Saturday, 22 February 2020

সন্ধ্যা ১



আমার খুব পুরোনো বন্ধু পিয়াস চক্কোত্তির হঠাৎ ফোন। সচরাচর কোনো বন্ধুর পুনর্মিলন বা কোনো খুব প্রয়োজনীয়  খবর দেওয়ার বাইরে খুব একটা যোগাযোগ নেই। আমি বাংলা নাটক-টাটক দেখি বলে কোনো কারণে হঠাৎ মনে হয়েছে, এটা আমাকে জানানো উচিত। তার জীবনসঙ্গিনী নবনীতা দশ ইয়ারী নামে একটি নাটকের দলে অভিনয় করতে শুরু করেছেন, সম্প্রতি। দুঃস্থ নাট্যশিল্পীদের সাহায্যার্থে শিশির নাট্যমঞ্চে চলছিল নাট্যোৎসব ২০২০। এই শিশির নাট্যমঞ্চ কিন্তু রবীন্দ্রসদন-নন্দন-আকাদেমী চত্তরের শিশির মঞ্চ নয়। হাওড়া রামরাজাতলার কাছে জরাজীর্ন বানী নিকেতন লাইব্রেরীর মধ্যে অবস্থিত একটি বিখ্যাত মঞ্চ। এখানে অনুষ্ঠিত হয় এমন অনেক কিছু যা প্রচারের আলোকে না এলেও কলকে পেতে বা আন্তর্জাতিক মানের হওয়া সত্ত্বেও অত্যন্ত অনাদর ও অশ্রদ্ধার মধ্যে লীন হয়েই থেকে যায়।
 ১)
যখন গিয়ে পৌঁছালাম, দুটি নাটকের প্রথমটি শুরু হয়ে গিয়েছে। অন্তর্ধান। হরিমাধব মুখোপাধ্যায়ের লেখা বেশ পুরোনো নাটক। আগে কখনো দেখি নি বা পড়ি নি। দেখতে দেখতে মনে পড়েই যায় কেনারাম বেচারাম-এর কথা। সেই ধাঁচেই পুরো কম্পোসিশন। মন কাড়ার মত অভিনয় যে খুব একটা আছে, তা নয়। গল্পের বাঁধুনীর টানে এগিয়ে যায় নাটক। অনেকটা পালিশের প্রয়োজন। টাইমিং এ সমস্যা আছে। সমস্যা আছে অভিনেতাদের চোখের দৃষ্টি সরে যাওয়ার ক্ষেত্রেও। তবে অবসরপ্রাপ্ত ডি-এস-পি, তাঁর সেক্রেটারী, ছোট-মেয়ে ও অল্পক্ষণের জন্য ভুল করে ধরে আনা কর্তাবাবুর ভূমিকায় যাঁরা অভিনয় করলেন, তাঁরা আলাদা করে দর্শকের মন জয় করেছেন। খুব কাঁচা অভিনয় যিনি আসলে অন্তর্হিত হয়েছেন, তাঁর। বড্ড আড়ষ্ট। কোথাও কোনো আলাদা নতুন সামাজিক ভাবে ভারী কোনো মরাল বা মেসেজ নেই। পুরোটাই কমেডি। হাস্যরসে পরিপূর্ণ।
তবে এরকম অভিনয় আমাদের বিভিন্ন পাড়াতেও হয়ে থাকে।  হয়ত আলো এবং শব্দের  অপটু সংযোজনের জন্য সেখানে নাটকের নাট্যগুণে খামতি থেকে যায়, অনেকটাই।এমনি সহজ-সরল এন্টারটেইনমেন্টের জন্য, ভালই। সব সময়ে সব কিছুকে খুব ভারী করে না দেখলে আমাদের আনন্দ পাওয়ার সুযোগ বাড়ে বই কমে তো না।
২। একই মঞ্চে একই সন্ধ্যায় অভিনীত হল দ্বিতীয় নাটক --অমীমাংসিত। থীম খুব সাধারণ বিয়ের পরে একজন আমাদের সমাজের মেয়ের কি অবস্থা হয়, পণ-প্রথার প্যাঁচে। রবিঠাকুরের ছোটগল্প দেনা-পাওনা-র পুনরুজ্জীবন। কিন্তু সেই খুব পুরোনো চেনা গল্পের নতুন মোড়ক মাননীয় নাট্যকার সৌমিত্র বসুর ছোঁয়ায় এক এমন অভিঘাত রেখে গিয়েছে যে আমি নিজেই নিজেকে নিয়ে অবাক। রেশ এর কিছুতেই কাটে না। অনেকদিন পরে এমন একটা নাটক দেখলাম, যেটা-কে সম্পূর্ন-রূপে নাটক বলা চলে। অনেক নামী-দামী নাটকের আধুনিক মোড়ক বদলাচ্ছে। সাউণ্ড-ট্র্যাক, কস্টিউম, মঞ্চ-বিন্যাস-এ হারাচ্ছে আসল নাটক ও অভিনয়-শৈলী। সেখানে শুধুমাত্র অভিনয় দিয়ে মানুষ-কে টেনে রাখা, তা-ও শুরুর দৃশ্য থেকে শেষ,খুবই কঠিন কাজ। শুধু রূদ্ধ্বশ্বাস  আর চোখের জল শরৎচন্দ্র যেমন টেনশন তৈরী করে ধরে রাখতেন,কাঁদাতে পারতেন,  বা নীহাররঞ্জন গুপ্ত, অনেকটা সে- রকম। তবে শরৎচন্দ্রের অতিনাটকীয়তা বর্জিত এই নাটকটি। চাঁচাছোলা। সোজাসাপটা। কিন্তু একজন যথার্থ পিতার জীবনের সবথেকে প্রিয়জন, তার সন্তানের অসীম আজীবন দুঃখ তাঁকে কোন মানসিক অসুস্থতার পথে ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে যায়, সেটাই দেখার।
স্টেজ কাঁপিয়ে অভিনয় করলেন সৌমিত্র বসু নিজে এবং তাঁর মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন যিনি। তবে সৌমিত্র বসু-র যথার্থ জুড়ি ছিলেন তাঁর বেয়াই মশাই। বর্ধমানের গ্রাম্য লোভী ব্যবসায়ী। এই চরিত্রে অভিনয় অত সহজ নয়! সেখানে একটা ঘড়িকে উলটো করে পরা, খাটো করে ধুতি পরা, পেট বের করে গেঞ্জির নিচ দিয়ে চুলকানো, ঠোঁট সরু করে ডিপ্লোম্যাটিক হওয়া, বা চরম নৃশংসতা, কোথাও কোনো খামতি নেই। ওনাকে অনায়াসে অভিনয়ের নিরিখে দশে-দশ দেওয়াই যায়।
অন্তঃসত্বা বাড়ির বৌ-কে পণ না দেওয়ার জন্য গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে মেরে ফেলে আত্মহত্যা বলে স্বামী, শ্বশুর ও শাশুড়ীর উদ্যোগের যে বাস্তব চিত্র স্টেজে দেখানো হয়েছে তা সত্যিই অনন্য ও অসাধারণ।ক্লাইম্যাক্স পেরিয়ে সেলসম্যান-কে বিষ মিশিয়ে হত্যার চেষ্টা, এবং তা আসলে বিষ নয়, জেনেও বিষ হিসেবে প্রয়োগের মাধ্যমে যে মানসিক বিকারগ্রস্ততার পরিতৃপ্তি একজন সামাজিক ভাবে নির্দোষ কন্যাসন্তান ও তার পিতা হওয়ার সুবাদে তিনি যে লাভ করছেন, তা অনবদ্য। 
এই নাটক-টি সকলের দেখা উচিত, শুধু প্রত্যেক চরিত্রের কাছ থেকে ছাল-ছাড়ানো অভিনয় কাকে বলে (ভাববেন না  অতি অভিনয় বলতে চাইছি), তা দেখার এবং যাঁরা নাটক করেন ও করতে চান, তাঁদের শেখার জন্য।
আমার আরো একবার দেখার ইচ্ছে রইল অন্তর্মূখ-এর এই বহির্মূখী প্রযোজনা।


No comments: