বিবাহ-অভিযান
(দ্বিতীয় পর্ব)
সেদিন ওদের
পালানোর কথা। সব প্ল্যান করা হয়ে গিয়েছে। পোকে বর্ধমানে সব সাজিয়ে ফেলেছে। বিয়ের মন্দির,
পুরোহিত, থাকার জায়গা, সব। নীতা বাড়ি থেকে বেরোবে টীউশনে যাওয়ার নাম করে। তারপর নিজেই
দু’টো থানায় যাবে, মালিপাঁচঘরা আর গোলাবাড়ি, নিজেই বেড়ালের গ্লায় ঘন্টা বাঁধতে।
নিজের হাতে লেখা চিঠি দিয়ে রিসিভ করে সেই কপি অন্য
কারো হাত দিয়ে আমার কাছে পৌঁছে দেবে। নিজে যাবে হাওড়া স্টেশনে। বন্ধু সেখানে অপেক্ষা
করবে। দেখা করার পর পাশাপাশি না থেকে একটু দূরে দূরে থেকে চলতে থাকবে, বর্ধমান পর্যন্ত।
সেখানে নেমে রাতটুকু কাটানো। পরদিন সকালে বিয়ে। তার পরদিন ফেরা। মোবাইল না থাকায় আগে
কথার দাম ছিল খুব মূল্যবান ব্যাপার। একমাস আগেও কাউকে কোথাও সময় দিয়ে থাকলে তার নড়চড়
হত না। তাই যেমন কথা তেমনি কাজ।
সেদিন সকাল থেকেই আমি বাড়িতে ছিলাম না। অনেকগুলো টিউশন পড়িয়ে কোনোরকমে চান-খাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়েছিলাম কাজে। টাইমস অফ ইণ্ডিয়াতে নিয়মিত লেখা বেরোচ্ছে তখন। ‘ক্যালকাটা টাইমস’ বলে যে সাপ্লিমেন্ট –টা তখন সবেমাত্র শুরু হয়েছে, তাতে মাথা গলানোর চেষ্টায় আছি। পুজোর আগে কুমোরটুলির মৃতশিল্পীদের দুরবস্থা নিয়ে একটা কিছু করে ফেলব ভাবছি। সুদীপ-দা (ঘোষ), যাঁর কাছে আমি অনেক কিছু শিখেছি, তিনি আমার কথা শুনে গ্রীন সিগ্ন্যাল দিয়েছেন। তাই সেদিন সব গুছিয়ে সকাল সকাল সোজা কুমোরটুলী।
বাড়িতে বলে
গিয়েছিলাম যে আমার বন্ধুর বিপদের কারণে কেউ যদি আমাকে খুঁজতে আসে যেন বলে দেওয়া হয়
যে রাত ন’টা হবে ফিরতে আমার।
সারাদিনের
কাজ সেরে সুদীপদাকে একদম স্টোরীর কপি ও ছবি দিয়ে তারপর ইভনিং শো-এ একটা সিনেমা দেখে
বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেই সাড়ে ন’টা বেজেই গেল। সারাদিনে খুব যে কেউ খোঁজ করেছে বলে জানা
গেল না। বাড়িতে একটি ছেলে এসে শুধু একটা খাম দিয়ে গিয়েছে লম্বা মত। সীল করা ছিল। খুলে
দেখলাম নীতার চিঠির রিসিভড কপি। সবে খেয়ে উঠেছি, তখন বুম্বা এসে ডেকে নিয়ে গেল।
আমার বন্ধুদের
বাড়ির সামনের ঘরে তিন-চার জন পুলিশ, নীতার জাঁদরেল জেঠু, তাঁর কয়েকজন শাকরেদ আর বন্ধুর
বাবা-মা ।
ঘরে ঢুকতেই,
বন্ধুর মা যেন আমাকে দেখে ছ্যাঁক করে উঠলেন। জেঠুকে বললেন,
-
এই
যে ইনি-ই তিনি, দাদা, যাঁর কথা বলছিলাম…এই হল নাটের গুরু। বন্ধু ভুল করছে, কোথায় আটকাবে,
তা নয় তাকে ভুল পথ দেখালো… উসকানী দিয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটাল।
-
জেঠু
হাত তুলে ছবি বিশ্বাস স্টাইলে কাকীমাকে থামিয়ে ধুতির কোঁচা টা ঝেড়ে সাজাতে সাজাতে বললেন,
-
তুই
বিলাস দার ছেলে?
-
হ্যাঁ…
-
আমি
ওনার ছাত্র ছিলাম…তা ওরকম একটা মানুষের এরকম ছেলে কেন…
-
‘ও
রকম’ আর ‘এরকম’ মানে? ঠিক বুঝলাম না। আমাকে ডেকেছেন কেন?
-
মানে
ওরকম দেবতূল্য বাবার এরকম রাক্ষসতূল্য ছেলে কেন? আর কেন ডেকেছি জানিস না, ন্যাকামী
হচ্ছে?
-
খুলে
বললে সুবিধা হয়, দেবতা-রাক্ষস-টাক্ষস জানি না, আমি আর আমার বাবা, দু-জন ভিন্ন ব্যক্তি,
তাই আলাদা রকমের ই তো হব। সেটাই স্বাভাবিক। আপনি আর আপনার বাবা কি হুবহু এক রকমের?
-
দেখলেন
তো দাদা, কেমন চ্যাটাং চ্যাটাং কথা…
কাকীমা বললেন।
থানার বড়বাবু বললেন, পাশ
থেকে,
-
আমাদের
হাতে ছেড়ে দিন স্যার, পালিশ টালিশ করলেই সব সুড়সুড় করে বেরিয়ে আসবে।
আমি ওনার দিকে তাকিয়ে হেসে
বললাম,
-
আগে
সরকারকে বলুন নিজের জুতোয় পালিশ করার কালি কিনে দিতে, তারপর তো আমি রইলুম।
-
তোর
সাহস তো কম নয় হে, ছোকরা? পুলিশের সঙ্গে কি ভাবে কথা বলতে হয় জানিস না?
-
জানি…পাব্লিক
সারভেন্ট আপনি…আমি হলাম গিয়ে পাব্লিক আর তাহলে আপনি কি? ভাবুন ভাবুন, ভাবা প্র্যাকটিস
করুন…
তারপর জেঠুর দিকে তাকিয়ে
বললাম,
-
কিছু
প্রয়োজন থাকলে বলুন, সময় নষ্ট হচ্ছে। আমার কাজ আছে…
খুব ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে
বললেন,
-
তাই
নাকি হে! আমাদের তো কোনো কাজ নেই। চা-বিস্কুট খেতে এসেছি রাতের বেলায়। বুইলি কি না।
তা কি কাজ কি করা হয় তোর? ঘটকালি?
-
না…ফ্রিলান্সার
জার্নালিস্ট…
-
আচ্ছা…ভারী
ব্যাপার…তা, ও ওরকম সবাই বলে… কোথাকার? সাল্কের কোনো ক্লাবের বাৎসরিক পত্রিকার না,
কি?
-
না…মানে
ওই আর কি…
- কেন রে নাম বলতে লজ্জা
কিসের?
- নাম বললে আপনি পার্মানেন্ট
করে দেবেন, প্লিজ?
- যাঃ বাবা…মানে?
- আপনার তো অনেক ক্ষমতা,
একটা বেকার ছেলে চাকরী পাবে, এই আর কি…
হামলি কাকু কখন পাশে এসে
দাঁড়িয়েছেন লক্ষ্য করি নি। হঠাৎ ওনার গলা শুনে ঘুরে তাকালাম, উনি বললেন…
-
টাইমস
অফ ইণ্ডিয়া তে লেখে আরো অনেক বড় জায়গায় লেখা-পত্তর ছাপা হয়।
হামলি কাকু আমাকে বেশ ভালবাসতেন।
সাহিত্য, গান, লেখালিখি এই সব নিয়ে ওনার সঙ্গে আলোচনা ও তর্ক বিতর্ক চলত। উনি পাশে
এসে দাঁড়াতে অনেকটা ভরসা পেলাম আর কি।
মনে হল জেঠুর স্বরে হঠাৎ
একটা বদল এল, সামান্য হলেও।
-
অ…তা
কি নিয়ে লেখা হয়…?
-
শিক্ষা
নিয়ে প্রধাণতঃ…বাকি ফ্যাশন , ঈকোনমি…ইত্যাদি…
-
তা
খবর আজ কি বলছে, নীতা কোথায়?
-
আমার
বন্ধুর সঙ্গে আছে, ভাল আছে…চিন্তা করবেন না, ফিরে আসবে, শিগগীর। নতুন বিয়ে থা করেছে,
দু-দিন ঘুরে একদম চলে আসবে।
-
স্পর্ধা
তো কম নয় তোমার…!
-
যাঃ
বাবা…আপনি নিজেই তো জিজ্ঞেস করলেন, আমি উত্তর দিলাম…
-
ওরা
একজ্যাকটলী কোথায় আছে বলবি? না হলে দেখাব মজা…তোর ওই বন্ধুর জীবন শেষ…বেশি পাঁইতাড়া
কষলে না তোর-টা ফুরোতে সময় লাগবে না।
-
জানি,
আপনি ক্ষমতাশালী সম্মানীয় ব্যক্তি। আমাকে ফুরোতে
আপনার কোনো সময় ই লাগবে না। শুধু ভেবে দেখুন জেঠু, দু-জন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ নিজেদের
পছন্দে বিয়ে করে আনন্দে বাঁচতে চাইছে, এবং নীতা ঠিক মানুষকেই পছন্দ করেছে বলে আমার
ধারণা। এতে কোনো ক্ষতি হবে না কারোর। সবাই ভাল থাকবে।
-
তুই
একথা বলতেই পারিস…তোর বন্ধুকে বাঁচাতে…নিজেকে বাঁচাতে…
-
না
আপনারা সবাই সুখে থাকবেন, যদি আজ এই মুহূর্তে সব মেনে নেওয়া হয়। আর বিগড়ে গেলে লাইফটাইম
আফশোষের সীমা থাকবে না। সব ঘেঁটে যাবে। কারণ নীতা ফিরে এলে, এই বিয়ে অবৈধ বলে জোর করে
প্রমানীত হলেও সারা সালকিয়ার মানুষ কিন্তু জানবে আসলে ঘটনাটা কি ঘটেছে…ভেবে দেখুন,
ঢি ঢি পড়ে যাবে! ঘাসবাগান থেকে ঘোষালবাগান পর্যন্ত আমাদের এই প্রিয় বন্ধু কে সবাই চেনে,
আমাদের প্রজন্মের আর ওর কিন্তু বেশ ভাল রেপুটেশন…বরং একজন মেয়ে হিসেবে নীতা ও তার পরিবারের
সম্মান হারাবে…তখন জেঠু, কিছু মনে করবেন না, আপনি কিন্তু ভিলেন হয়েই থেকে যাবেন। এই
সব কেসে বাবা-মায়েরা প্রথমী এরকম- ই করেন। কিন্তু কয়েক্মাস পরেই আবার সন্তানস্নেহে
সব মাফ করে বুকে টেনে নেন, দু-পক্ষেই। ফলে
একবার চলে গেলে সেই সম্মান আবার উদ্ধার করা কিন্তু আর যাবে না। আর আমে-দুধে মিশে গেলে
তখন আপনি নিজের বিবেকের কাছে দোষী থেকে যাবেন। আমি ভুল বলে থাকলে ক্ষমাপ্রার্থী…আপনার
আমাকে নিয়ে যা ইচ্ছে হয় করতে পারেন…
-
হুঁ…
(***ঘটনার ছ’মাস পর থেকে আমার কথা যে
অক্ষরে অক্ষরে মিলে যে গিয়েছিল সেদিন, তা নিয়ে আমি আজও গর্ব বোধ করি। খুব মনে হয় পঁচিশ
বছর পরেও, একই ভাবে, একটা ভরাডুবি থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলাম।)
পকেট থেকে
বের করলাম নীতার চিঠির কপি…
-
এটা
নিশ্চয়ই দেখেছেন আপনি…
-
নীতার
নিজের হাতে লেখা চিঠি, নিজেই থানায় জমা দিয়ে গিয়েছে…আর আমরা কেউ যাতে কেউ বিপদে না
পড়ি, তাই তার কপি আমাদের পৌঁছে দিয়েছে…
জেঠু শুনে আকাশ থেকে পড়লেন।
-
ও
নিজে এসব করেছে?
-
হ্যাঁ
জেঠু…আপনার থেকে আমি অনেক বয়েসে ছোট…অনুরোধ করছি…ওদেরকে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরতে দিন
প্লিজ…ওরা দু জনেই কিন্তু খুব বুদ্ধিমান ও বিচক্ষণ মানুষ, আশীর্বাদ করুন ওদের যেন মঙ্গল
হয়…
-
হুঁ…
-
আমি
তাহলে আসি?
-
হ্যাঁ
দরকার হলে কিন্তু ডেকে পাঠাব…
-
ওকে
ছাড়বেন না দাদা…মহা শয়তান ওটা আর ওই পোকে টা…আমার ছেলের মাথাটা খেয়েছে…
কাকীমা চিৎকার করতে লাগলেন। শুন্তে পেলাম, জেঠু শুধু বললেন,
-
আমি
আছি তো…তোমার থেকে আমার চিন্তা আরো অনেক বেশি…নীতার
ভবিষ্যৎ আমাদের সমাজে…
বুঝলাম ঠিক জায়গায় হিট
হয়েছে কথা।
আমি যখন বেরোচ্ছি কাকীমা
চিৎকার করেই চলেছেন,
-
ওরা
যদি এবাড়িতে এসে ওঠে তোমরা সব আমার মড়া মুখ দেখবে…কি দাদা, আপনার নাকি অনেক ক্ষমতা,
ওইটুকু একটা ছেলে আপনার মুখে ঝামা ঘষে চলে গেল, আর আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন।
পোকে আর আমার বন্ধুর ওপর
আমার বল ভরসা এতটাই যে আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। আবার ফিরে গেলাম। মাথায় আগুন
জ্বলছে। ঘরে ঢুকলাম।নিজেকে সংযত করলাম…
-
জেঠু,
কাকীমা উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন, আপনি ওনাকে বোঝান। আর নীতা ও আমার বন্ধুরা বর্ধমানে আছে,
কোথায় আমি ও জানি না…দেখবেন ওদের যেন কারো ক্ষতি না হয়, আপনাদের এই সাময়িক ও ব্যক্তিগত
ঈগোর টানাপোড়েনে।
কাকীমাকে বললাম,
-
সেদিন
যখন বলতে এলাম, অনেক বাজে কথা বলেছেন, মেনে নিলে আজ এই দিন দেখতে হত না, কাউকেই। আপনাদের
জেদের জন্য আজ নীতা আর আপনার ছেলে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কার থেকে? না নিজের বাবা-মায়েদের থেকে। বাহ! আর দোষ হল গিয়ে
আমাদের। কেন? না বাবা-মা ভরসা দেওয়ার বদলে তাড়িয়ে দিয়েছেন, তখন আমরা তাদের ভরসা দিয়েছি…বাহ!
নিজেরা কোথায় তাদের বল-ভরসা হবেন, তা নয় হয়ে উঠেছেন শত্রু…এই আপনাদের দায়িত্বজ্ঞান?
লজ্জা হওয়া উচিত, আমাদের মত বাইরের উটকো লোক-কে আপনাদের পারিবারিক ব্যাপারে যে নাক
গলাতে হল…কেন হল? ভেবে দেখবেন তো? কার দোষ, কে দায়ী…খালি যাকে হাতের সামনে পাব, তার
ওপরে দায় চাপিয়ে দিলেই কি নিজেরা দায়মুক্ত হওয়া যায়?...যত্ত সব বাজে কথা…
বলে হালকা হয়ে বেরিয়ে চলে
এলাম। কাল দুপুর পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় কাটলে হয়।
হে ভগবান! পুলিশ যেন ওদের
কাউকে খুঁজে না পায়। আর পেলেও যেন কিছু না করে।! আসা করি জেঠু পুলিশকে সেরকম ই নির্দেশ
দেবেন এই রকম কথার পরে…
(আগামী পর্বে শেষ)



