আমার মুঠোফোনে বারবার নোটিশ – স্নিগ্ধদেবের
গানের অনুষ্ঠানের। ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১৭। আবার সেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের
ডক্টর ত্রিগুণা সেন মঞ্চে। এই মঞ্চে বোধ হয় উনি সবথেকে সাবলীল। নিজেকে একটা ঘরোয়া পরিবেশের
মধ্যে খুঁজে পান বলে এমন বলিষ্ঠ হয়ে ওঠে ওনার পরিবেশন, যে তাঁর নিজেকে মেলে ধরার মধ্যে
বেশিরভাগ-টাই দেখে শুনে মনে হয় উনি বোধ হয় কাউকে শোনাতে আসেন নি, শুধু নিজের আত্মিক
প্রশান্তি খুঁজে পেতে গান গাইতে এসেছেন।
‘এই সময় লাইভ’ আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের
মূল ভিত্তি ছিল রাগাশ্রয়ী কিছু গান। আমি যখন পৌঁছালাম তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা। সাউণ্ড
চেক সবে শুরু হল। আমার কাছে কোনো এন্ট্রি-পাস ও ছিল না। গিয়ে জানালাম স্নিগ্ধদেবকে।
শুধু বললেন ওসব কিছু লাগবে না। আমি আমার আসন এমনিই দখল করতে পারি। সাউন্ড চেকের সুবাদে
কিছু অনুষ্ঠানের বাইরের গানও শোনা হয়ে গেল।
 |
| আর্য |
অনুষ্ঠান স্নিগ্ধদেবের একক নয়। সঙ্গে ছিলেন দুই নামকরা শিল্পী
– আর্য এবং নন্দিনী। আর্য-কে প্রথম জানলাম চিনলাম এখানেই। সুদূর
জলপাইগুড়ি থেকে এসেছে্ন তিনি। বয়স ১২ বছরের কাছাকাছি মাত্র।স্কুলের বাৎসরিক পরীক্ষা
শেষ করে চলে এসেছেন। আর নন্দিনী সঙ্গীত জগতের এখন এক অতি পরিচিত নাম। অনুষ্ঠানের সূত্রধার শুরুতে সকলের পরিচয় এবং স্তুতিতে
যখন ব্যস্ত, আমাআর তখন মনে হচ্ছিল, গান শুরু হোক, এত কথা কেন!
রাগসঙ্গীত কেমন হয় তা বোঝাতে এই অনুষ্ঠানের অয়োজন নয়। রাগভিত্তিক
সঙ্গীতের মধ্যে যে মাধুর্য লুকিয়ে আছে তা শ্রোতৃবৃন্দকে অনুধাবন করানোই শিল্পীদের একমাত্র উদ্দেশ্য।
তাই সমস্ত পরিবেশন সাজানো হয়েছিল, এক অনিন্দ্যসুন্দর সূত্রে – দিবসের সান্ধ্যকালীন লগ্ন থেকে ভোরের আগে পর্যন্ত পর পর যে
সমস্ত রাগ একে একে সময়-কে প্রক্ষিপ্ত করে চলে, সেই বিন্যাসে।
 |
| নন্দিনী |
পরপর দর্শক বিমুগ্ধ হলেন মধুবন্তী, হংসধ্বনী, খামাজ, পাহাড়ী,
বাগেশ্রী, কাফি, কৌশিকধ্বণি ও বৈরাগীর চলনে। অসাধারণ চিন্তায় বিন্যস্ত হল ্প্রতিটি
রাগের চলন অনুযায়ী পরিচয়জ্ঞাপক সংগীত এবং তাদের ওপর ভিত্তি করে বহুল প্রচলিত, হিন্দি
এবং বাংলা গানের সমাহার।
শুরুতেই সরস্বতী বন্দনায় আর্য দেখালেন তিনি এই বয়সে নিজেকে কোন
উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন, অনেক উচ্চগ্রামেও তিনি কি প্রচণ্ড সাবলীল। অনেক বড় নামকরা গায়কের
যে কোনোদিন হিংসার কারণ হতে পারে তাঁর বিস্তার।মনে গুঞ্জরণ সৃষ্টি না করে ক্ষান্ত হলেন
না তিনি। “থোড়ি সি রহিয়ো, অব না যাইয়ো…” তে আবার প্রমাণ করলেন, যাঁদের সঙ্গে বসেছেন, তাঁদেরকে কোথাও
কোথাও ছাপিয়ে যেতেই পারেন। তবে অল্প বয়সের কারণেই হবে হয়ত, সরগম- এর তাৎক্ষনিক বিস্তারে
যে কল্পনাপ্রবাহ থেকে সুরসৃষ্টির প্রতিফলণ ঘটে, সেখানে খানিকটা অভাব প্রতিভাত হয়। হেমন্ত
মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া “আমার ক’বার মরণ হবে বল…” অসাধারাণ
লাগল নন্দিনীর কন্ঠে। এই গানটি আসলে সদ্য ইহলোক ছেড়ে চলে যাওয়া জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের “ডোর ডোর বোলাওত, মতওয়ারী”-র উপসর্গ
মাত্র, তা-ও দেখালেন নন্দিনী।
 |
| স্নিগ্ধদেব |
সবকিছুর মধ্যে কাফি রাগে গাইলেন স্নিগ্ধদেব, “যবসে শ্যাম সিধার…”। সেই সঙ্গীতের
অনুরণন, ততক্ষণ শুনে আসা সব সুর ও বিন্যাস-কে ছাপিয়ে গেল। আমার মনের আধার সেই সন্ধ্যায়
এই সঙ্গীতসুধা আহরণ করে পরিপূর্ণ হল। আর জায়গা রইল না তারপরে।
হ্যাঁ, এটা সত্যি, শেষ পর্যন্ত বসে ছিলাম, যদি এর থেকেও ভাল
কিছু শুনতে পাই, এই আশায়। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। সেদিনের শিল্পীদের মধ্যে নন্দিনীই
একমাত্র জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ মহাশয়ের সরাসরি শিষ্যা। তিনি তাঁর শ্রদ্ধেয় সদ্যপ্রয়াত গুরুদেবকে
শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করলেন, অনুষ্ঠানের শেষ গান দিয়ে “আমি তো হার মেনেই আছি/দেখি জয় কর কি করে…”
সত্যি-ই আমাদের সব
শ্রোতাদের বাস্তব বাহ্যিক চেতনার উপলব্ধি বিলীন হয়েছিল শিল্পীদের সুর-তাল-লয়ে, আর সোলো
হারমোনিয়ামের মিউজিক্যাল ইন্টারভ্যালে।