- #natokreview2021
-
ভাল নাটক থাকলে
আমাকে জানাবি তো! যাব!
- নিশ্চয়ই!!!! তুমি যাবে…? সত্যি?
-
কেন যাব না!
- বেশ তবে সেই কথাই রইল।
-
কিন্তু আমি
ভুলে যাব কাজের চাপে। মনে করানোর দায়িত্ব কিন্তু তোর।
- বেশ। কতদিন আগে?
দু'এক দিন আগে বললেই হবে।
আমি
আগে কোনোদিন ‘অ-পবিত্র’ নাটকটি দেখি নি। শুনেছি, নাকি দারুণ। চন্দন সেনের
নির্দেশনায় যখন, তখন বেশ ভারী হবে বিষয়বস্তু সেটাই স্বাভাবিক। সঙ্গে সব্যসাচী চক্রবর্তীর
মত মানুষ যখন আছেন, তখন ব্যাপারটা খোলতাই না হয়ে যায় না। সব মিলিয়ে এই নাটক-টিকে ‘ভাল’ নাটকের গোত্রে দেখার আগেই ফেলে দিয়েছিলাম। তাই আমি
দায়িত্ব নিয়ে আমার ও আমার বন্ধুর জন্য টিকিট কেটে ফেললাম অনেক আগেই। যে রকম হাই-ভোল্টেজ
নাটক, তাতে পরে টিকিট না-ও পাওয়া যেতে পারে। অনেকটা আগেই কেটে নিয়ে বন্ধুকে জানিয়ে
রাখলাম।
১১ই
ফেব্রুয়ারী, ২০২১, বিষ্যুদবারে লেডি রানু মুখার্জী মঞ্চে শো, সন্ধ্যা ৬ টায়। টিকিট
কাটার সঙ্গে সঙ্গে জানিয়েছি। আবার এক সপ্তাহ আগে জানিয়েছি। গত ৯ তারিখেও জানিয়েছি,
কথামত। মোবাইল ফোনের যুগ হলেও আমার একটা পুরোনো বদ অভ্যাস আছে। আমি যদি কাউকে কোনোদিন
কোনো সময় দিয়ে থাকি, ভুলি না। আর সেই নিয়ে আমাকে বার বার কেউ মনে করিয়ে দিক সেটাও আমি
চাই না। যদি এক মাস আগে কাউকে কোথাও অপেক্ষা করতে বলে থাকি, যদি কোনো খুব গুরুত্বপূর্ণ
কিছু কাজ পড়ে না যায়, বা কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে, তাহলে সে কথা আমি রাখি। অন্যথা হয় না।
মুশকিল হল, আমি হোয়টসঅ্যাপের যুগে যা যা আশা করি তা সত্যিই আউটডেটেড। না হলে কি আর
এত বার বলা সত্ত্বেও নাটকের প্রত্যেকটি শো-এ কারোর না কারোর মোবাইল ফোন বেজে ওঠেই ওঠে!
আমার আজ আশা করাটাই ভুল যে বাকিরাও ঠিক এতটাই নিয়মানুবর্তী হবে, আমার মত। একবার বলা সময় ধরে রাখা আর সেই ব্যাপারে ফোন বা মেসেজ না করে
তা মেনে চলার বিষয়ে।
ফলে
চিত্র গিয়ে দাঁড়াল এই, গত ৯ তারিখে তাকে মনে করানোর পর আর বিরক্ত করি নি কোনোভাবেই।
১১ তারিখে নাটকের শো এর ২০ মিনিট আগে কি মনে
হল যে কোথায় আছে একবার দেখি। ফোন করতে বলে কিনা,
-
এ বাবা…ভুলে গেছি একদম! দাঁড়া আধঘন্টায় আসছি।
কপাল
চাপড়ে ভাবলাম, আমারই ভুল। ইস!!! একবার যদি আজ সকালে মনে করাতাম!
আমি
প্রবেশ দ্বারে অনেকদিনের পরিচিত মাননীয় সজল-দা কে ফিট করলাম নিজের ও বন্ধুর নাম বলে।
অনেকদিনের যাতায়াতের সুবাদে সজলদা আমাকে বললেন,
-
ওনার টিকিট
আমার কাছে রাখার দরকার নেই, ওনাকে আপনার নাম বলতে বলবেন। বাকি দায়িত্ব আমার।
এটাই
কলকাতা। এটাই আকাদেমী। কাঠের চেয়ার বিশেষ আরামদায়ক নয় বটে, কিন্তু স্পন্ডেলোসিস তো
ধরিয়ে দেয় না!
প্রবেশ
পথে লম্বা লাইন। আমি একটু ভিড় কমলে ঢুকব বলে পাশে একটা অন্ধকার জায়গায় দাঁড়ালাম। ছ’টা বেজে গিয়েছে, কিন্তু কাউকে
ঢুকতে দেওয়া হয় নি, তখনও। দেখি পাশে দাঁড়িয়ে আছেন একাই, অভিনেতা পার্থসারথী দেব মহাশয়।
আলাপ হল। নাম্বার দিলেন আমাকে বিশ্বাস করেই। মিনিট পাঁচেক খানিক গল্প-টল্প করার পর
বললেন,
-
চলুন লাইনে
গিয়ে দাঁড়াই।
উনি
তো লাইন ভেঙে ঢুকে যেতেই পারতেন, কিন্তু গেলেন না। আবার ভাবলাম, এটাই কলকাতা, এটাই
আকাদেমী।
নাটক
শুরুই হল খানিকটা দেরিতেই। স্টেজ ভরে অভিনেতা-অভিনেত্রী। নাটকে ‘করাস’ এর ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ, বোঝাই যাচ্ছিল। নাটকের
শুরুতেই নাটকের মধ্যে উপজীব্য কনফ্লিক্ট বেশ পরিষ্কারঃ মানুষের ধর্মান্ধতা, যা বিজ্ঞান
ও যুক্তিবাদকে মানে না। নাটকের আধার করা হয়েছে বাইবেল-কে। দেখানো হয়েছে খ্রীষ্টান-দের
মধ্যে কিছু মানুষ বাইবেলকে আশ্রয় করে ‘ঈশ্বর’ নামের আড়ালে কিভাবে কিছু মধ্যযুগীয় ভাবধারা-কে লালন
করে ধর্মভীরু মানুষদের মধ্যে তা প্রচার করে সমাজের কেন্দ্রবিন্দুতে গিয়ে বসেছেন এমন
ক্ষমতা নিয়ে যে, সেই সমাজ, এমনকি আইন-ও তাঁদের নিয়ন্ত্রণে।
কথন
বাইবেল-কেন্দ্রিক হলেও কোথাও শুরুতেই মনে হচ্ছিল, ‘বাইবেল’ একটি ‘সিম্বল’ মাত্র। যে কোনো দিন, যে কোনো সময়ে তা ‘রামায়ণ-মহাভারত-গীতা’ বা ‘কোরাণ’ অথবা অন্য যে কোনো ধর্মগ্রন্থ হয়ে উঠতে পারে, আমাদের
সকলের সবার এই এত সব অজানা নিয়ে, যা ক্লাস ফাইভের ইতিহাস বই-তেই শেষ। কিন্তু কেউ বিশ্বাস
করবেন না, যে ধর্ম আর সৃষ্টির বিভেদ নেই। না হলে কাজী নজরুল ইসলাম যা শ্যামাসঙ্গীত
সৃষ্টি করেছেন, সৈয়দ মুজতবা আলি যা সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, হিন্দু ফিলসফিকে অবলম্বন
করে তা কোনো বিভেদের কথা বলে না। আরো বাস্তবে নামব? আমি যে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি,
সেখানে সরস্বতী পুজো কমিটির আশি শতাংশ ছাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের। এক বছর খুব টানাটানি।
আমাদের সেই আধা-অশিক্ষিত জনজাতি-ই এসে বলেছিল,
-
স্যার পুজো
হবে না মানে! আমাদের ওপর ছেড়ে দিন।
খাওয়া-দাওয়া
থেকে আরম্ভ করে কোনো কিছুর অভাব রাখেনি।
ঈদে-সিমুই
এনে দিয়েছে, যার বাবা হত-দরিদ্র। আমরা শিক্ষক। শিক্ষা দিই। মা্নুষের চোখ খোলার কাজ
আমাদের। নাটক ও তাই –ই আমি বিশ্বাস করি। আমাদের গ্ল্যামার নেই, নাটকের
আছে। অন্ততঃ আমাদের থেকে অনেক বেশি করে!
‘অ-পবিত্র’ নাটকটির সঙ্গে ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির খুব মিল আছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদ সৃষ্টি করছে ধর্মান্ধতা। সেই বিভেদের শিকড় খুব অজান্তেই গভীরতর হয়ে চলেছে। ফল ভুগছে মানুষ নিজেই। কিন্তু বোধ নেই, যে পৃথিবীর কোনো ধর্ম কখনই মানবতার বিরূদ্ধে উঠে দাঁড়ায়নি, কোনোদিন, বলেও নি।
শুধু ঈশ্বর-কে খুঁজেছে নানা পথ বেয়ে। এসবই এই নাটকে ব্রাডির মত চরিত্রদের বাইবেলের মত পবিত্র গ্রন্থের (আগেই বলেছি বাইবেল একটি সিম্বল মাত্র, এখানে) প্রতিটি শব্দকে নিজের মত একপেশে অনুধাবন করে দুমড়ে-মুচড়ে মানূষের কাছে পরিবেশন করা মাত্র, যা সাধারণ জনগণের বোধশক্তির বাইরে, কারণ বৃহত্তর সাধারণ উচ্চশিক্ষিত ধর্মান্ধ মানুষদের দেবতাজ্ঞানে পুজো করে। তাই ‘অ-পবিত্র’ নাটকের প্রতিপাদ্য বিষয় চিরকালীন হয়ে ওঠে তা প্রমানের মাধ্যমে।
ভরা
কোর্টরুমে মাননীয় বিচারপতি দ্বিধায় পড়ে যান। কারণ তিনি নিজেও কোনো কোনো সময়ে ধর্মান্ধতার শিকার। ধর্মভীরুতা তাঁর যুক্তিকে
পর্যন্ত আচ্ছাদিত কর দেয় মাঝে মাঝে। ঘটনাচক্র ও সূক্ষ্ম যুক্তির লড়াই-এ তিনি ধাঁধায় পড়ে যান ; বুঝে উঠতে পারেন না কোনটা
সত্যি আর কোনটা মিথ্যে। ড্রামণ্ডের ভূমিকায় সব্যসাচী চক্রবর্তী বেশ ভাল। অনেকদিন পর
ওনাকে ‘চার্বাক’-এর বাইরে স্টেজে দেখলাম। তবে বোঝা যাচ্ছে ওনার বয়স
হয়েছে। মাঝে মাঝেই লক্ষ্য করা গেল ডায়লগ আটকে যাচ্ছে। পাকা অভিনেতা বলে ধরতে দিলেন
না। আসলে ওনার ব্যক্তিত্ব আর কণ্ঠের ভার অনেক ছোট ছোট ভুল-চুক-কে অনায়াসে মুছে দিতে
পারে। তাঁর প্রতিপক্ষে ব্রাডির চরিত্রে অসিত বসু-ও ভালই। কিন্তু তাঁর একটা টিপিক্যালিটি
আমার পছন্দ হল না – আরিস্টোক্রেসি বোঝাতে স্পণ্ডোলোটীক হতে হয় না। এই
ট্রেণ্ড যদিও এই নাটকের নাট্যকার ও অভিনেতা চন্দন সেনের, চি্রকালই,- তা যে রকমের চরিত্র-ই
হোক না কেন। আমি অন্তত ছোটবেলা থেকে ওনাকে এরকম-ই দেখে আসছি, ঘাড় ঘোরানোয় আড়ষ্ট উনি।
হয়ত বাস্তবিক-ই কোনো মেডিক্যাল বা কঞ্জেনিটাল সমস্যা হবে, ভেবে দেখি নি, কারণ ওনার
নাটক সম্পর্কে পড়াশোনা বা কোনো লেখা, আজ ও আমাকে ঋদ্ধ করে। কিন্তু ব্র্যাডি-কে এরকম
আড়ষ্ট অভিব্যাক্তিতে মানায় নি। আমি ঠিক বুঝতে পারি নি, খুব সাধারণ একজন দর্শক হিসেবে,
নাট্যকার ও পরিচালক চন্দন সেন মহাশয়ের হর্নবেকের চরিত্রে সারাক্ষণ একটা সিগারেট হাতে
নিয়ে সেটা না জ্বালিয়ে স্টেজে থেকে যাওয়ার গুরুত্ব বা মহিমা কি ছিল! বিবেক হিসেবে পুরো
ঘটনার সাক্ষী থেকে মাঝে মধ্যে দর্শকের মধ্যে একটা মজার মোড়কে সিরিয়াস ডায়ালগ দিয়ে তাদের
ঊন্মেষ ঘটানোর চেষ্টায় তিনি কোনো ত্রূটি রাখেন নি। কিন্তু তাতে দর্শক-কুল খুব যে সাড়া
দিয়েছেন তা নয়। আমি জানি না, এটা বোধ হয় নাটকটির মার্কেটিং এর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা
একটি দিক যে চন্দন সেন যেহেতু নাটকের পোস্টার ক্যারেক্টার এবং তাঁকে ভারী কম্বিনেশনে
দেখিয়ে টিকিট বিক্রি করা হয়েছে, সেহেতু বোধহয় সারাক্ষণ স্টেজে থেকে উনি ব্যাপারটাকে
কস্ট এফিশিয়েন্ট করে তুলতে চেয়েছেন যাতে দ্ররশক পরে না বলতে পারে – ওইটুকু ভূমিকার জন্য অত্ত বড় পোস্টার!!! আর এটা একেবারে সত্যি যে স্টেজ
অন্ধকার হলেই যে হাততালির রোল উঠছিল তা বোধ করি দর্শকদের অন্ধ কর্তব্যবোধ থেকে। আমি,
ব্যক্তিগতভাবে নাটকে এমন একটা আলাদা করে জায়গা পাই নি যা হাততালির যোগ্য।
নাটকের মধ্যে সবথেকে কাঁচা চরিত্র যদি কেউ থেকে থাকে তা হল রেচেল-এর ভূমিকায় তোর্ষা ব্যানার্জী। ওনাকে নিয়ে দলের আমার ভাবা উচিত। এত ভারী নাটকে এতটা সস্তা অভিনয় মানায় না। এত খারাপ অতি-অভিনয় আমি শেষ দেখেছি শিশির মঞ্চে, একটি অত্যন্ত অনামী দলের ব্যোমকেশ নাটকের পরিবেশনে আর দমদম ব্রাত্যজনের ‘দেবদাস’ নাটকে। সহজ কথায় আকাদেমীর স্টেজে রেচেল-কে একজন যাত্রাশিল্পী মনে হচ্ছিল। ‘নটআনন’-এর মত তিরিশ বছরের প্রতিষ্ঠিত দল এ রকম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করার জন্য আর লোক পেল না, তাও বত্রিশ-তম অভিনয়ে! কেউ এ-কথা বলেন নি বোধ হয়।
বোধ হয় চন্দন সেন-সব্যসাচী চক্রবর্তী-র নাটক বলে বলা যাবে না, কারণ তাঁরা এতই বড়, এতই বিশাল যে ভুল করেন না। আমার চোখে যেটা ভুল মনে হচ্ছে, সেটা হয়ত ভুল নয়। নাটক তো! খুব ভারী আর্ট ফর্ম! তাই ব্যাপারটা বোঝার আছে। আসলে হয়ত ওই ‘রেচেল’ চরিত্র-টার লাউড হওয়া-টা খুব জরুরী ছিল, কারণ সিচ্যুয়েশন তাই-ই ডিমাণ্ড করে। আমার কাছে হাস্যকর!
শান্তিলাল
মুখার্জী অনেক দিন ধরে স্টেজে অভিনয় করছেন। ব্রাঊনের চরিত্রে যা অভিনয় করলেন রেচেলের মত দূর্বল চরিত্রের
সঙ্গে, অনেকটাই। বেশ সুন্দর। এর থেকে বেশি কিছু করার ছিল না, শান্তিলাল-এর । ওনার পুত্র
ঋতব্রত মুখার্জী ‘করিক’ চরিত্রদের একজন। কিন্তু তার ‘হাওয়ার্ড’-এর চরিত্রে ছোট্ট অভিনয় অল্প পরিসরে মন কাড়ে। অন্য
সবার থেকে নিজের অভিনেতা হিসেবে পৃথক পরিচয়
সে এইটুকু জায়গাতেই গড়ে নেয়।
সারা
নাটক টি দু’ ঘন্টার-ও বেশি সময় ধরে অভিনীত হল, একই রকম, মোনোটনাস
ভাবে। কোনো ওঠা-পড়া নেই। সবটাই লিনিয়ার বা সরলরৈখিক। সবই খুব প্রেডিক্টেবল। নাট্যকার নাটকটি শেষ করার
জন্য ক্ল্যাসিক্যাল মেথডেই নির্ভর করেছেন। নাটকের তিনটি সংলাপ আমার খুব ভাল লেগেছে
এবং আমার স্থির বিশ্বাস এই তে-পায়ার ওপরেই নাটক-টি দাঁড় করিয়েছেন নাট্যকার।
১। ঈশ্বর মানুষ-কে সৃষ্টি করে নি।
মানুষ-ই ঈশ্বরের স্রষ্টা।
২। দ্বিধা তাঁদের মধ্যেই জন্মায় যাঁরা
প্রকৃতরূপে শিক্ষিত।
৩। ব্র্যাডি মারা যাবার পরে, ড্রামণ্ড
বলছেনঃ কোনো কনফ্লিক্ট-ই রইল না।
শুধু যতটা নাটকের hype, সে পরিমাণে expectations meet করল না, দর্শক হিসেবে, এত ভারী স্টার-কাস্ট নিয়েও।
***বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ দাম্পত্য ও নিপাট প্রেম ছাড়া।




No comments:
Post a Comment