Saturday, 2 November 2019

২০শে আক্টোবর, ২০১৯ -- অন্তিম গর্ভাঙ্ক


২০শে অক্টোবর ২০১৯ অন্তিম গর্ভাঙ্ক

·         অংশ ১
-        --  আস্পদ্দার কতা দেখ দেখি! মদ খেয়ে পীড়া হয় বলে মদ ত্যাগ কত্তে হবে!-- পীড়া হয় প্রতিকার কর।মেডিকল সায়ান্স হয়েচে কি জন্যে? পীড়া আরাম করে আবার খা।বিচ্ছেদ-মিলনের সুখ পাবি – 

Rich the treasure
Sweet the pleasure
Sweet is the plasure after pain

·         অংশ ২
-“ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে শ্রী কৃষ্ণ দৈবকীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করিলেন
বাবা! এ তোমার হলপ পড়া নয়, এতে বিদ্যা চাই।
-আই ডু ক্যান। স্যর, ডু স্যর? সান-ইন-ল। ডু স্যর?
-করতো জামাইবাবু, তুমি যদি ঠিক কত্তে পার, তবে তোমাকে আমাই ডেপুটি বাবু করে দেব --ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে শ্রী কৃষ্ণ দৈবকীর গর্ভে জন্মগ্রহণ কল্যেন
- ইন দি মানথ অফ অগস্টো স্যর
-তুই যদি স্যর বলবি, তবে তোকে আমি ঘটিরাম করব।
-ইন দি মানথো আগস্টো, আন দি ব্ল্যাক এইট ডেজ,কিষেণজি টেক বার্থ ইন দি বেলী আফ  দৈবকী।

·         অংশ ৩
“Wine is the fountain of thought
The more we drink, the more we think”




এরকম অজস্র, অগুন্তি স্যাটায়ার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে নাটকের ছত্রে ছত্রে। যিনি নাটক বেঁধেছেন, তিনি জিনিয়াস জিনিষ (alliteration-এর স্বার্থে) দীনবন্ধু মিত্র। তৎকালীন চরমপন্থী স্বাধীনতা সংগ্রামীরা বোমা-বন্দুক দিয়ে যা করতে পারেন নি, ইনি একা কলমের খোঁচায় এমন নীলদর্পন লিখলেন, সায়েবরা সেই ঝটকাতেই কুপোকাত। বিস্ফোরণ পারমানবিক বোমার সমতুল।

সধবার একাদশী’  নামকরণের মধ্যে সে স্যাটায়ার লুকিয়ে আছে, তা নাটকে আদ্যোপান্ত বয়ে নিয়ে যাওয়া খুব দুরূহ কাজ। কিন্তু নিখুঁতভাবে তা সম্পন্ন হয়েছে।

সোহন বন্দ্যোপাধায়-কে অনেক ধন্যবাদ, যে এরকম পিরিয়ড নাটক তো আর হয় না সচরাচর। হলেও তা অন্য আঙ্গিকে। সেই এত পুরোনো নাটকটিকেই  অনুসরন ও অনুকরণ করে অনুরণন তৈরী করতে রীতিমত সাহস লাগে। আর তা দেখিয়েছেন।

নাটকের শুরুতে, ছোট ভূমিকা, যা মূল নাটকে ছিল না, বা মাঝে মাঝে বার্নাড শ এর মত বেশ খানিকটা বর্ণনা, নাটককে আরো অনেকটাই ঋদ্ধ করেছে। সেগুলো-তে দীনবন্ধু মিত্রের কোনো কৃতীত্ব নেই। সবটাই সোহন বাবুর প্রাপ্য।

ঘটনা, বর্ণনা বা ঘটনাস্থল দেখানোর জন্য মঞ্চের পিছনে প্রোজেকশন ব্যবহার করাটা ভালই হয়েছে। কিন্তু শেষের দিকে ব্যাপারটা একটু একঘেয়ে মনে হয়েছে আমাদের দুজনের।

সবথেকে বড় ত্রুটি বলে মনে হয়েছে, আবার-ও আগের নাটকটির মতো শেষে একটা মর‍্যাল প্রিচিং। না বললেই চলত না! আজকের সামাজিক চিত্রপটেও এই নাটকটি যে কালজয়ী, সেটা আলাদা করে না বললেই ভাল হত। দর্শক-দের স্বাধীন ভাবনা-চিন্তার ওপর এভাবে্ ছুরি-কাঁচি চালানো একপ্রকার নৃশংসতা ও একবারেই অনভিপ্রেত!

তবে বুঝতে পারি নি, বুমের-ও এরকম নাটক ভাল লেগে যাবে। শুরুতে একটু কিন্তু কিন্তু ছিল মনে। কিন্তু নিজেই যখন ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল, আমার কেমন লাগছে,আর আমি একটা  লাইভ স্মাইলী ওকে বিনিময়ে দিলাম, তখন বুঝতে বাকি রইল না যে ওর ভাল লাগছে বলেই প্রশ্নটা আমাকে করেছে। বাকিটা সময় তন্ময় হয়েই দেখল নাটকটা। এমনকি ব্রেকে বাইরেও গেল না একবারও। উলটে সেই সময়ে লক্ষ্য করল যে মাঝামাঝি জায়গায় কোন কোন আসন খালি পড়ে আছে, যাতে আমরা আরো একটু ভাল করে দেখতে পাই। তবে শেষ পর্যন্ত আর সে ঝুঁকি নিতেই হল না, কারণ আমাদের বুদ্ধি চুরি করে আমাদের সামনের দর্শকরা অন্য আসনে চলে গিয়েছেন। আর আমাদের দৃষ্টিপথে কোনো বাধাই নেই।

যত চরিত্র আছে, ছোটো-বড়-মেজো-সেজো-ন, সবাই তুখোড় অভিনয় করলেন। স্যাটায়ার-কে যথার্থ ভাবে ফুটিয়ে তোলার অভিঘাত এতটাই, যে দর্শক অত মনোগ্রাহী ডায়ালগে কোনো রকমে হাসির তোড়জোড় করলেও, হাততালি দেওয়ার উপক্রম হলেও, সেই ডায়ালগের পিছনে যে অন্ধকার-কে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে,তা এতই crude grotesque, সেই হাসি আর হাততালি-ও সিঁটিয়ে গিয়েছে।।ফেটে পড়তে পারে নি।আড়াই ঘণ্টা, চোখ সরলো না। যা সকলের অভিনয়, তাতে শুধু কাঞ্চন-এর চরিত্রে যিনি সেদিন ছিলেন, তিনি কোথাও কোথাও একটু কম। হয়তো সেদিনের জন্য কোনো এক অজ্ঞাত কারনে উনি একটু স্তিমিত ছিলেন। পরে আর এরকম হবে না। মহিলা চরিত্রে কুমুদিনী মন কেড়ে নেন। অটল-এর অভিনয় অসামান্য। সোহন বাবুর মত দাপুটে অভিনেতার সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে ওই মাপের অভিনয় করে যাওয়া চাড্ডিখানি কথা নয়। ভোলার চরিত্রে অভিনয় দেবাঞ্জনের। সে আমার আর বুমের ব্যক্তিগত স্তরে এতটাই ভাললাগার পাত্র যে আমরা তার অভিনয়ে অভিভূত, আপ্লুত। বোধহয় ওর প্রতি আমাদের দূর্বলতার দরুন একটু বেশি-ই প্রশংসা করে ফেললাম, কিন্তু কোনো মিথ্যে নেই। আচ্ছা, বরং সমতা বিধান করে দিই।  'ভোলা' চরিত্রে অভিনয় অনাড়ম্বর হলেও বেশ মনোগ্রাহী। দীনবন্ধু শেক্ষপীরের (Shakespeare)  নাটকের অনুকরনে ভাঁড় বা jester’ element  বা instrument-টিকে আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ফেলে কি সুন্দর করে ব্যবহার করেছেন, তা সত্যি-ই উপভোগ্য।

নিমচাঁদ দত্ত নিমে দত্ত মধুসূদন দত্তের নকলে  বাবু সমাজ, মধুসূদনের wasted talent  তাঁর অসম্ভব উন্নাসিকতা লিখে তো ফেলেছিলেন দীনবন্ধু মিত্র, ফুটিয়ে তো তুলেছিলেন কলমের ডগা দিয়ে খোঁচা দিয়ে হৃদয়ে রক্তপাত ঘটাতে, কিন্তু দীনবন্ধু যাঁকে যা কল্পনা করে লিখেছিলেন, তা স্টেজে ফুটিয়ে তোলা বেশ কষ্টসাধ্য। আমি তো আর দীনবন্ধু মিত্রের সময়ে গিয়ে এই নাটকের অভিনয় কোনোদিন দেখি নি, তবে সোহন বাবু যা করলেন, নিমে দত্তের ভূমিকায়, তা ঠিক বর্ননা করার জন্য যথার্থ শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। অনেকটা লিখব ভেবেছিলাম। কিন্তু এত ভাল, ভাল নয়। শেষে তাই ভাল-র তোড়ে খেই হারিয়ে গেল।

বুম তো ভেবেই পেল না, মানুষ-টা কি করে পর দু-টো নাটকে, দু-রকম মুডে, দুটো এক্কেবারে ভিন্ন চরিত্রে এ-রকম দাপটে অনায়াসে নির্ভূল ভাবে অভিনয় করে গেলেন! কি করে।

বেরিয়ে শুধু বলল,নিজের মনে মনেই, বিড়বিড় করে rigorous rehearsal  লাগে। তারপর সারা রাস্তা দু-জনের মধ্যে আর কোনো বাক্যবিনিময় হয় নি।

মৌনতা ভেঙ্গেছিল সেদিন ডিনারে চিকেন বিরিয়ানী আহারে








Tuesday, 29 October 2019

২০শে অক্টোবর, ২০১৯ঃ দ্বিতীয় অঙ্ক


ক্ষিদের চোটে আমার আর বুমের পেটে ততক্ষণে ছুঁচোয় ডন বৈঠক দিচ্ছে। সোয়া পাঁচটা হবে তখন। এতটা সময় কোথায় কাটানো যায়। বেশি দূরে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে হল না। লেডী রানু মুখার্জী মঞ্চের বাইরেই ভাজাভুজির ভুরিভোজ। যাঁরা সেখানে নিয়মিত নাটক দেখতে যান, সবাই সেই ফিশ ফ্রাই আর ডিমের ডেভিলের গুনমান সম্পর্কে সব জেনেও আবার খাবো স্টাইলে সেখানেই পেট ভরান। এই কাঊন্টারে এক অদ্ভুত ব্যাপার। কখনো আজ অব্দি দেখি নি যে চাহিদার সঙ্গে উৎপাদন এবং বন্টনের কোনো সামঞ্জস্য আছে। চাহিদার থেকে উৎপাদন কম রেখে একটা কৃত্রিম হাহাকার সৃষ্টি করা হয়, অকারনেই। যিনি বিক্রি করেন, তাঁর তাড়াহুড়ো দেখলেই মনে হবে, এই সব শেষ হয়ে গেল বুঝি এবং এর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই উনি পাত-তাড়ি গোটাবেন। বুম যথারীতি  ডিমের ডেভিল দেখে লালায়িত। আমার কাছ থেকে একশো টাকার নোট নিয়ে ভাঙ্গাতে গিয়ে না পেয়ে ফিরে এল। খুচরো নিয়ে যখন দু হাত দূরে আবার ফিরত গেল, শেষ ডিমের ডেভিল-টা নির্দয় কোনো ব্যক্তি বুমের জন্য অপেক্ষা না করেই কিনে নিয়ে রসনা তৃপ্তি সেরেছেন। সেই অজানা ব্যক্তি ও দোকানদারের প্রতি কুপিত হয়ে বুম আর সেখান থেকে কিছু খাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিল। আমি-ও কথা না বাড়িয়ে টিকিট কাউন্টারের সামনে মুক্ত মঞ্চের কাছে এলাম। সেখানে পাপড়ি চাট ছিল, এই বাঁচোয়া। পেটে ওই সুস্বাদু খাবার যেতেই, বুমের মুড ঠিক হয়ে গেল। আমার ভরসা নন্দন চত্তরের আদি অনন্তকাল থেকে চেনা সেই আমন্ত্রন। আশ মিটিয়ে দুটো ডিমের ডেভিল, একখানা ফিশফ্রাই ৩-১ শেয়ারে আর কয়খান কচুরী আলুর-দম দিয়ে। সঙ্গে একটা ছোট পেপসি কোলা। আহ! পেট জুড়োলে প্রাণ-ও জুড়োয়। তবে এত কিছু করেও, সবে তখন পাঁচটা চল্লিশ।

ভরসা পেন্টিং এক্সিবিশন, আকাদেমী অফ ফাইন আর্টস-এ। বুমেরও এই ব্যাপারে বেশ আগ্রহ আছে।কাছাকাছি কোথাও এলে আমি আর বুম সময় পেলেই এখানে একবার ঢুঁ মেরে যাই। ছবির কিছু বুঝি বা না বুঝি, আমার বিশ্বাস, আমরা ন্যূনতম নান্দনিক দৃষ্টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে অন্তত একটা আনন্দ খুঁজে পাই। যতটুকুই বোধগম্য হোক না কেন, সেখানে আলোচনা আমার আর বুমের মধ্যেই সীমিত। বুম লাইন ড্রয়িং/ পেনসিল স্কেচ ভালই আঁকে, কোনো ট্রেনিং বা শিক্ষানবিশী ছাড়াই। সেন্স অফ প্রোপোরশান বেশ ভাল। ইন্টারপ্রেট ও করতে পারে, নিজের সরল স্বাভাবিক চোখ দিয়ে। আমার মত জটিল মানসিকতা নয় বলেই বোধ হয়, অনেক কঠিন ছবি-ও দেখেছি নিজের মত করে সহজ সরল ভাবে ব্যাখ্যা করে দিতে পারে। আমার মনের সব জট ছাড়িয়ে হেসে বলে, তুমি! বাবা, তুমি এই সহজ ব্যাপারটা বুঝতে পারলে না! ইনক্রেডিবল”! অঙ্ক শিক্ষকের কথা মনে পড়ে যায়। মনে হয়, নাঃ! সত্যি-ই কি গর্হিত অপরাধ করে ফেললাম, এত সহজ জিনিষ-টা আমি বুঝে উঠতে পারলাম না। অনেক কিছু বুঝতে, শিখতে ও জানতে আজকাল বুম বা তার জেনারেশনের কাউকে আমার প্রয়োজন হয়। ওদের দেখার চোখ আমাদের থেকে একবারেই পৃথক -- অনেক সহজ, সরল, সোজাসাপটা। 

জল রঙ ২
জল-রঙ ১
যতই মিক্সড মিডিয়া-তে পেন্টিং এর চল বাড়ুক, যতই তেল রঙের আলো ছায়ায় ছবিরা প্রাণ পাক না কেন, আমার দেখার নেশা জল রঙ্-এ আঁকা ছবি। যাঁরা তা আঁকতে পারেন, তাঁরা ঈশ্বর, আমার কাছে। প্রথম জল রঙে আঁকা ছবি আমার চোখে লেগেছিল, অবন ঠাকুরের হাতে আঁকা। বাবা দেখিয়েছিলেন। ব্যাস ক্লাস নাইনে দেখা সেই ছবিগুলোই হয়ে গেল পরম ছবি, যার ওপরে বোধহয় বাস্তবে আর হয় না -- পরম শূন্য উষ্ণতার মত। ওটাই স্কেল। ওটা দিয়েই আজও ভাল খারাপের বিচার চলতে থাকে মনের গভীরে। আজ-ও কেউ অবন ঠাকুর-কে ছাড়াতে পারল না।

জল রঙ ৩
কিছু জল রঙ্-এ আঁকা ছবি দেখতে পেলাম, সেদিন। মিনিয়েচার। ১৬/১২ ফ্রেমে। কালার ক্রাঊড। ভিড়ে ঠাসা মানুষের কিছু ছবি। আর কিছু ছবি ঐতিহাসিক স্থানের,  ইঁট-পাথরের তৈরী, অনেক দর্শকের ভিড়। বেনারসের ঘাটের একটি অসাধারণ ছবি দেখে মনে পড়ে গেল অবন ঠাকুরের আঁকা গঙ্গার ঘাটের কাছে বট গাছের নিচের সেই প্রাত্যহিক চিত্রের কথা, জল রং-এ আঁকা, আবার-ও। সেই অসম্ভব ছবি গুগল ঘেঁটে পাওয়া যাবে না। জোড়াসাঁকো গেলে তবেই মানব জনম সার্থক হবে, অমন একটা ছবি কেউ আঁকতে পারে দেখে, তা-ও আবার জল রং-এ। ভেবেই পাই না -- জেবড়ে যায় না, একটু-ও একবার-ও!! একবার স্মাজ করলেই জল রঙ দিয়ে ছবি আঁকাই শেষ, মেক আপ এর কোনো জায়গা নেই ঠিক নাটকের মত একবার ডেলিভার করার পর, আর ফিরৎ এসে কারেকশনের সুযোগ নেই কোনো জায়গা নেই যে একটা ভুল ডেলিভারেন্স কে প্রোটেক্ট করবে। জীবনে রোমাঞ্চ  চাও? জল রঙ্-এ ছবি আঁক, বা নাটক কর, বুঝবে!  "The world is a stage..." ব্লা ব্লা ব্লাহ!!!

লেখাটা ভুল লাইনে চলে যাচ্ছে। ফিরে আসি।

আমি আকাদেমী গ্যালারী থেকে বেরোতে যাব, হঠাৎ পিছন থেকে বুমের ডাক, বাবা, একটা জিনি দেখবে এস। সাদার্ন গ্যালারীটা সেদিন এমন ভাবে আলাদা করা ছিল যে আমি লক্ষ্যই করি নি। ফটোগ্রাফি-র এক্সিবিশন চলছে। বুম আমাকে টেনে নিয়ে গেল একটা ছবির কাছে। এরকম ছবি তো কত তুলেছ তুমি! তোমার ছবির এক্সিবিশন হয় না কেন? এরকম প্রশ্নের উত্তরে আমি আর কি বলি! নিজেকে সিধু জ্যাঠা মনে হল। (এই allusion তাঁরাই বুঝবেন যাঁরা সোনার কেল্লা-য় সিধু জ্যাঠার ডায়ালগ টা জানেন)। মনে পোরে গেল চন্দ্রবিন্দুর গানের কিছু কলিঃ



"আমাদের বগল ভরা স্ট্রাগল আছে/ ছাগল ভরা মাংস

তাই চাড্ডি পরে শোধ করে যাই/ লোন-এরই ভগ্নাংশ
একদিন আমেরিকাও ধ্বংস হবে/ বিলেত যাবে ঝুলে
আর জয় বাঙ্গালী থাকবে শুধু/ ভাতে ঈশবগুলে..." 

আমি আর ব্যতিক্রমী হতে পারলাম কই!


মোবাইল ফোন, ক্যামেরার মেগাপিক্সেল, ডিজিট্যাল এডিটিং এর চক্করে এখন আর ছবি তোলার মধ্যে রোমাঞ্চ-টাই হারিয়ে গিয়েছে। শেষ মনে রাখার মত কিছু স্লাইড তুলেছিলাম, তাজমহলে। ফিল্ম স্লাইড দ্যাখার মত যন্ত্র আর পাওয়া যায় না। অনেক স্মৃতির হাত ধরে আবার ফিরে এলাম বর্তমান মুহূর্তে।

তৈল চিত্র
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এর ভারতীয় রিপ্রেসেন্টেটিভ অতনু পাল-এর এক্সিবিশন। সব ছবির প্রিন্ট ক্যানভাসে। টেক্সচারে যে নতুন এফেক্ট তৈরী হয়েছে তা ছবিগুলোকে অসাধারণ পেন্টিং-এর রূপ দান করেছে। কিছু ছবি বেশ abstract। উনি নিজে ভাগ্যক্রমে সেখানে ছিলেন। ওনাকে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক কি না, জানার জন্য কথা বলতেই উনি নিজেকে অনেকটা মেলে ধরলেন। বেশ কিছুটা সময় কেটে গেল। শিখলাম, দেখলাম এবং জানলাম যে শুধু প্রিন্ট করার সময়ে ক্যানভাসে প্রিন্ট হবে এটা বলে দেওয়াটাই যথেষ্ট। আলাদা কোনো চাপ নেই। আমার এর আগে কোনো ধারণা ছিল না যে ক্যানভাসে এত ভাল প্রিন্ট হয়। পরদিন সকালেই নিজের ক্যামেরার ধূলো ঝেড়ে বের করলাম। কিছুদিন আগে নিজের ওপর খুব রাগের মাথায় ছুঁড়ে ভেঙ্গেছিলাম। সারিয়েছি। দু-চারটে ছবি তুলে টেস্ট করে আবার তুলে রেখেছিলাম। বেরোনোর আর ইচ্ছে হয় নি। তবে দেখলাম এখনো চলে। কিন্তু একটা লেন্স একেবারেই গিয়েছে।

সময় প্রায় হয়ে এসেছিল। পরের প্রহসন দেখার জন্য।  সধবার একাদশী, দীনবন্ধু মিত্রের লেখা। আগের নাটকের টিকিট পয়সা দিয়ে কিনেছিলাম বলে দেবাঞ্জনের কাছে খুব গালি খেয়েছি। এ বারে আর এই সৎ সাহস-টা ওকে দেখাতে পারলাম না। ও আমাদের দু জনের জন্য দু-টো টিকিট আলাদা করে তুলে রেখেছিল। টিকিটের অলঙ্করণের ধারণা-ও বেশ আলাদা। দেখে ভালই লাগবে যেন ঊনিশ শতকের নিউজ-প্রিন্ট-এ তৎকালীন হরফে এবং ভাষায় ছাপা। বুমের খুব টেনশন হচ্ছিল, দেবাঞ্জন মেক আপ-টা নেবে কখন। সাড়ে ছটায় নাটক শুরু, তখন প্রায় ছটা পঁচিশ ছুঁই ছুঁই, আর দেবাঞ্জন তখনও আড্ডায় মশগুল। কি করে কি হবে! আমি বললাম, ওর চিন্তা-টা ওকে-ই করতে দিতে। কিন্তু বুম দেবাঞ্জনকে খুব ভালবাসে। কিছুতেই মাথা থেকে চিন্তা-টা গেল না। আমরা আকাদেমীর সামনে থেকে লেডী রানু মুখার্জী মঞ্চের দিকে হাঁটা দিলাম।

Monday, 28 October 2019

২০ শে অক্টোবর, ২০১৯ঃ প্রথম অঙ্কঃ


সকাল থেকেই একটা অন্যরকম অনুভূতি। আজ  আমার ছেলে-কে নিয়ে নাটক দেখতে যাব। এটা যে প্রথম বার, তা নয়। আগেও বহুবার গিয়েছি। কিন্তু উত্তেজনার পারদ-চড়া-টা অন্য জায়গায়। কলেজ জীবনের সেই দিন গুলোযখন পরপর দু-টো নাটক একটানা একদিনে দেখে ফেলা,বা পর পর তিনটে সিনেমাঅবশেষে আমার ছেলেকেও সেই পথে টানতে পেরেছি, যে সে অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে রাজী হয়েছে, এ এক বিরাট প্রাপ্তি।

বুমের কোচিং-ক্লাস ছুটি তিনটেয়। আমার ফোনে দেখি বুমের ফোন, পৌনে তিনটের সময়ে। কি করে ম্যানেজ করে পনেরো মিনিট আগেই বেরিয়ে এসেছে। আমিও আমার বন্ধু, নটরঙ্গের নাট্যকর্মী দেবাঞ্জনের কাছ থেকে নাটকের টিকিট সংগ্রহ করে,বুম-কে নিয়ে আসার জন্য তখন বাসে। শরৎ বোস রোড থেকে, আকাদেমী আমাদের সময়ে পৌঁছাতে হবে। বুমকে নিয়ে আবার ফিরতি বাসে। দেখতে পাচ্ছি প্রতিটি ট্রাফিক সিগন্যালে বুম অত্যন্ত বিরক্ত হচ্ছে, দেরী হয়ে যাচ্ছে বলে।  আমরা গেটে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেবাঞ্জন চিৎকার করে বলল, আরে কি গো, যাওভিতরেশুরু হয়ে গিয়েছে তো।

নাটকের নাম যদিদং নাটক ও নির্দেশনা, সোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিনয়ে, দেবশঙ্কর হালদার ও সোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। বিষয় মোটেও জটিল নয়। এক দম্পতি, তাঁরা ডিভোর্স চান। উপযুক্ত কাউকে না পেয়ে, ডিভোর্স লইয়ার ভেবে দেবশঙ্কর কে রাস্তা থেকে কিডন্যাপ করে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন আসু সমাধানের জন্য।কিন্তু পাকচক্রে দেবশঙ্কর হলেন একাধারে ভণ্ড উকিল এবং সাধুবাবা। কিন্তু খুব সাঙ্ঘাতিক রকমের মানবিক, ও বাস্তববাদী। দেবশঙ্করের হাত ধরে, মানুর মা, অর্থাৎ তাঁর স্ত্রী হয়ে ওঠেন এক জীবন্ত চরিত্র, যদিও স্টেজে, এমনকি ব্যাকগ্রাঊন্ডেও মানুর মা-এর একটাও ডায়ালগ, উপস্থিতি ও অস্তিত্ব নেই। দম্পতিদের শত পার্থক্য থাকলেও, রাগে মাথায় খুন চেপে গেলেও, দম্পতি-রা মন থেকে অবিচ্ছেদ্য-ই থেকে যান, অন্য কেউ-ই কোনোদিন সেই স্থান দখল করতে পারেন না। কাগজে কলমে যা-ই হোক না কেন, টান মুছে যায় না, সে তা কেউ স্বীকার করুক বা না করুক -- নাটকের এই হল সার বক্তব্য, আপাদমস্তক কমেডির মোড়কে।

দেড় ঘন্টার স্ল্যাপস্টিক কমেডী। অসাধারণ ডায়ালগ, বিস্তৃতি ও বিন্যাসের বাঁধুনী। অসাধারণ অভিনয়। অট্টহাস্য ও হাততালি-তে সরগরম অডিয়েন্স অডিটোরিয়াম-কে করে তুলছে গমগমে। এমন নাটক, মাত্র তিনটি চরিত্র নিয়ে যে হতে পারে, বুমের ধারণার-ও বাইরে ছিল। আর আমি এমন হিলারিয়াস নাটক শেষ কবে দেখেছি, ভুলে গিয়েছি। কেনারাম বেচারাম দেখতে গিয়েছিলাম, মনে সেভাবে দাগ কাটে নি। গরুর গাড়ির হেডলাইট-এর শো হাউসফুল হলেও, হেডলাইটের জোর স্তিমিত হয়ে এসেছে। সবথেকে মন ভেঙ্গে গিয়েছে 'ভূশণ্ডির মাঠে' দেখতে গিয়ে। অনেকটা আশা, আমার, বুমের যে একটা দারুণ অভিজ্ঞতা হবে। আশা এবং মোহ, দুই-ই  ভঙ্গ। যাক গিয়ে, আমরা বরং 'যদিদং'-এ আসি। নাটকটিতে দু'-একটা জায়গা ছাড়া, অশ্লীলতা বা কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর চেষ্টা কোথাও নেই। আসলে আদ্যোপান্ত কমেডি তৈরী করতে গেলে সারাক্ষণ সব জায়গায় একেবারে শুদ্ধ কমেডি পরিবেশন করা অসম্ভব। সেখানে নাট্যকার-কে অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের রুচি-র নিচে নামতে হয়। তবে এই নামার একটা সুবিধা আছে। কোথাও সাধারণ মানুষের কাছে এই ধরণের কমিক ডায়ালগ বেশ গ্রহণযোগ্য এবং তা নাটককে পপুলার করে বৈ কি! আমি বলছি না, 'যদিদং' সে রকমের উপাদানে পূর্ণ। দু-এক জায়গায়, হয়ত ভাবলে আরো সমৃদ্ধ কিছু বেরিয়ে আসতে পারত, যেখানে সোহন এবং দেবশঙ্কর বাবুদের মত প্রতিভাবান, অভিজ্ঞ নাট্যকার ও অভিনেতারা রয়েছেন। 

পুরো নাটকটা শেষ হওয়ার সময়ে শুধু নাটকের মেসেজ দেওয়ার জন্য আলাদা করে যে মরাল ডায়ালগ রাখা হয়েছে, তা হঠাৎ-ই পরিষ্কার হরফে নেমে আসার ফলে নাটকে সারাক্ষন ধরে চলে আসা কমেডি ধূলিসাৎ হয়ে যায় এবং এই মরাল প্রিচিং-এর মোড টা কোথাও যেন একটা দর্শকের মেরিট-কে খেলো করে দেয় যেন ও ভাবে না বোঝালে তাঁরা বুঝতেনই না।

মনে হতেই পারে বেশি খুঁতখুঁতে মানুষ হিসেবে এমন নাটকের দোষ-ত্রুটি ধরতে বসেছি।

কি একটা যেন থেকে যাচ্ছে, দুজনের মধ্যে, যেটাকে কিছুতেই ভাগ করা যাচ্ছে না। -- এটাই নাটকের মূল বার্তা। 

আর সবথেকে বড় যা থেকে গেল, নাটক শেষে, তা হল, কমেডির রেশ। কিছুতেই আলাদা করে তা ভাগ করা যাবে না, নাটক-টা না দেখলে।

মন ভেঙ্গে গেল। দেবাঞ্জন-কে যখন বললাম, আর একবার নাটক-টা দেখার ইচ্ছে রইল, দেবাঞ্জন আমাদের বলল, কল শো ছাড়া, এটা আর নটরঙ্গ স্টেজ করবে না, হয়ত"।

মন খারাপ লাগল বটে, খুবই। কিন্তু তখন-ও আর একটা নাটক দেখা বাকি। 

আমাদের খুব ক্ষিদে পেয়েছিল। সকাল ১১টার পর থেকে পেটে কোনো দানা-পানি পড়ে নি, বুম, আমার দুজনেরই।

Sunday, 20 October 2019

বিল্টুর ডায়েরী - চতুর্থ পর্ব

স্কুলের পরীক্ষা চলছে বিজ্ঞান খাতায় ইচ্ছে হচ্ছে লাল-নীল-সবুজ-হলুদ, সব রঙ মিশিয়ে গুলে ঢেলে দিই হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলেন তৃষ্ণা ম্যাডাম মাথার চুলটা এমন করে কেটেছেন যেন ধূমকেতু পায়ের নখ, হাতের নখে ফ্লুরোসেন্ট নেলপালিশ আমার সামনে এসে আঙ্গুল নেড়ে কি যেন বলতে গেলেন দেখলাম, নেলপালিশ আর চোখের মণি, দুটোই নীল রঙের এল--ডি বাল্বের মত জ্বলজ্বল করছে কি ভূত না কি! আমি ভয়ের চোটে কিছু বলার আগেই ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললাম আর সায়েন্স ম্যা কে জিজ্ঞেস করলাম চিৎকার করে,

-       - - কেন তৃষ্ণা ম্যা আমাকে মার্ক করে এরকম সব সময়ে পিছনে লেগে থাকেন আর অপদস্থ করেন সকলের সামনে?

এর জবাব এল আরও সাংঘাতিক ভাবে সায়েন্স ম্যাম হোয়াইট বোর্ডে মার্কার পেন দিয়ে ক্লাস টেন-এ কি সব খোপ কাটা কাটা চৌকো চৌকো ঘরে গ্রাফ বলে যেমন করে দাঁড়ি কাটে, সেই সব এঁকে সেরকম করে বোঝাতে আরম্ভ করলেন দুটো লাইন টেনে, একটা ক্রস চিহ্ন বানালেন যেখানে একটা লাইন আর একটা লাইন কে ক্রস করেছে একটা পয়েন্টে। ঊনি বলে চলেছেন,

-        - - এটা এক্স অ্যাক্সিস, আর এটা ওয়াই আর, এই ধর গিয়ে হলে তুমি দুটো রে (আলোর সোজা লাইন্) তোমার ওপরে বাইসেক্ট করছে আমরা দেখতে পাচ্ছি।...তাই তোমাকেই বাছা হয়েছে, সবার মধ্যে থেকে। তুমিই সে...যকে বার বার বেছে নেওয়া হবে, সবার সামনে অপমান করার জন্য্, বারে বারে...

ক্লাসের ফার্স্ট বয় কিংশুক বলে উঠল,
-          মুরগী! কোঁকর কোঁ!
-           
সারা ক্লাস হেসে উঠল। তৃষ্ণা ম্যাম স্কেল টেবিলে ঠুকে সাইলেন্স বলে চেঁচালেন বটে, কিন্তু ওনার ঠোঁটের কোনেও সবটা সাপোর্ট করে একটা মুচকি হাসি। যার মানে হল গিয়ে, ঠিক হয়েছে! এটাই তোর শাস্তি! ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম  না যে, আমি করেছি টা কি?
মনে মনে আরও ভাবলাম, আমার কি দোষ, বাবাও তো ঠিক এরকম করেই মা এর সঙ্গে ঝগড়া হলে এই একই প্রশ্ন করে, আরে বাবা, আমি করেছি টা কি? আমার বাবাকে তখন একটা বেচারা ভালমানুষ মনে হয় শুধু এখন আমাকে কেউ ভুল করে এরকম বেচারা ভাবে না, আর ভাল ভাবা তো দূর্! তবে আমার বয়েই গেল। সারাদিন সব জায়্গা থেকে বকুনি খেতে খেতে এখন অভ্যেস হয়ে গ্যাছে। তাই আর গায়ে মাখি না বিশেষ। বলছে বলুক। এরা সব, মানে বড়রা নিজেদের নিয়েই স্যাটিসফায়েড নয়, তাতে আমাদের নিয়ে তো হবেই। হিংসে হিংসে! আমরা যে দিব্বি খেলে-দেলে-টিভি দেখে-খেয়ে দেয়ে আনন্দে আছি, সেটা মনে হয় সহ্য করতে পারে না। আর ভাল সুবিধে হল যে, আমরা কিছু ঘুরিয়ে বললেই, আমরা 'ঈল ম্যানরড্', বড়দের ঠিক সম্মান করতে শিখিনি। এ সব আর কতদিন চলবে! 

...ওদিকে একগাদা লাইন ওই বোর্ডে আমার ওপর দিয়ে আঁকা চলতে লাগল শেষে মনে হল একটা মাকড়সার জাল, আর সেই জালে আমি আটকে গেছি একটা মাকড়সা, ইয়া বড়, আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে তার চোখ দুটোও তৃষ্ণা ম্যামের মতই, এল--ডি লাইটের মত জ্বলছে, আর তার থেকে বের হচ্ছে লেজার-রে সেই লেজার রে আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। আমি যেন কানা। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। আমি কোন দিকে যাব, কোথায় গিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাব, কিছুই ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না আর নড়ব কি! মাকড়সার জালে বন্দী যত চিৎকার করতে যাচ্ছি, গলা ভয়ে বুজে যাচ্ছে ঠোঁট নড়ছে শুধু, কিন্তু কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছে না হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে মরে যাওয়ার আগের মুহূর্ত। ম্যামের মত দেখতে মাকড়সাটার রেঞ্জের মধ্যে আমি, এক লহমায় আমাকে নিজের শুঁড় দুটো দিয়ে বা সামনের হাত দুটো বাড়ীয়ে গিলে ফেলতে পারে! হাঁ করে সবে এল-ই-ডির মত জ্বলতে থাকা নখ সমেত দাঁড়ার ঝাপটা দিতে যাবেন, আমাকে মারার জন্য, কোথা থেকে দেখলাম আমাদের দুজনের মাঝখানে প্রিন্সিপ্যাল স্যার এসে হাজির, বাজপাখির রঙের শেডের ব্লেজার পরা আর শকুনের মত ঠোঁট।

-         -- কি ব্যাপার তৃষ্ণা! তুমি আবার.....আবার এর পিছনে লেগেছ! তুমি আমার রুমে এস, কথা আছে।

-         -- স্যার, না...মানে, এই ছেলেটি বড় অসভ্য। সব পরীক্ষায় টুকে টুকে ভাল ছেলে সাজতে চায়।

-       -- তাই নাকি! ( তারপরে আমার দিকে তাকিয়ে)  তাহলে তো তুমি খুব বড় অভিনেতা, সাত্যকি! 

         আমি তো কিছু বুঝে উঠতে পারছি না! কি যে আমার ওপর আসতে চলেছে, কে জানে! 

ত       -- তোমার  জন্য এইবারে আমাদের এই স্কুল প্রথমবার গানের কম্পিটিশনে স্টেট লেভেলে পৌঁছেছে। তুমি কার কাছে গান শেখ?

-        -- কারোর কাছে নয় স্যর। বাবাও চান আমি কারো একজনের কাছে শিখি, কিন্তু মা চায় না। স্কুলের এত পড়াশোনার চাপ... তারপর আমি যেগুলো ভাল পারি সে সব নিয়ে বসার সময় হয় না। আর সময় হলেও সেগুলো তো সবাই বলে 'সময় নষ্ট'। তাই আর সময় হয়ে ওঠে না। 

-        -- সে কি কথা ! তোমারএত ট্যালেন্ট্...জাস্ট নষ্ট হতে দেওয়া যায় না! তোমার বাবা-কে আমার সঙ্গে দেখা করতে বোলো, খুব শিগগির। তোমার ডায়েরী নিয়ে ছুটির পরে আমার সঙ্গে দেখা কোরো। আমি লিখে দেব। আমাদের সবাইকে তোমাকে নিয়ে সপ্তাহ খানেকের জন্য দিল্লী যেতে হতে পারে। সেই সময়ে যত পরীক্ষা থাকবে, তোমার জন্য মাফ। তোমাকে দিতে হবে না

আমি অবাক চোখে দেখলাম প্রিন্সিপ্যালের দিকে। একবার চোখ বন্ধ করে আবার তাকালাম। দেখলাম স্বয়ং শিবঠাকুর দাঁড়িয়ে, প্রিন্সিপ্যালের জায়গায়। আমার কাঁধে হাত রেখে মুচকি হাসলেন। সে হাসির মানে আমি বুঝি আমি আছি তো, তোমার চিন্তা কিসের। অত সুন্দর ধুঁতরো ফুল রাস্তার পাশের গাছ থেকে এনে আমাকে তুমি দিয়েছ। সবাই তো এটা ওটা যা দেয়্, কিনে দেয়। তোমার দেওয়ায় আমি খুশি হয়েছি।

সবে শিব্ঠাকুরকে আমি কিছু বলতে যাব, দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আর পল্টু হাঁ করে চেঁচাচ্ছে।....

ওঃ! বুঝলাম! যা দেখলাম সবই স্বপ্ন। এখন সকাল। মনে করার চেষ্টা করলাম, সেদিন কি বার, স্কুলে যেতে হবে কি না! হ্যাঁ। বুধবার। আজ আবার পরীক্ষাও আছে, বিজ্ঞান। 

আচ্ছা বিজ্ঞান তো এত কিছু পারে! কেন পারে না আমাদের মত ছোটোদের একটা ব্যবস্থা করতে.... এরকম ভয়ানক লেখাপড়ার হাত থেকে একটু মুক্তি দিতে!

কোনোমতে রেডি হয়ে স্কুলে গিয়ে পৌঁছালাম। ফার্স্ট পিরিওডেই পরীক্ষা। আবার তৃষ্ণা ম্যাম! কি বিতৃষ্ণা!

-     -- এই যে সাত্যকি! গুড মর্নিং! কনগ্র্যাচ্যুলেশন! উই আর অল প্রাঊড অফ ইউ! তোমার জন্য আজ স্কুলের ইতিহাসে প্রথম ঘটেছে এমন একটা ঘটনা। আমাদের স্কুল জুনিয়র সোলো ভোক্যাল কম্পিটশনে স্টেট লেভেলে গিয়েছে, আর তুমি হচ্ছ আমাদের স্কুলের একমাত্র রিপ্রেসেন্টেটিভ।
      আমি অবাক! সময় নিয়ে ঢোঁক গিলে কোনোমতে বললাম,

-          -- থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাম!

এই কথা মুখ থেকে বেরোলো বটে কিন্তু, ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না, এ ও স্বপ্নের অংশ নয় তো! নিজের গালে কষে এক থাপ্পড় মারলামজেগে আছি কি না দেখতে!

ম্যাম বললেন,

-     -- এ কি সাত্যকি? কি করছ তুমি? পাগল হয়ে গেলে নাকি! নিজেকে ওভাবে কেউ মারে নাকি! 
       বলে কাছে টেনে নিয়ে মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে আমার সামনে নিচু হয়ে বসে বললেন।

-        -- আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। পারবে  আমাকে ক্ষমা করে দিতে?

আমি শুনেই কেঁদে ফেললাম।  সারা ক্লাসরুমে সকলের সামনে ওনার কাছ থেকে এতটা সম্মান তো আমি কোনোদিন পাই নি! কারো কাছ থেকেই পাই নি। কাউকে দেখতে পাচ্ছি না, চোখ ঝাপসা। ম্যাম ততক্ষণে আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন।  মায়ের মতই সুন্দর গন্ধ ওনার গায়ে। আমাকে যখন ছাড়লেন, দেখলাম ওনার দু-চোখেও জল। গর্বে চিৎকার করে বললেন,
-         -- থ্রি চিয়ার্স ফর সাত্যকি!
         সারা ক্লাস গম গম করে উঠল।
-          -- হিপ হিপ হুররে!
 আর আমি মনে মনে বললাম,
-          -- জয়, শিবঠাকুরের জয়! জয়, বাবা-মায়ের জয়! জয়, পল্টুর জয়!
 -- আজ পরীক্ষাটা দারুণ হবে। কিচ্ছু গুলিয়ে যাবে না। কিচ্ছু ভুলে যাব না লিখতে লিখতে।

(চলবে...)