চন্দ্রালোকে চিৎপাতঃ
সেদিনের সিকনি নিয়ে কেমিক্যাল
পরীক্ষা করতে গিয়ে আগাপাশতলা খেয়ে কিন্তু জগার কোনো আক্ষেপ নেই। আজ তার কথায় কেউ পাত্তা
দিচ্ছে না বটে, একদিন বুঝবে মানুষ যে তার ধারণাগুলো সময়ের থেকে এগিয়ে ছিল। আমরা বন্ধুরা
আড্ডার প্রতি পরতে পরতে তা টের পেতাম। একসময়ে তাকে যখন আমাদের টেনিদা বা ঘনাদা ইত্যাদি
প্রভৃতি চরিত্রের সাথে নেহাত জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছিল, তাতে তার ঘোর আপত্তি।
তার সঙ্গে কথা বলে একদিন আমাদের বন্ধু সকল এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে, সব বুঝে-শুনে
তার নিজেকে অনেকটা পাগলা দাশুর মত বলা যেতে পারে। আমরাও সত্যি বলতে কি, দেখলাম যে,
বেশ মিল।
অমর বাবুর ক্লাসে ভূগোল
পড়ানো হচ্ছিল। পুরো সৌরজগতে পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদের ওপর গিয়ে পড়ল জগার নজর।
সে সব নিয়ে কত ভাবনা চিন্তা, এ-সবের কূল-কিনারা আমরা কেন, অনেক সময়ে স্যারেরা-ও খুঁজে
পেতেন না। এমনিতে পড়াশোনায় ভাল নয় বলে জগাকে কোনো মাস্টারমশাই খুব একটা ঘাঁটাতেন না।
তবে আমাদের ধারণা ছিল একদম-ই আলাদা। জগা পড়াশোনায় যে ভাল নয়, এটা একটা অজুহাত মাত্র,
স্যারদের কাছে। আসলে ওকে প্রশ্ন করলে এমন সব উত্তর আসবে যে স্যারেরা নিজেরাই ঘেঁটে
যাবেন – তা সেই কারণেই জগাকে সচেতন ভাবে এড়িয়ে চলা। কিন্তু
সব সময়ে কি চাইলেই আর এড়িয়ে চলা যায়! জগার মনে প্রশ্ন থাকলে ও কি আর চুপ থাকতে পারে?
ক্লাসে প্রশ্ন করে বসে। তখন তো স্যারেরা ওকে এড়িয়ে যেতে পারেন না। বেশির ভাগ স্যার
ওকে পালটা প্রশ্ন করে ধরাশায়ী করে চুপ করিয়ে দেন। অনেকে আবার ও প্রশ্ন করলেই উত্তম-মধ্যম
পিটিয়ে দেন, নিজের কাছে প্রশ্নের উত্তর যে নেই, শিক্ষক হয়ে যে আসলে হেরে গিয়েছেন পিছনের
বেঞ্চে বসা একটা অতি সাধারণ মানের ছাত্রের কাছে, সেটা মেনে নিতে পারেন না আর কি। যাঁদের
মার-ধর-বকা-ঝকা পছন্দ নয়, তাঁরা ‘পরে বলছি তোর প্রশ্নের উত্তর’ বলে এড়িয়ে চলে যেতেন। জগা ছিল আমাদের হিরো, কারণ তার মন সেই শিশুর মত,
যে অনায়াসে নির্ভীক ভাবে বলতে পারে, “রাজা, তোর কাপড় কোথায়?”
জগার চন্দ্রাভিযানে ফেরা
যাক। একদিন একটা দড়ি নিয়ে তাকে দেখা গেল দু’তলা থেকে আর ইস্কুলের উঠোন পর্যন্ত কি সব মাপামাপি
করছে। দড়ির শেষে একটি ওলন ঝোলানো। জগা কিছু করলে আমরা সবাই সব ছেড়ে সেদিকেই নজর রাখতাম।
এমনিতে অনেক কথা বলে কিন্তু এই সব সময়ে ওর পেট থেকে কোনো কথা বের করা বেশ কঠিন। তবুও
অনেক কষ্টে জানা গেল, যে চাঁদের মধ্যাকর্ষণ যদি পৃথিবীর থেকে ছয়গুণ কম হয়, তাহলে এই
ইস্কুল-টাকে যদি চাঁদে নিয়ে যাওয়া হয়, তাহলে আর ইস্কুলের মেন গেটের কোনো প্রয়োজন আদৌ
থাকবে কি না তা নিয়ে সে পরীক্ষা করতে বসেছে। সেক্ষেত্রে, প্রতিটি ক্লাসরুমে রাস্তা
থেকে সোজা একলাফে প্রবেশ করা সম্ভব। আমাদের ইস্কুল বিল্ডিং দু’তলা। আর আমরা যারা লাফালাফিতে দড়, তাদের কোনো অসুবিধা নেই। যারা মোটা,
অর্থাৎ কি না স্বাস্থ্যবান, তাদের একটু চাপ হবে বটে, কিন্তু তাদের সেটা শিখতে গেলে
শারীরিক উন্নতি-ও হবে। আপনারা ভাবুন, এ হেন জগা-কে অঙ্কে কাঁচা বলে দাগিয়ে দেওয়ার সত্যি-ই
কি কোনো মানে হয়? একবার না হয় x2-y2 এর ফর্মূলা বলতে পারেনি। স্যার যখন সেই জন্য তাকে
পালিশ করে ছেড়ে দিলেন, ও মার খেতে খেতে বলতে থাকল একনাগাড়ে, “আরে স্যার, জানিনা বলেই তো আমি ছাত্র আর আপনি স্যার। শেখার জন্যই তো
ইস্কুলে ভর্তি হয়েছি। যদি জানতাম, তাহলে কি আর ইস্কুলে আসতাম? না কি আপনি স্যার হতেন
আর আমি ছাত্র!!!” শুনে আরো মার। কিন্তু কথাটার মধ্যে যুক্তি যে নেই
তা তো বলা যাবে না। তাই না?
চাঁদ নিয়ে ক্লাসে বোমা-টা
ফাটানোর অপেক্ষায় ছিল জগা। বোমা ফাটানোর আগে, মশলা লাগে, তাকে ঠিক করে বাঁধতেও হয়।
তবে না ফাটানো যায়। জগা বেশ কিছুদিন ধরে সেই মালমশলা যোগাড় করে বাঁধছিল, আমরা বুঝতে
পারছিলাম। অঙ্ক, ভূগোল আর জড়বিদ্যা মিলিয়ে কি সব প্যাঁচ কষছে সে।
সেদিন ছিল উত্তম-বাবু-র
জড়বিদ্যার ক্লাস। ‘আলোক’ পরিচ্ছেদ নিয়ে আমরা সবাই মাথার চুল ছিঁড়ছি। আলো
তার মত দিব্যি যাচ্ছিল, কি যে দরকার ছিল তাকে আয়না, লেন্স, তাদের আবার উত্তল-অবতল,
পর্দা, এইসব দিয়ে আটকানোর। জগা কিন্তু গুলে খাচ্ছিল সব, সদবিম্ব-অসদবিম্ব ওর হাতের
মুঠোয়। আমরা সেটা বুঝলাম সেই ক্লাসে যেদিন উত্তম স্যার বললেন,
“বড় হলঘরে সিনেমা দেখতে গেলে কেমন তল এর প্রয়োজন?”
সারা ক্লাসে জবাব দেওয়ার
জন্য একটাই হাত উঠল। আমাদের সকলের শিরদাঁড়া সোজা। যে বেড়ালটা এতক্ষণ জানলার কার্নিশে
বসে ঝিমোচ্ছিল, উঠে একটা বিরাট আড়মোড়া ভেঙে বসে ড্যাবডেবিয়ে চেয়ে রইল, যেন কিছু ঘটতে
চলেছে, সেই প্রত্যাশা তার-ও। অমিত পাশ থেকে আলতো করে স্বগতোক্তি করল, “গেলো আজ স্যারের দিনটা, কার মুখ দেখে উঠেছিলেন কে জানে!”
- জগা, তুমি এই নিয়ে কিছু
বলতে চাও?
- হ্যাঁ স্যার, অনেক কিছু…
- তাই না কি! তা তার-…
- কোত্থেকে শুরু করব ঠিক
বুঝতে পারছি না। আচ্ছা স্যার, চাঁদের গা তো অমসৃণ।
- হ্যাঁ।
- তাহলে সেখানে আলোর বিক্ষিপ্ত
প্রতিফলণ হওয়া সম্ভব।
- হ্যাঁ।
- আর চাঁদের আলো পৃথিবীতে
পৌঁছাতে ১.২৬ সেকেন্ড মত লাগে। তাতে অন্ততঃ দূরদর্শণের মত বিরাট সময়ের ফাঁক থাকবে না।
- বাহ! তুই তো অনেক জানিস
রে জগা! কিন্তু দূরদর্শনের সঙ্গে চাঁদের কি সম্পক্কো!
- হ্যাঁ, স্যার সেটাই তো
আসল কথা! ভেবে দেখুন, তাহলে সেক্ষেত্রে চাঁদের সাদা গা-টাকে আমরা কেন সিনেমা দেখানোর
জন্য ব্যবহার করতে পারি না কি? সারা পৃথিবীর লোক একসাথে দেখতে পাবে।এটার নাম দেওয়া
হবে ‘মুনলাইট’!
পুরো ক্লাস চুপ। প্রায়
তিরিশ সেকেণ্ড। স্যারের ফরসা মুখ বাঙালী থেকে অত্যাচারী বৃটিশদের মত হয়ে যাচ্ছে, আমরা
দেখতে পেলাম। তিনি এগোতে লাগলেন জগার দিকে যেমন করে কোনঠাসা শিকারের দিকে ক্ষুধার্ত
সিংহ অগ্রসর হয়। প্রশ্ন করলেন স্যার,
- কিন্তু সাউন্ড শুনবে
কি করে? সবাই একসঙ্গে?
- কেন? রেডিও আছে তো। বিবিধ
ভারতী-তে সাউন্ড চলবে আর আকাশে চাঁদের গায়ে সিনেমা-র ছবি…
- চাঁদের গায়ে যে কলঙ্ক
গুলো আছে সেগুলো আসলে কি জানিস, তুই?
- স্যার, ওটা নিয়ে আমিও
ভেবেছি। ওটা কোনো সমস্যা-ই নয়। এটা সফল হলে না হয় একটা রোবট ওয়ালা রকেট পাঠিয়ে চাঁদের
গা-টা একটু ঝাড়পোঁছ করে দেওয়া হবে। লোকজন অনেকদিন যায় নি তো, তাই ওরকম নোংরা হয়ে গেছে।
ভাববেন না স্যার, ওরকম কালো কালো দাগ, পারিজাত সিনেমার পরদায় আছে, কলকাতার রেগাল-র
অবস্থা আরো খারাপ। রাখী-র টা অবশ্য বেশ পরিষ্কার।
- তাই নাকি! তুই তো বেশ
খোঁজ খবর রাখিস।
- হ্যাঁ, মানে ওই আর কি!
- তা শেষ সিনেমা কি দেখেছিস?
কোথায়?
- মচলতি জওয়ানী…ওই রেগালেই…দেখে উল্টোদিকে হিং-এর কচুরী খেয়ে বাড়ি এলাম যে...
আমরা সবাই স্তম্ভিত, আবার।
ক্লাসের শব্দশূন্যতা দেখে জগা বুঝল ইমোশানাল হয়ে ভুল তথ্য ভুল লোক-কে দিয়ে ফেলেছে।
- বাহ বাহ! এটা আবার জীবনশৈলীর
পাঠ না কি রে!!! (বলতে বলতে জগার আরো কাছে এগিয়ে যাচ্ছেন স্যার) তা এতে লাভ কি হবে?
- বিজ্ঞান মানুষের সাহায্যে
লাগবে। বাংলা রচনায় তো আমরা তাই লিখি।
- আজকের এই সিনেমার নাম
‘কুচলতি সম্ভোগ’… তোর
গায়ে এমন আলোকরশ্মির নিয়মিত প্রতিফলন হয়ে বিচ্ছুরণ ঘটবে যে তোকে ওই হুকে টাঙিয়ে রাখলে
তোর বন্ধুরা তোকে আয়না হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে।
- স্যার স্যার…আমি মানে ইয়ে স্যার, কি ভুলটা বললাম সেটাই তো বুঝলাম না…আলোচনা করতে গেলেই আপনারা শুধু আমাকে মারেন, এটা কি ঠিক!
আমাদের তো জগার প্রতি এটা
একপেশে অন্যায় বলে চিরকালই মনে হয়েছে।
আপনাদের কি মনে হয়, জানার
অপেক্ষায় রইলাম।
No comments:
Post a Comment