Saturday, 26 December 2020

উষ্ণশীতকথাঃ ০১

#warmwintertales
বাবা-মা, শিক্ষক,আত্মীয়-পরিজন, এনাদের বাইরে যারা আমাকে পৃথিবী-তে কিছু করে খাওয়ার জন্য একটা শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, এবং যা নিয়ে আমার আজকে এত আস্ফালন (আসলে আত্মসম্মানবোধ-কে মানুষ এই চোখেই দেখে আজকাল)তারা হল আমার বন্ধুরা। এবং সেও অতি মুষ্টিমেয়। শুরুতে যাঁদের কথা আমি বললাম, মানে বাবা-মা ও অন্যান্যরা, তাঁরা যখন হাল ছেড়ে দিয়েছেন, সেই হাল অজান্তেই শক্ত করে ধরেছে সেই বন্ধুরা। এখন তাদের মধ্যে প্রত্যেকেই আমার একান্ত কাছের হলেও তাদের মধ্যে chief architect-রা ছিল হাতে গোনা। পাঁচে পঞ্চবান-ও পেরোবে না। তাদের সঙ্গে দ্যাখা হলে উল্লাট উল্লাস, আর whatsapp/facebook-এ নিরন্তর আপাত ঝগড়ার আড়ালে খুংশুটি বা বিতর্ক। আর সবথেকে মজার কথা একটা অদ্ভূত অনুভূতি যে বিপদে বা খারাপ থাকলে, একবার ডাকলেই পাশে পাওয়া যাবে, যা সত্যি-ই আজ  প্রায় অবলুপ্তির পথে – এ এক পরম পাওয়া। এটা একটা website এর মত continuous development আমার জীবনে। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে কিছু না কিছু শিখেই চলেছি, আর তাঁরাও শিখিয়ে চলেছেন। সবাই।

সেইরকম এক পরম নিকট বন্ধু,যার হাত ধরে আমার কর্মজীবনের হাতেখড়ি হঠাৎ-ই যারপরনাই উৎসাহে লিখছেন বছর খানেক ধরে। এবং এই শীতের লেখার মরশুমি নাম রেখেছেন, #warmwintertales. কিছু কথা জমা হয়েছে ক’দিনে। ভাবলাম এই হ্যাশট্যাগেই ছাড়ি। 

#১ 
পার্ক স্ট্রীটে কি এমন আছে যে যেত্তেই হবে সব্বাইকে, খ্রীসমাসের সময়ে? আমাই তো ক’দিন আগে এক্রোপলিস মল এর রাস্তায় ঢুকে গুলিয়েই ফেলেছিলাম। পার্ক স্ট্রীটের থেকে কম কিসে!সঙ্গে উলটো দিকের মাঠ-টা যা সাজিয়েছে না! পুরো একঘর!অনেকগুলো কচিকাঁচা ছিল, বিভিন্ন সাইজের। বড়দের মধ্যে আমরা সবথেকে বড় হওয়ার সুবাদে, বড়দিনের মরশুমে পকেটে বড় ধাক্কা। আর ওই হাসিমুখ দেখতে আমরা যে খলখলে হয়ে গেলাম, সেটা টের ও পেলাম না। প্লাস্টিক মানি-র এই সুবিধা,পথে যে বসলাম বুঝতে পারি না। কিন্তু এ রকম পথে বসায় আমি বার বার রাজি। এরা বড় হয়ে গেলেই কেলো। …’coz time flies/come with me (Godzilla Soundtrack)।

#২
২৫ শে ডিসেম্বর। নাটক দেখে বেরিয়ে থ’ হয়ে গেলাম। লাল টুপিতে আর নানান সাজে জনস্রোত। কলকাতা ভাসছে। নন্দন-রবীন্দ্রসদন চত্তরে থৈ থৈ করছে শুধু মানুষ। চলছে  গানমেলা। তার-ই তিনখানা মঞ্চ। একটা আবার নিবেদিত হয়েছে যে কোনো সাধারণ গাইয়ে মানুষের প্রতিবেদনের তরে। রোজ ৬ টার সময়ে দাও অডিশন, পাশ করলে, গেয়ে ফেলে মন মাতিয়ে দাও। অনেকদিন পর এত ভিড় দেখে কেমন যেন একটা out-of-the-world  অনুভূতি হচ্ছিল। খাপ খাইয়ে নিলাম। মনে হল সব কিছু এরকম-ই থাকুক!

#৩
আমার কাছে ছবি তোলার মত ভাল ক্যামেরা নেই। এই ক’দিন আগে আমার স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে রায়পুরে গিয়েছিলাম। ওরা বারবার বলছিল, আমার সেই একখান ডিজিটাল এস-এল-আর এর কথা যা আমি আমদানি করেছিলাম আমার বিদেশে থাকা বন্ধুর মাধ্যমে ১৯৯৯ সালে। তখন কলকাতা সেভাবে ডিজি্টাল এস-এল-আর চোখেই দেখেনি। আমার প্রাণের ক্যামেরা চলে বটে কিন্তু তার আসল যে মজা ৮০-৩০০ মি মি-তে, সেই লেন্সটার মাউণ্টিং-এ সমস্যা। নস্টালজিক হয়ে যতবার মেট্রোগলিতে ডঃ লোধের কাছে নিয়ে গিয়েছি, উনি তাকে ভায়াগ্রা খাইয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। যে মুহূর্ত-কে ধরব বলে তাক করে বসে আছি, কয়েক ঘন্টা ধরে ট্রাইপডে আটকিয়ে, সেই ক্লাইম্যাক্সে, যখন সেই প্রতীক্ষীত মুহূর্ত ও শাটারের মিলনে অনবদ্য একটি ছবির জন্ম হবে বলে, শাটারটাই ফলস। ফেক অরগ্যাসম। রেগে-গিয়ে আর তাকে নিই না। মোবাইলে দিব্বি খুব অল্প আলোতেও ছবি উঠে যাচ্ছে। হাজার একটা দুর্দান্ত এডিটিং আপ, দিব্বি পকেটে পুরে ঘোরা যায়। পোস্ট করার ইচ্ছে হলে যেখানে ইচ্ছে বসে করে দেওয়া যায়, ডাম্প করে ফটোশপ করার ঝক্কি থেকে মুক্ত। আর এস-এর-আর এ সেলফি? হবে কি?…কেউ জানলে বলে দেবেন।
#৪
-স্কুল কবে খুলবে আর্য-দা? 
-জানি না। আমাদের যেতে হচ্ছে সপ্তাহে কয়েকদিন, কিন্তু ছাত্রদের জনয় কবে খুলবে ঠিক বলতে পারছি না।
-অনলাইন ক্লাস তো চলছে। 
-মনে মনে হাসলাম। যে দেশে মিড-ডে মিলের লোভ দেখিয়ে স্বাক্ষর করে তোলায় ব্রতী হয়েছি, সেখানে অনলাইন ক্লাস! রাজ্য সরকার চেষ্টা করছেন। শুনলাম ছাত্র-ছাত্রী-রা ট্যাব পাবে। কিন্তু আমার ধারণা অনুসারে ৮০ শতাংশ শিক্ষকই এখনো ডিজিট্যাল ক্লাসরুম ব্যাপারটা জানেন না। এর সঙ্গে কিন্তু তাঁদের বিদ্যা-বুদ্ধি-মেধা কে গুলিয়ে ফেলবেন না। আমার মনে হয়েছে, এই নিয়ে সবার আগে, দরকার হোক বা না হোক, শিক্ষকদের প্রযুক্তিগত দিক থেকে যথার্থ ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করতে হবে।
স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে যখন রায়পুরে বেড়াতে গেলাম, দেখলাম হুগলী নদীর প্রায় মোহনার কাছে অবস্থিত গ্রামটি একটি ডক-এর মত। নৌকা মেরামত-ই তাদের প্রধান পেশা। ১৪ বছরের ছেলে থেকে ৬০/৬৫ বছরের বুড়ো সবাই সকাল থেকে কাজে ব্যস্ত। যেখানেই আড্ডা জমানোর চেষ্টা করলাম, কেমন একটা সন্দিগ্ধ চোখে দেখতে লাগল অথবা পাত্তাই দিল না। বুঝেই উঠতে পারছিলাম না, গোলমাল-টা কোথায় হচ্ছে। 
একজায়গায় ছবি তুলতে গিয়ে, একটি কুড়ি-পেরোনো ছেলে ধমকের সুরে বলল,
-কতা কানে যাচ্চে নি। ত্যাকুন থে কইতিসি, ফটো তুল্বে নি কো। ফোন ছুঁড়ে ফেলি দেব!
আমি ফোন পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম।দলের একজন বলল, 
-আসলে আমরা সবাই চোলাই খাসসি তো, তাই ও অমন করে বলল। ককুন কে কি করে কোনো ঠিক লাই গো।আসসা একটা কতা কয়েন, ঊই ফটকগুলান লয়ে আপনি কি করবেন?
-আমি তো মানুষ!কখনো কখনো মনে হয়, আমি খুব খারাপ আছি। বুঝলে। আমি যখন তোমাদের মত সুন্দর অথচ গরীব মানুষদের নিজের তোলা ছবি দেখি, মনে হয় আমি সুখের স্বর্গে আছি। খুব খুব ভাল আছি। কে বলতে পারে, তুমি যদি আমার মত সুযোগ সুবিধা পেতে, হয়ত আমার থেকেও বড় মানুষ হতে।
শুনে সবাই কেমন যেন হঠাৎ গলে গেল।
খানিকটা আড্ডা হল, মন প্রাণ খুলে।
রাস্তায় উঠলাম। একটা ছোটা হাতি ম্যাটাডোর থামাল একটি বাইক-চালক। দুই চালকেরই গোঁফের রেখা উঠছে সবে। বাইকের চালক বলল,
-কি বে শালা, আমার কই?
দেখলাম গ্লাস ভর্তি চোলাই নেমে এল জানলা দিয়ে। এক ঢোঁকে সাবাড়।
-মোড়ের মাথায় থাকবি, পরেরটা আমি খাওয়াবো, আসছি।
…আম সাধারণ আকন্ঠ ডুবে থাকুক চোলাই চালানে। চলুন, আমরা ততক্ষণ একটু অনলাইনে ক্লাস করে দেশের ভবিষ্যৎ গড়ি...

Friday, 25 December 2020

যুযুৎসু-র প্যাঁচ


গতকালই শুনে এলাম, এক জায়গায় অফিসিয়াল কাজে গিয়ে, “ব্যাটা (আমার ‘কলচর’ নিয়ে যদি প্রশ্ন ওঠে, তাই আসল আসল শব্দ টা বদলে দিলাম) শুভেন্দু নাকি?” আমি ভাবলাম এই নামে হাজার একটা মানুষ থাকতে পারেন, তাই সরল বিশ্বাসে বক্তা কে জিজ্ঞেস করলাম “তিনি কে ভাই, আমি চিনি?” নেহাত আমার থেকে বয়সে অনেক ছোট, নাহলে ওর বডি-ল্যাঙ্গুয়েজ বলছিল আমাকে তুলো-ধোনা করে দিলে ওর শরীর জুড়োত। 
“তুমি জান না! ন্যাকামী হচ্ছে! এটা নতুন চলতি খিস্তি। বাজারে বললেই লোকে ক্ষেপে আগুন হয়ে যাচ্ছে”। 
বুঝলাম যে বাংলার সংস্কৃতি-তে ভদ্রলোক রাজনৈতিক অজাচার করে আমাদের ক্লাসিক্যাল ক্যারেক্টর, ‘বিভীষণ’-এ ভাগ বসিয়েছেন। আপাততঃ “ঘরের শত্রু বিভীষণ” না বলে রিপ্লেসমেন্টে “শুভেন্দু” বলে চালিয়ে দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু ক্লাসিকস রামায়ণ-মহাভারতে একমাত্র বিভীষণ-ই ঘরের শত্রু ছিলেন না। ধৃতরাষ্ট্রের শত-পুত্রের মধ্যে অন্যতম গুণনিধি যুযুৎসু কিন্তু পান্ডব পক্ষে যোগদান করেছিলেন এবং যুদ্ধ শেষে তিনি পিতা-মাতার কাছে ফিরত-ও এসেছিলেন। এক বিশেষ রকমের মল্লযুদ্ধে যুযুৎসু ছিলেন অপরাজেয় যা থেকে ‘যুযুৎসুর প্যাঁচ’ কথাটি এসেছে। এর অর্থ হল ‘যে প্যাঁচ আর ছাড়ানো যায় না।“ অনেকটা সলমন খানের ‘সুলতান’-এর শেষ প্যাঁচের মত –যা একবার দিলে আর ওঠা যায় না। 
যাক গিয়ে। যে কথা বলতে গিয়ে এত অতিরিক্ত কথা এসে গেল -- রামায়ণ-মহাভারত বা তার বিভিন্ন অংশ ও চরিত্র নিয়ে নানা রকমের নাটক হয়েই চলেছে অনেক আগে থেকেই। তবে আমার কাছে মনে রাখার মত ছিল শাঁওলী মিত্রের একক অভিনয়ে “কথা অমৃত সমান” আর কোভিডের আগে দেখা নান্দীকারের ‘পাঞ্চজন্য’। রাধা ও গান্ধারীর ভূমিকায় মা ও মেয়ে যথাক্রমে স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত ও সোহিনী সেনগুপ্ত, অনবদ্য। কৃষ্ণ কি ধুরন্ধর ছিলেন, তাঁকে দেবতা থেকে মানুষ করে দেওয়ার প্রধান কারিগর গান্ধারী কিভাবে তাঁর ম্যাজিক্যাল আর মিথিক্যাল ক্যারিশমা-কে ইথেরিয়াল থেকে রিয়েল করে তুলেছেন দেখার মত। আর ‘উরুভঙ্গম’ আমি এখন-ও দেখে উঠতে পারি নি। 
‘মুখোমুখি’-র নতুন নাটক ‘অন্ধযুগ’ (ধরমবীর ভারতী লিখিত, প্রণতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুদিত ও পৌলমী চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত)  নাটক-টিও সেই অবয়বে গঠিত। আসলে দুর্যোধনের উরুভঙ্গের পর মহাভারতের গপ্প-টা ঠিক কি ছিল, কেউ ঠিক মনে রাখতে পারি না, ঠিক বাংলা বর্ণমালার শেষ দিকটার মত ‘…য-র-ল-ব-শ’ তারপর? তারপর হ-য-ব-র-ল। সেই বেড়াল কি করে আবার রুমালের আকার ফিরত পেল তা দেখতে হলে, জানতে হলে শিখতে হলে ‘অন্ধযুগ’ অবশ্যই দেখতে হবে। এতেও আমি যদি আপনাদের এই নাটকটি দেখার তিতিক্ষা গঠন করতে অসমর্থ হই, তবে একটু হাঈ-ভোল্টেজ দিয়ে দিই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন, সৌমিত্র চট্টোপাধায়, এবং সেই সৌমিত্র চট্টোপাধায় যাঁর নামটুকুই যথেষ্ঠ,স্বয়ং তাঁর এই নাটকটি করার কথা ছিল। পারেন নি।আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন। আমার চোখে জল এল নাটক-টি দেখতে দেখতে হঠাৎ-ই যখন একটি সময়ে কৃষ্ণের চরিত্রে তাঁর আকাশবানীতে (ভুল করে রেডিও ভাববেন না)ভয়েস ওভারে ভাসল হল। ওফ, মার্ভেলাস। কোথায় দেবশঙ্কর হালদার (অশ্বত্থামা-র ভূমিকায়) কোথায় পৌলমী চট্টোপাধ্যায় (সৌমিত্রের কন্যা গান্ধারীর ভূমিকায়) কোথায় বাকি চরিত্রদের দাপুটে অভিনয়। সব ভাসিয়ে দিলেন শুধু কন্ঠ  দিয়ে অভিনয় করে।  সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-কে হারানোর পরে আজ এটাই বিলু দত্ত নিবেদিত শ্যামবাজার মুখমুখি-র প্রথম শো। পরের শো আজ  থেকে ঠিক একমাস পরে আকাদেমী-তেই ২৫ শে জানুয়ারী, ২০২১ তারিখে।
আমার বাল্যবন্ধু ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-এর ভাবশিষ্য দেবনাথ (চট্টোপাধায়,কাকতালীয় ভাবে) ছোট চরিত্র হলেও খুব গুরুত্বপূর্ন চরিত্র যুযুৎসু-র ভূমিকায় অভিনয় করে দেখিয়ে দিল ওর মধ্যে কি আগুন জ্বলছে। ওর অভিনয় দিয়ে ও বুঝিয়ে দেয়, নিঃশব্দে, “নাটক করব বলে ভাল চাকরি ছেড়েছি সবে তো দু’বছর…দেখাব আস্তে আস্তে কি হয়”। আমি-ও অপেক্ষায় আছি ওকে অনেক বড় জায়গায় দেখব বলে।
এরকম একটা নাটকে ছন্দপতন ঘটে যখন অত্যন্ত সীমিত সময়ের মধ্যে ‘যুধিষ্ঠির’ চরিত্রের আগমণ ঘটে। একদম মুখস্থ সংলাপ রোবোটের মত আওড়ে গেলেন। মনে হয় দর্শক আসনে থাকা অনেকেই ছিলেন যাঁদের হয়ত ঘন্টা খানেক সময় দিলে ওনার থেকে অনেক ভাল অভিনয় করে দেখিয়ে দিতেন। বেশ খারাপ লাগল যে এতটা দূর্বল অভিনয় অভিজ্ঞ নাট্য-পরিচালিকা হয়ে পৌলমী দেবী কেন লক্ষ্য করলেন না বা লক্ষ্য করেও কম্প্রোমাইজ করলেন। নাটক যা বলে আসছে, প্রতিটা চরিত্র নিয়ে দর্শকের মনের মধ্যে কিন্তু একটা ছবি আঁকা হয়ে যায়, তারপর যদি নিজেদেরই হাতে আঁকা সেই ছবির সঙ্গে অভিনয় চরিত্রের কোনো মিলই না থাকে, তবে দোষ কার! তবে ভিতরের কথা জানি না। হয়ত কোনো আপৎকালীন পরিস্থিতিতে এরকম করতে বাধ্য হয়েছে দল। কিন্তু দর্শক বড় নির্মম। খারাপের কোনো অজুহাত তারা মানে না কারণ, টিকিটের দাম নেহাত কম নয়। আশা রাখি পরের শো গুলোতে এরকম হবে না।
কার্টেন কল-এ কোভিড পরিস্থিতিতে এত দর্শক-সমাগম দেখে পৌলমী দেবী অভিভূত। আমাদের ধন্যবাদ জানালেন। না বলে পারলাম না, যে আমরাও নাটকদেখনবাজ-রাও স্টেজ খুলতে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি।
নাটক চলুক…ভাল হোক বা খারাপ…না হলে লিখব কি!!!! যদিও লিখে খাওয়া আমার পেশা নয়, নিতান্তই শখে…।

Sunday, 13 December 2020

Chhayanat: A Virtual Natyamela: December 2020

পুরো পুজোটাই কেটে গেল, স্টেজ ব্যাপারটা বাদ রেখে। পারফর্মিং আর্ট বন্ধ। মাঝেমধ্যে কিছু অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছিল, ঠিক পাতে দেওয়ার যোগ্য নয়, কারণ সেগুলো নাটক কম, সিনেমা বেশি। কড়াকড়ি শিথিল হতে হতে, অনেক মানুষ-কে হারাল পৃথিবী, যে ক্ষতি অপূরনীয়। আমি যখন লিখতে বসেছি, লীয়ারের নাম ভূমিকার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় গত হয়েছেন, গত হয়েছেন মনু মুখার্জী-ও। সৌমিত্রবাবু-র ভাবশিষ্য, দেবনাথ চট্টোপাধ্যায় আমার পরম বন্ধু, এক্কেবারে ছেলেবেলার। তার দেওয়া পোস্টে জানতে পারলাম যে স্টেজ আবার খুলছে। ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০২০ তে দুপুর বেলায় আছে ‘’অন্ধযুগ’ নাটকের শো, আকাদেমি তে। তার আগে জানলাম, আমার ছেলের কাছ থেকে যে ‘কে’ এর শো আছে জ্ঞানমঞ্চে, ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২০ তারিখে। মন আনন্দে ভরে উঠেছিল, আবার নাটক হবে শুনে। শেষ নাটক দেখেছি, মার্চ মাসে । তারপর থেকে নাভিশ্বাস উঠে এসেছে, বারে বারে, দর্শকাসনে বসার জন্য। নাটক দেখার সেই স্পেল ছিল নাট্যোৎসবের। পরপর দেখেছিলাম বেশ কয়েকটি ভাল নাটক। তারপর মনে ধন্দ জেগেছিল, নাট্যোৎসব আবার হবে তো।

স্টেজে কিছু হুট করে শুরু হওয়ার আগে, অনলাইনে নাট্যোৎসব ঘোষিত হল ঃ


ছায়ানট – দ্য ভারচ্যুয়াল নাট্যমেলা। পয়লা ডিসেম্বর থেকে ৫-ই ডিসেম্বর পর্যন্ত। আয়োজনে, ‘দশ-ইয়ারী’ থিয়েটার দল। গত কয়েক বছর আগে শুরু করেছেন দলটি, কলকাতায় এবং দ্রুততার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন নাট্যপ্রেমী মানুষদের মধ্যে। এর মূল কারণ হল, শুধু নিজেদের দল নয়, অন্যান্য  দলের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে, কোনো প্রতিযোগীতায় না গিয়ে, একসঙ্গে কাজ করার মানসিকতা, যেখানে মূলমন্ত্র হল, ‘কাজ করলে তবে না ভুল হবে, ভুল থেকে শিখি, যত ভুল করব তত বেশি শিখব’।

আমি অধীর আগ্রহে বসে ছিলাম, অনেকদিন পর নাটক দেখব বলে। এক তারিখে সন্ধ্যেবেলায় নাট্য মেলার শুরুতে কিছু কথাবার্তা তো থাকবেই। ডঃ ময়ূরী মিত্র প্রাণ ঢেলে বলে গেলেন অনেক কিছু। খুব জড়তা ছাড়াই। কিন্তু বড্ড দীর্ঘ হয়ে উঠেছিল একটা সময়ে, কারণ আমরা এসেছি নাটক দেখতে। ‘দশ-ইয়ারী’ থিয়েটার দলের মূল কর্ণধার, সুচিতা রায়চৌধুরী, তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মধ্যেই জানালেন সেদিনের নাটকের মূল ভাব সম্পর্কে। তাঁর নিজের লেখা নাটক। আমরা দেবদেবীদের নিয়ে পলিটিক্যাল স্যাটায়ার প্রথম দেখছি এরকম তো নয়, কিন্তু এই নাটক-টি সামান্য হলেও একটু অন্য ধরণের, যেটা না দেখলে বোঝা যাবে না। যাতে ভয়েস রেকর্ডিং ভালো হয়, তাই হয়ত একটু যাত্রার মত উচ্চ তানে বাঁধা। তবে মাঝে মাঝে যেন মেলোড্রামা আর ডায়ালগ, দুটোই এই যাত্রা-আঙ্গিকের চাহিদা প্রকাশ করে। দেখে  ফেলুন সময় করে ষোলো মিনিটের এই নাটক টি। নাকি ‘নাটিকা’ বলব!

লিঙ্কঃ https://www.youtube.com/watch?v=8FS_0-9_Nfs&feature=youtu.be

দ্বিতীয় দিন, ২ তারিখে ছিল নাটক “আমি সুরঞ্জন”। পঁচিশ মিনিটের ত্রিকোণ প্রেমের গল্প। দেখানো হয়েছে, থুড়ি, শোনানো হয়েছে স্পষ্টতই ত্রিকোন প্রেমের অন্তর্দ্বন্দ্ব, বিশেষ রূপে শ্লেষিত হয়েছে  অদ্ভুত মানসিক জটিলতা। শোনানো হয়েছে বললাম এই কারনে যে এটি আদ্যোপান্ত শ্রুতিনাটক এবং একটি নাট্যোৎসবে এটা একটা অভাবনীয় পাওনা। সানডে সাসপেন্স যেখান থেকে উৎসারিত আমরা সেই মেইন স্ট্রীম শ্রুতিনাটক কে ভুলতে বসেছি। শাঁওলী মিত্রের একক অভিনয় দেখেছিলাম ‘কথা অমৃত সমান’-এ । এখন আর পারেন না। ওটা শ্রুতি হিসেবেই অভিনীত হয়। তবে এই শ্রুতিতে একটা নতুন মনোগ্রাহী অংশ আনা হয়েছে। শ্রুতি যতক্ষণ চলেছে, নানা রকমের ক্লিপিং বা স্টিল শট দিয়ে না ভরিয়ে, রাখা হয়েছে স্টুডিওর র’ ভার্শান, যা অনলাইনে দর্শকদের অনেকটাই চরিত্রের সঙ্গে একাত্ব করে তুলবে। শিক্ষনীয়, শুধু শব্দ উচ্চারণ করে কি করে মনের ও শরীরের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটাতে হয়।

 লিঙ্কঃ https://www.youtube.com/watch?v=0gvz3me-jO8&feature=youtu.be

তৃতীয় দিনে আবার বেহালা ‘ঘুমচোখ’- দলের তৈরী করা দুটি শ্রতি নাটকঃ প্রথম নাটক “একটি দিনের জন্য”। আধঘণ্টায় স্বপ্ন ছোঁয়া ও ভাঙার গল্প ‘কাপুরুষ” সিনেমার ধাঁচে। তবে হ্যাঁ, এই গল্পটা 'কাপুরুষ'-এর মত সীমিত মানুষের গল্প নয়, বেশির ভাগ মানুষের-ই মনে হবে, “আরে এ তো আমার গল্প! ওরা জানল কি করে!” সেদিনের থালায়, গুরুপাক এই ভোজনের পরে, শেষ চোদ্দ মিনিটের মধ্যে চাটনি, মিষ্টি ও পাঁপড়ের সম্ভার গোছানো হল দ্বিতীয় শ্রুতি নাটক, ‘হ্যামলেট’ নামক সেই ক্লাসিকের হাত ধরে। এটা ঠিক দেব সাহিত্য কুটিরের “শেক্সপীয়রের ট্র্যাজেডী” বই-এ যে রকম করে পুরো নাটকটিকে ছোট্ট করে লেখা আছে সে রকম। শুধু প্রাধান্য পেয়েছে হ্যামলেটের মৃত্যুর সময়ে যন্ত্রণা, যেমন আমারা দেখেছি শাহিদ কাপুরের ‘হায়দর’ সিনেমাটিতে। শুধু সব কিছুর মধ্যে এক একটি চরিত্র আলাদা আলাদা জায়গায় বসে রেকর্ডিং করে গিয়েছেন সেটা বড্ড প্রকট, আর এই নাটকে পর পর ছেলে-ভোলানো স্টিল ছবির স্লাইড শো না থাকলেই হাল হত। নাটক যতটা উঠছিল, তার উচ্চতাকে কমিয়ে আনে এই অবাঞ্ছিত ছবির সমাহার। অবাক হলাম ‘ঘুমচোখ’ শ্রুতি নাটক নিয়েই কাজ করে বিশেষ করে, বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মের সঙ্গেও তাঁরা অনেক বছর ধরে যুক্ত, তবু কেন ওনারা এই ব্যাপআরে ঘুমিয়ে রইলেন, কেন তাঁদের চোখ খুলল না?

লিঙ্কঃ https://www.youtube.com/watch?v=Dm4Q0revH-I&feature=youtu.be

চতুর্থ দিনের জন্য সবাই অপেক্ষায় ছিলাম, কারণ দলের নাম একটু ভারী – ‘অনুযুগ’, আর নাটকের নাম 'যাত্রী'। দল রমরমিয়ে চলছে চব্বিশ বছর ধরে, আর কর্ণধার সজল চক্রবর্তীর লেখা ‘যাত্রী’-র বয়স ও প্রায় সমান। সমান চাহিদা আজও বাজারে এই নাটকটির। শহর-গ্রাম-মফঃস্বলের সীমানা ভেঙে সমস্ত শ্রেণির মানুষের কাছে এই দলের আর কোনো প্রযোজনা এত দীর্ঘস্থায়ী হয় নি বলে নিজেই দাবী করেছেন সজল বাবু, সেদিনের মুখবন্ধে। কেন, কি ব্যাপার, কি এমন আছে এই নাটকে – উত্তর খুঁজতে হলে দেখে ফেলুন। আমি বরং শেষ দিনের জন্য কি লিখব সেই নিয়ে ভাবতে বসি।

লিঙ্কঃ https://www.youtube.com/watch?v=RjaSzXYaxsE&feature=youtu.be

শেষ বলে ছক্কা – মনোজ মিত্র লিখতেনও সে রকম। ‘উমা’- তে তিনি নিজে বলে গিয়েছেন অঞ্জন দত্ত কে, “গল্পটা কিন্তু বলে যেতে হবে, একজন হলেও, বলে যেতে হবে।“ ঠিক সেরকম-ই এক দম্পতির গল্প বলা আছে তাঁর ‘আঁখিপল্লব’ নাটকে যেখানে আপাত স্বার্থপর দু জন মানুষ এক সঙ্গে থাকতে থাকতে, ঝগড়া করতে বুঝতেও পারেন না বাঁধনটা কত আঁট হয়ে গিয়েছে। ভাল পরিবেশন। সময় করে দেখে ফেলুন। আঁখিপল্লব ফেলার সুযোগ পাবেন না।

লিঙ্কঃ https://www.youtube.com/watch?v=_6yNDQ2B3q0&feature=youtu.be

সব থেকে ভাল ব্যাপার এই যে, ‘দশ ইয়ারী’ নাট্যদল এই কঠিন সময়ে তাঁদের সীমিত ক্ষমতা ও নাটক-কে টিঁকিয়ে রাখার জেদ নিয়ে এতগুলো দলকে একত্রিত করে গোটা একটা ভার্চ্যুয়াল নাট্যোৎসব করে সবাই কে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেল...গল্পটা যে বলে যেতে হবে...!!!

নাটক কে কেউ থামাতে পারবে না। নাটক থামবে না। নাটক তো জীবনের…তাই…এটা বুঝতে ‘পিরানদেল্লো’ –কে, তাঁর যে ছয়টি চরিত্র, পরিচালক পাচ্ছিল না, তাঁদের একবার দেখতে, পড়তে‌ বুঝতে হবে। তবেই না ‘ভাবা’ প্র্যাকটিস হবে।

…ভাবলেই মানুষ আর সুখী থাকে না…বিপ্লব হয়...।।