২০ শে মার্চ, ২০২১, আকাদেমী অফ ফাইন আর্টস, লেডি রাণু মুখার্জী মঞ্চঃ
“না না! পেটের মধ্যে অত বায়ু থাকা মোটেও ভাল না! তুমি কিছুদিন পরে এসে আমকে বা অন্য কোনো ডাক্তারকে দেখিয়ে নিও, কিন্তু”!
ডাক্তারবাবু পেদো-কে এই কথা বলতেই হলের মধ্যে বেশ চাপা হাসির একটা গুঞ্জন। আমি বুঝলাম ঘটনাটা নটরঙ্গের বৃহত্তর পরিবারের কাছে কিছু অজানা নয় এবং আজ নাটকটির প্রথম দিন প্রথম শো হওয়ার দরুণ, খুব স্বাভাবিক ভাবেই পরিবারের কাছের মানুষরা তো আসবেনই, সবটাই জানবেনও, যে একদিন সারাদিন 'মিথ্যেcar এর সত্যি' নাটকের মহড়ায় সত্যিcar এর মিথ্যে-টা আসলে কি ছিল।
মাস খানেক আগে হঠাৎ খবর পাই যে আমার ভ্রার্তৃস্বরূপ ‘নটরঙ্গ’-র অন্যতম সদস্য দেবাঞ্জন, হৃদয়ঘটিত গোলযোগে (আসল হৃদয় দেয়া-নেয়া-য় কোনো গোলযোগ নেই, শুধু ‘যদিদং’এর অপেক্ষা) আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। তড়িঘড়ি তৈরী হয়ে বেরোতে যাব, তখন ফোনে জানলাম, সেরকম কিছু নয়, বায়ু-ঘটিত রোগ। আর তাতেই নাকি কর্পোরেট হাসপাতাল দু-দুটো স্টেন্ট বসানোর জন্য প্রস্তুত। দেবাঞ্জন তখন সিদ্ধান্ত নেয়, যে সে স্টেন্ট বসাবে না, পরিবর্তে খালি পেটে বিড়ি-সিগারেট আর খাবে না। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরল। কিন্তু লোকচক্ষুর অন্তরালে সেদিন হাসপাতালে যাবার পথে এবং পরে যা ঘটেছিল, তা আমি আজ শো এর পরে ওর কাছের মানুষদের মুখে শুনে আমি স্তম্ভিত। কারণ সেদিন দেবাঞ্জন নাকি শবাসনে পরপর মুখ ও পায়ুদ্বার দিয়ে পবন মুক্ত করে গিয়েছে, একটানা, কখনো সশব্দে কখনও নিঃশব্দে। শুধু গন্ধ জানান দিয়েছে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে। ফলে সবাই সেদিন অনুধাবন করেছিল যে, ছেলের এলেম আছে। 'মিথ্যেCar এর সত্যি’ নাটকটিতে দেবাঞ্জনের পার্শ্বচরিত্রে অভিনয়। চরিত্রের নাম দারণ সমাপতনে, ‘পেদো’।
আজ ছিল নাটকটির প্রথম অভিনয়, আকাদেমী অফ ফাইন আর্টস-এর লেডি রাণু মুখার্জী মঞ্চে। নাটক রচনা, নির্দেশনা, প্রযোজনা ও অভিনয়ে ‘নটরঙ্গ’-র প্রাণপুরুষ শ্রী সোহন বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়।
কার্টেন কল-এ জানা গেল সোহন-বাবু কোভিড দশায় গত বছরে মার্চ মাসেই নাটকটি লিখে শেষ করেন। আর তারপর থেকে এই প্রথম স্টেজে ওঠা। অকপট স্বীকারোক্তি ওনার, “অনেকদিন পরে নাটক করলাম”।
নাটকের গপ্প বলতে আমি বসি নি। তবে কিছু কথা তো থেকেই যায় আমার তরফ থেকে, ভাল বা খারাপ লাগা নিয়ে। আপনার সঙ্গে মতামত নাও মিলতে পারে আমার সঙ্গে, নাটকটি দেখার পরে, কিন্তু নাটকটির ভাল চেয়ে কিছু কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে। ধরুন, আপনি কোনোদিন ‘যদিদং’ দেখেন, তারপর এই 'মিথ্যেCar এর সত্যি’ নাটকটি-কে serio-comedy হিসেবে কত আর দেবেন? -- মেরে কেটে দশে ছয়।
তবে কি না সোহনবাবু চিরকালই দারুণ নাট্যকার। স্ক্রিপ্ট নিয়ে কোনো কথা হবে না। শুধু Opening scene ও rising of action-এ বোঝাই যাচ্ছিল না, প্রায় প্রথম পনেরো মিনিট ধরে, যে নাটকটির বিষয়বস্তু কি। আর এই পনেরো মিনিটে খাপছাড়া একটা ভাঁড়ামো-ঘেঁষা অভিনয়ের চোরা স্রোত-কে এক ধাক্কায় বেঁধে ফেলল তিনটি চরিত্রের উপস্থিতিঃ
১. ফুলটুসি
২. গোবিন্দ পোদ্দার (সঙ্গে পেদো)
৩. রীতা (শমিতের স্ত্রী)
নাটকের bantering তাঁদের ছোঁয়ায় শক্তিশালী satire হয়ে উঠল। বারে বারে হাসির রোল উঠল perfect satirical humour-এর উপস্থাপনায় ।
নাটক যত এগিয়ে চলল satire-এর আড়ালে আমাদের নিজেদের সম্পর্কের জটিলতা উন্মুক্ত হতে লাগল নিছক হাসির মাধ্যমে। খুব ভারী করে দেখালে, মানুষের চেনা সমস্যার মুখোমুখি-তে মন ভারী হয়ে যাবে। তাই সোহন বাবু একেবারে ঠিক পন্থা অবলম্বন করেছেন -- Satirical humour, to repeat the genre of Serio-comedy (comedy with a very serious underlying message) with a very grave social message. মনে পড়িয়ে দেয় বার্নাড শ'-এর 'Arms and the Man'-এর কথা বা অলিভার গোল্ডস্মিথ-এর 'She Stoops to Conquor'-এর bare naked slapstick satire.
আগেই বলেছি নাটকের উপজীব্য নিয়ে আমি আলোচনা করব না এখানে, কারণ এই ধুঁকতে থাকা 'বাংলা থিয়েটার' নামক দূর্ধর্ষ আর্ট ফর্ম কোভিড পরবর্তী দশায় খারাপ তো আছেই, সঙ্গে গল্প বলে দিলে আর আপনার দেখতে যাবার টান থাকবে না। বরং নাটকটির চারিত্রিক সমালোচনায় আসি।
মাঝে মধ্যে 'শশা' শব্দের মধ্যে পুংলিঙ্গের'ঘ্যাচাং'-এর অভিব্যক্তিস্বরূপ প্রকাশ বা 'পোঁদ' শব্দের বার বার ব্যবহার নাটকের রুচি-তে আঘাত হানে বটে, কিন্তু তা বাস্তবসম্মত এবং শ্রেনী ও শিক্ষা-র বিভাজন কে ব্যাখ্যা করে। ঠিক যেমন করে আপামর সংস্কৃতিমনস্ক বাঙালী বইমেলায় 'মৌসুমী '-র স্টলের লাইনকে 'আনন্দ' বা 'দে'জ'-এর থেকে বেশি দীর্ঘায়িত করে ভিড় করে, বা 'গরুর গাড়ির হেডলাইট' ও 'ফ্যাতাড়ু'-র শো কে হাউসফুল করে তোলে, ঠিক সেই টানেই এখানেও এত crude humour এ ক্রূদ্ধ না হয়ে, বিরক্তি প্রকাশ না করে, সবাই হেসে ওঠে বার বার। এ যেন আমাদের সবার মনের কথা যে, 'আমি ও সব বলতে পারি না তো কি হবে, আমার হয়ে কেউ তো বলে দিল!' এ-ও এক পরম সুখ। সোহন বাবু কোথাও সেই অনুষঙ্গের ব্যবহারে কসুর করেন নি কারণ আমি লক্ষ্য করেছি ওনার দৃষ্টিকোণ নাটককে দর্শকের কাছে কঠিন ও দুর্বোধ্য করে তোলা নয়, বরং connect করা, যতটা সরল স্বাভাবিক উপায়ে সম্ভব। আর সেই crude satirical humour-এর ধারাল অস্ত্রের ব্যবহার যথোপযুক্ত ভাবে পেশ করেছেন, পঞ্চায়েত প্রধান গোবিন্দ পোদ্দার (সঞ্জীব চক্রবর্তী), ফুলটুসি (অনন্যা বোস), পেদো(দেবাঞ্জন বসু) এবং বুড়ো মাতাল বাগদী (অরুণ মিত্র)।
নাটকের চলন একবার ফার্স্ট গিয়ারে পড়ে গেলে আর থামে না। গিয়ার উঠতে থাকে, পড়তেও থাকে, হাইওয়ে ড্রাইভের মত। কিন্তু, climaxএর পর falling of action বা Denouement (দ্যেনুমাঁ)-র অংশ দীর্ঘায়িত মনে হয়। নাটক শেষ হবে হবে করেও হয় না। রানু-চরিত্রে মৌসুমী সেনগুপ্ত অনবদ্য। কিন্তু আমার চাহিদার শেষ নেই বলেই বোধ হয় মনে হচ্ছে, silence-কে হয়ত উনি আরো খানিকটা কথা বলাতে পারতেন, ওনার অভিজ্ঞ অভিব্যক্তি দিয়ে। কোথাও কোথাও নাটক তাই চাইছিল, দর্শক চাইছিল, কিন্তু পাওয়া গেল না।
আর ডাক্তার রাজকুমার রায়ের চরিত্রে সোহন বাবু....আমি সোহন বাবুর অন্ধ ভক্ত। ওনাকে নিয়ে বলতে বসলে, একপেশে লাগবে। তাই ওনার সমালোচনায় গেলাম না আর।
নাটকটি বার বার দেখা যায়, আনন্দ পাওয়ার জন্য, সামজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়-কে হাসির আড়ালে গভীর ভাবে উপলব্ধি করার জন্য।
তবে ভোটের সরগরম বাজারে, এই নাটকের সবথেকে আকর্ষক ডায়ালগ বুড়ো বাগদী ঝেড়ে গিয়েছেন,
"আমি তোকে ভোট দিলুম, তুই আমাকে প্যাকেট(চোলাই এর পাউচ) দে...বলেছিলি দিবি..."
মনে হয় আমরা, জনসাধারণ, ভোট বাজারে ঠিক ওই বুড়ো বাগদীর মত ভোটার, নেশায় বুঁদ হয়ে আছি।
যা রয়ে গেল দিনের শেষে তা হল নাটকটির main protagonists, ডাক্তারবাবু আর রাণুর ঊর্ধ্বে উঠে নাটকের রাশ ও রেশ, দু'ই-ই ধরে রাখলেন গোবিন্দ পোদ্দার ও ফুলটুসী। ওরাই যেন আমার কাছে এই নাটকের হীরো আর হীরোইন। মন জয় করে নিল।
এই নাটকের পরের শো ১৬ই মে, মধুসূদন মঞ্চে।
দেখে এসে জানান আমার বক্তব্যের সঙ্গে আপনিও একমত কি না!
নাটকটির নামকরণের সার্থকতাও আপনার বিচার্য বিষয়....
নাটকঃ মিথ্যেCar-এর সত্যি
প্রযোজনাঃ নট-রঙ্গ
নাট্য রচনা ও নির্দেশনাঃ সোহন বন্দ্যোপাধ্যায়
অভিনয়েঃ
হারু- ভোলানাথ বারিক
শশাঙ্কঃ সম্বুদ্ধ ব্যানার্জী
ফুলটুসিঃ অনন্যা বোস
শমিতঃ অর্চিস্মান বিশ্বাস
রমিতঃ অভিজিৎ চক্রবর্তী
রীতা (শমিতের স্ত্রী)ঃ অর্পিতা ব্যানার্জী
রানুঃ মৌসুমী সেনগুপ্ত
গোবিন্দ পোদ্দারঃ সঞ্জীব চক্রবর্তী
পেদোঃ দেবাঞ্জন বসু
বুড়ো বাগদীঃ অরুণ মিত্র
রক্তচোষাঃ রতন দাস
ডঃ রাজকুমার রায়ঃ সোহন বন্দ্যোপাধ্যায়
নেপথ্যেঃ
আবহঃ স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়
আলোঃ সুদীপ সান্যাল
মঞ্চঃ সৌমিক-পিয়ালী
মঞ্চ নির্মাণঃ মদন হালদার
শব্দ প্রক্ষেপণঃ জয়ন্ত পাল
রূপসজ্জাঃ বিধাতৃ দেব সরকার
প্রযোজনা সহকারীঃ মধুবন্তী গুপ্ত
No comments:
Post a Comment