Tuesday, 27 July 2021

জগবন্ধুর গপ্পকথা ১ঃ জগার ভাঁড়ামো

 সালঃ ১৯৮৯, স্থানঃ মহীনাথ পাড়া, সালকিয়া, হাওড়া।

 

জগবন্ধু-র সমস্যা অনেক। তার মধ্যে কি করে যে কেলাস এইট টা উতরোবে, তাই নিয়ে টানা-পোড়েন। ইংরেজি কেলাসে এদিকে পড়ায় নিউটন অত্তবড় লোক হয়ে অঙ্ক ছাড়া সবেতে ফেল মারত, তাতে কিস্যু হত না। পুরো বাপ-কা বেটা! আর ওর বেলাতেই কেন "কিস্যু হবে না তোর দ্বারা!"-- মার্কা কথা শুনতে হয়।

 এই তো সেদিন পদার্থ বিদ্যার কেলাসে শিখল, কি না যে, যে কোনো পদার্থকে তাপ দিলে তা থেকে সবার আগে তার মধ্যে যে জলীয় অংশ থাকে, মানে জল-জাতীয় যা কিছু আছে তা সব বাষ্পীভূত হয়ে পড়ে থাকে আসল, নিখাদ পদার্থ। যেমন, চিনি যদি আসলে কার্বণ হয়, আর রসোগোল্লার রস তার দ্রবণ, তাহলে সেই রস কে একনাগাড়ে তাপ দিলে পড়ে থাকবে কালো কার্বণ মাত্র। সাদা চিনির বদলে কালো কার্বণ।

 তা জগার অনেক দিনের প্রশ্ন ছিল মনের ভেতর, যে সর্দি, অর্থাৎ কি না শ্লেষ্মা, যাকে চলতি কথায় 'সিগনি' বা 'সিকনি' বলে, তার মধ্যে মাল আসলে আছে টা কি। কি খেয়াল হল, একদিন সক্কাল বেলায় উঠে ভজা-দার চা-এর দোকান থেকে একটা ভাঁড় এনে তাতে নাক থেকে ঝেড়ে ফেলল কয়েক দফা হলদে-সব্জে রঙের  সেই পদার্থ যা থেকে আগুনের সাহায্যে সে বের করতে চলেছে  যুগান্তকারী এক মৌল -- সেই মূলের হাত ধরে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে মুছে যাবে সর্দি-কাশি। এক ডোজ খেতে হবে শুধু 'জগাম্যাক্সিন ফোর্ট'...অনেক ভেবে-চিন্তে ওষুধের এই নামটাই লাগসই মনে হয়েছে জগার।

 তা যেমন ভাবা তেমনি কাজ!

বাড়ির বাইরে চাতালে তিনটে ভাঙা ইঁটের উনুনের নিচে কয়েকটা শুকনো গাছের ডালের জ্বালের আগুনে বসন্তি হল সেই অমূল্য সিকনি ভর্তি ভাঁড়ের। আগুনে সেই ঘন দ্রবণ স্ফুটনাঙ্ক পেরিয়ে যখন প্রায় সম্পৃক্ত হওয়ার মুখে, ডান কানে এক পাক...জগার বাপ...

-- এটা কি হতিসে?

-- বিজ্ঞানের এর হাতে নাতে পরীক্ষা...

-- আমার অন্ন ধ্বংস কইর‍্যা ই-সব নোংরামো করবি না তুই, ক'য়ে দিলুম। টুশনে যাস নাই কেন?

-- এই কাজ টাই টিঊশনে দিয়েছে বাবা।

-- নিজের বাপরে মিথ্যা কতা কওন দিতে শিখাইচে স্যার! টুশনে নিজের সর্দি ঝাইড়া পুড়াইতে কইসে?

গালে এক থাপ্পড় পড়ল জগার। তারপর পিঠে কিল।

মনে মনে জগা ভাবতে লাগল, একটা গাছ থেকে একদিন একটা  আপেল পড়েছিল মাটিতে। একটা লোক সেটা দেখে বিজ্ঞানের ধ্যান-ধারণা ওলট-পালট করে দিয়েছিলেন। আজ সেরকম একটা আবিষ্কার ওর হাত ধরে হতে হতেও হারিয়ে গেল। পৃথিবী একদিন জগার বাপের কাছ থেকে জবাব চাইবে, কেন আজ তাকে ভাঁড়-ভর্তি সর্দি জ্বাল দেওয়ার জন্য, আগাপাশতলা ধোলাই দেওয়া হয়েছিল।

জগা জানে, ইতিহাস, মানে সময়, কাউকে ক্ষমা করে না, যদিও ক্ষমা-ই পরম ধর্ম। তাই আজ বাবা-কে সে ক্ষমা করে সময়ের হাতে ছেড়ে দিল সবটাই। শুধু একটাই খেদ রয়ে গেল -- একটা বিরাট আবিষ্কারের হাত থেকে পৃথিবী বঞ্চিত হল, যার ভ্রূণ ঐ সাধারণ একটা ভাঁড়ের মধ্যে নিহিত ছিল। 

No comments: