Monday, 29 March 2021

দশে কত, 'দশ ইয়ারী'!!!!

আমি সব নাটকেই খুঁত ধরি।



হরিমাধব মুখোপাধ্যায় রচিত 'অন্তর্ধান' নাটকটির ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো। স্থান, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের বিখ্যাত ত্রিগুণা সেন মঞ্চ। 'দশ ইয়ারী' খুব যে নামকরা দল, তা বলা যাবে না। বড় জোর বছর দু'-আড়াই-এর দল হবে। কোভিড দশায় অনলাইনে নাটক করার সাহস দেখিয়েছে এই দল, রীতিমত নাট্যোৎসবের ছকে। তাই আবার খুব হেলাফেলার চোখে দেখা যাবে না, 'দশ ইয়ারী'-কে কারণ, তাঁদের ইয়ার-দোস্তের সংখ্যা শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ত্রিগুণা সেন মঞ্চের কথা অনেকেই জানেন। আর এও নিশ্চয়ই জানেন, একই নাটকে মঞ্চ ও দর্শকের রকমফের অনুযায়ী, খুব সচেতন ভাবে না হলেও, অভিনেতাদের অভিনয়ের মানের ফারাক হয়, অবশ্যই। ত্রিগুণা সেন মঞ্চ বা আকাদেমী অফ ফাইন আর্টসের লেডি রাণু মুখার্জী মঞ্চ বা মধুসূদন মঞ্চ আর হাওড়ায় শরৎ সদন বা শিশির মঞ্চে অভিনীত নাটক 'অন্তর্ধান' আর ত্রিগুণা সেন মঞ্চের 'অন্তর্ধান' -- আকাশ-পাতাল তফাৎ। অভিনেতাদের 'মুড'-ই আলাদা জায়গায় বাঁধা হয়ে যায়। তাই নদীর এপার আর ওপারে, হাওড়ার সাধারণ দর্শক (আমি হাওড়ার বাসিন্দা) আর যাদবপুর ক্যাম্পাসের মঞ্চের দর্শকের মধ্যে পার্থক্য থাকবে অবশ্যই। কারণ পরবর্তীকালে হাওড়ায় এই একই নাটক মঞ্চস্থ হতে দেখেছি।

নাটকের নাট্যগুণ বিচার করতে গেলে হবে না। কিছু ক্ষেত্রে 'আপিল' নাট্যগুণকে ছাপিয়ে শুধু ইস্থেটিক্স দাবী করে। নাটকটি দেখতে দেখতে, মনোজ মিত্রের 'কেনারাম বেচারাম'-এর স্পষ্ট ছাপ পরিলক্ষিত হয়। পার্থক্য আছে বটে, অনেকটাই। কিছু কিছু জায়গায় নাটকটি হিউমর ছেড়ে স্যাটায়ারের খোলস ধরে। আমাদের কিছু শেখাতে চায়। সেই শেখানোর সুর খুব অন্তঃসলিলা। ওপর থেকে বড় একটা বোঝা যায় না।


নাটকটির সবথেকে বলিষ্ঠ চরিত্র দু'টি, নায়িকা অর্থাৎ ঊমাশশী গিন্নী-র ভূমিকায় নবনীতা চক্রবর্তী আর তাঁর বাবা, রিটায়ার্ড ডিএসপি বা দাদু-র ভূমিকায় শ্রী দ্বিজপদ দত্ত। দারুণ জমিয়ে অভিনয় করলেন দুজনেই। বোঝা গেল অভিনয় টা ওনাদের আর বোঝা নয়, ভাললাগা ও ভালবাসার জায়গা হয়ে উঠেছে। সঙ্গে ছোট মেয়ে বুন্নির চরিত্রে মনিকুন্তলা রুদ্র নজর কাড়েন। তাঁর অভিব্যক্তি ও বেশ আকর্ষক আর খুব ভাল সেন্স অফ টাইমিং। ভুল করে স্টেশন থেকে যাঁকে ধরে আনা হল, সেই ব্যক্তির ভূমিকায় সুধীরঞ্জন মিত্রের অভিনয় খুব সামান্য অংশে হলেও দারুণ। দুর্ভাগ্য এই যে দর্শক চাইছিলেন, যে ওনার আবার আগমন ঘটুক, কিন্তু নাটকের অগ্রগতিতে তাঁর আর ফিরে আসার স্থান ছিল না। রিটায়ার্ড ডি-এস-পির সহকারী প্রমথ-র ভূমিকায় পুষ্পেন্দু রায়চৌধুরীর মানুষের মন জয় করার প্রচুর সু্যোগ নিয়েও সদব্যবহার করতে পারলেন না।

প্রচুর কমিক রিলিফের জায়গা ছিল। উনি নিজেকে মেলে ধরলেন না। তাই একটু কাঁচা-ই লাগল। সবথেকে বড় দুর্বলতা নাটকটির অভিনয়ে, আসল অন্তর্হিত কর্তা, সারদারঞ্জন মিত্রের। এই ভূমিকায় অভিনয় করেছেন দীপাঞ্জন গাঙ্গুলী। জানি না পরিচালিকা শ্রীমতি শুচিতা রায়চৌধুরী কেন হরিমাধব মুখার্জী রচিত এই কমেডিতে বৈপরীত্যের মাধ্যমে রসআস্বাদনের এমন অস্ত্র- তে কিছুতেই শান না দিয়ে চালাতে গেলেন। সব কিছুর মধ্যে এই চরিত্রটি এত আড়ষ্ট যে নাটকটি যে উচ্চতায় উঠছে, তা সশব্দে ধরণীপাতে। ফলতঃ সব দিক থেকে নাটকীয়তা ধরে রাখার অদম্য চেষ্টা চলল ক্লাইম্যাক্স ও তার পরবর্তী অংশে, ওনার উপস্থিতিতে। সব হল কিন্তু সবই কেমন হঠাত করে পানসে, স্বাদ-গন্ধ-বর্ণ বিহীন। দর্শকের মধ্যে এতক্ষণ ধরে তৈরী করা কৌতুহল যে এক লহমায় ভেঙে একটা দুর্দান্ত সিচুয়েশনাল ক্রেসেন্ডো উপহার দিতে পারত নাটকটি, কিন্তু তা দর্শকের আর পাওয়া হল না।

খুব খুঁত ধরলাম বটে। কিন্তু একটা কথা মানতেই হবে, অনেক বাংলা সিরিয়াল বা সিনেমার থেকে ঢের ভাল, 'দশ ইয়ারী'-র এই নাটক 'অন্তর্ধান', কারণ ভাঁড়ামী বর্জিত এই নাটক দর্শকদের হাসাতে, আনন্দ দিতে কোথাও কসুর করে নি।

এটা বলা ভুল, যে দর্শক শুধু ট্র‍্যাজেডি দেখতেই বার বার ছুটে যায়। আমি নিজে 'গরুর গাড়ির হেডলাইট' এর হাজার শো এর ওপরের সংখ্যা-র মধ্যে পাঁচটির সাক্ষী। সাক্ষী 'ফ্যাতাড়ু'-র চারটে শো এর ও 'ফুড়ুত'- এর তিনটে শো এর। আশা করব 'দশ ইয়ারী' নাটকটিকে সেই জায়গায় নিয়ে গিয়ে পৌঁছাবে, যেখানে আমি নির্দ্বিধায় বার বার প্রাণ খুলে হাসতে যাব। 'অন্তর্ধান'-এ সব ভুলচুক অন্তর্হিত হবে।

হবেই হবে। হতেই হবে...

তাই দশে কত দেব 'দশ ইয়ারী'-কে, সেটা না হয় কিছুকাল পরেই ভাবা যাবে।





নাটকের লিঙ্কঃ https://www.youtube.com/watch?v=_shVNc_KJ84

** যে ভুলটা ক্ষমার অযোগ্য তা হল, ইউটিউবে নাটকটির ভিডিও-তে লেখাঃ

নিদ্দেশনাঃ সূচিতা রায়চৌধুরী

'নিদ্দেশনা' ও 'সূচিতা' বানান দু'টি সূচিপত্রে চোখে বড় দাগা দিয়ে গেলো গো!!!


No comments: