Sunday, 28 February 2021

কফি হাউসের আড্ডায় নিখিলেশ (স্যর)

 

নিখিলেশ প্যারিসে

মঈদুল ঢাকাতে

নেই তারা আজ কোনো খবরে

গ্র্যাণ্ডের গিটারিস্ট গোয়ানিজ ডিস্যুজা

ঘুমিয়ে আছে কোনো কবরে

আর্ট কলেজের ছেলে

নিখিলেশ সান্যাল

বিজ্ঞাপনের ছবি আঁকত…”



কফি হাউস- কলেজ স্ট্রীট

 

শেষ যেদিন কফি হাউসে গেলাম প্রায় দেড় বছর পরে, এই লাইনগুলো মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ এটা আলাদা করে বলার কিছু নেই, কারণ যে কোনো বাঙালী, আর কিছু জানুক না জানুক, জীবনের কোনো না কোনো সময়ে এই গান-টি মান্না দে-র কন্ঠে শুনেছে এবং কফি হাউস জায়গাটি যে একটি বিশ্ববিখ্যাত কালচারাল হাব তা নিয়ে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রাখেনি। কফি হাউসে গেলে যে ওই গানের লাইন মনে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। তার মধ্যে নতুন কিছু নেই। তবে কি নতুন তা বলি।

 

আমাদের ঝাউতলার স্মোক হাউসে বছর তিনেক আগে দিগন্ত (রোজ সকালে মীর-এর কাছে অনবদ্য সেনস-অফ-হিউমর নিয়ে হাওড়া থেকে দিগু নামে বহুদিন ধরে পরিচিত ছিল)তার গোল্ড ফ্লেকে টান দিয়ে আমাকে বলল,

-কফি হাউসের নিখিলেশ স্যার কে চেনো?

প্রসঙ্গ, হাওড়ার ট্যালেন্ট গঙ্গা পার না হলে পরিচিতি পায় না। ব্যতিক্রমী নারায়ণ দেবনাথ, ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় ও হাতে গোনা কয়েকজন।

-সে আবার কি!! গানে তো ওরকম কত লোকের নাম থাকে। সব-ই তো কাল্পনিক!

-  বললাম তোমাকে। তোমার জন্য খনি। খুঁড়ে বের কর।তোমার ইস্কুলের কাছেই। আর এখান থেকে সাইকেলে পনেরো মিনিট। ক্ষীরোদতলার গলির কাছে। নিখিলেশ স্যার ফিকশন নন। একদম বাস্তব।

 


সময় নষ্ট করলাম না।ফোন নম্বর যোগাড় করে ওনার সময় চাইলাম। দিলেন। ক্ষীরোদতলার কাছে পঞ্চাননতলা রোডের ওপর একটি ফ্ল্যাটে উনি থাকেন। এলাকায় পরিচিত নাম। আমাকে কোনো বেগ পেতে হল না ওনার ফ্ল্যাট খুঁজে পেতে। দরজা খুলতেই এক দুরন্ত মহিলা আমাকে আপ্যায়ণ করে বসালেন। মিসেস নিখিলেশ।বয়স পঁয়ষট্টি হবে। বাংলা বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষিকা। অধ্যক্ষা হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন। ঘরে ভীষণ একটা বোঁটকা গন্ধ।এতটাই উগ্র সে গন্ধ যে আমার খাপ খাওয়াতে সময় লাগবে, বুঝলাম। মিসেস নিখিলেশ আমার কাচে ক্ষমা চেয়ে নিলেন ঐ গন্ধের জন্য। বাড়িতে একটি অতি বৃদ্ধ কুকুর আছে। সে এক অদ্ভুত রোগে ভুগছে। অনেক চিকিৎসক দেখানো হয়েছে কিন্তু কোনো সুরাহা হয় নি। সারা গায়ে ঘা। ওষুধ আর ঘা-এর দুর্গন্ধ মিশে এই অদ্ভুত গন্ধের সৃষ্টি।

 

-আমরা মন থেকে এই অসুস্থ কুকুরটিকে ফেলতে পারি নি। এভাবে কাউকে জীবিত অবস্থায় ফেলে দেওয়া যায় না।

 

ওনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সাহিত্যের আলোচনায়, বর্তমান শিক্ষার পরিস্থিতির কাটা-ছেঁড়ায় এতটাই মশগুল হয়ে গেলাম যে ভুলেই গেলাম যে আমি ওনার সঙ্গে নয়, নিখিলেশ স্যারের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।  

সাতটা থেকে প্রায় আটটা, আমি জিজ্ঞেস করলাম,

-স্যার কখন আসবেন?

-ওর কথা আর বোলো নাস্টুডিও-টাকে সাজাচ্ছে আবার। এই বয়সে।কোনো মানে হয়!

-স্টুডিও-টা কোথায়?

-বেলিলিয়াস লেনের মুখে, পুরোনো বাড়িতে।

- আমি কি তবে ওখানে চলে যাব? একটুখানি তো এখান থেকে!

- তুমি বসো, আমি দেখছি।

মোবাইলে ফোন করলেন।

-কি ব্যাপার তোমার? আর্য-কে যে সময় দিয়েছ গল্প করবে বলে.... তা ও আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে?

অন্যদিক থেকে কি উত্তর এল তা বুঝলাম না।

-হ্যাঁ তুমি এস। শিগগির।

আমার দিকে ফিরে বললেন,

-চলে এসেছে বলল। আর পাঁচ মিনিট। মনে আছে ওর, তোমাকে যে সময় দিয়েছে। কিন্তু আটকে গিয়েছে।

আমি মনে মনে ভাবলাম, আমার এরকম গুনীজনের স্নেহধন্য হয়ে আটকে থাকতে কোনো আপত্তি নেই। প্রতি পদে শেখার, জানার, ওনাদের কাছ থেকে।

দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন একজন সত্তর পেরোনো সাদা চুল-দাড়িতে ঢাকা শুভ্রকান্তি মানুষ।খুব আস্তে আস্তে কথা বলেন।

-আমার বড্ড দেরী হয়ে গেল, তাই না! কিছু মনে কোরো না ভাই আর্য। আমি কিন্তু দর বাড়াতে ইচ্ছে করে দেরী করিনি।

বলে নিজেই স্মিত হেসে আমার পাশে এসে বসলেন।

-   বল কি জানতে চাও।

-   আমি কিন্তু স্যার নেহাতই গল্প করতে এসেছি। আমি পেশাগত ভাবে ইস্কুল শিক্ষক। আর নিজের শখে কিছু কাগজ-পত্রে লেখালিখি করে থাকি।

-   কেন? টিঊশন পড়াও না?

-   না স্যার। ছোটবেলা থেকে স্বাধীন জীবনের স্বপ্ন দেখেছি। আমার পেশার প্রতি আমি একশ শতাংশ কমিটেড থেকেও টিঊশন না পড়ানোর জন্য, নিজের শখ-সাধ-আহ্লাদ সব বজায় রাখতে পেরেছি। একান্ত পেটের টান না পড়লে টিউশন আমি পড়াব না বলেই স্থির করেছি। নিজেই নিজের রাজা হয়ে দিব্বি চলে তো যাচ্ছে।

-   সাব্বাশ। চালিয়ে যাও।

-   যা জানার জন্য আমি উন্মুখ হয়ে আপনার কাছে ছুটে এলাম, তা হল আপনি-ই কি সেই নিখিলেশ যার কথা আমরা মান্না দে-র কফি হাউসের সেই আড্ডাটা গানে শুনে এসেছি?

-    একেবারেই তাই।

-   আপনি-ই যে তিনি সে বিশ্বাস আপনার হল কি করে? কফিহাউসে তো অনেক নিখিলেশ থাকতে পারে।তাই না।



একটু-ও রেগে না গিয়ে বললেন,

-   তবে শোনো, বলিষাটের দশকের গোড়ার দিক। অরুন বোস, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, পি আচার্য এক্ষণ পত্রিকার সম্পাদক, সবাই মিলে আড্ডা হত। আমরা যেখানে বসতাম তার পাশে, দরজা দিয়ে ঢুকেই ডানদিকে দুটি চেয়ারে বসত শক্তি-সুনীলপুলক (বন্দ্যোপাধ্যায়) আর দেবাশিষ ব্যানার্জী ছিল আমাদের দলের বন্ধু।তবে ওরা নিয়মিত আসত না। বিলাল চৌধুরী-ও আমাদের দলের বন্ধু। তা ১৯৬৪ সালে হঠাৎ পুলক-দা এই কফি হাউস গানটা বাঁধল। তখন আমি শহরে নেই। দিল্লি-তে গিয়েছি আনিমেশন শিখতে। আর সেখানেই যত গন্ডগোল।সমাপতন গানের ক্ষেত্রে আর আমার নিজের কাছে ফ্যালাসি। প্যারিস থেকে ডাক পেয়েছিলাম চিঠিতে। সেটা কফি হাউসের আড্ডায় সবাইকে জানিয়েছিলাম।১৯৬৩ সালে পান্নালাল ইন্সটিটুশনে ১৬৭ টাকা মাইনের চাকরিতে যোগদান করি, ৫ টাকা ডি-এ। যা পেতাম তা থেকে বাড়িভাড়া দেওয়ার পর যেটুকু বাঁচত, তা খরচ করতে পারতাম না। কিন্তু তা আমার প্যারিস যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাই আর সেখানে যাওয়া হল না। সেটা আর কফি হাউসের কাউকেই জানানো হয় নি। ভাগ্য সেই সময়ে আমাকে দিল্লি-তে টেনে নিয়ে গেল। কফি হাউসের সবাই ভাবল, আমি বোধ হয় পাহ্রী মানে প্যারিস পাড়ি দিয়েছি।সেই সূত্রে গানটির কয়েকটি ছত্র আমাকে নিয়ে বাঁধা হয়েছিল।


গানের মধ্যে মইদুল ঢাকাতে…’-র মইদুল আর কেউ নন, বিলাল চৌধুরী স্বয়ং। গ্র্যান্ডের গিটারিস্ট গোয়ানিজ ডিস্যুজা সত্যিই একটি খ্রীস্টান গোয়ানিজ ছেলে, নাম মনে পড়ছে না, কারণ ও মাঝে মাঝে আড্ডায় আসত । ট্রিঙ্কাস-এ গিটার বাজাত আসলে। আমার সঙ্গে সময়ের মিল না হওয়ায়, হাতে গোনা কয়েকবার মাত্র সাক্ষাত হয়েছে। ১৯৬৬ সালে আবার ফিরত আসি কলকাতায়। দিল্লির স্প্রিং ডেল স্কুলের পার্মানেন্ট চাকরী, ৩৫০ টাকা মাইনে, সঙ্গে দেড়শো টাকায় ফ্ল্যাট, আটাচড বাথরুম সমেত, আমার কাছে অনেক বেশি পাওয়া। কিন্তু পারলাম না, টিঁকতে। আঁকার রসদ পাচ্ছিলাম বটে, কিন্তু মন ভরছিল না। ওখানেও আর্টিস্টস সোসাইটি ছিল। সুনীল দাস, জে-ডি টাইলার, ধীরাজ চৌধুরী-র মত মানুষরা ছলেন তার সদস্য। সবার কাছ থেকে অনেক কিছু নিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরলাম।



শুধু ছবি এঁকে যে পেট চলে না, তা আমার থেকে বেশি কেউ জানত না, বোধ হয়। কলকাতা তথা পৃথিবীবিখ্যাত স্কুল তখন সাউথ পয়েন্ট স্কুল। ১৯৭০ সালে সেখানে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। যে কাজটি প্রথমেই করেছিলাম তা হল, আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট বিষয়টিকে ক্লাস এইট অর্থাৎ আপার প্রাইমারী লেভেল পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করা।

১৯৭৩ সালে প্রথম ব্যক্তিগত এক্সিবিশন করি। নিমন্ত্রণ পত্র লিখেছিলেন কমলকুমার মজুমদার স্বয়ং। কাজ করে চললাম, থামলাম না।

-এই বয়সে নিজেকে এরকম সুস্থ রেখেছেন কি করে?

-সুস্থ?

আমার পিঠ চাপড়ে বললেন,

-১৯৯৩ সালের ২৪ সে ডিসেম্বর। হার্টে সাত-খানা ব্লক। চারবার বাইপাস, দুবার রিপেয়ার,স্টেন্ট, কিছু বাকি রইল না।

আমি অবাক। এরপর কতটা মনের জোর থাকলে মানুষ কাজ করে যেতে পারেন।জিজ্ঞেস করে ফেললাম, কি করে পারেন!!!


-বোধ হয় ১৯৭১-৭২ এর নকশালদের প্রভাব আমার মনে ছাপ ফেলেছিল, বেশ গভীর ভাবে। পরে বুঝেছিলাম, সেই অভিজ্ঞতা আমাকে মানসিকভাবে কতটা কঠিন করে দিয়েছে, সৃষ্টির ক্ষিদে কিভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। জীবনের অন্যতম শক্তি যে শিল্প সৃষ্টির মধ্যে নিহিত আছে, তা আমার মনের মধ্যে এতটাই বিশ্বাস গড়ে তুলেছিল, যে তা আজও  আমাকে আমার পথ থেকে বিচ্যুত হতে দেয় নি।

-আপনার শিল্পচেতনাকে কোন ধরণের মধ্যে ফেলবেন?

-আমি অত নাম-ধাম নিয়ে চর্চা করি না। পৃথিবীর সমস্ত শিল্পীর প্রথম চাহিদা হল, সে একটি নিজস্ব কিছু তৈরী করবে। আর সেটাই হবে তার একমাত্র পরিচিতি। সেই ইউনিকনেস সবাই গড়তে পারে না। অন্যান্য শিল্পীদের প্রভাব থেকেই যায়। সবাই কি আর পাবলো পিকাসো, না কি ভ্যান খগ!

- হ্যাঁ,আপনার ছবি দেখে আমার মনে হয়েছে, পিকাসো-খগ-যামিনী রায়ের এক অদ্ভুত মিশেল।


- আধুনিক অঙ্কন-শিল্প এনাদের ছাড়া অসম্পূর্ণ।

- আপনাকে কোথাও একটা জ্যামিতি টানে।

- দ্য ভিঞ্চি-র অব্জেক্টিভ সাবজেক্ট জিওমেট্রি এক চিরন্তন সত্য যাকে উপেক্ষা করার কোনো জায়গাই নেই। পিকাসো সেটিকে নিজের মত দুমড়ে মুচড়ে যা করেছেন, তা পরম জ্যামিতি।

-সঙ্গে ইম্প্রেশনিসম

-একদম ই ঠিক বলেছ।

- আমাকে আপনার কালেকশনে যে পিকাসোর বই আছে পড়তে দেবেন?

- এ সব বই আর পাওয়া যায় না। তোমাকে এসে, এখানে বসে পড়তে হবে।

- আমি রাজি। আপনার আঁকা ছবির কপি পেতে পারি?

- ওঠ দেখি।


উঠলাম। খাটের নিচ থেকে বেরোলো এক বিশাল ট্রাঙ্ক। তা থেকে বেরোল একটি লিগাল মাপের সাইজের বাদামী খাম।

-   এই নাও তোমার জন্য। খুলে দেখ।

খুলে দেখলাম নিখিলেশ স্যারের আঁকা সেরা ছবিগুলোর একটি অনবদ্য সংগ্রহ, পোস্টার ফর্মে।

পায়ে হাত দিয়ে ওনাকে প্রণাম না করে পারলাম না।

 

-   বল, আর কোনো প্রশ্ন আছে তোমার?

-   হ্যাঁ, শেষ কবে কফি হাউসে গিয়েছেন?

-   শুনেছি রেনোভেশন হয়েছে।তার আগে শেষ গিয়েছিলাম।

-   কেমন লাগল? একা একাই কফি খেলাম। ব্ল্যাক কফি। কফি ঊইথ ক্রীম খাওয়া বারণ। সব একই রকম আছে। আড্ডা-টা নেই

-   কেউ চিনল আপনাকে?

-   খুব পুরোনো দু-জন বেয়ারা।


-   কেমন লাগল?

-   এই যে গেলাম, বেশ মজা হয়েছে মনে মনে যে যুবক বৃদ্ধ হয়েছে

-   কফি হাউস, সেই গান, আপনার নিখিলেশ দাস থেকে নিখিলেশ সান্যাল হয়ে ওঠা, এই নিয়ে এক কথায় কিছু বলতে চাইবেন?

-   কিছুতেই কিছু হয় না/ বাঁধাগুড়ির ময়ণা কামাক্ষা (চট্টোপাধ্যায়)-র লেখা দুলাইন। তুমি বুঝে নিও, নিজের মত করে।

 

এখন যখন ফেসবুকে দেখি কফিহাউসের নিউটাউনে কি বাড়-বাড়ন্ত, অনলাইনে সিট বুক করতে হয়, মনে হয় শিল্প যেন তার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবছে, কফি হাউস দৌড়চ্ছে, ইন্টেলেকচ্যুয়াল ছাপ বা ব্র্যান্ড-ইমেজ বেচে, আমি শিল্প নামক বস্তুটি ভিক্ষা মাগিয়া ফিরি, দাদা আমাকে বাঁচাতে দুটো পয়সা দিবে গো!

 


গত দুবছর ধরে নিখিলেশ স্যার শয্যাশায়ী। তাঁর কাজ থেমে গিয়েছে। আগামী মঙ্গলবার সকাল নটার সময়ে এই অবস্থাতে আমাকে সময় দিয়েছেন।

 

ধন্য আমি ধন্য হে, পাগল তোমার জন্য যে…”

(আবার ধার করতে হল, পুলক-কাকুর লেখা গানের লাইন। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়  হাওড়ার সালকিয়া নিবাসী ছিলেন। ছিলেন আমার বাবার অন্তরঙ্গ বন্ধু। প্রতিবছর পূজোর সময়ে তিনি মুম্বাই থেকে শ্রী রাম ঢ্যাং রোডের পৈত্রিক রাজবাড়িতে আসতেন। আমি বাবার সঙ্গে যেতাম। সেই সূত্রে তিনি আমার কাকু।)

 

 

 

 

x

Monday, 15 February 2021

অ-পবিত্র পবিত্রবা...

 

-         #natokreview2021

-         ভাল নাটক থাকলে আমাকে জানাবি তো! যাব!

-         নিশ্চয়ই!!!! তুমি যাবে? সত্যি?

-         কেন যাব না!

-         বেশ তবে সেই কথাই রইল।


-         কিন্তু আমি ভুলে যাব কাজের চাপে। মনে করানোর দায়িত্ব কিন্তু তোর।

-         বেশ। কতদিন আগে?

দু'এক দিন আগে বললেই হবে।

আমি আগে কোনোদিন অ-পবিত্র নাটকটি দেখি নি। শুনেছি, নাকি দারুণ। চন্দন সেনের নির্দেশনায় যখন, তখন বেশ ভারী হবে বিষয়বস্তু সেটাই স্বাভাবিক। সঙ্গে সব্যসাচী চক্রবর্তীর মত মানুষ যখন আছেন, তখন ব্যাপারটা খোলতাই না হয়ে যায় না। সব মিলিয়ে এই নাটক-টিকে ভাল নাটকের গোত্রে দেখার আগেই ফেলে দিয়েছিলাম। তাই আমি দায়িত্ব নিয়ে আমার ও আমার বন্ধুর জন্য টিকিট কেটে ফেললাম অনেক আগেই। যে রকম হাই-ভোল্টেজ নাটক, তাতে পরে টিকিট না-ও পাওয়া যেতে পারে। অনেকটা আগেই কেটে নিয়ে বন্ধুকে জানিয়ে রাখলাম।

১১ই ফেব্রুয়ারী, ২০২১, বিষ্যুদবারে লেডি রানু মুখার্জী মঞ্চে শো, সন্ধ্যা ৬ টায়। টিকিট কাটার সঙ্গে সঙ্গে জানিয়েছি। আবার এক সপ্তাহ আগে জানিয়েছি। গত ৯ তারিখেও জানিয়েছি, কথামত। মোবাইল ফোনের যুগ হলেও আমার একটা পুরোনো বদ অভ্যাস আছে। আমি যদি কাউকে কোনোদিন কোনো সময় দিয়ে থাকি, ভুলি না। আর সেই নিয়ে আমাকে বার বার কেউ মনে করিয়ে দিক সেটাও আমি চাই না। যদি এক মাস আগে কাউকে কোথাও অপেক্ষা করতে বলে থাকি, যদি কোনো খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ পড়ে না যায়, বা কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে, তাহলে সে কথা আমি রাখি। অন্যথা হয় না। মুশকিল হল, আমি হোয়টসঅ্যাপের যুগে যা যা আশা করি তা সত্যিই আউটডেটেড। না হলে কি আর এত বার বলা সত্ত্বেও নাটকের প্রত্যেকটি শো-এ কারোর না কারোর মোবাইল ফোন বেজে ওঠেই ওঠে! আমার আজ আশা করাটাই ভুল যে বাকিরাও ঠিক এতটাই নিয়মানুবর্তী হবে, আমার মত। একবার বলা  সময় ধরে রাখা আর সেই ব্যাপারে ফোন বা মেসেজ না করে তা মেনে চলার বিষয়ে।

ফলে চিত্র গিয়ে দাঁড়াল এই, গত ৯ তারিখে তাকে মনে করানোর পর আর বিরক্ত করি নি কোনোভাবেই।  ১১ তারিখে নাটকের শো এর ২০ মিনিট আগে কি মনে হল যে কোথায় আছে একবার দেখি। ফোন করতে বলে কিনা,

-         এ বাবাভুলে গেছি একদম! দাঁড়া আধঘন্টায় আসছি।

কপাল চাপড়ে ভাবলাম, আমারই ভুল। ইস!!! একবার যদি আজ সকালে মনে করাতাম!

আমি প্রবেশ দ্বারে অনেকদিনের পরিচিত মাননীয় সজল-দা কে ফিট করলাম নিজের ও বন্ধুর নাম বলে। অনেকদিনের যাতায়াতের  সুবাদে সজলদা আমাকে বললেন,

-         ওনার টিকিট আমার কাছে রাখার দরকার নেই, ওনাকে আপনার নাম বলতে বলবেন। বাকি দায়িত্ব আমার।

এটাই কলকাতা। এটাই আকাদেমী। কাঠের চেয়ার বিশেষ আরামদায়ক নয় বটে, কিন্তু স্পন্ডেলোসিস তো ধরিয়ে দেয় না!

প্রবেশ পথে লম্বা লাইন। আমি একটু ভিড় কমলে ঢুকব বলে পাশে একটা অন্ধকার জায়গায় দাঁড়ালাম। ছটা বেজে  গিয়েছে, কিন্তু কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় নি, তখনও। দেখি পাশে দাঁড়িয়ে আছেন একাই, অভিনেতা পার্থসারথী দেব মহাশয়। আলাপ হল। নাম্বার দিলেন আমাকে বিশ্বাস করেই। মিনিট পাঁচেক খানিক গল্প-টল্প করার পর বললেন,

-         চলুন লাইনে গিয়ে দাঁড়াই।

উনি তো লাইন ভেঙে ঢুকে যেতেই পারতেন, কিন্তু গেলেন না। আবার ভাবলাম, এটাই কলকাতা, এটাই আকাদেমী।

নাটক শুরুই হল খানিকটা দেরিতেই। স্টেজ ভরে অভিনেতা-অভিনেত্রী। নাটকে করাস এর ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ, বোঝাই যাচ্ছিল। নাটকের শুরুতেই নাটকের মধ্যে উপজীব্য কনফ্লিক্ট বেশ পরিষ্কারঃ মানুষের ধর্মান্ধতা, যা বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদকে মানে না। নাটকের আধার করা হয়েছে বাইবেল-কে। দেখানো হয়েছে খ্রীষ্টান-দের মধ্যে কিছু মানুষ বাইবেলকে আশ্রয় করে ঈশ্বর নামের আড়ালে কিভাবে কিছু মধ্যযুগীয় ভাবধারা-কে লালন করে ধর্মভীরু মানুষদের মধ্যে তা প্রচার করে সমাজের কেন্দ্রবিন্দুতে গিয়ে বসেছেন এমন ক্ষমতা নিয়ে যে, সেই সমাজ, এমনকি আইন-ও তাঁদের নিয়ন্ত্রণে।

কথন বাইবেল-কেন্দ্রিক হলেও কোথাও শুরুতেই মনে হচ্ছিল, বাইবেল একটি সিম্বল মাত্র। যে কোনো দিন, যে কোনো সময়ে তা রামায়ণ-মহাভারত-গীতা বা কোরাণ অথবা অন্য যে কোনো ধর্মগ্রন্থ হয়ে উঠতে পারে, আমাদের সকলের সবার এই এত সব অজানা নিয়ে, যা ক্লাস ফাইভের ইতিহাস বই-তেই শেষ। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করবেন না, যে ধর্ম আর সৃষ্টির বিভেদ নেই। না হলে কাজী নজরুল ইসলাম যা শ্যামাসঙ্গীত সৃষ্টি করেছেন, সৈয়দ মুজতবা আলি যা সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, হিন্দু ফিলসফিকে অবলম্বন করে তা কোনো বিভেদের কথা বলে না। আরো বাস্তবে নামব? আমি যে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি, সেখানে সরস্বতী পুজো কমিটির আশি শতাংশ ছাত্র মুসলিম সম্প্রদায়ের। এক বছর খুব টানাটানি। আমাদের সেই আধা-অশিক্ষিত জনজাতি-ই এসে বলেছিল,

-         স্যার পুজো হবে না মানে! আমাদের ওপর ছেড়ে দিন।

খাওয়া-দাওয়া থেকে আরম্ভ করে কোনো কিছুর অভাব রাখেনি।

ঈদে-সিমুই এনে দিয়েছে, যার বাবা হত-দরিদ্র। আমরা শিক্ষক। শিক্ষা দিই। মা্নুষের চোখ খোলার কাজ আমাদের। নাটক ও তাই ই আমি বিশ্বাস করি। আমাদের গ্ল্যামার নেই, নাটকের আছে। অন্ততঃ আমাদের থেকে অনেক বেশি করে!

 অ-পবিত্র নাটকটির সঙ্গে ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির খুব মিল আছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদ সৃষ্টি করছে ধর্মান্ধতা। সেই বিভেদের শিকড় খুব অজান্তেই গভীরতর হয়ে চলেছে। ফল ভুগছে মানুষ নিজেই। কিন্তু বোধ নেই, যে পৃথিবীর কোনো ধর্ম কখনই মানবতার বিরূদ্ধে উঠে দাঁড়ায়নি, কোনোদিন, বলেও নি।


শুধু ঈশ্বর-কে খুঁজেছে নানা পথ বেয়ে। এসবই এই নাটকে ব্রাডির মত চরিত্রদের বাইবেলের মত পবিত্র গ্রন্থের (আগেই বলেছি বাইবেল একটি সিম্বল মাত্র, এখানে) প্রতিটি শব্দকে নিজের মত একপেশে অনুধাবন  করে দুমড়ে-মুচড়ে মানূষের কাছে পরিবেশন করা মাত্র, যা সাধারণ জনগণের বোধশক্তির বাইরে, কারণ বৃহত্তর সাধারণ উচ্চশিক্ষিত ধর্মান্ধ মানুষদের দেবতাজ্ঞানে পুজো করে। তাই অ-পবিত্র নাটকের প্রতিপাদ্য বিষয় চিরকালীন হয়ে ওঠে তা প্রমানের মাধ্যমে।

ভরা কোর্টরুমে মাননীয় বিচারপতি দ্বিধায় পড়ে যান। কারণ তিনি নিজেও কোনো কোনো  সময়ে ধর্মান্ধতার শিকার। ধর্মভীরুতা তাঁর যুক্তিকে পর্যন্ত আচ্ছাদিত কর দেয় মাঝে মাঝে। ঘটনাচক্র ও সূক্ষ্ম যুক্তির লড়াই-এ  তিনি ধাঁধায় পড়ে যান ; বুঝে উঠতে পারেন না কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যে। ড্রামণ্ডের ভূমিকায় সব্যসাচী চক্রবর্তী বেশ ভাল। অনেকদিন পর ওনাকে চার্বাক-এর বাইরে স্টেজে দেখলাম। তবে বোঝা যাচ্ছে ওনার বয়স হয়েছে। মাঝে মাঝেই লক্ষ্য করা গেল ডায়লগ আটকে যাচ্ছে। পাকা অভিনেতা বলে ধরতে দিলেন না। আসলে ওনার ব্যক্তিত্ব আর কণ্ঠের ভার অনেক ছোট ছোট ভুল-চুক-কে অনায়াসে মুছে দিতে পারে। তাঁর প্রতিপক্ষে ব্রাডির চরিত্রে অসিত বসু-ও ভালই। কিন্তু তাঁর একটা টিপিক্যালিটি আমার পছন্দ হল না আরিস্টোক্রেসি বোঝাতে স্পণ্ডোলোটীক হতে হয় না। এই ট্রেণ্ড যদিও এই নাটকের নাট্যকার ও অভিনেতা চন্দন সেনের, চি্রকালই,- তা যে রকমের চরিত্র-ই হোক না কেন। আমি অন্তত ছোটবেলা থেকে ওনাকে এরকম-ই দেখে আসছি, ঘাড় ঘোরানোয় আড়ষ্ট উনি। হয়ত বাস্তবিক-ই কোনো মেডিক্যাল বা কঞ্জেনিটাল সমস্যা হবে, ভেবে দেখি নি, কারণ ওনার নাটক সম্পর্কে পড়াশোনা বা কোনো লেখা, আজ ও আমাকে ঋদ্ধ করে। কিন্তু ব্র্যাডি-কে এরকম আড়ষ্ট অভিব্যাক্তিতে মানায় নি। আমি ঠিক বুঝতে পারি নি, খুব সাধারণ একজন দর্শক হিসেবে, নাট্যকার ও পরিচালক চন্দন সেন মহাশয়ের হর্নবেকের চরিত্রে সারাক্ষণ একটা সিগারেট হাতে নিয়ে সেটা না জ্বালিয়ে স্টেজে থেকে যাওয়ার গুরুত্ব বা মহিমা কি ছিল! বিবেক হিসেবে পুরো ঘটনার সাক্ষী থেকে মাঝে মধ্যে দর্শকের মধ্যে একটা মজার মোড়কে সিরিয়াস ডায়ালগ দিয়ে তাদের ঊন্মেষ ঘটানোর চেষ্টায় তিনি কোনো ত্রূটি রাখেন নি। কিন্তু তাতে দর্শক-কুল খুব যে সাড়া দিয়েছেন তা নয়। আমি জানি না, এটা বোধ হয় নাটকটির মার্কেটিং এর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা একটি দিক যে চন্দন সেন যেহেতু নাটকের পোস্টার ক্যারেক্টার এবং তাঁকে ভারী কম্বিনেশনে দেখিয়ে টিকিট বিক্রি করা হয়েছে, সেহেতু বোধহয় সারাক্ষণ স্টেজে থেকে উনি ব্যাপারটাকে কস্ট এফিশিয়েন্ট করে তুলতে চেয়েছেন যাতে দ্ররশক পরে না বলতে পারে ওইটুকু ভূমিকার জন্য অত্ত বড় পোস্টার!!! আর এটা একেবারে সত্যি যে স্টেজ অন্ধকার হলেই যে হাততালির রোল উঠছিল তা বোধ করি দর্শকদের অন্ধ কর্তব্যবোধ থেকে। আমি, ব্যক্তিগতভাবে নাটকে এমন একটা আলাদা করে জায়গা পাই নি যা হাততালির যোগ্য।

নাটকের মধ্যে সবথেকে কাঁচা চরিত্র যদি কেউ থেকে থাকে তা হল রেচেল-এর ভূমিকায় তোর্ষা ব্যানার্জী। ওনাকে  নিয়ে দলের আমার ভাবা উচিত। এত ভারী নাটকে এতটা সস্তা অভিনয় মানায় না। এত খারাপ অতি-অভিনয় আমি শেষ দেখেছি শিশির মঞ্চে, একটি অত্যন্ত অনামী দলের ব্যোমকেশ নাটকের পরিবেশনে আর দমদম ব্রাত্যজনের দেবদাস নাটকে। সহজ কথায় আকাদেমীর স্টেজে রেচেল-কে একজন যাত্রাশিল্পী মনে হচ্ছিল। নটআনন-এর মত তিরিশ বছরের প্রতিষ্ঠিত দল এ রকম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করার জন্য আর লোক পেল না, তাও বত্রিশ-তম অভিনয়ে! কেউ এ-কথা বলেন নি বোধ হয়।


বোধ হয় চন্দন সেন-সব্যসাচী চক্রবর্তী-র নাটক বলে বলা যাবে না, কারণ তাঁরা এতই বড়, এতই বিশাল যে ভুল করেন না। আমার চোখে যেটা ভুল মনে হচ্ছে, সেটা হয়ত ভুল নয়। নাটক তো! খুব ভারী আর্ট ফর্ম! তাই ব্যাপারটা  বোঝার আছে। আসলে হয়ত ওই রেচেল চরিত্র-টার লাউড হওয়া-টা খুব জরুরী ছিল, কারণ সিচ্যুয়েশন তাই-ই ডিমাণ্ড করে। আমার কাছে হাস্যকর!

শান্তিলাল মুখার্জী অনেক দিন ধরে স্টেজে অভিনয় করছেন। ব্রাঊনের  চরিত্রে যা অভিনয় করলেন রেচেলের মত দূর্বল চরিত্রের সঙ্গে, অনেকটাই। বেশ সুন্দর। এর থেকে বেশি কিছু করার ছিল না, শান্তিলাল-এর । ওনার পুত্র ঋতব্রত মুখার্জী করিক চরিত্রদের একজন। কিন্তু তার হাওয়ার্ড-এর চরিত্রে ছোট্ট অভিনয় অল্প পরিসরে মন কাড়ে। অন্য সবার  থেকে নিজের অভিনেতা হিসেবে পৃথক পরিচয় সে এইটুকু জায়গাতেই গড়ে নেয়।

সারা নাটক টি দু ঘন্টার-ও বেশি সময় ধরে অভিনীত হল, একই রকম, মোনোটনাস ভাবে। কোনো ওঠা-পড়া নেই। সবটাই লিনিয়ার বা সরলরৈখিক।  সবই খুব প্রেডিক্টেবল। নাট্যকার নাটকটি শেষ করার জন্য ক্ল্যাসিক্যাল মেথডেই নির্ভর করেছেন। নাটকের তিনটি সংলাপ আমার খুব ভাল লেগেছে এবং আমার স্থির বিশ্বাস এই তে-পায়ার ওপরেই নাটক-টি দাঁড় করিয়েছেন নাট্যকার।

১। ঈশ্বর মানুষ-কে সৃষ্টি করে নি। মানুষ-ই ঈশ্বরের স্রষ্টা।

২। দ্বিধা তাঁদের মধ্যেই জন্মায় যাঁরা প্রকৃতরূপে শিক্ষিত।

৩। ব্র্যাডি মারা যাবার পরে, ড্রামণ্ড বলছেনঃ কোনো কনফ্লিক্ট-ই রইল না।

শুধু যতটা নাটকের hype, সে পরিমাণে expectations meet করল না, দর্শক হিসেবে, এত ভারী স্টার-কাস্ট নিয়েও।

 নট আনন-এর নাট্যকর্মীরা রেগে যাবেন শুনলে, কিন্তু বিশ্বাস করুন,  সব দেখে-শুনে কেমন যেন মনে হচ্ছিল, মাঝে মাঝেই, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের পথনাটিকা দেখছি।

 যে কোনো স্বতন্ত্রতা আসলে নিরপেক্ষ নয়। তা বাঁচে কিন্তু তার প্রতিপক্ষ-তে। প্রতিপক্ষ না হলে সব শূন্য, পূর্ণতা নেই, কোনোকিছুর-ই। তাই প্রতিপক্ষ তৈরী করি। তিরিশ বছরের নটআনন কিছু এমন করুন, যাতে কি না আমি বার বার ফিরে আসি, দর্শক হিসেবে।

 

***বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ দাম্পত্য ও নিপাট প্রেম ছাড়া।

 

Thursday, 11 February 2021

All Night Long--সারারাত্তির



সারারাত্তিরসারারাত্তিরসারারাত্তির

কিছুই নয়, শুধু অনেকদিন ধরে স্বভাবদোষে লেখালিখি করার সুবাদে ইচ্ছে হল একটু লিটল ম্যাগাজিনের মেলায় ঘুরেই আসি। ইচ্ছামতি নামক ছোটদের বৃহত্তম বাংলা ঈ-ম্যাগজিনের সম্পাদিকা মহাশ্বেতা প্রথম আমাকে সুযোগ করে দেন তাঁদের পত্রিকায় লেখার জন্য। তার আগে-পরে নিয়মিত সংবাদপত্রে লেখালিখি চলছিল। কিন্তু খুব মানিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছিল। যা লিখছি তার অর্ধেক কেটে-কুটে সাফ করে দিচ্ছেন সাব-এডিটর-রা। অ্যাকিঊট স্পেস ক্রাঞ্চ। ভাল লেখার জায়গা, যে কোনো মুহূর্তে খেয়ে নিতে পারে ভুল বাংলায় লেখা, আধা হিন্দি-র সব বিজ্ঞাপন। আমি তো কোন ছার। মাননীয়  ডঃ চিন্ময় গুহ-র মত প্রসিদ্ধ গুনীজন যখন ঘুমের দরজা ঠেলে-র মত কলাম লিখছেন নিয়মিত, রোববার-এর পাতায়। তখন তিনি আমার বাবার সঙ্গে এই একই কথা দুঃখের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলেন, আমাদের সালকিয়ার বাড়িতে বসে। একটি অগ্রগন্য বাংলা দৈনিকে লেখাপড়া সংক্রান্ত যাবতীয় ধরণের লেখা প্রকাশিত হত সেই সংবাদপত্রের একটি বিশেষ পাতায়। সেই পাতাটির সত্তর শতাংশ গড়ে উঠত আমার হাত ধরে। উঠে গেল।  কারণ, পাবলিক বোধহয় ঠিক খাচ্ছিল না। দুটো শাহ্রুখ-আমীর-সলমান বা ক্যাটরীনা-কাজল-দীপিকা-আলিয়া-দের ছবি দিয়ে, তাঁরা কি খান, রাতে কোন পাশ ফিরে শুয়ে থাকেন, শেষ কার সঙ্গে এঁদের ডিনার/ডেট হয়েছিল, ট্যুঈটারে কে কি বললেন, সে সব লেখাপড়ার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া সংক্রান্ত যে সব সমস্যা আছে, তার সমাধানের জন্য প্রাইভেট টিঊটর (যেখানে চটি-জুতো রাখার জায়গা পাওয়া যায় না) বাদ দিয়েও রায় অ্যাণ্ড মার্টিন বা ছায়া প্রকাশনী তো আছেই।সংবাদপত্রে এসব লেখাপড়া-র পাতা টাতাকে পাত্তা দেওয়া অযৌক্তিক। তাই পাতাটাই তুলে দেওয়া হল। শিক্ষা কোনো এক শ্রেণির কাছে আজ বহুমূল্য হলেও তা বেশির ভাগ মানুষের কাছে প্রান্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন, তার উত্তর দিতে গেলে মুস্কিল আছে। যেমন মুস্কিলের খবর--লিটল ম্যাগাজিন মেলায় কবি-সাহিত্যিকদের আমন্ত্রিত হওয়া ও না-হওয়ার হাওয়ায় তাঁরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে একে অপরের দিকে শব্দের কাদা-ছোঁড়াছুড়ি করছেন। কবি তো,! শব্দ নিয়েই তাঁদের খেলা! সে কাদা ছোঁড়াছুড়িতেই হোক না কেন! কবে না কোনো পক্ষ বলে ওঠেন, এ হল ‘post-modern hungrealism’আপনি ঠিক বুঝবেন না। গত রবিবারে একটি নাটক দেখলাম, তাতে বলা হচ্ছে বার বার জানার চেষ্টা কোরো  নাসে ভার কিন্তু অনেক কিছু নষ্ট করে দেবে। খুব সত্যি। সদ্য শিখেছি অতি আধুনিক fibre optics কিন্তু x-ray-তে ধরা পড়বে না। সব OTT (over-the-top) প্ল্যাটফর্ম একসঙ্গে প্যারেড করবে, অদৃশ্যমান হয়ে। নীরেন চক্কোত্তির নিষ্পাপ শিশুর নিজের কাপড় এমন ভিজে যাবে, লজ্জায় ও শঙ্কায় যে আর সে রাজপথে বেরোবে না জিজ্ঞেস করতে, রাজা তোর কাপড় কোথায়?

এ হেন পরিস্থিতিতে যে একটা লিটল ম্যাগাজনের মেলার আয়োজন করা গিয়েছে এই তো অনেক। দর্পণ, একুশ শতকভূমধ্যসাগর এই কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিনের ঈ-পত্রিকায় আমি লিখি। এম সি সরকার প্রকাশিত মৌচাক-এরও আমি নিয়মিত লেখক।কিন্তু মৌচাক লিটল ম্যাগাজিন নয়, লিটল-দের জন্য অতি পুরাতন ও ঐতিহ্যশালী বাংলা ম্যাগাজিন। কিছুদিন আগেই তার কর্ণধার, অত্যন্ত ভাল মানুষ, সমিত (সরকার)-বাবু আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন চাঁদের পাহাড়ে, অকস্মাৎ-ই। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি! এঁদের সকলের মধ্যে দর্পণীদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে কাছের। কিছুক্ষণ দর্পণীদের সঙ্গে কাটিয়ে, ছেলের জন্য একটা কুড়ি-টাকার তালপাতার সেপাই কিনে ঘোরাতে ঘোরাতে সেই রাত্তিরে-র জন্য সারারাত্তির নাটকের টিকিট কেটে ফেললাম, আকাদেমীর রানু মুখার্জী মঞ্চে।

Third Bell এর তালিকায় এই নাটক-টা কোথাও ছিল না সারারাত্তির। দুই নট, এক নটী, কাঞ্চন- অরূপ ও তিতাস। সময়, দশ মিনিটের বিরতি সমেত দুঘন্টা-র মত। নাম শুনে ভাববেন না ফেলনা কিছু। কারণ, বাদল চট্টোপাধ্যায় দুদ্ধর্ষ  ও বর্ষীয়াণ নাট্যকার‌ সঙ্গে সোমনাথ মুখোপাধ্যায়ের মত অভিজ্ঞ পরিচালক। নান্দীরঙ্গ নাট্যদল হিসেবে খুব সুপরিচিত না হলেও যা পরিবেশন করেন তা নেহাত ফেলনা নয়। গ্ল্যামার কম বলে হয়ত বয়সোচিত অভিনেতা মেলে না, কিন্তু যাঁরা সেদিন এই সারারাত্তির নাটকে রানু মুখার্জী মঞ্চে খান আশি দর্শককে টান করে বসিয়ে রাখলেন শুধু ডায়ালগের জোরে, তা প্রশংসার অপেক্ষা রাকে বৈ কি!

মঞ্চভাবনা, সজ্জা, শব্দ সংযোজনা নির্ভুল। কিন্তু নাটকের স্ক্রিপ্ট এতটাই জোরালো আর ধারালো যে সে সবের অপেক্ষায় নাটকের ওঠা-পড়া নেই বিশেষ। সবটাই ডায়ালগ-ধর্মী।কস্টিউম ও খুব একটা গুরুত্বপূর্ন নয় কখনই। সে সব অনুষঙ্গ ব্যতিরেকেই নাটক নির্মেদ ভাবে চলতে থাকে, রোমহর্ষক হতে থাকে কথোপকথনের মাত্রা। সরল জিনিষ জটিল হতে থাকে ধীরে ধীরে। অজগরের মত গ্রাস করে  নিঃশব্দে, সব দর্শকদের। এমন সব মাথা ঘোরানো ডা্যালগ আছে যার বোধ গভীর । ভীষণভাবে আপাত সুখী,  আইডিয়াল বলা চলে এমন অতি সাধারণ দাম্পত্য জীবনের মূল-কে ধরে নাড়া দেয়।পরস্পর-কে চেনা-জানা শব্দবন্ধের অর্থ কি তা ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেয়।  অন্ধকারে আলো খোঁজা মানুষদের আলো পাওয়া কে সমাজ কিভাবে আমাদের সবথেকে কাছের মানুষকে এক লহমায় কয়েক কোটি আলোকবর্ষ দূরে  একটি কৃষ্ণগহ্বরে নিয়ে নিক্ষেপ করে, যেখান থেকে never-to-return for eternity একটা যাত্রা শুরু হয়, তা লক্ষনীয়। এই যাকে ভালবাসায় ভরিয়ে দেওয়া হচ্ছিল, সে কী করে স্বপ্নসন্ধানী হওয়ার দোষে একজন নীচ মানুষ রূপে প্রতিভাত হয়ে ওঠে, সবথেকে কাছের মানুষের কাছে, তা সত্যি-ই পরস্পর-কে সবথেকে বেশি চিনি বা জানি এই সর্বগ্রাহী প্রেমতত্ত্বের সাধারণ ধারণা-কে খন্ডণ করে। সব দেখে শুনে প্রশ্ন ওঠে -- তবে আমরাও কি কাচের ঘর এ বাস করি? ঘর ভাঙা অত সহজ নয়, নাটক বলছে। কাচ একবার ভাঙলে আর জোড়া লাগে না, বলা  হয়। প্রশ্ন ওঠে, সম্পর্ক কাচের ওপর ভিত্তি করে কেন দাঁড়িয়ে ছিল এতদিন? শক্ত জমির ওপর দাঁড়ালেও তো এ রকম ভাবে ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনাই থাকে না।

মজাদার ব্যাপার হল, এরকম একটা সিরিয়াস গল্পকে প্রথমে একটি ভূতের গপ্প বলে মনে হতেই পারে, কারণ আবহ সেরকমই। প্রটাগনিস্ট বৃদ্ধ বাড়ির মালিক, যেন এক প্রেত। তিনি বিবেকের রূপ ধারণ করে এক সুখী দম্পতির মধ্যে বিভেদ আনার চেষ্টা করছেন--এরকম মনে হতে পারে। শুরুর দিকে কিছু অংশ রিপিটিটিভ ও একঘেয়ে মনে হতে পারে। আস্তে আস্তে যখন rising of action- এ সব পাকিয়ে গুলিয়ে জট পাকতে থাকে, তখন কোথাও অতি সাধারণ দর্শকের মাথায় ওই ফেলে আসা একঘেয়ে রিপিটিটিভ সিকোয়েন্সের অনুরণন ঘটতে থাকে। বোঝা যায় সহজেই, কেন অতিরিক্ত জোর দেওয়ার উদ্দেশ্যে ওই রিপিটিশন ছিল। আর সেগুলোকে একঘেয়ে মনে হবে না। কারণ সেই পরমানু গুলো সজ্জিত হচ্ছিল ফিশন বিস্ফোরণের জন্য। সেই বিস্ফোরণের আলোকে উদ্ভাসিত হবেন নায়িকা। আবিষ্কৃত হবে মনের মানুষ রঞ্জন, যার হাত ধরে বোঝা যাবে, জানা যাবে সুখ আর আনন্দ-র মধ্যে যে মহাজাগতিক পার্থক্য আছে তার। প্রসঙ্গতঃ বলে রাখা ভাল, আলোক প্রক্ষেপণ এই নাটকে শুরুতে যে ভৌতিক পরিবেশ তৈরী করেছিল তা একবার ভেঙ্গে যাওয়ার পর, আর বাকি সব অনুষঙ্গের মতই, তা ভূমিকাহীন হয়ে যায়। একমাত্র আলোর সাঙ্কেতিক অর্থ ধরা যায় নায়িকার স্বপ্নের রঞ্জন যখন বাস্তবে তার মনে উদ্ভাসিত হয়, ধরা দেয় অবশেষে তার কাছে।  বাকি আলোক প্রক্ষেপণ শুধু স্টেজ আর দর্শকের পার্থক্য নিরূপণের উদ্দেশ্যে।


রঞ্জন সেই সালোকসংশ্লেষের সবুজ ক্লোরোফিল, যা সব পেরিয়ে মানুষের প্রেম-কে স্বভোজী করে তোলে। সব ভেঙ্গে প্রানে আনন্দ আনে। জানতে হবে বুঝতে হবে, আনন্দ পেতে গেলে, সুখ বিসর্জন দিতে হয়। আনন্দ ও সুখ শব্দ-দুটি ব্যাকরণগতভাবে ও অভিধানে সমার্থক হলেও বাস্তবে তা নয়। ক্ষণিকের আনন্দ সারাজীবনের সুখ কেড়ে নিতে পারে। আনন্দ-লাভের বীজ সেই চরম সত্য-তে নিহিত আছে। They are conflicting, contradictory and sometimes antonymous in nature.

প্রতিটি আপাত-দৃঢ় সম্পর্ক দাঁড়িয়ে আছে সুখ-এর বাঁধুনিতে। তফাতে থাকুন আনন্দ-এর। যে কোনো মুহূর্তে সে এই বাঁধন ছিড়ে দিতে পারে। রঞ্জন বৃদ্ধ, কারণ সে অভিজ্ঞতায় পূর্ণ এবং অমর। তার কাছ থেকে প্রত্যাশা-ও ভুল। কারণ সে বাঁধা পড়ে না। একবার ধরা দিয়ে আনন্দের জীয়ণকাঠি ছুঁয়ে দেয় শুধু। কত মানুষ শুধু রঞ্জনের আশাতেই সারা জীবন কাটিয়ে দেয়, পায় না। যারা পায়, তারা কি? দর্শক বিচার করুক।

ডায়ালগের ওভারল্যাপিং আছে। জটিল ডায়ালগ উলটে যাওয়ার প্রবণতা আছে। আর আছে মূল বৃদ্ধের চরিত্রের ডায়লগ ডেলিভারি-তে দেবশঙ্কর হালদার টিপিক্যালিটির স্পষ্ট ছাপ। নাটকের নায়ক-নায়িকা দম্পতির বয়স অভিনেতাদের আসল বয়েসের সঙ্গে মেলে না। এই সব বিচ্যুতি কাটিয়ে উঠলে, সারারাত্তির জনমানসে অনেক বেশি জনপ্রিয় নাটক, ভারী তারকাখচিত, একটি একটি করে চরিত্রের মুখোশ-খসানো নাটক থানা থেকে আসছি-কে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিতে পারে।

সারারাত্তির-এর প্রতিধ্বনি আমাকে আনন্দ দিল না সুখ দিল, তা সময়ের হাতে ছেড়ে দিলাম। দেখি, প্রতিধ্বনি অনুরণন হয়ে আমার স্মৃতিস্তভে কতটা দাগ কাটতে পারে।


 

Sunday, 7 February 2021

ঘুড়ি


কাচগুঁড়ো ভেঙে মাঞ্জা দেওয়া

টানা না ছাড়া না, কি

টিপনি দিয়েছো সাগুদানা মাড়

ষোলোটা আনাই ফাঁকি

 

একবগগা কল খাটালে

পেট-কাটি বাতি-মোম

কান্নিক খেয়ে আকাশের বুকে

গোঁৎ মেরে সংযম

 

লাট খাওয়া তো অনেক হল

এইবারে লুটে খাও

অনেক কষ্টে ভাতের আঠায়

লেজ-জুড়েছি তাও

 

হাফতেল ছেড়ে ধর দেড় খান

ঊড়ানে দেখো আঙুল না কাটে

ভো-কাটা হয়ে থেকোনা  গো যেন

ধান-কাটা  ওই পোড়া ন্যাড়া মাঠে।