প্রসঙ্গ -- নীহারবালাঃ
সালকিয়ার বাড়ি থেকে যখন বেশ কিছু পুরোনো shellac মানে গালার রেকর্ড উদ্ধার করা হল, তখন কি আর জানতাম, যে আমি এরকম একটা ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে পড়ব!
বন্ধু ড.রাজীব চক্কোত্তি (তুখোড় ভাষাবিদ ও ‘শৃন্বন্তু’-র মাননীয় সম্পাদক) মশায় যখন আমাকে প্রথম দু’টি গান গালার রেকর্ড থেকে ডিজিটাইজ/ ডিজিটালাইজ করে পাঠালেন, আমি সেই গান দু’টির গায়িকা নীহারবালা সম্পক্কে দু-চার কথা লিখতে গিয়ে বেশ হোঁচট খেলাম। শ্রীমান গুগল-জেঠুর কাছেও just কোনো তথ্য নেই। আছে কুল্লে একখান ছবি।
অগত্যা কি আর করা যাবে! এই সব ব্যাপারে আমার সর্বশেষ ভরসা আমার গুরুদেবসম দাদা ও প্রতিবেশী অনিন্দ্য-দা (অনিন্দ্য রায়)-র শরণাপন্ন হলাম। এটুকু বলে রাখি, যে উনি সত্যি-ই সিধু-জ্যাঠা বটে। ভারতীয় মার্গ সঙ্গীত ও ইতিহাস, তথা পুরোনো বাঙালীর শিকড়, (ফুটবল সমেত) সম্পর্কে ওনার জ্ঞান বিস্ময়কর ও তা গল্পের ছলে অনায়াসে যে ভাবে তিনি বলে যান, সে-ও সত্যি-ই রোমহর্ষক। উনি আবার নিজে জাত তবলিয়া। তবে পেশায় ব্যবসায়ী। আমি এরকম oddly combination-এ talented মানুষ ওনাকে ছাড়া আর আমার নিতান্ত ক্ষুদ্র পরিসরে আর দ্বিতীয় দেখেছি বলে প্রতিভাত হয় না, যিনি এভাবে অতি অনায়াসে প্রয়াসহীন ভাবে ঘণ্টার পর ঘন্টা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মার্গসঙ্গীত কে মিশিয়ে মনোহর গল্প বলে যেতে পারেন। শ্রোতার বয়েস সাত থেকে সত্তর, যে কোনো।
এই রে! আমি কিন্তু অনিন্দ্য-দা বা রাজীব চক্কোত্তি--কারোর প্রোফাইলের গল্প বলতে বসি নি। শুধু এইটুকু শুরুতেই বোঝাতে চাইছি যে, আমার মত কিচ্ছু-না-জানা একজন মানুষ এঁদের মত গুণীজনের সান্নিধ্য পেয়ে ধন্য। আর, আমি প্রথমেই সঠিক মানুষগুলির কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলাম, যথার্থ কারণে। অনিন্দ্য-দা প্রথম দিনেই আমাকে যথেষ্ট তথ্য দিয়েছিলেন, এবং তা দিয়ে অনায়াসে নীহারবালার জীবনী উচ্চমাধ্যমিকের রচনার মত করে লিখে ফেলাই যেত, কিন্তু তাতে কি আর আশ মেটে? সে বড় পানসে। গল্প চাই গল্প! যে গল্প গল্পের মত শোনালেও খাঁটি বাস্তব ও বাঙালীর ইতিহাস। কিন্তু তা নিয়ে, দুঃখের বিষয়, কারো কোনো তাপ-উত্তাপ নেই। তখনো ছিল না, আজও নেই। অথচ এনাদের মত মানুষের হাত ধরেই কোথাও বাঙালীর শিল্প-চর্চা কঠিন মন্দার মুখেও টিঁকে ছিল।
ভাবো তো সকলে! তাক লেগে যাবে, যাঁদের সঙ্গে নীহারবালার নাম জড়িয়ে --
তারাসুন্দরী
সুভাষচন্দ্র বসু
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
দীনেদ্রনাথ ঠাকুর
কাজী নজরুল ইসলাম
আর্ট থিয়েটার
মিনার্ভা থিয়েটার
বিশ্বরূপা থিয়েটার
ঋষি অরবিন্দ
এই নামের তালিকা কোনো ঐতিহাসিক ক্রমানুসার নয়। জীবনের বিভিন্ন সময়ে নীহারবালা-র জীবন এঁদের দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
১৮৯৮ সাল। নীহারবালার জন্ম। পিতৃ ও মাতৃপরিচয় অজ্ঞাত। তখনকার যুগে গায়িকা ও নায়িকা –এই যুগল প্রতিভা এক ব্যাক্তির মধ্যে নিহিত থাকাটাই দস্তুর ছিল এবং সেই সব প্রতিভাবান নারীদের বেশিরভাগ-ই উঠে আসতেন তৎকালীন ‘রামবাগান’ অর্থাৎ এখনকার সোনাগাছি অঞ্চল থেকে। ফলে এঁদের যতই প্রতিভা থাকুক না কেন, এঁদের বারবণিতা হিসেবে দেগে দেওয়া হত। কারণ সামাজিকভাবে তথাকথিত ভদ্রপরিবারের নারীদের জন্য এই নায়িকা-কাম-গায়িকা হওয়া ছিল ব্রাত্য। পুরোটাই করা হত উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ভাবে। কিন্তু সোডার জলে বুজগুড়ি কেটে ওপরের দিকে ধাবমান হবে না, তা কি হয়। সেটাও দস্তুর। প্রতিভাকে চেপে রাখা যায় না, যাবেও না কোনোদিন। সে তার মত করে বিকশিত হবেই। সমাজও সেখানে নিরূপায়। দস্তুর-কে ছাপিয়ে প্রতিভাকে মেনে নিতে বাধ্য হয় সমাজ।
নীহারবালার জন্ম-কে টাইমলাইনে ফেললে দেখা যাবে তার ঠিক আগের বছরেই সুভাষচন্দ্র বসু-র জন্ম। তার তের বছর আগেই গোড়াপত্তন হয়েছে জাতীয় কংগ্রেসের। নীহারবালার বড় হয়ে মানুষের দৃষ্টিগোচর হতে হতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ। বিশ্বযুদ্ধে ভারত বৃটিশদের সাহায্য করলে ভারত স্বাধীনতা পাবে, সে কথার খেলাপ করেছে ইংরেজ-রা। বাপুজীর প্রতি সমগ্র জাতির আশ্বাস ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে। সারা দেশ ডুবে আছে ভয়ে, হতাশায়, অভাবে, দুর্ভিক্ষে। বাঙালীরাও যেন কোথাও একটা সর্বহারা হয়ে পড়েছে। মানুষের হাতে তখন খাবার পয়সা পর্যন্ত নেই। গান-থ্যাটার (থিয়েটার) বা কোনো বিনোদনমূলক কিছু বয়ে নিয়ে চলার মত ক্ষমতা সমগ্র জাতিরই নেই।
নীহারবালা-র অস্তিত্ব উপলব্ধি করতে গেলে প্রথমেই তাঁকে এই টাইমলাইনের মধ্যে রাখতেই হয় কারণ, এটা জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে কোন পরিস্থিতিতে তাঁর মতো একজন তারকা অন্ধকারে হারিয়ে যান এবং সে সম্পর্কে কোনো রকম ঐতিহাসিক দলিল আজ পর্যন্ত সঠিকভাবে এক জায়গায় করে পাওয়া যায় না। ১৮৮৫ সালে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। আর নীহারবালার জন্ম হল ১৮৯৮-এ। ঠিক তার আগের বছরে, ১৮৯৭ সালে জন্ম হয়েছে সুভাষচন্দ্র বসুর। এর কিছু বছর আগেই ১১ই সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩-এ স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো বক্তৃতা সম্পন্ন করেছেন এবং সেই বিজয়ে মুগ্ধ বাঙালী তাঁকে হারান ৪ঠা জুলাই, ১৯০২ সালে। নীহারবালার বয়েস তখন চার বছর। এর পর থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত নীহারবালার জীবন সম্পর্কে বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তাঁর অস্তিত্বের প্রথম চিহ্ন আমরা পাই ১৯১৮ সালে তিনি যখন প্রথম রঙ্গালয় যোগদান করেন।পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে এই তিনি প্রথম দাগ কাটার মত করে অবতীর্ণ হলেন। প্রথম নাটক ‘কিন্নরী’। সুপ্রভার ভূমিকায় নীহারবালা। ফাটিয়ে দিলেন অভিনয়ে। পরের চমক ‘ফুল্লরা’ -- নাম ভূমিকায় নীহারবালা। এবার অভিনয় তো আছেই, সঙ্গে এই নাটকের গান সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ফিরিয়ে ছাড়লেন তিনি। গানের নাম, “তুমি আমারি”। তারপর মঞ্চস্থ হল, ‘অযোধ্যার বেগম’। নীহারবালা হজরত মহলের ভূমিকায়। খোদ নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের খাস বেগম। নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ-কে লর্ড ডালহৌসী কুশাসনের অভিযোগে মেটেবুরুজে নির্বাসিত করেছিলেন। নীহারবালা পর পর অভিনয় ও গানে মন কাড়তে লাগলেন আপামর সাধারণের, খুব কঠিন সময়ে। অভিনীত হল,
ইরাণের রানী
গৃহপ্রবেশ
চণ্ডীদাস
রাজা ও রানী (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আবহে দেশে বড় সঙ্কট। মানুষ খাবে কি তার ঠিক নেই, বিনোদন হয়ে উঠল বিলাসিতা। থিয়েটার দেখতে মানুষ পয়সা খসাতে নারাজ। তিনজন মানুষ পার্টনারশিপে থিয়েটার তথা অভিনয় শিল্পকে বাঁচাতে উদ্যোগী হলেন। গড়লেন ‘আর্ট থিয়েটার’। আর্ট থিয়েটার নতুন করে পরিচিত হল এবং ব্যবসা শুরু করল। নামের এই পরিবর্তন আমাদের আগ্রহের উদ্রেক করে বৈ কি! যে তিনজন পার্টনারশিপে আবদ্ধ হয়ে বাংলা থিয়েটারকে এ হেন পরিস্থিতিতে লাইফ-লাইন দিতে উদ্যোগী হলেন, বাংলার ইতিহাস সেভাবে তাঁদের গুরুত্ব দেয় নি। তাঁরা হলেন,
১। তারাসুন্দরী
২। অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
৩। প্রবোধচন্দ্র গুহ
তখনকার যুগের নাট্যসাম্রাজ্ঞী ছিলেন তারাসুন্দরী। সমসাময়িক বিখ্যাত নাট্যকার অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তারাসুন্দরীর একটি বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ছিল। তাঁদের একটি পুত্র-সন্তানও ছিল যাঁর অকালমৃত্যু ঘটে, এবং সে কারণে ধীরে ধীরে অপরেশচন্দ্রের সঙ্গে তারাসুন্দরীর মত-পার্থক্য ঘনীভূত হয় ও তাঁরা একে অপরের থেকে দূরে চলে যান, যদিও সে সব অনেক পরের কথা।
তারাসুন্দরী আগে থেকেই রঙ্গালয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন। সুতরাং আর্ট থিয়েটার গঠিত হওয়ার পরে তারাসুন্দরী সেখানে যে নিয়মিত অভিনয় করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। নতুন করে সবকিছু শুরু হল বটে, কিন্তু বেশিদিন হালে পানি পেল না। বিরাট অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে আর্ট থিয়েটার। ১৯২৩ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর সাধের আর্ট থিয়েটার বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন, তৎকালীন পঁচিশ হাজার টাকার বিনিময়ে। গড়ে ওঠে ‘আর্ট থিয়েটার লিমিটেড’। এছাড়া বাজারে আর্ট থিয়েটার লিমিটেডের নামে একশ’ টাকায় মোট দু’শো পঞ্চাশ-টি শেয়ার বাজারে ছাড়া হয়। অপরেশ্চন্দ্রের ভাগ্যে কি জুটলো? -- না এককালে তাঁরই আর্ট থিয়েটার লিমিটেডে পাঁচশ’ টাকার ম্যানেজারির চাকরি। অনেক বড় হৃদয় না থাকলে, এরকম সম্ভব নয়। এই আর্ট থিয়েটার-ই আজকের স্টার থিয়েটার।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে বলে রাখা ভাল যে আজকের ‘স্টার থিয়েটার’ কিন্তু তার এই নিজেস্ব নাম নিয়েই প্রথমে স্থাপিত হয়, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দের ২১ শে জুলাই-এ, বীডন স্ট্রীটের ঠিকানায়। রূপকার ছিলেন নটী বিনোদিনী ও তাঁর তথাকথিত লিভ-ইন পার্টনার গুর্মুখ রায়-এর। নটী বিনোদিনী তখন বাংলার বিনোদনের শিখরে। তাঁকে লোভ দেখানো হল যে নতুন থিয়েটার হলের নাম রাখা হবে ‘বি-থিয়েটার’, তাঁরই নামের আদ্যক্ষরে। তিনি সব উজাড় করে দিলেন, থিয়েটারের স্বার্থে। ছেড়ে চলে এলেন 'ন্যাশনাল থিয়েটার'। কিন্তু সমাজ তা মেনে নিল না। একটি প্রতিষ্ঠানের নাম রেড-লাইট এরিয়ার মহিলার নামে! ছি ছি! তাই নামকরণ হল, ‘স্টার থিয়েটার’।
নীহারবালা প্রথম স্টার থিয়েটারে যোগদান করেন ১৯২১সালে। তখন স্টার থিয়েটার ধুঁকছে। ভীষণ অস্তিত্ব সঙ্কট। হাল ধরলেন অপরেশচন্দ্র ও তাঁর লিভ-ইন পার্টনার তারাসুন্দরী। ১৯২৩ সালে স্টার থিয়েটার নাম বদলে হয়ে গেল ‘আর্ট থিয়েটার’।
বিষয় গিয়ে এরকম দাঁড়ায়,
স্টার থিয়েটার ১৮৮৩
স্টার থিয়েটার -> আর্ট থিয়েটার
আর্ট থিয়েটার -> আর্ট থিয়েটার লিমিটেড১৯২৩
আর্ট থিয়েটার লিমিটেড -> স্টার থিয়েটার
এই ভাবে আদি-অন্ত, প্রাক্তন ও বর্তমানের ফাঁস সম্পুর্ণ হল।
আর্ট থিয়েটারের প্রথম নাটক ছিল ‘কর্ণার্জুন’। নাট্যকার অপরেশচন্দ্রের নিজের লেখা এই নাটকের কুশীলবদের নাম শুনলে তাক লেগে যাবেঃ
কর্ণঃ তিনকড়ি চক্রবর্তী
অর্জুনঃ অহীন্দ্র চৌধুরী
শকুনিঃ নরেশ মিত্র
পরশুরামঃ অপরেশচন্দ্র নিজে
বিকর্ণঃ দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
দ্রৌপদীঃ নিভাননী দেবী
(নিভাননী দেবী-কে আমরা পরে উত্তমকুমারের সঙ্গে মায়ের চরিত্রে চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে দেখেছি।)
নীহারবালাকে নিয়ে লিখতে বসে এত কথা আসছে এই কারণে যে তাঁর জন্মের প্রায় কুড়ি বছর এই ‘কর্নার্জুন’ নাটকে নীহারবালার আরো বড় আত্মপ্রকাশ, আর তাতেই পুরো যাকে বলে কি না ‘হিট’। এখান থেকেই বলা যেতে পারে তাঁর উত্থান থেকে উড়ান। প্রথমে দেখতে পাই নীহারবালা ‘কর্ণার্জুন’ নাটকে ‘নিয়তি’-র ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। নিয়তির দু’টি গান আবার সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ফিরতঃ
১। কখন ভাঙি কখন গড়ি/ নাইকো ঠিকানা
২। আমি আঁধারে বেঁধেছি ঘর/ আলোর দেশের পারে
দেশের খুব কঠিন আর্থসামাজিক পরিস্থিতির মাঝখানে ‘কর্ণার্জুন’ রমরমিয়ে দু’শো-ষাট রজনী পার করে ফেলে, আর্ট থিয়েটারের স্টেজে। এটা বাংলার অভিনয়ের ইতিহাসে একটি বিরাট মাইলফলক।
নীহারবালা প্রসঙ্গে যদি এখানে বলতেই হয় তাহলে নীহারবালাকে টক্কর দেয়ার মত সমসাময়িক একমাত্র যিনি পড়েছিলেন তিনি নীহারবালার মালকিন, তারাসুন্দরী নিজে। ১৯১৮ সালে নীহারবালা রঙ্গালয়ে যোগ দেন। কে কিভাবে তাঁকে সেখানে টেনে এনেছিলেন, তা ঠিক জানা যায় না। তারাসুন্দরী নীহারবালার থেকে কুড়ি বছরের বয়ঃজ্যেষ্ঠা। তারাসুন্দরী সাধারণতঃ সিরিয়াস রোলে অভিনয় করতেন আর নীহারবালা একেবারে ভিন্ন রকমের -- প্রধানতঃ লাস্যময়ী নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন।
আর্ট থিয়েটারের গোড়াপত্তনের পরে মাত্র তিন বছরের মধ্যে মোট একুশটি নাটক মঞ্চস্থ হয়, যা অভাবনীয়, অন্ততঃ সারা দেশের তৎকালীন আর্থসামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে। আরো উল্লেখ্য এই যে আর্ট থিয়েটার লিমিটেড কিন্তু হেলাফেলার বস্তু ছিল না। ভাবলে অবাক হতে হয় যে এই আর্ট থিয়েটারে স্বয়ং গিরীশ ঘোষের স্বনামধন্য পুত্র ‘দানীবাবু’ যোগদান করেন। আর এই একুশটি নাটকের মধ্যে নয়টি কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের নাটক, ছোটগল্প ও উপন্যাস অবলম্বনে তাঁর নিজের নির্দেশনায় আর্ট থিয়েটার সেগুলো পরিবশন করত। আর্ট থিয়েটারের শুরুর দু'মাসের মধ্যে ‘রাজা ও রানী’ মঞ্চস্থ হয়। সেখানে কুমার সেনের ভূমিকায় ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী স্বয়ং। এই নাটকেও নীহারবালাকে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথের যতগুলি নাটক ছিল সবকটিতে গান শেখাতেন দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে আর তার মঞ্চসজ্জা করতেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। নির্দেশনা, আগেই বলা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের নিজের। নীহারবালার কন্ঠে দীনুঠাকুরের নির্দেশনায় যে সমস্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত কালজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও বাঙালীর অকারণ সমাজসচেতন মুরুব্বিয়ানায় হারিয়ে গেল, সেগুলি হলঃ
১। সে আমার ধ্যানেরই ধন
২। অলোকে কুসুমে না দিও
৩। সে আসে ধীরে
৪। এবার উজাড় করে লও হে ( নাটক ‘শোধ-বোধ’)
একসময়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ‘আর্ট থিয়েটার’-এর সম্পর্ক এমন জায়গায় পৌঁছাল যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং ‘প্রজাপতি নির্বন্ধ’-র নাট্যরূপ (আমরা যা ‘চিরকুমার-সভা’ হিসেবে জানি) কিন্তু শিশির ভাদুড়ীর মত মানুষকে না দিয়ে তা দিয়ে দিলেন আর্ট থিয়েটারকে, মঞ্চস্থ করার জন্য। এই ‘চিরকুমার-সভা’- নাটকে কিন্তু নীহারবালার ‘নীরবালা’ চরিত্রে অভিনয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেই চরিত্রের গানে ও অভিনয়ে রবীন্দ্রনাথের মত খুঁতখুঁতে মানুষও মুগ্ধ হলেন। এই নাটকে তিনি গেয়েও ছিলেন, নেচেও ছিলেন। পরে ‘সুদামা’ চরিত্রে ‘শাওন ঘন বরষে’- গেয়ে সুনাম অর্জন করেন নীহারবালা। এছাড়াও ‘গৃহপ্রবেশ’, ‘বশীকরণ’, ‘শোধবোধ’, ‘বউ-ঠাকুরানীর হাট’ (যার নাট্যরূপের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘পরিত্রাণ’), ‘বৈকুন্ঠের খাতা’, ‘চিত্রাঙ্গদা’ -- এই সব নাটকেই নীহারবালা কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন।
এসব চলতে চলতে নীহারবালার জীবন অন্তরালে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছে। গানের প্রত্যেকটি নাটকের মধ্যেই কিন্তু নীহারবালার উপস্থিতি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ১৯২৩ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত তাঁর জীবন, যাকে বলে ‘ফ্লোটিং’। অন্তরালে রূপ নিচ্ছিল গভীরতর কিছুর। এই সময়ে অভিনয় ও সঙ্গীতচর্চায় তাঁর অপরিমেয় পারদর্শিতা প্রকাশ পায়। কিন্তু তিনি ধীরে ধীরে যে পথে চলতে থাকেন ও আমরা যদি তার কারণ খুঁজে দেখতে যাই, তাহলে আবার আশ্চর্য হয়ে যাব। দেখা যাবে যে, সঙ্গীত তাঁকে অভিনয়ের থেকে অনেক বেশী আকৃষ্ট করেছে। রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শ নিঃসন্দেহে নীহারবালাকে আলাদা করে সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট করে।
অবশেষে সঙ্গীতে তাঁর নিমজ্জন-ও ঘটল। ক’জন পারে, যখন তিনি তারকা, তখন সব গ্ল্যামারের হাতছানিকে উপেক্ষা করে নিজেকে সঙ্গীতচর্চায় পুরোপুরি নিয়োজিত করতে, কোনো খ্যাতির আশা ব্যতিরেকেই?
এ ঘটনা কি ভাবে ঘটল, তা-ও অবিশ্বাস্য।
তখন গ্রামোফোন রেকর্ড (এইচ-এম-ভি) করাতেন অর্থাৎ সেখানকার সিনিয়র মিউজিক ট্রেনার ছিলেন জমিরুদ্দীন খাঁ সাহেব। ১৯৩২ সালে খাঁ সাহেব ইহজগৎ ত্যাগ করলে গ্রামোফোন রেকর্ডে সেই পদ লাভ করেন জমিরুদ্দীন খাঁ সাহেবের যোগ্য চেলা, এতদিন ধরে তাঁর সহযোগী বা অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে কাজ করে আসা কাজী নজরুল ইসলাম। কাজী নজরুল ইসলামের অধীনে কে না এসেছিলেন গান রেকর্ড করতে!
ইন্দুবালা
আঙুরবালা
সত্য চৌধুরী
জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী (জ্ঞান গোঁসাই)
কে-এল সায়গল
কুমার শচীনদেব বর্মন
ধীরেন্দ্রচন্দ্র মিত্র
জগন্ময় মিত্র
ও আরো অনেকে।
এই গান রেকর্ড করার সুবাদে নীহারবালার প্রথম যোগাযোগ ঘটে কাজী নজরুল ইসলামের সাথে। কাজী নজরুল-ও জহরত চিনতে ভুল করেন নি। নীহারবালা-কে গড়ে তুললেন। গান বা সঙ্গীতচর্চা নীহারবালা কে এতটাই প্রভাবিত করে যে তিনি ধীরে ধীরে তাঁর অভিনয়জীবন ছেড়ে গানের দিকে ঝুঁকতে থাকেন এবং তা তাঁকে শেষ পর্যন্ত এমন এক আধ্যাত্মিক স্তরে পৌঁছে দেয় যে তিনি সবকিছু ছেড়ে একসময় সোজা চলে যান পণ্ডিচেরী-তে, ঋষি অরবিন্দের ‘অরোভিল’-এ। মাঝে ১৯৩০ সালে আর্ট থিয়েটারের অবলুপ্তি ঘটে। সেই সময়ে তিনি মিনার্ভা থিয়েটারে যোগ দেন। তাঁর কাজ ছিল মঞ্চের পিছনে থেকে উঠতি নাটকের মেয়েদের গানের তালিম দেওয়া। তখন এরকম মানুষের বেশ অভাব ছিল। এর পর তিনি ‘নাট্যনিকেতন—এ কিছুদিনের জন্য যোগ দেন। ১৯৩১ সালে ‘নাট্যনিকেতন’-এর নাম হয় ‘বিশ্বরূপা’।
‘নাট্যনিকেতন’-এও অল্প সময়ের জন্য হলেও নীহারবালা রীতিমত ছাপ রেখে যান। তিনটি নাটকে তাঁর অভিনয় ও গান উল্লেখযোগ্য
১। সিরাজদ্দৌলা
২। মীরকাশিম
৩। সাবিত্রী (নাম ভূমিকায়)
১৯৫৪ (বিতর্কিত তথ্যানুসারে ১৯৫৫) সালের ৭ই মার্চ নীহারবালা ইহলোক ত্যাগ করেন, ঐ অরোভিল-এই। আমরা যদি কোনভাবে নীহারবালা-কে একটি মাপকাঠি ধরে নিই, তাহলে বাংলার অভিনয় ও সঙ্গীত জগতের ইতিহাসের পর পর যে সমস্ত দুয়ার একের পর এক উন্মোচিত হবে তা বিস্ময়কর। এমনকি ‘অবিশ্বাস্য’ বললেও কম বলা হবে না। খুব কষ্টের বিষয় এই যে, এই ধরণের মানুষরা তৎকালীন সমাজে নীহারবালা ‘দাসী’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন, কারণ তাঁদের সামাজিক ভাবে মূলস্রোতে উদ্ভাসিত করা তৎকালীন সমাজের পক্ষে অত্যন্ত অসম্মানজনক ছিল। সমাজের এই ধরনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ এনারা মহিলা বলেই তাঁদের প্রতি করা সম্ভব ছিল। সামাজিক রীতিনীতির প্রতিবন্ধকতাকে সম্মান দিতে গিয়ে নিজেদের বংশপরিচয় পর্যন্ত গোপন রাখতে বাধ্য হতেন, এই সমস্ত পরম পূজ্য মহিলা ব্যক্তিত্বরা।
তাই নীহারবালা ‘দেবী’- কে কুর্ণিশ। তাঁর থেকে মাত্র এক বছরের বড় সুভাষচন্দ্র বসু দেশ-কে বিদেশী শাসকদের হাত থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতার পথে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছিলেন। আর নীহারবালা, বাঙালীর নারীস্বাধীনতা-কে, যা নিজের দেশের মাটিতেই, নিজের দেশের সমাজের গণ্ডীতেই ছিল পরাধীন।
উপহারস্বরূপ রইল ওনার কিছু গানের লিঙ্ক, যার কয়েকটি আমাদের পৈত্রিক-সূত্রে পাওয়া ব্যক্তিগত সংগ্রহঃ
https://www.youtube.com/watch?v=YPM4cuQY1tE&t=43s
https://www.youtube.com/watch?v=7yYcV4eZ0ok
https://www.youtube.com/watch?v=4DgTBHIGO2M
No comments:
Post a Comment