Wednesday, 29 September 2021

বিবাহ অভিযান -- পর্ব ২

 

বিবাহ-অভিযান (দ্বিতীয় পর্ব)

সেদিন ওদের পালানোর কথা। সব প্ল্যান করা হয়ে গিয়েছে। পোকে বর্ধমানে সব সাজিয়ে ফেলেছে। বিয়ের মন্দির, পুরোহিত, থাকার জায়গা, সব। নীতা বাড়ি থেকে বেরোবে টীউশনে যাওয়ার নাম করে। তারপর নিজেই দু’টো থানায় যাবে, মালিপাঁচঘরা আর গোলাবাড়ি, নিজেই বেড়ালের গ্লায় ঘন্টা বাঁধতে।
নিজের হাতে লেখা চিঠি দিয়ে রিসিভ করে সেই কপি অন্য কারো হাত দিয়ে আমার কাছে পৌঁছে দেবে। নিজে যাবে হাওড়া স্টেশনে। বন্ধু সেখানে অপেক্ষা করবে। দেখা করার পর পাশাপাশি না থেকে একটু দূরে দূরে থেকে চলতে থাকবে, বর্ধমান পর্যন্ত। সেখানে নেমে রাতটুকু কাটানো। পরদিন সকালে বিয়ে। তার পরদিন ফেরা। মোবাইল না থাকায় আগে কথার দাম ছিল খুব মূল্যবান ব্যাপার। একমাস আগেও কাউকে কোথাও সময় দিয়ে থাকলে তার নড়চড় হত না। তাই যেমন কথা তেমনি কাজ।

সেদিন সকাল থেকেই আমি বাড়িতে ছিলাম না। অনেকগুলো টিউশন পড়িয়ে কোনোরকমে চান-খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়েছিলাম কাজে। টাইমস অফ ইণ্ডিয়াতে নিয়মিত লেখা বেরোচ্ছে তখন। ‘ক্যালকাটা টাইমস’ বলে যে সাপ্লিমেন্ট –টা তখন সবেমাত্র শুরু হয়েছে, তাতে মাথা গলানোর চেষ্টায় আছি। পুজোর আগে কুমোরটুলির মৃতশিল্পীদের দুরবস্থা নিয়ে একটা কিছু করে ফেলব ভাবছি। সুদীপ-দা (ঘোষ), যাঁর কাছে আমি অনেক কিছু শিখেছি, তিনি আমার কথা শুনে গ্রীন সিগ্ন্যাল দিয়েছেন। তাই সেদিন সব গুছিয়ে সকাল সকাল সোজা কুমোরটুলী।

বাড়িতে বলে গিয়েছিলাম যে আমার বন্ধুর বিপদের কারণে কেউ যদি আমাকে খুঁজতে আসে যেন বলে দেওয়া হয় যে রাত ন’টা হবে ফিরতে আমার।

সারাদিনের কাজ সেরে সুদীপদাকে একদম স্টোরীর কপি ও ছবি দিয়ে তারপর ইভনিং শো-এ একটা সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেই সাড়ে ন’টা বেজেই গেল। সারাদিনে খুব যে কেউ খোঁজ করেছে বলে জানা গেল না। বাড়িতে একটি ছেলে এসে শুধু একটা খাম দিয়ে গিয়েছে লম্বা মত। সীল করা ছিল। খুলে দেখলাম নীতার চিঠির রিসিভড কপি। সবে খেয়ে উঠেছি, তখন বুম্বা এসে ডেকে নিয়ে গেল।

আমার বন্ধুদের বাড়ির সামনের ঘরে তিন-চার জন পুলিশ, নীতার জাঁদরেল জেঠু, তাঁর কয়েকজন শাকরেদ আর বন্ধুর বাবা-মা ।

ঘরে ঢুকতেই, বন্ধুর মা যেন আমাকে দেখে ছ্যাঁক করে উঠলেন। জেঠুকে বললেন,

-         এই যে ইনি-ই তিনি, দাদা, যাঁর কথা বলছিলাম…এই হল নাটের গুরু। বন্ধু ভুল করছে, কোথায় আটকাবে, তা নয় তাকে ভুল পথ দেখালো… উসকানী দিয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটাল।

-         জেঠু হাত তুলে ছবি বিশ্বাস স্টাইলে কাকীমাকে থামিয়ে ধুতির কোঁচা টা ঝেড়ে সাজাতে সাজাতে বললেন,

-         তুই বিলাস দার ছেলে?

-         হ্যাঁ…

-         আমি ওনার ছাত্র ছিলাম…তা ওরকম একটা মানুষের এরকম ছেলে কেন…

-         ‘ও রকম’ আর ‘এরকম’ মানে? ঠিক বুঝলাম না। আমাকে ডেকেছেন কেন?

-         মানে ওরকম দেবতূল্য বাবার এরকম রাক্ষসতূল্য ছেলে কেন? আর কেন ডেকেছি জানিস না, ন্যাকামী হচ্ছে?

-         খুলে বললে সুবিধা হয়, দেবতা-রাক্ষস-টাক্ষস জানি না, আমি আর আমার বাবা, দু-জন ভিন্ন ব্যক্তি, তাই আলাদা রকমের ই তো হব। সেটাই স্বাভাবিক। আপনি আর আপনার বাবা কি হুবহু এক রকমের?

-         দেখলেন তো দাদা, কেমন চ্যাটাং চ্যাটাং কথা…

কাকীমা বললেন।

থানার বড়বাবু বললেন, পাশ থেকে,

-         আমাদের হাতে ছেড়ে দিন স্যার, পালিশ টালিশ করলেই সব সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসবে।

আমি ওনার দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম,

-         আগে সরকারকে বলুন নিজের জুতোয় পালিশ করার কালি কিনে দিতে, তারপর তো আমি রইলুম।

-         তোর সাহস তো কম নয় হে, ছোকরা? পুলিশের সঙ্গে কি ভাবে কথা বলতে হয় জানিস না?

-         জানি…পাব্লিক সারভেন্ট আপনি…আমি হলাম গিয়ে পাব্লিক আর তাহলে আপনি কি? ভাবুন ভাবুন, ভাবা প্র্যাকটিস করুন…

তারপর জেঠুর দিকে তাকিয়ে বললাম,

-         কিছু প্রয়োজন থাকলে বলুন, সময় নষ্ট হচ্ছে। আমার কাজ আছে…

খুব ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে বললেন,

-         তাই নাকি হে! আমাদের তো কোনো কাজ নেই। চা-বিস্কুট খেতে এসেছি রাতের বেলায়। বুইলি কি না। তা কি কাজ কি করা হয় তোর? ঘটকালি?

-         না…ফ্রিলান্সার জার্নালিস্ট…

-         আচ্ছা…ভারী ব্যাপার…তা, ও ওরকম সবাই বলে… কোথাকার? সাল্কের কোনো ক্লাবের বাৎসরিক পত্রিকার না, কি?

-         না…মানে ওই আর কি…

- কেন রে নাম বলতে লজ্জা কিসের?

- নাম বললে আপনি পার্মানেন্ট করে দেবেন, প্লিজ?

- যাঃ বাবা…মানে?

- আপনার তো অনেক ক্ষমতা, একটা বেকার ছেলে চাকরী পাবে, এই আর কি…

 

হামলি কাকু কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন লক্ষ্য করি নি। হঠাৎ ওনার গলা শুনে ঘুরে তাকালাম, উনি বললেন…

 

-         টাইমস অফ ইণ্ডিয়া তে লেখে আরো অনেক বড় জায়গায় লেখা-পত্তর ছাপা হয়।

 

হামলি কাকু আমাকে বেশ ভালবাসতেন। সাহিত্য, গান, লেখালিখি এই সব নিয়ে ওনার সঙ্গে আলোচনা ও তর্ক বিতর্ক চলত। উনি পাশে এসে দাঁড়াতে অনেকটা ভরসা পেলাম আর কি।

 

মনে হল জেঠুর স্বরে হঠাৎ একটা বদল এল, সামান্য হলেও।

-         অ…তা কি নিয়ে লেখা হয়…?

-         শিক্ষা নিয়ে প্রধাণতঃ…বাকি ফ্যাশন , ঈকোনমি…ইত্যাদি…

-         তা খবর আজ কি বলছে, নীতা কোথায়?

-         আমার বন্ধুর সঙ্গে আছে, ভাল আছে…চিন্তা করবেন না, ফিরে আসবে, শিগগীর। নতুন বিয়ে থা করেছে, দু-দিন ঘুরে একদম চলে আসবে।

-         স্পর্ধা তো কম নয় তোমার…!

-         যাঃ বাবা…আপনি নিজেই তো জিজ্ঞেস করলেন, আমি উত্তর দিলাম…

-         ওরা একজ্যাকটলী কোথায় আছে বলবি? না হলে দেখাব মজা…তোর ওই বন্ধুর জীবন শেষ…বেশি পাঁইতাড়া কষলে না তোর-টা ফুরোতে সময় লাগবে না।

-         জানি, আপনি  ক্ষমতাশালী সম্মানীয় ব্যক্তি। আমাকে ফুরোতে আপনার কোনো সময় ই লাগবে না। শুধু ভেবে দেখুন জেঠু, দু-জন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ নিজেদের পছন্দে বিয়ে করে আনন্দে বাঁচতে চাইছে, এবং নীতা ঠিক মানুষকেই পছন্দ করেছে বলে আমার ধারণা। এতে কোনো ক্ষতি হবে না কারোর। সবাই ভাল থাকবে।

-         তুই একথা বলতেই পারিস…তোর বন্ধুকে বাঁচাতে…নিজেকে বাঁচাতে…

-         না আপনারা সবাই সুখে থাকবেন, যদি আজ এই মুহূর্তে সব মেনে নেওয়া হয়। আর বিগড়ে গেলে লাইফটাইম আফশোষের সীমা থাকবে না। সব ঘেঁটে যাবে। কারণ নীতা ফিরে এলে, এই বিয়ে অবৈধ বলে জোর করে প্রমানীত হলেও সারা সালকিয়ার মানুষ কিন্তু জানবে আসলে ঘটনাটা কি ঘটেছে…ভেবে দেখুন, ঢি ঢি পড়ে যাবে! ঘাসবাগান থেকে ঘোষালবাগান পর্যন্ত আমাদের এই প্রিয় বন্ধু কে সবাই চেনে, আমাদের প্রজন্মের আর ওর কিন্তু বেশ ভাল রেপুটেশন…বরং একজন মেয়ে হিসেবে নীতা ও তার পরিবারের সম্মান হারাবে…তখন জেঠু, কিছু মনে করবেন না, আপনি কিন্তু ভিলেন হয়েই থেকে যাবেন। এই সব কেসে বাবা-মায়েরা প্রথমী এরকম- ই করেন। কিন্তু কয়েক্মাস পরেই আবার সন্তানস্নেহে সব মাফ করে বুকে টেনে নেন, দু-পক্ষেই।  ফলে একবার চলে গেলে সেই সম্মান আবার উদ্ধার করা কিন্তু আর যাবে না। আর আমে-দুধে মিশে গেলে তখন আপনি নিজের বিবেকের কাছে দোষী থেকে যাবেন। আমি ভুল বলে থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী…আপনার আমাকে নিয়ে যা ইচ্ছে হয় করতে পারেন…

-         হুঁ…

(***ঘটনার ছ’মাস পর থেকে আমার কথা যে অক্ষরে অক্ষরে মিলে যে গিয়েছিল সেদিন, তা নিয়ে আমি আজও গর্ব বোধ করি। খুব মনে হয় পঁচিশ বছর পরেও, একই ভাবে, একটা ভরাডুবি থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলাম।)

পকেট থেকে বের করলাম নীতার চিঠির কপি…

-         এটা নিশ্চয়ই দেখেছেন আপনি…

-         নীতার নিজের হাতে লেখা চিঠি, নিজেই থানায় জমা দিয়ে গিয়েছে…আর আমরা কেউ যাতে কেউ বিপদে না পড়ি, তাই তার কপি আমাদের পৌঁছে দিয়েছে…

জেঠু শুনে আকাশ থেকে পড়লেন।

-         ও নিজে এসব করেছে?

-         হ্যাঁ জেঠু…আপনার থেকে আমি অনেক বয়েসে ছোট…অনুরোধ করছি…ওদেরকে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরতে দিন প্লিজ…ওরা দু জনেই কিন্তু খুব বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ মানুষ, আশীর্বাদ করুন ওদের যেন মঙ্গল হয়…

-         হুঁ…

-         আমি তাহলে আসি?

-         হ্যাঁ দরকার হলে কিন্তু ডেকে পাঠাব…

-         ওকে ছাড়বেন না দাদা…মহা শয়তান ওটা আর ওই পোকে টা…আমার ছেলের মাথাটা খেয়েছে…

কাকীমা  চিৎকার করতে লাগলেন।  শুন্তে পেলাম, জেঠু শুধু বললেন,

-         আমি আছি তো…তোমার থেকে আমার চিন্তা আরো  অনেক বেশি…নীতার ভবিষ্যৎ আমাদের সমাজে…

বুঝলাম ঠিক জায়গায় হিট হয়েছে কথা।

 

আমি যখন বেরোচ্ছি কাকীমা চিৎকার করেই চলেছেন,

 

-         ওরা যদি এবাড়িতে এসে ওঠে তোমরা সব আমার মড়া মুখ দেখবে…কি দাদা, আপনার নাকি অনেক ক্ষমতা, ওইটুকু একটা ছেলে আপনার মুখে ঝামা ঘষে চলে গেল, আর আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন।

 

পোকে আর আমার বন্ধুর ওপর আমার বল ভরসা এতটাই যে আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। আবার ফিরে গেলাম। মাথায় আগুন জ্বলছে।  ঘরে ঢুকলাম।নিজেকে সংযত করলাম…

 

-         জেঠু, কাকীমা উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন, আপনি ওনাকে বোঝান। আর নীতা ও আমার বন্ধুরা বর্ধমানে আছে, কোথায় আমি ও জানি না…দেখবেন ওদের যেন কারো ক্ষতি না হয়, আপনাদের এই সাময়িক ও ব্যক্তিগত ঈগোর টানাপোড়েনে।

কাকীমাকে বললাম,

-         সেদিন যখন বলতে এলাম, অনেক বাজে কথা বলেছেন, মেনে নিলে আজ এই দিন দেখতে হত না, কাউকেই। আপনাদের জেদের জন্য আজ নীতা আর আপনার ছেলে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কার থেকে?  না নিজের বাবা-মায়েদের থেকে। বাহ! আর দোষ হল গিয়ে আমাদের। কেন? না বাবা-মা ভরসা দেওয়ার বদলে তাড়িয়ে দিয়েছেন, তখন আমরা তাদের ভরসা দিয়েছি…বাহ! নিজেরা কোথায় তাদের বল-ভরসা হবেন, তা নয় হয়ে উঠেছেন শত্রু…এই আপনাদের দায়িত্বজ্ঞান? লজ্জা হওয়া উচিত, আমাদের মত বাইরের উটকো লোক-কে আপনাদের পারিবারিক ব্যাপারে যে নাক গলাতে হল…কেন হল? ভেবে দেখবেন তো? কার দোষ, কে দায়ী…খালি যাকে হাতের সামনে পাব, তার ওপরে দায় চাপিয়ে দিলেই কি নিজেরা দায়মুক্ত হওয়া যায়?...যত্ত সব বাজে কথা…

 

বলে হালকা হয়ে বেরিয়ে চলে এলাম। কাল দুপুর পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় কাটলে হয়।

হে ভগবান! পুলিশ যেন ওদের কাউকে খুঁজে না পায়। আর পেলেও যেন কিছু না করে।! আসা করি জেঠু পুলিশকে সেরকম ই নির্দেশ দেবেন এই রকম কথার পরে…

(আগামী পর্বে শেষ)

 

Thursday, 23 September 2021

বিবাহ অভিযানঃপর্ব ১


ফটকে, টুটু, ফুচান, আর্য, পোকে ও আর এক বন্ধু। সাল ১৯৯৭, এরাই মোটামুটি সালকিয়া কামিনী স্কুল লেনের বারোয়ারীতলা মাতিয়ে রাখে, তখন।  সে বছর আমার সবে চলে যাওয়া জন্মদিন-টাও ম্যাড়ম্যাড়ে! কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে খাওয়ার কথা ছিল, সে টুকুই যা। চাপা একটা টেনশন তো চলছে, ভিতরে ভিতরে। ওরা হুলিয়ে আনন্দ করে সে দিনে, অন্যবার। এবারে হল না। ২০ তারিখের পর থেকে আর কামিনী স্কুল লেনের দিকে যাওয়া হয় নি। বারণ আছে। বারোয়ারি তলাও নাকি থমথমে। যে কোনো সময়ে পুলিশি হামলা হতে পারে। সেই ভয়ে টুটু আর ফুচান গা ঢাকা দিয়েছে। ফটকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আমাদের মূল আড্ডা ছিল টুটুদের বাড়ির নিচের ছোট্ট একটা ঘরে, যেখানে দৈনিক উৎসব চলত বললেও ভুল বলা হয় না। এখন টুটুবাবুই যদি নিরুদ্দেশ হয়ে থাকেন তাহলে আর যাই কোথায়। বিভিন্ন দূত মারফত খবরে প্রকাশ যে আমাকেও খোঁজা হচ্ছে। হচ্ছে তো, হচ্ছে। আমি কাজ আর পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ততার জন্য এমনিতেই বাড়িতে বিশেষ থাকি না। আর না আমি কাউকে ভয় পাই। তাই আমাকে খুঁজে বের করলে, তখন দেখা যাবে।


সবে সারাদিনের খাটা-খাটুনির পরে বাড়ি ফিরেছি। এমন সময়ে আমাদের জুনিয়র ভাই বুম্বা বাড়িতে এসে হাজির।

-       চল, তোকে ডাকছে…পুলিশ এসেছে…

-       তুই এগো আমি আসছি…

-       না তোকে নিয়ে যেতে বলেছে, নাহলে আমি ক্যালানি খাব…

বাবা অত রাত্তিরে আমাকে বেরোতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, (আমি আমার বাবা-কে 'আপনি' বলে সম্বোধন করি)

-       কোথায় চললি এত রাত্রে?

-       আমার এক বন্ধু খুব বিপদের মধ্যে আছে, একটু যেতে হবে। চিন্তা করবেন না। তবে ফিরতে একটু দেরি হতে পারে।

-       আচ্ছা, বড় হয়েছ, যা করবে সাবধানে।

হেসে বললাম,

-       নিশ্চিন্তে থাকুন।

পকেটে ব্রহ্মাস্ত্র ভরে বেরোলাম। এই সময়টার অপেক্ষায় ছিলাম, উতরে গেলেই ‘অল ক্লিয়ার'।

যা ভাবছেন তা নয়। নকশালদের গল্প নয় এটা। প্রিয় বন্ধুর পাতি পালিয়ে বিয়ে করে ফেলার গল্প, হিন্দি সিনেমার মত। আজ থেকে ঠিক পঁচিশ বছর আগে।

আমার বয়েস তখন তেইশ। বন্ধুরা মনের দিক থেকে আমাকে চল্লিশের বুড়ো বলে ক্ষেপানোর চেষ্টা করত, কিন্তু আমি তাতে আনন্দ পেতাম, কারণ এর পিছনে লুকিয়ে ছিল আমার প্রতি তাদের অনেকটা সম্মান ও সম্ভ্রম। যেকোনো ছোট-বড় সিরিয়াস বিষয়ে প্রত্যেকে আমার শলা-পরামর্শ নেয়। তাতে আমার নিজেকে ওই ছোট পরিসরে বেশ বিজ্ঞ বলে মনে হত। সবে প্রেমে জোরসে দাগা খাওয়া আমি, এই বন্ধুদের নির্ভেজাল উষ্ণতায়, সব কষ্ট ভুলেই গিয়েছিলাম।

আমাকে যিনি দাগা দিয়েছিলেন তাঁর -ই এক বন্ধুর সঙ্গে আমাদের প্রিয় বন্ধুর প্রণয় ঘটিত সম্পর্ক স্থাপিত হল। সবটাই তলে-তলে। আমাদের কেউ কিছু বুঝতে দেয় নি। যখন নিজেরা এসে স্বীকার করল, তখন গাড়ি অনেকদূর গড়িয়ে গিয়েছে। সোজা বিয়ের প্ল্যান। কিন্তু বাড়ির দিক থেকে কোনো পক্ষই সম্মত হলেন না। আমরা বোঝাতে গিয়ে কাকু-কাকীমাদের কাছে যার-পর-নাই অপমানিত হলাম। কিছুতেই কিছু হল না যখন, একমাত্র উপায় পড়ে রইল পালিয়ে যাওয়া। শুনেই অনেক বন্ধুরা ধাঁ। কারণ কন্যের জেঠু সালকিয়ার পুরোনো আমলের তাবড় কংগ্রেস নেতা। এক ডাকে বাঘে গরুতে জল খায়।

বারোয়ারীতলায় বটগাছের নিচে বসে আছি। জরুরী মিটীং। বন্ধু ও তার প্রেমিকা, পোকে আর আমি।

- কি করবি বল?
আমি জিজ্ঞেস করলাম বন্ধুকে ও তার হবু-স্ত্রী কে।
সপাটে উত্তর,
- অনেক তো হল...কি আবার করব, পালাবো। অনেক আগেই বলেছিলাম, তুই আমাকে বোঝালি। কিছু হল? উলটে চাড্ডিখানি জ্ঞানের কথা শুনে এলি তো…সম্মান টা কোথায় রইল? বারণ করেছিলাম আমি…

-       আরে গুরুজনেরা ওরকম বলেন। আর ভেবে দেখ আজ থেকে ছ’মাস বাদে কিন্তু কেউ তোদের দিকে আঙুল তুলতে পারবে না, যে তোরা না জানিয়ে সব করেছিস। কার সম্মান বাড়ল তখন বুঝতে পারবি।

-       হ্যাঁ আর তুই ও জ্ঞান দিস না ভাই…মিঞা-বিবি রাজি/তো কা করেগা কাজী!
- সেই…ঠিক কথা…তুই একা পালিয়ে কি করবি? দাঁড়া, বিবি কে জিগাই…হ্যাঁ রে, নীতা, তুই বল...
- ও যা বলবে, তোরা যা বলবি, তাই হবে...
- বাব্বা! বিয়ের আগেই, এত ভক্তি…!!!

-       এই বাজে কথা বলিস না, মুড নেই শোনার, কাজের কথা বল…

-       পুলিশ তোদের কুকুরের মত খুঁজবে, ধরা পড়লে, নিজের মত বদলাবি না তো? তোর একটা হ্যাঁ বা না, আমাদের সকলের জীবন ধ্বসিয়ে দিতে পারে।
- বিয়ে হয়ে গেলে আবার কি রে! কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না।
বন্ধুটি বলল।
- আইনের খাপ বুঝিস? সব ওরকম গায়ের জোরে হয় না। ফাটা বাঁশের মত। আর জানবি সব মেয়েদের দিকে ঝোলা আইন। একবার যদি ভুল করে কোনো দূর্বল মুহূর্তে বলে বসে যে না ও স্বেচ্ছায় পালায় নি। তুই আর আমরা জোর করেছি। তাহলে সবার আগে তুই আর তার পর আমরা, সবাই মিলে ডুবব।
- আর্য-দা, তোরা এত কথা বলছিস, এটা তো ভাবছিস না, যে আমি যে তোদের বন্ধুর সঙ্গে পালাব, কোথায় থাকব, কতদিন কি ভাবে, সব তোদের হাতে ছেড়ে দিয়েছি, তার পর যখন ফিরব, আমার নিজের সামাজিক সম্মান, আমার বাবা-মায়ের আত্মসম্মান কোথায় থাকবে, সেখানে, আমি যদি সবাইকে ফাঁসাই?

-       রাগ করিস না। বোঝার চেষ্টা কর, তোর জেঠু এমনিতেই আমাদের এই বন্ধুকে দু’চক্ষে দেখতে পারেন না। তারপর আবার এই ঘটনার পর কি হবে কেউ ভাবতেও পারছিস না। পুলিশ ছেড়ে কথা বলবে না। ঊনি নিজের ভাই-ঝি কে উদ্ধার করতে কাউকে ছেড়ে কথা বলবেন বলে মনে হয় তোর? সব ক্ষমতা উজাড় করে দেবেন।

-       তাহলে তুই বল কি করা যায়।

-       বিকেলের দিকে পালা…খবর হতে হতে রাত। একটা দিন হাতে পাবি। সকালে ভোরের আগে বিয়ে যেন হয়ে যায়। সেটা পোকের দায়িত্ব।পুলিশ সকালে জেগে কাজ করা শুরু করতে করতে গল্প অনেকটা গড়িয়ে যাবে। এই সব কেসে পুলিশ খুব একটা নড়ে বসত না, যদি না জেঠু জ্যাঠামী করতেন…আর অবশ্যই তিনি করবেন ও…আমি ও নার জায়গায় থাকলে একই কাজ করতাম।

-       অলরাইট। ঠিক ই বলছিস।

-       আলাদা আলাদা যাবি। আর নীতা, তোর আঠারো হয়ে গিয়েছে তো? আমাদের বন্ধুর বয়েস যে একুশের বেশি সে নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। নীতা একটা চিঠি লেখ থানার ওসি কে, সঙ্গে হায়ার সেকেন্ডারীর মার্কস শিট আর মাধ্যমিকের অ্যাডমিট কার্ড…দু-টোই অ্যাটেস্টেড লাগবে। চিঠিতে ওই দিনের-ই তারিখ অবশ্যই দিবি। বয়ানে লিখবি, যা করছিস তা স্বেচ্ছায় ও স্বজ্ঞানে, কারো কোনোরকম চাপ ছাড়া। আর এই ঘটনার দরুণ যেন কাউকে কোনোভাবে হ্যারাস না করা হয়, কারণ, তোরা ফিরে আসবি।

পোকে বলল,

-       সে আমি লিখে দেব ‘খন, নীতা তুই শুধু সই করে দিবি।

-       না অত কত্তে হবে না, তুই পুরোহিত মন্দির আর বিয়ের আয়োজন আর ওদের থাকার জায়গা দেখ। এমন জায়গা দেখবি, যেখানে শকুন ও খোঁজ না পায়। আর সেটা তোদের অন্য কাউকে, এমনকি আমাকে বলার-ও দরকার নেই। ব্যাক আপ জায়গা রাখবি থাকার, যাতে বিপদ বুঝলে অন্য জায়গায় ওরা সটকে যেতে পারে। আমি একটা নম্বর দিচ্ছি (আমাদের বাড়িতে তখন ফোন ছিল না)। পালানোর একদিন পরে সেখানে ফোন করবি, আমি না বলা পর্যন্ত ফিরবি না। ওকে? আর নীতা নিজের চিঠিটা পুরোটা নিজের হাতে লিখবে। হ্যাঁ, বয়ান-টা তুই বলে দিতে পারিস। যে পয়েন্টগুলো বললাম, একটাও যেন মিস না হয়।

-       সব বুঝলাম, সে চিঠি থানায় পৌঁছে দেবে কে? বেড়ালের গলায় ঘন্টি-টা বাঁধবে কে শুনি? তাকে আইডেন্টিফাই করতে কতক্ষণ!!!

বন্ধু জিজ্ঞেস করল।

-       আমি যাব। নিশ্চিন্তে থাক।ওটা আমার ভাবনা। আর দু-জন-কেই বলছি, কোনোভাবে ধরা পড়লে পালাবার চেষ্টা করবি না, কিন্তু বয়ানে যেন কারো কোনো বদল না হয়। কারোর প্রতি কারোর বিশ্বাসের একচুল এদিক ওদিক হলে কিন্তু কিছু ধরে রাখা যাবে না…সরল জিনিষ জটিল হয়ে যাবে। পোকে সব সেট করে জানা। বাকিটা সেই অনুযায়ী হবে।। বেশিক্ষণ এখানে থাকিস না। আর নীতা, তুই কি কাউকে জানাবি, তোর দিকে?

-       না, দরকার নেই, আমি একাই কাফি…

 (চলবে)

***এই বাস্তব গল্পের বাস্তব নায়ক-নায়িকার অনুমতি নিয়ে তাদের ২৫ তম বিবাহবার্ষিকী-তে আমার আন্তরিক উপহার...।

Sunday, 5 September 2021

ম্যাস্টরমশাই: পর্ব ৮: Happy Teachers' Day

 


আমি যে সরকার পোষিত বিদ্যালয়ে কর্মরত, সেখানে এখন ছাত্র-সংখ্যা মাত্র তিন-এ এসে ঠেকেছে। ১৯৯৭ সালে আমি যখন সেখানে যোগদান করি, ছাত্রসংখ্যা নয় নয় করে আড়াই-শো
র কাছাকাছি।এরকম নয় যে আমরা সবাই খুব খারাপ পড়াই বা আমরা অযোগ্য। নেহাত দুর্ভাগ্যের ফেরে আমরা এখানে পড়ে আছি। মন্ত্রি-আমলা-আধিকারিক-জেলা পরিদর্শক-করনিক-গ্রুপ ডি স্টাফ সবাই সত্যটা জানেন। কিন্তু যাঁর কাছেই শিক্ষার উন্নয়ণ বা বিদ্যালয়ের উন্নয়ণের জন্য গিয়ে দাঁড়াব, তাঁদের বেশিরভাগের কাছেই সম্ভ্রম তো দূর, পাওনা জোটে সরাসরি বা ঘুরিয়ে অনেকটা অবমাননা। ভাবটা যেন, আমরা এই বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যই আজ এই দূরবস্থা। তাঁদের কারোর কোনোদিন কোনো দায় ছিল না, বা আজও  নেই। আজ পর্যন্ত যাঁরা এত তড়বড়িয়ে আমাদের সকল্কে অপমান অরে এসেছেন, বা অনুকম্পার পাত্র করে মেলে ধরেছেন সর্ব স্তরে তাঁরা শিক্ষকদের ওপর দায় চাপিয়েছেন, আজও  চাপান। কিন্তু এই তেইশ বছরে কোনো স্তর থেকে কোনো কেউ এক জন শিক্ষার্থী এই বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে উপকার করেন নি।

আমরা এভাবে কাজ করতে চাই না। তাই লুফে নিয়েছিলাম আমাদের যখন নিজের ইচ্ছে মত অপশান দিয়ে অনত্র কোথাও চলে যেতে বলা হল, বছর পাঁচেক আগে। নজিরবিহীন ভাবে এক ডি-আই সাহেব শিক্ষক বা ম্যানেজিং কমিটির তোয়াক্কা না করে, সকলের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিদ্যালয়ের গেট লাথি মেরে ভেঙে দু-দুটো সরকারী অফিস জোর করে বসিয়ে দিলেন স্কুলের ঘর দখল করে। যে কটি ছাত্র ছিল, তাদের বলে দেওয়া হল বিদ্যালয় উঠে গিয়েছে। তারা বিদ্যালয় প্রাঙ্গন শূন্য করে বিদায় নিল। অন্যান্য ছাত্র-ক্ষুধার্ত বিদ্যালয় তাদের লুফে নিল। আমাদের মান-সম্মান-পরিচিতি স্থানীয় অঞ্চলে আরও বহুগুণে উলঙ্গ হল। সবাই সেই অপমান তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করল যেমনটা হয় আর কি। সাধারণ মানুষ আর কতটা জানেন, যে এই লোকেশনে পোস্টিং পেতে গেলে এস-এস-সি-র মত কঠিন পরীক্ষায় প্রথম দশের মধ্যে থাকতে হয় বা একটা র‍্যাঙ্কের ফারাকে পোস্টিং হয়ে যেতে পারে হাওড়া ময়দানের বদলে পাঁচলা বা বাগনান বা উদয়নারায়ণপুর? সুতরাং যাঁরা এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় রত ও ব্রতী তাঁরা যে কোনো দিন যে কোনো সময়ে আন্তর্জাতিক মানের। প্রথমেই যাঁদের কথা বলেছি, তাঁরা সব্বাই এটা  জানেন,এবং এই বেদনা কে উপভোগ করেন। সাধারন মানুষের চোখে আমাদের স্কুল-টি দাগী আসামীর মত, মিডিয়া ট্রায়ালে নয়, খোদ সরকারী উদ্যোগেই হুইসপারিং ক্যাম্পেনের শিকার, যার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই।

আচ্ছা বেশ,স্কুল তুলে আমাদের অন্যত্র পাঠানোর কি হল? না স্কুলের পুরো ফাইলটাই হারিয়ে গেল। শেষবারের কথা অনুযায়ী

-ওসব ফাইল টাইল বাদ দিন।থেকেই বা কি হত। এখন আর অপশন অনুযায়ী কিছু হচ্ছে না। কটা ছাত্র ভর্তি করার চেষ্টা করুন। না হলে আপনাদের মত স্কুলের স্টাফেদের কোথায় পোস্টিং হবে সে গ্যারান্টি নেই।

- কিন্তু আমাদের যে ছাত্রস্বল্পতার দোহাই দিয়ে স্কুল তুলে দেওয়ার চিঠি দেওয়া হয়েছিল, তার কি হবে?

-এখনও যখন ওই স্কুল থকেই মাইনে পাচ্ছেন, তাহলে উঠে নিশ্চয়ই যায় নি।

- আর আমরা যে হিন্দি মিডিয়াম পাওয়ার জন্য আবেদন করলাম তার কি হবে? এই অঞ্চলে বাঙালী নেই, কোথা থেকে ছাত্র পাব?

- হাওড়া জেলা ইস্কুল ছাত্র পায় কি করে?

-জেলা ইস্কুল লোকাল স্কুল নয়। আপনাদের সাহায্য ছাড়া এগোনো যাবে না। প্লিজ হেল্প।

- তিন জন ছাত্রের জন্য আট জন শিক্ষকআর কি চাইছেন বলুন তো?

-এই অনুপাত টা স্বাভাবিক করতে।

- ছাত্র ধরে আনা কি ডি-আই এর কাজ নাকি…!!!!

- স্যার, কিছু মনে করবেন না, আমরাও শিক্ষকতার পেশায় এসেছি, শিক্ষকতা করতে। জানতাম না যে ছাত্র ধরাটা আমাদের জব প্রোফাইলের মধ্যে পড়ে। আর স্কুলে প্রত্যেক বিষয়ের শিক্ষক না থাকলে আজকের যুগে কোনো পড়ুয়া কি ভর্তি হবে আমাদের মত সাধারোন মানের স্কুলে? সবাই জেলা স্কুলেই ভিড় জমাবে।

-আচ্ছা দেখছি কি করা যায়!

-আম্ফানে স্কুলের ক্লাসরুমের ছাদ উড়ে চলে গিয়েছে। আরো অনেক আনুষঙ্গিক ক্ষতি।একটু যদি টাকা অনুমোদন করে দেন।

-কি করবেন আর বিল্ডিং সাজিয়ে? ওই তো কটা ছাত্রযাক গেআপনি বরং অমিতাভ বাবুর সঙ্গে কথা বলুন।

অমিতাভ বাবুর সঙ্গে বহু বছরের আলাপ।উনি আপার ডিভিশন ক্লার্ক। খুব অভিজ্ঞ মানুষ। যে ডি-আই সায়েব-ই হাওড়ায় আসেন,মোটামুটি অনেকটাই অমিতাভ বাবুর চোখ দিয়ে দেখেন। আর চারপাশে যখন আরও কিছু শিক্ষক উপস্থিত হন, স্বাভাবিকভাবেই ভার বেড়ে যায় তাই আরো অনেকটা। অনেক বছরের আলাপ থাকা সত্ত্বেও তখন তুমি থেকে আপনি-তে উত্তরণ ঘটাই, সম্বোধন কে, যাতে ওনার মান ও ঠাট বজায় থাকে।এই মান ও ঠাট বজায় রাখার জন্য উনি রোজ জুতো পালিশ করে আসেন, বাংলা ভাষার উন্নয়ণের স্বার্থে গর্ব করে দিদিমনিদের সামনে জাহির করেন যে কিছু মনে করবেন না, আপনি যখন ফোন করেছিলেন আমি পায়খানায় ছিলামআমি আবার পায়খানাকে পায়খানা বলি, আপনাদের মত পটি-ফটি বলা আমার ঠিক ধাতে আসে না।" তাই সকলে একটু সম্ভ্রম করে চলেন আর কি! আর উনিও বেশ সর্বসমক্ষে তা উপভোগ করেন।

-অমিতাভবাবু, ভাল আছেন?

এই কথা অনেককে টপকে বলে ওনার চশমার কাচ দিয়ে একটা কৌণিক দৃষ্টিগোচর হওয়াটাই কঠিন। তারপর আরো দু-মিনিট পরে

-কি দাদা, ভাল আছেন তো?

পাত্তা না দিয়ে এক অন্য ভদ্রলোক-কে কাছে ডেকে কানে কানে কি সব বললেন। এবং ভদ্রলোক বললেন,

-রাতে ফোন করব।

উনি চলে যেতেই অমিতাভ বাবু বললেন,

-হেডমাস্টার হয়েছে! কি করে যে ইস্কুল চালায়!

আর একজন বললেন,

-আপনি রিটায়ার করলে যে কত ইস্কুলের কি দশা হবে।

আমি জোরে বললাম, উনি থাকতেই আমাদের যা দশা আর বলবেন না, উনিই শেষ ভরসা।

এইবার দেবতা কৃপা করে তাকিয়ে বললেন

-কি সমস্যা, আপনার।

- এই ডি-আই স্যার পাঠালেন। স্কুল বিল্ডিংটার বড্ড ক্ষতি হয়ে গিয়েছে আম্ফানে। যদি একটু দেখেনমোবাইলে ছবি তোলা আছে।

-ও সব দেখা আছে।পুরোনো সব ব্যাপার এই সুযোগে আম্ফান বলে চালিয়ে বেশ খানিকটা টাকা হাতানোর চেষ্টাতা ডি-আই অফিস কি টাকা দেওয়ার ভাঁড়ার খুলে বসে আছে? যে চাইলেই পাওয়া যাবে? পদ্ধতি আছে

-বেশ পদ্ধতি টা কি?

-কাউকে দিয়ে এস্টিমেট করিয়ে জমা দিন।

-আচ্ছা।

চেনা-পরিচিতির মধ্যে এক-ভদ্রলোক-কে ধরে এস্টিমেট নিয়ে রীতিমত তাঁর লেটারহেডে সব তথ্য ও ছবি সমেত জমা দিতে গেলাম এক দিনের মধ্যে।

-কি করছিলেন এতদিন, ঘুমোচ্ছিলেন? ডেট তো কবে পেরিয়ে গিয়েছে।

-সে কি আগের দিন তো তা বললেন না!

-আজ বলছি।

একটা ফোন এল ওনার মোবাইলে, উনি উঠে গেলেন একপাশে। আমি ভগ্নহৃদয়ে শুনতে শুনতে বেরিয়ে এলাম চাপা গলায় উনি কাউকে বলছেন,

-আরে লাখ তিনেক তো পেয়েই যাবেন, তাড়াতাড়ি ব্যাকডেটে জমা করে দিন, প্লিজ! রিসিভিং এ যাবেন না, আমার কাছে আসবেন সরাসরি।

আজকাল শ্বাপদ দেখলে আর ভয় নয়, হাসি পায়। কারণ জানি এরকম মানুষদের বিষদাঁত সব ভাঙা।আর  শিরদাঁড়াও। তাই তাদের হিংসে, যাদেরটা সোজা আছে তাদের প্রতিনিয়ত ছোট করে তাদেরটাও যদি ভাঙা যায়।

তাই, গত দশ বছরে আমাদের বিদ্যালয়ে কোনো গণিত শিক্ষক নেই।

তাই, হিন্দি/ইংরেজী মিডিয়াম চেয়েও পাওয়া যায় না।

তাই, স্কুলের খাতে গ্রান্ট হওয়া কম্পিউটারের টাকা ডি-আই ভয় দেখিয়ে অন্য বিদ্যালয়-কে দিয়ে দেন।

তাই, ইস্কুলে ছাত্রদের জলের সাপ্লাই নেই। সেখানে জোর করে ঢোকানো অফিসে বসে যায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র।

তাই, আমাদের মাননীয় প্রেসিডেন্ট নিচের তলায় আমাদের আশ্রিত দরবারে বসে, একবার ওপরে এসে জিজ্ঞেস করেন না, যে স্কুলটির উন্নয়নের জন ঠিক কি কি করা উচিত বলে আমরা মনে করি।

তাই, দরকারী ফাইল হারিয়ে যায়।

তাই, ট্রান্সফারের ফাইল-ও হারিয়ে যায়, যাতে শিক্ষকদের চোখ রাঙানো যায়।

শিক্ষকদের ছোট করার মধ্যে যে অভিনব মানসিক তৃপ্তি, তার ফলে দিনে দিনে হাড়-পাঁজরা বেরিয়ে পড়ছে সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার।

যে জাতি শিক্ষকদের সম্মান করতে জানে না, তাদের অগ্রসর হওয়া অসম্ভব।

ভাববেন না যে আমরা একা এরকম পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে আছি। পড়ুয়াহীন বা পড়ুয়ার অভাবে ভুগছে খান বত্রিশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শুধু হাওড়া জেলার বুকে।

তাবড় শিক্ষক-রা যাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল এবং আছে, তাঁরা ব্যক্তিগত প্রোফাইল-এর উন্নতি ঘটানো বা জাতীয় শিক্ষক-এর সম্মানে ভূষিত হওয়ার লোভে চিরকালই আত্মবিস্মৃত হয়ে থেকেছেন।

তাই, সবটাই ওই পালিশ করা জুতোর তলায়না কি পায়খানায়? সরকারী ভাবে…?

আর হোয়াটস-অ্যাপ গ্যালারী ভরে উঠুক Happy Teachers Day এর প্রত্যাশায়