সারারাত্তির…সারারাত্তির…সারারাত্তির…
কিছুই
নয়, শুধু অনেকদিন ধরে স্বভাবদোষে লেখালিখি করার সুবাদে ইচ্ছে হল একটু লিটল ম্যাগাজিনের
মেলায় ঘুরেই আসি। ‘ইচ্ছামতি’ নামক ছোটদের বৃহত্তম বাংলা ঈ-ম্যাগজিনের সম্পাদিকা
মহাশ্বেতা প্রথম আমাকে সুযোগ করে দেন তাঁদের পত্রিকায় লেখার জন্য। তার আগে-পরে নিয়মিত
সংবাদপত্রে লেখালিখি চলছিল। কিন্তু খুব মানিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছিল। যা লিখছি তার অর্ধেক
কেটে-কুটে সাফ করে দিচ্ছেন সাব-এডিটর-রা। অ্যাকিঊট স্পেস ক্রাঞ্চ। ভাল লেখার জায়গা,
যে কোনো মুহূর্তে খেয়ে নিতে পারে ভুল বাংলায় লেখা, আধা হিন্দি-র সব বিজ্ঞাপন। আমি তো
কোন ছার। মাননীয় ডঃ চিন্ময় গুহ-র মত প্রসিদ্ধ
গুনীজন যখন ‘ঘুমের দরজা ঠেলে’-র মত
কলাম লিখছেন নিয়মিত, ‘রোববার’-এর পাতায়। তখন তিনি আমার বাবার সঙ্গে এই একই কথা
দুঃখের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন, আমাদের সালকিয়ার বাড়িতে বসে। একটি অগ্রগন্য বাংলা
দৈনিকে লেখাপড়া সংক্রান্ত যাবতীয় ধরণের লেখা প্রকাশিত হত সেই সংবাদপত্রের একটি বিশেষ
পাতায়। সেই পাতাটির সত্তর শতাংশ গড়ে উঠত আমার হাত ধরে। উঠে গেল। কারণ, পাবলিক বোধহয় ঠিক খাচ্ছিল না। দুটো শাহ্রুখ-আমীর-সলমান
বা ক্যাটরীনা-কাজল-দীপিকা-আলিয়া-দের ছবি দিয়ে, তাঁরা কি খান, রাতে কোন পাশ ফিরে শুয়ে
থাকেন, শেষ কার সঙ্গে এঁদের ডিনার/ডেট হয়েছিল, ট্যুঈটারে কে কি বললেন, সে সব লেখাপড়ার
থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া সংক্রান্ত যে সব সমস্যা
আছে, তার সমাধানের জন্য প্রাইভেট টিঊটর (যেখানে চটি-জুতো রাখার জায়গা পাওয়া যায় না)
বাদ দিয়েও রায় অ্যাণ্ড মার্টিন বা ছায়া প্রকাশনী তো আছেই।সংবাদপত্রে এসব লেখাপড়া-র
পাতা –টাতাকে পাত্তা দেওয়া অযৌক্তিক। তাই পাতাটাই তুলে
দেওয়া হল। শিক্ষা কোনো এক শ্রেণির কাছে আজ বহুমূল্য হলেও তা বেশির ভাগ মানুষের কাছে
প্রান্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন, তার উত্তর দিতে গেলে মুস্কিল আছে। যেমন মুস্কিলের
খবর--লিটল ম্যাগাজিন মেলায় কবি-সাহিত্যিকদের আমন্ত্রিত হওয়া ও না-হওয়ার হাওয়ায় তাঁরা
দ্বিধাবিভক্ত হয়ে একে অপরের দিকে শব্দের কাদা-ছোঁড়াছুড়ি করছেন। কবি তো,! শব্দ নিয়েই
তাঁদের খেলা! সে কাদা ছোঁড়াছুড়িতেই হোক না কেন! কবে না কোনো পক্ষ বলে ওঠেন, “এ হল ‘post-modern hungrealism’…আপনি ঠিক বুঝবেন না”। গত রবিবারে একটি নাটক দেখলাম, তাতে বলা হচ্ছে বার বার – জানার চেষ্টা কোরো না…সে ভার কিন্তু অনেক কিছু নষ্ট করে দেবে…। খুব সত্যি। সদ্য শিখেছি অতি আধুনিক fibre
optics কিন্তু x-ray-তে ধরা পড়বে না। সব OTT
(over-the-top) প্ল্যাটফর্ম একসঙ্গে
প্যারেড করবে, অদৃশ্যমান হয়ে। নীরেন চক্কোত্তির নিষ্পাপ শিশুর নিজের কাপড় এমন ভিজে
যাবে, লজ্জায় ও শঙ্কায় যে আর সে রাজপথে বেরোবে না জিজ্ঞেস করতে, “রাজা তোর কাপড় কোথায়”?
এ
হেন পরিস্থিতিতে যে একটা লিটল ম্যাগাজনের মেলার আয়োজন করা গিয়েছে এই তো অনেক। ‘দর্পণ’, ‘একুশ শতক’ ও ‘ভূমধ্যসাগর’ এই কয়েকটি
লিটল ম্যাগাজিনের ঈ-পত্রিকায় আমি লিখি। এম সি সরকার প্রকাশিত ‘মৌচাক’-এরও আমি নিয়মিত লেখক।কিন্তু ‘মৌচাক’ লিটল ম্যাগাজিন নয়, লিটল-দের জন্য অতি পুরাতন ও
ঐতিহ্যশালী বাংলা ম্যাগাজিন। কিছুদিন আগেই তার কর্ণধার, অত্যন্ত ভাল মানুষ, সমিত (সরকার)-বাবু
আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন চাঁদের পাহাড়ে, অকস্মাৎ-ই। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি!
এঁদের সকলের মধ্যে দর্পণীদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে কাছের। কিছুক্ষণ দর্পণীদের
সঙ্গে কাটিয়ে, ছেলের জন্য একটা কুড়ি-টাকার তালপাতার সেপাই কিনে ঘোরাতে ঘোরাতে সেই রাত্তিরে-র
জন্য ‘সারারাত্তির’ নাটকের
টিকিট কেটে ফেললাম, আকাদেমীর রানু মুখার্জী মঞ্চে।
Third Bell – এর তালিকায় এই নাটক-টা কোথাও ছিল না – ‘সারারাত্তির’। দুই
নট, এক নটী, কাঞ্চন- অরূপ ও তিতাস। সময়, দশ মিনিটের বিরতি সমেত দু’ঘন্টা-র মত। নাম শুনে ভাববেন না ফেলনা কিছু। কারণ, বাদল চট্টোপাধ্যায়
দুদ্ধর্ষ ও বর্ষীয়াণ নাট্যকার সঙ্গে সোমনাথ
মুখোপাধ্যায়ের মত অভিজ্ঞ পরিচালক। ‘নান্দীরঙ্গ’ নাট্যদল
হিসেবে খুব সুপরিচিত না হলেও যা পরিবেশন করেন তা নেহাত ফেলনা নয়। গ্ল্যামার কম বলে
হয়ত বয়সোচিত অভিনেতা মেলে না, কিন্তু যাঁরা সেদিন এই ‘সারারাত্তির’ নাটকে রানু মুখার্জী মঞ্চে খান আশি দর্শককে টান
করে বসিয়ে রাখলেন শুধু ডায়ালগের জোরে, তা প্রশংসার অপেক্ষা রাকে বৈ কি!
মঞ্চভাবনা,
সজ্জা, শব্দ সংযোজনা নির্ভুল। কিন্তু নাটকের স্ক্রিপ্ট এতটাই জোরালো আর ধারালো যে সে
সবের অপেক্ষায় নাটকের ওঠা-পড়া নেই বিশেষ। সবটাই ডায়ালগ-ধর্মী।কস্টিউম ও খুব একটা গুরুত্বপূর্ন
নয় কখনই। সে সব অনুষঙ্গ ব্যতিরেকেই নাটক নির্মেদ ভাবে চলতে থাকে, রোমহর্ষক হতে থাকে
কথোপকথনের মাত্রা। সরল জিনিষ জটিল হতে থাকে ধীরে ধীরে। অজগরের মত গ্রাস করে নিঃশব্দে, সব দর্শকদের। এমন সব মাথা ঘোরানো ডা্যালগ
আছে যার বোধ গভীর । ভীষণভাবে আপাত সুখী, আইডিয়াল
বলা চলে এমন অতি সাধারণ দাম্পত্য জীবনের মূল-কে ধরে নাড়া দেয়।পরস্পর-কে ‘চেনা-জানা’ শব্দবন্ধের অর্থ কি তা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেয়।
অন্ধকারে আলো খোঁজা মানুষদের আলো পাওয়া কে
সমাজ কিভাবে আমাদের সবথেকে কাছের মানুষকে এক লহমায় কয়েক কোটি আলোকবর্ষ দূরে একটি কৃষ্ণগহ্বরে নিয়ে নিক্ষেপ করে, যেখান থেকে
never-to-return
for eternity একটা যাত্রা শুরু হয়,
তা লক্ষনীয়। এই যাকে ভালবাসায় ভরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, সে কী করে স্বপ্নসন্ধানী হওয়ার দোষে
একজন নীচ মানুষ রূপে প্রতিভাত হয়ে ওঠে, সবথেকে কাছের মানুষের কাছে, তা সত্যি-ই ‘পরস্পর-কে সবথেকে বেশি চিনি বা জানি’ এই সর্বগ্রাহী
প্রেমতত্ত্বের সাধারণ ধারণা-কে খন্ডণ করে। সব দেখে শুনে প্রশ্ন ওঠে -- তবে আমরাও কি
‘কাচের ঘর’ এ বাস করি? “ঘর ভাঙা
অত সহজ নয়”, নাটক বলছে। কাচ একবার ভাঙলে আর জোড়া লাগে না, বলা হয়। প্রশ্ন ওঠে, সম্পর্ক কাচের ওপর ভিত্তি করে কেন
দাঁড়িয়ে ছিল এতদিন? শক্ত জমির ওপর দাঁড়ালেও তো এ রকম ভাবে ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনাই থাকে
না।
মজাদার ব্যাপার হল, এরকম একটা সিরিয়াস গল্পকে প্রথমে একটি ভূতের গপ্প বলে মনে হতেই পারে, কারণ আবহ সেরকমই। প্রটাগনিস্ট বৃদ্ধ বাড়ির মালিক, যেন এক প্রেত। তিনি বিবেকের রূপ ধারণ করে এক সুখী দম্পতির মধ্যে বিভেদ আনার চেষ্টা করছেন--এরকম মনে হতে পারে। শুরুর দিকে কিছু অংশ রিপিটিটিভ ও একঘেয়ে মনে হতে পারে। আস্তে আস্তে যখন rising of action- এ সব পাকিয়ে গুলিয়ে জট পাকতে থাকে, তখন কোথাও অতি সাধারণ দর্শকের মাথায় ওই ফেলে আসা একঘেয়ে রিপিটিটিভ সিকোয়েন্সের অনুরণন ঘটতে থাকে। বোঝা যায় সহজেই, কেন অতিরিক্ত জোর দেওয়ার উদ্দেশ্যে ওই রিপিটিশন ছিল। আর সেগুলোকে একঘেয়ে মনে হবে না। কারণ সেই পরমানু গুলো সজ্জিত হচ্ছিল ফিশন বিস্ফোরণের জন্য। সেই বিস্ফোরণের আলোকে উদ্ভাসিত হবেন নায়িকা। আবিষ্কৃত হবে মনের মানুষ “রঞ্জন”, যার হাত ধরে বোঝা যাবে, জানা যাবে ‘সুখ’ আর ‘আনন্দ’-র মধ্যে যে মহাজাগতিক পার্থক্য আছে তার। প্রসঙ্গতঃ বলে রাখা ভাল, আলোক প্রক্ষেপণ এই নাটকে শুরুতে যে ভৌতিক পরিবেশ তৈরী করেছিল তা একবার ভেঙ্গে যাওয়ার পর, আর বাকি সব অনুষঙ্গের মতই, তা ভূমিকাহীন হয়ে যায়। একমাত্র আলোর সাঙ্কেতিক অর্থ ধরা যায় নায়িকার স্বপ্নের “রঞ্জন” যখন বাস্তবে তার মনে উদ্ভাসিত হয়, ধরা দেয় অবশেষে তার কাছে। বাকি আলোক প্রক্ষেপণ শুধু স্টেজ আর দর্শকের পার্থক্য নিরূপণের উদ্দেশ্যে।
“রঞ্জন” সেই সালোকসংশ্লেষের সবুজ ক্লোরোফিল, যা সব পেরিয়ে
মানুষের প্রেম-কে স্বভোজী করে তোলে। সব ভেঙ্গে প্রানে ‘আনন্দ’ আনে। জানতে হবে বুঝতে হবে, ‘আনন্দ’ পেতে গেলে, ‘সুখ’ বিসর্জন দিতে হয়। আনন্দ’ ও সুখ’ শব্দ-দুটি ব্যাকরণগতভাবে ও অভিধানে সমার্থক হলেও
বাস্তবে তা নয়। ক্ষণিকের ‘আনন্দ’ সারাজীবনের ‘সুখ’ কেড়ে নিতে পারে। ‘আনন্দ’-লাভের বীজ সেই চরম সত্য-তে নিহিত আছে। They are
conflicting, contradictory and sometimes antonymous in nature.
প্রতিটি
আপাত-দৃঢ় সম্পর্ক দাঁড়িয়ে আছে ‘সুখ’-এর বাঁধুনিতে। তফাতে থাকুন ‘আনন্দ’-এর। যে কোনো মুহূর্তে সে এই বাঁধন ছিড়ে দিতে পারে।
‘রঞ্জন’ বৃদ্ধ, কারণ সে অভিজ্ঞতায় পূর্ণ এবং অমর। তার কাছ
থেকে প্রত্যাশা-ও ভুল। কারণ সে বাঁধা পড়ে না। একবার ধরা দিয়ে আনন্দের জীয়ণকাঠি ছুঁয়ে
দেয় শুধু। কত মানুষ শুধু রঞ্জনের আশাতেই সারা জীবন কাটিয়ে দেয়, পায় না। যারা পায়, তারা
কি…? দর্শক বিচার করুক।
ডায়ালগের
ওভারল্যাপিং আছে। জটিল ডায়ালগ উলটে যাওয়ার প্রবণতা আছে। আর আছে মূল বৃদ্ধের চরিত্রের
ডায়লগ ডেলিভারি-তে দেবশঙ্কর হালদার টিপিক্যালিটির স্পষ্ট ছাপ। নাটকের নায়ক-নায়িকা দম্পতির
বয়স অভিনেতাদের আসল বয়েসের সঙ্গে মেলে না। এই সব বিচ্যুতি কাটিয়ে উঠলে, ‘সারারাত্তির’ জনমানসে অনেক বেশি জনপ্রিয় নাটক, ভারী তারকাখচিত,
একটি একটি করে চরিত্রের মুখোশ-খসানো নাটক ‘থানা থেকে আসছি’-কে চ্যালেঞ্জের
মুখে ফেলে দিতে পারে।
‘সারারাত্তির’-এর প্রতিধ্বনি
আমাকে আনন্দ দিল না সুখ দিল, তা সময়ের হাতে ছেড়ে দিলাম। দেখি, প্রতিধ্বনি অনুরণন হয়ে
আমার স্মৃতিস্তভে কতটা দাগ কাটতে পারে।


No comments:
Post a Comment