Tap here for Drishya Bharati e-mag Nov 22 Issue
লুইজি পিরানদেল্লো - কজন নাম শুনেছেন? নাট্যকার বা নাটককার হিসেবে জুড়ি মেলা ভার। তার ওপর আবার ইংরেজীতে লিখতেন না। লিখতেন মাতৃভাষা ইতালীয়তে ৷ একাধারে গল্প ও কবিতাও লিখেছেন। তবে যেহেতু তাঁর লেখা খুব একটা অনুদিত হয়নি তাই বিশ্বসাহিত্যের দরবারে তাঁর পরিচিতি তুলনামূলক ভাবে বেশ কমই বলা চলে ৷ ১৯৩৪ সালে তাঁকে সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় ৷ কেন তাঁকে এই পুরস্কার? না His almost magical power to turn psychological analysis into good theatre. বাংলা ভাষায় কিছু নাটক পাগল মানুষ তাঁদের বিদ্যা ও বুদ্ধি দিয়ে উপলব্ধি করেন যে পিরানদেল্লো নিজের নাটকের মধ্যে সেই ঈসকাইলাসের সময় থেকে শেক্সপীয়রকে গুরু মেনে আর ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ববাদের সমস্ত এলিমেন্টস কে এক করে যা তৈরী করছেন তা হাইজেনবার্গের বোমা আবিষ্কারের থেকে কিছু কম ছিল না। এক একটি নাটকের আঘাত যেন এক একটি পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ৷ মানুষ ভেবেই পাচ্ছে না- একি দেখলাম একি শুনলাম একি পড়লাম। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে আরম্ভ করে রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত সবাই ওনার নাটক দ্বারা দারুণ ভাবে অনুপ্রাণিত হন।
অনেক আগে একবার দেখেছিলাম " কোথাকার চরিত্র কোথায় রেখেছ " । এটা দ্বিতীয়বার। গত ২১ শে অক্টোবর '২০২২ - এ মধুসূদন মঞ্চে শো ছিল। লোভ সামলাতে পারিনি। গিয়েছিলাম ৷ প্রথমেই দেবেশ চট্টোপাধ্যার মহাশয় কে ধন্যবাদ জানাই যে সংস্তবের হাত ধরে উনি বেশ কিছু প্রডাকশন কে বাংলা থিয়েটারের জগতে বেশ জোরালো ভাবে ধরে রেখে দিয়েছেন। এগুলির অস্তিত্ব সংকট তৈরী হত যদি না উনি হাল ধরতেন এবং সেগুলিকে প্রয়োজন অনুপাতে সমসাময়িক করে তুলতেন।
"Six Characters in Search of an Author" – পিরানদেল্লোর লেখা ও অভিনীত নাটকটির আসল নাম এটাই। ১৯২১ সালে এটি প্রথম অভিনীত হয়। দর্শক স্তম্ভিত হন, চিন্তার প্রসারে ৷ সাহিত্য কি? আমরা সকলেই সাধারণ ভাবে জানি যে সাহিত্য হল গিয়ে সময়ের দলিল স্বরূপ ৷ গল্প, উপন্যাস, কাব্য, নাটক - যা ই হোক না কেন তাতে চরিত্র লাগে একজনই হোক বা দশজন। তবে না প্লট কে বাঁধা যাবে!
এবার ভাবুন যে আপনার বাড়িতে কিছু অজানা অচেনা মানুষ এসে আপনাকে ডেকে বললেন -
"দাদা আমরা না এই কজন চরিত্র আছি , আমাদের
গল্পটা একটু লিখে দিন না… সবই রেডি , আপনি শুধু
লিখে দেবেন।" চমকে যাওয়ার মত,
তাই না?
তবে আজকাল যে রকমারী contents আপনারা দেখছেন , সে তুলনায় আপাত ভাবে পানসে মনে হতে পারে। কিন্তু কিছু
জিনিস থাকে যা ঠিক বলে বোঝানো যায় না… এই নাটকটি ঠিক সেরকম ৷
নাটকটি দেখতে যাওয়ার আগে আমার
সঙ্গী আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে নাটকটি আসলে কি নিয়ে - মানে বেসিক থিমটা কি ৷ আমি
তখন উত্তর দিতে পারিনি ৷ তবে নাটক দেখে বেরোনোর পর ওকে উত্তর দিলাম নাটকের মধ্যে
থাকা সংলাপ থেকেই -
এই নাটকটার কাজ ই হল
চরিত্রাগুলোকে ঘেঁটে দেওয়া ৷
আপাতভাবে খুব ইন্টেলেকচুয়াল
শোনালেও আদপেই কিন্তু তা নয় । বরং একদম মূল বিষয় - নাটক হল বাস্তবের রুপায়ণ মাত্র
৷ অভিনয় করে কখনোই সেই সব বাস্তব চরিত্রের কাছাকাছি পৌঁছানো যাবে না।
বাকি টা বলা অসম্ভব্।
নাটকটি দেখতে গেলে নাটক শুরু
হওয়ার পনেরো মিনিট আগে পৌঁছাতে হবে। নাটকের শেষ বোঝা গেলেও শুরুটা বোঝা অসম্ভব।
নাটকের দশ মিনিটের বিরতিও অদৃষ্ট্পূর্ব। বাকিটা ম্যাজিক। চোখ ফেরানো দায়। মোনালিসা
চট্টোপাধ্যায় আর অভ্র মুখোপাধ্যায় সারাটা মঞ্চ জুড়ে যা করে গেলেন তা অভিনয় শিল্পে
স্মরণীয়। সেখানেই কোথাও একটা বাস্তব চরিত্র ও অভিনয়ের দাগটাকে সুচারুরূপে মুছে
দেওয়া হয়েছে ৷ অভিনয় করতে করতে অভিনয়কেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে সেটিকে আবার
দর্শকের মনে গেঁথে বসিয়ে দেওয়াও একটা চ্যালেঞ্জ৷ দুগ্ধ মন্থন করলে যে স্নেহজাতীয়
পদার্থ লব্ধ হয় - এ তার মত ৷ যত মন্থিত হয়,
উপলব্ধি ততই উদ্ভুত হয় ৷ প্রশ্ন ততই
প্রকট হয় - কোনটা সত্যি?
সত্যিই তো অভিনেতাদের কোনো সত্ত্বা নেই। তারা আজ এই চরিত্রে কাল ওই চরিত্রে অভিনয় করে বাস্তব চরিত্রের কাছে আসার চেষ্টা করেন মাত্র ৷ তাঁরা কোনো দিনই আসল চরিত্র হয়ে উঠতে পারবেন না। বাস্তব চরিত্রেরা অনেক বেশি দড় ৷ তাঁদের নড়বার জায়গা নেই ৷ যার যেখানে যতটুকু ভূমিকা তা তারা প্রত্যেকে করে যেতে বাধ্য ৷ অভিনয় করে কি আর সেই বাস্তবকে পুনসৃষ্টি করা যায় নাকি!
দৃশ্যতঃ এই মঞ্চেসেই পুনঃ
সৃষ্টি প্রকল্পের যথার্থ ভাগীদার হলেন আলোক প্রক্ষেপক পল্লব জানা ও সপ্তর্ষি
মজুমদার আর আবহ প্রক্ষেপক অনিন্দ্য নন্দী ও ময়ূরছন্দা ঘোষ। স্বাভবিক অভিনয়ের
তোড়ে কিছু কিছু জায়গায় স্পটলাইট মিস হয়েছে ৷
অভিনয় নিয়ে কিছু বলার হলে
কয়েকটি চরিত্রের কথা একটু বলার দরকার। এক,
বাচ্চা ছেলে ভ্যাবলার ভূমিকায় ময়ূখ।
পাক্কা দু ঘন্টা ধরে নির্বাক স্থবীর অসহায় একটি চরিত্রে কি মারাত্মক অভিনয়!
শিক্ষনীয়। মায়ের চরিত্রে তমালী চৌধুরী অসাধারণ ৷ আর অসীম রায়চৌধুরী তো পোড়
খাওয়া অভিনেতা ৷ নাটকের কনক্লিক্টের তিনিই উল্টোদিকের সূত্রধার।
আর আলাদা করে নজর কেড়েছে কোরক
সামন্ত, ছেলের ভূমিকায়। তার অভিব্যক্তি চালচলন ক্ষোভের বহি:প্রকাশ আলাদা করে
নজর কাড়ে। বাকি সবাই খুবই ভাল, তবে আলাদা করে নজর কাড়তে পারেন নি ৷
তবে নাটকটি দেখে সাহস করে একটা
কথা আপনাদের সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিই - নিউটনের আপেল পড়া দেখার মত পিরানদেল্লোর
মধ্যে এই নাটকের সৃষ্টির বীজ কোথাও না কোথাও সেই বিখ্যাত সংলাপে নিহিত আছে বলে
আমার ধারণা :
"All the world's a
stage and all the men and women, players."
এটা কার লেখা জানতে চেয়ে
আমাকে নিশ্চয়ই অপ্রস্তুতে ফেলবেন না।
আর আমার ধারণা ভুল কি না তা
নাটকটি ভবিষ্যতে দেখে আমাকে জানাতে ভুলবেন না। আমারও তো দল ভারী করার একটা তাগিদ
থাকেই না কি!


No comments:
Post a Comment