এ বাবা! না, না! আমি একেবারেই কোনো রাজনৈতিক বিষয়ে প্রবেশ করার প্রতিপাদ্য হিসেবে এমন একটি নামকরণ বেছে নিই নি। এই কথার প্রাথমিক অবতারণার কারণ হল, মানুষ এখন নিঃসন্দেহে judgemental হয়ে পড়েছে। এটা আমাদের দোষ নয়। পরিস্থিতি আমাদের বাধ্য করেছে, নিজের জ্ঞানগম্মি পাশে সরিয়ে রেখে চটজলদি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে। তাতে দু'টি চরম সুবিধা আছেঃ প্রথমতঃ সমস্যার তাৎক্ষণিক দ্রুত সমাধান হয়, দূরবর্তী ফলাফল ব্যতিরেকে, আর মূলতঃ এই ধরণের সিদ্ধান্তে একটা herd immunity তৈরি হয় যেখান থেকে প্রান্তিক কয়েকটি মুষ্টিমেয় মানুষ কি বললেন, তাতে বৃহত্তর সমাজের কি-ই বা যায় আসে! তাঁরা কাঁঠালের আঠা, লাগ্লে পরে ছাড়েন না, এমন শালা পিরীতি, সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে...তাদের কিলিয়ে just পকা পক পাকিয়ে দিলেই হল!
ব্যাপারটা ভারী ও নগ্ন হয়ে যাচ্ছে। ফিলজফিক্যাল আলোচনার গভীরে প্রবেশ করার মত জটিলতার সৃষ্টি হতে চলেছে।কিন্তু বিষয়টি আদপেই একেবারে ভিন্ন, সরল এবং অতি সাধারণ। কেউ অন্য কোনও যোগাযোগ খুঁজে পেলে, তা কাকতালীয় ও ব্যক্তিগত। Infotainment না কি entertainment আপনার 'একান্ত আপন' হাতে!
সেদিন শেষ স্কুলে যেতে হবে। আবার কোভিড ১৯ এর প্রকোপে সরকার বাহাদুর আমাদের রাজ্যে বিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ ঘোষণা করেছেন। পাহাড়-প্রমাণ কাজ জমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। বেতনের রিক্যুইসিশন-ও জমা করা হয় নি। আমার ছেলের এদিকে ক্লাস টুয়েলভের বোর্ড প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা। কোভিড থেকে তাকে দূরে রাখার প্রয়াসে আমি-ই দায়িত্ব নিয়েছি গাড়ি করে তাকে দিয়ে ও নিয়ে আসার। সুতরাং সেই সকালে মরার সময়-ও নেই। মৃত্যু এলেও তাকে একটু দেরীতে আসতে বললে ভাল হয়। ওয়ান ওয়ের চক্করে না ফাঁসার জন্য গাড়ি নিয়ে আকাদেমি অফ ফাইন আর্টস থেকে একটু বিড়লা তারামণ্ডলেরও দিকে এগিয়ে গিয়ে এলিয়ট পার্কের গেটের সামনে এমার্জেন্সী লাইট জ্বালিয়ে 'নো-পার্কিং' এ দাঁড়িয়ে আছি। স্থির বিশ্বাস যে ছেলে আমার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে চলেই আসবে, রোজ যেমন আসে। চেনা ছক। কিন্তু সেদিন যে কি হল...কুড়ি মিনিট কেটে গেল আসে আর না। গাড়ির মধ্যে গরমে স্টীমড হওয়ার থেকে একটু বাইরে এসে নেমে দাঁড়ালাম। বাইরেটা বেশ আরামদায়ক, আর পুলিশ এসে ছবি তুলে নিঃশব্দে কেস দিয়ে দেওয়ার আগে আমি অন্ততঃ দেখতে পাব, ও কথা বলতে পারব। সত্যি কথা বললে ও দোষ স্বীকার করে নিলে, বেশিরভাগ সময়ে ওনারা ছেড়েই দেন। আমার শিক্ষকতার প্রোফাইল অব্দি যেতে হয় না। সময় যেন আর কাটে না। এতটাই অস্হির হয়ে আছি যে গান শোনা বা ওয়েব সিরিজ দেখে খানিকটা সময় কাটিয়ে দেওয়ার মত মানসিক অবস্থা নেই। সিগারেট খেতেও আজকাল আর ভাল লাগে না। বার দুয়েক ছেলের ফোনে ফোন করলাম। একবার 'স্যুইচড অফ' আর দ্বিতীয় বার বেজেই গেল, প্রভু তুললেন না। ওনাদের যেন স্মার্টফোন টা দেওয়াই হয়েছে ফোন হিসেবে ব্যবহারটুকু বাদ দিয়ে।
এই রকম মাথা গরম অবস্থায় সামনে এক মহাপুরুষের আবির্ভাব!
- জ্য় ভোলেনাথ...হমে দো রুপিয়া দে দে বেটা!
এমন হঠাত করে হাঁক পেড়েছে, চমকে উঠেছি। পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে দশ টাকা দিতে যাব, দেখি নেই। একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে বললাম, চল্লিশ টাকা ফেরত দিতে। ওব্বাবা! সে পঞ্চাশ টাকা নোট নিয়ে বাঁ-হাত বের করতেই দেখি, হাতে একটা জ্যান্ত সাপ জড়ানো আর তার মুখে বাবাজী টাকার নোট ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আমাকে ভয় দেখানোর জন্য সাপটাকে হঠাত আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে কি না,
- বোল বেটা, জয় শিব শম্ভু।
আমি নেহাতই এই শিবঠাকুরের চেলা বলে নিজেকে মানি বলে এই দেবতার প্রতি আমার দূর্বলতার সুবাদে দু'টাকার বদলে দশ টাকা দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু এই সাধু আমাকে ভয় দেখিয়ে গোটা পঞ্চাশ টাকাটাই আত্মসাৎ করতে চাইছে। মেজাজ এমনিতেই খাপ্পা ছিল। চোখ বন্ধ করে সাপজড়ানো হাতটাকে আমার দিকে এগিয়ে দিতেই, খপাত! বাবাজি-র হাত থেকে সাপ কেড়ে নিয়ে সোজা গাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। বাবাজি অবাক। কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্থবীর, ছবির মত।
- বেটা ওয়াপিস দে দো! খিলৌনা নেহি হ্যায়! ডস দেঙ্গে তো মর জাওগে। জহরিলা হ্যায়!
ল্যাজ তো নেই, যে দিকের মুখ বন্ধ, সেই দিক ধরে ঝুলিয়ে দিলাম। আর মুখের দিক চেপে ধরে একটা গেঁট। ম্যাজিকের মত সম্মোহিত হয়ে দেখতে লাগল বাবাজি।
ছোটবেলায় মামার বাড়িতে ছোটমামা আর সন্তোষ দা শিখিয়েছিল সাপ কেমন করে ধরতে হয়। লুকিয়ে লুকিয়ে ধরতাম। নিজের রিফ্লেক্স ঠিক রাখার অব্যর্থ অভ্যাস। বাবাজি তো আর বোঝে নি, যে খাপে খাপ হয়ে যাবে। তাও আবার দু-মুখো বেলে সাপ। সাপুড়ে-রা খেলা দেখাতে এলে যে গুলোর গায়ে গেঁট বেঁধে ঝুলিয়ে দিলে অজগরের মত ওরা নিজেরাই খুলে নিতে পারত। শিরদাঁড়ায় খুব জোর। তবে না আছে ফনা, না আছে বিষ। এদের গা-ও অন্য সাপেদের মত অতটা ঠাণ্ডা হয় না।
গেঁট খুলতেই আড়াই-ফুটি মোটা দড়ির মত হাতে পাকিয়ে বললাম,
- চল পুলিশের কাছে।
ব্যক্তিগত ভাবে সাপ রাখা অপরাধের মধ্যে পড়ে। বনদপ্তরের সম্পত্তি এরা সব। আমরা কোথাও দেখতে পেলে, বন দপ্তরকে যেন খবর দিই, ওদের মেরে না ফেলে। দপ্তর থেকে লোক এসে ওদের নিয়ে যত্নের সঙ্গে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দেন। মনে রাখবেন। সাপ বর্তমানে endangered। এরা শেষ হয়ে গেলে আর আলোপ্যাথিক ওষুধ পাবেন না। ওদের বাঁচান, নিজেরা বাঁচুন।
যাক গিয়ে। বাবাজি তো থরথর করে কাঁপে। আর বলে,
- দে দিজিয়ে বাবা! গলতি হো গ্যয়া! প্রভু আপ কা ভ্লা করেগা!
- আমাকে ভয় দেখাচ্ছিলে কেন!
বাবাজি চোখের ইশারা করতেই দেখি একটা গেরুয়া পরিহিত ছেলে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। বয়েস, আমার ছেলের বয়সীই হবে, বা একটু ছোট।
- এ কে?
- মেরা লড়কা হ্যয়।
- আমারো ছেলে এর ই মত।
- বহুত বড়া বনেগা আপকা লড়কা। বাহার বিদেশ যায়গা!
সাপটা ফিরত দিয়ে বললাম,
- আবার বাজে বকছ কেন!
- দো দিন সে ভুখা হুঁ। দোনো হি। কালিঘাট প্যায়দল যা রাহা হূঁ। অগর কুছ খানে কো মিল যায়ে তো। আপ মিল গয়ে।
- দেখতেই পাচ্ছি, আমাকেই সাপ দিয়ে খাইয়ে দিচ্ছিলে এক্ষুণি।
- হম আপসে ঝুট নেহি বোলেঙ্গে। হম ইহাঁ কল্কত্তা সে চলেঙ্গে হরদুয়ার। আপকা বেটা ঔর আপ কে লিয়ে দুয়া মাঙেঙ্গে।... আপ ইয়ে রুদ্রাক্ষ রখ লিজিয়ে। আপকে বেটে কে লিয়ে। ইসসে উসকা ভলা হোগা।
- রুদ্রাক্ষ কি প্লাস্টিকের!
- আপকা বিসওয়াস যো ভি হো, ইসকো খোনা মত। গরীব সন্ত আপ কে লিয়ে জরুর দুয়া মাঙেঙ্গে।
কি জানি রুদ্রাক্ষ-টা হাতে নিয়ে মনে হল, নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী অনেক মানুষকে যতটা পারি সাহায্য করার চেষ্টা করি, এরা তো আমার কাছে সরাসরি সাহায্যই চাইছে, আর প্রাণভরা আশীর্বাদও করছে।
দু-মুখো সাপ আর দু'সাধুর কপালে জুটল দু'শো টাকার নোট।
তাই নিয়েই ওরা নাচতে নাচতে চলে গেল।
দূর থেকে দিনের বেলার ফ্রেমে যেন ধরা পড়ল, সত্যজিৎ রায়ের 'মহাপুরুষ' ছবির শেষ দৃশ্যটুকু।



No comments:
Post a Comment