কি হবে সেখানে গিয়ে?
-পরীক্ষা আছে।
-মায়ের শ্রাদ্ধের কি হবে?
-কালিঘাটে গিয়ে করে নেব।

 

কিছুদিন আগেই পিতৃবিয়োগের পর আমার এক সহকর্মী তাঁর মেদিনীপুরের গ্রামের ভিটেয় সারা গ্রাম-কে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করে খাইয়ে সামাজিক হতে বাধ্য হয়েছেন। সেখানে অত বছর আগে এক কিশোরের কি অন্তর্দৃষ্টি! ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়, সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা এই অপুকে দেখে।এর অর্থ কি অপু তার মায়ের প্রতি দায়বদ্ধ ছিল না, না কি মায়ের প্রতি তার কোনো নাড়ির টান বা ভালবাসা কোনোটাই ছিল না? পড়শির শেষ চিঠি পাওয়া মাত্র সে আসে নি কি সব পিছনে ফেলে?  আসলে শৈশবে দিদির মৃত্যু, কৈশোরের শুরুতেই বাবা-কে হারানো, তার শিক্ষা-দীক্ষা ও বিজ্ঞানচেতনা তার চিন্তাধারাকে মৃত্যুঞ্জয়ী করে তুলেছে। অপু এখন রোমে রোমে শিরায় শিরায় জানে বেঁচে থাকার মানে কি, সে উপলব্ধি করে,


"কোন দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল
কোন দেশেতে চলতে গেলেই দলতে হয় রে দূর্বা-কোমল!"

বাংলায় আমাদের পরের প্রজন্ম নাও থাকতে পারে। যা একদিন অপুর কাছে 'কলকাতা' ছিল, আজ আমাদের সন্ততিদের চোখে তা সারা বিশ্ব। তাদের বুকে অপুর মতই স্বপ্ন-ভরা। বুকে আগলে বড় করে ছেড়ে দেওয়াই চিরকালের রীতি। এখানে হঠাৎ যাঁরা আধুনিকতার দোহাই দিয়ে পরের প্রজন্ম-কে দোষ দেন যে তাদের মধ্যে মানবিকতার ভাগ বড় কম, নতুন প্রজন্ম বড় স্বার্থপর, তাঁরা নিজেরাই আসলে তাই, কারণ তাঁরা ছাড়তে শেখেন নি। কারণ তাঁরা পিছন ফিরে অতীতের দিকে তাকিয়ে দেখেন নি যে পরিস্থিতি সামাজিক ভাবেই চিরকালীন ও অমোঘ সত্য। কারণ তাঁরা জানেন তাঁদের সন্ততি ছাড়া আর কেউ তাঁদের পাত্তা দেবে না, কারণ নিজেদের জীবনে তাঁরা সেরকম কিছু করার চেষ্টাই করেন নি, যাতে অন্য কিছু নিয়ে তাঁরাও বাঁচতে পারেন। 'জীবনমুখী' গান বলতে নচিকেতার 'বৃদ্ধাশ্রম'-কে বাইবেল বলে আঁকড়ে ধরে বসে আছেন। অথচ, শিলাজিৎ-এর

"যা পাখি উড়তে দিলাম তোকে

খুঁজে নে অন্য কোনো বাসা

খুঁজে নে অন্য কোনো মানে

খুঁজে নে অন্য ভালবাসা..."

এই লাইনগুলোর বেদবাক্যসমান সত্যতা তাঁদের ছোঁয় না। কারণ সে সব বাবা-মায়েরা চাননা সন্তান স্বাধীন হোক। আর একটা দারুণ কথা আছে না, "There is a pleasure in pain." - সেটাকে সত্যি করে তুলে দুঃখবিলাসী হয়ে ওঠার দায় কাঁধে তুলে নিয়েছেন তাঁরা, পরের প্রজন্ম-কে দোষারোপ করে।

যে কোনো ভালবাসা, মানব-বন্ধন পোক্ত ও পরিপূর্ণ হয়, সেই ভালবাসার মানুষগুলো-কে মুক্তি দেওয়ায়, সমাজের দোহাই দিয়ে বেঁধে রেখে নয়।

-----



No comments: