#natokreview2021 #SoumitraChattopadhyay #Pherabanglanatok
আমার জন্মদিন ১৯ তারিখে। আবার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের-ও। মাস-টা আলাদা হলেও, তারিখটা তো একই, তাই সেটা ভেবেই শিহরণ জাগে। সকাল থেকেই ফেসবুক –হোয়াটসঅ্যাপে নানারকম মেসেজের ঢল। তবে খুব ভাল লাগল ২০২০ সালে ওনার জন্মদিনের কিছু পারিবারিক ছবি দেখে। দেখতে দেখতে মনে হল, সেই clichéd truth -- উনি যে আর নেই, সেটা বিশ্বাস করাটাই কঠিন।
সেই বিশ্বাসে আঘাত দিয়ে সকলকে আলাদা করে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যই যেন ১৯ শে জানুয়ারী, ২০২১ তারিখে ওনার স্মৃতিতে আকাদেমী-তে ‘ফেরা’ নাটকের শো রাখা হয়েছিল। প্রথমবার সৌমিত্র-বাবু কে ছাড়া হত এই শো। অভিনয়ে ছিলেন, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, দেবশঙ্কর হালদার ও সৌমিত্রবাবুর স্নেহধন্য কন্যা পৌলমী চট্টোপাধ্যায়। আমি ভাবতে বসেছিলাম, এনারা পারবেন, ওনাকে ছাড়া অভিনয় করতে! স্টেজে কেঁদে ফেলবেন না তো! আবার মনকে বোঝালাম, এ বড় কঠিন ঠাঁই the show must go on. কারোর পার্থিব যাওয়া-আসা নাটকের প্রবেশ ও প্রস্থানের মতই। কে না জানে,
সৌমিত্রবাবুর কথা ভেবেই যেন লেখা মনে হচ্ছে, তাই না? তবে বিধাতা সে সব দ্বিধা রাখেন নি, বাধ সাধলেন। আমি আকাদেমি-তে ১৭ই জানুয়ারী, ২০২১ তারিখে bloodmates আয়োজিত রক্তদান শিবিরে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আসার ফলে বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারলাম, যে অনিবার্য কারণ বশতঃ ‘ফেরা’-র শো বাতিল হয়েছে। বদলে স্মৃতিচারণে নিপাট আড্ডা, কলকাতার নানা আড্ডাবাজ ব্যক্তিত্বদের নিয়ে – মানে, এরকম ভাবে ভাবা হচ্ছে। রাতে অবসরে ফেসবুক খুলে দেখি আমার বন্ধু পোস্ট করেছে, যে সৌমিত্রবাবুর স্মৃতিচারণ তাঁর জন্মদিনে, কথায় নয়, গানে-কবিতায় নয়, তা হবে নির্ভেজাল সঙ্গীতে। সেই সঙ্গীত নিবেদন করতে এককথায় দেবশঙ্কর-বাবুর অনুরোধে রাজী হয়েছেন বিখ্যাত দুই বাঙ্গালী – পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ (সরোদে) ও পণ্ডিত তন্ময় বোস (তবলায়)। শত দুঃখের মাঝেও মন নেচে উঠল। শেষ ক্লাসিক্যাল কনসার্ট কবে শুনেছি, মনে নেই। আর কলকাতায় এই জুটি কত বছর প্র একসঙ্গে বাজাবেন সে হিসেব নেই কারোর কাছেই। তাই মনটা বেশ নেচে উঠল। মনে মনে ভাবলাম ‘ফেরা’ নাটকের বর্তমান অভিনেতাদের এটাই প্রয়োজন ছিল, খুব – আরও কিছুটা সময় পেরোনো, সৌমিত্রবাবুকে ছাড়া, এই নাটক্টি মঞ্চস্থ করতে নিজেদের মনকে প্রস্তুত করা।
আমার আকাদেমি-তে সিট ফিক্সড। এম-রো এর মাঝামাঝি ২৩-২৮। না পেলে অন্য কথা। তবে দু-একবার ছাড়া এরকম হয় নি। ওখান থেকে সম্পূর্ন স্টেজের ম্যাগ্নানিমিটি আর ভিস্যুয়াল আপিল যতটা তৈরী হয়, অন্য কোথাও থেকে আমি পাই নি। সবাই বলে বটে, নাটক দেখতে হলে যত সামনে থেকে দেখা যায় ততই ভাল। কিন্তু আমি দেখেছি, যত সামনে যাব, তত চোখ আটকে যাবে বিশেষ কোনো চরিত্র-তে। ধরা পড়ে যাবে ফাঁকা পেয়ালা বা কার্ডবোর্ডের তলোয়ার। চড়া মেক-আপ এর পরিষ্কার খোলস আর চরিত্র বা অভিনয়-কে স্বররগীয় করে তুলবে না। আমি চাই না এই ম্যাজিক নষ্ট হোক। তাই একটু দুর-ই ভাল। আমি তো ইন্দ্রজালে আটকা পড়তেই এসেছি।
যাই হোক, টিকিট কেটে উত্তেজনার বশে ঢুকে পড়েছিলাম হলের মধ্যে। দেখি দুই পণ্ডিতে মিলে সুরের লড়াই ভেঁজে নিচ্ছেন। আর তার পর দুজনে আকাদেমীর সামনে সবাই যেখানে দাঁড়িয়ে চা আর বিখ্যাত ডিমের ডেবিল খায়, সেখানে দাঁড়িয়ে। খুব একটা ভিড় নেই। আমি গিয়ে একটা সেলফি তোলার অনুরোধে হাসিমুখে দু-জনেই রাজি। মনে হল ওনারাও যেন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছেন। হঠাৎ হাজির হলেন তাঁদের মধ্যে দেবশঙ্কর-বাবু। তাঁদের ভাব বিনিময়ের পরে তিন অবিসংবাদিত তারকাদের একসঙ্গে একটা ছবি তোলার জন্য আবার অনুরোধ জানাতেই আবার রাজি। অবিশ্বাস্য! শুধু দেবশঙ্কর বাবু বললেন, একটু শ্লেষ মিশিয়ে
- ফেসবুকে দেওয়ার জন্য, না কি!
ধরে ফেলেছেন ঠিক। কথাটা সত্যি হলেও এরপর আর কি করে তা বলি। কিন্তু আমিও সিদ্ধান্ত নিলাম, এই ছবিটা আর সেলফি-টা নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহেই রাখব। পোস্ট করব না, কোথাও-ই, ওনাদের সম্মানে। তাই আমিও উত্তর দিলাম,
- না ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখার উদ্দেশ্যে।
হলে ঢুকে বসলাম। দর্শক যে খুব হয়েছে, বলা যাবে না। সম্পুর্ণ অন্ধকার নিকশ-কালো ব্যাকগ্রাউণ্ডে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ব্লো-আপ যেন শূন্যে ভেসে আছে। আর তার সামনে মহাসঙ্গীতের আয়োজন। সি-শার্পে তানপুরার আবেশ কেমন আস-পাশ সব ভুলিয়ে দিল। এই মায়াময় সন্ধ্যা যে অমৃত ঢেলে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত, অমৃতপুত্রের সন্ধানে, তা এক অনির্ব্বচনীয় মহিমায় ধরা দিল আমার সমস্ত স্নায়ুসূত্রে চাপা উত্তেজনা সৃষ্টি ক’রে।
ধ্রুপদ পর্বে অসামান্য রাগের বিস্তার ঘটালেন সরোদে তেজেন্দ্রনারায়ণ, রবীন্দ্রসঙ্গীত-কে মূল আশ্রয় কর। আলাপ শুরু হল কখনো লীন তালের স্রোতে, কখনো উন্মুক্ত চালে। তালে অল্প করে ঢুকে আবার রাগের বিস্তার ঘটাতে লাগলেন পণ্ডিত। আমরা মোহিত। মুগ্ধ। সঙ্গে তন্ময় বোস-ও নিজেকে ডুবিয়ে নিচ্ছিলেন সেই সুরের মূর্চ্ছণায়। কেমন করে হঠাৎ খেয়াল হল একসময়ে যে বিলম্বিত হয়ে মধ্যলয়ে ঢুকে পড়েছে বাজনা। আমরা দর্শক-শ্রোতা-রা এতটাই মশগুল যে সেই চলনে তাল ও সুর কিভাবে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গিয়েছে, তার কোনো পৃথক অনুভূতি নেই। সুর-তালের খেলা যখন ঝালা পর্যায়ে গিয়ে শেষ হল, তখন যেন আমরা যেন আর ইহজগতে নেই। পণ্ডিতদ্বয় অতীব অমায়িক। দর্শক-শ্রোতাদের কাছে অনুমতি চেয়ে নিলেন, একটি সেই সন্ধ্যার শেষ নিবেদনের জণ্য।
সীমিত পরিসরে সব পর্যায় ছুঁয়ে উত্থান ও পতন। তারপর হঠাৎ শেষ।
শ্যামবাজার মুখোমুখি-র বিলু দত্ত মহাশয় স্টেজে এসে অনুষ্ঠান শেষ করলেন। আমি মঞ্চের পিছনে গেলাম, টিকিটের পিছনে দুই পণ্ডিতের সই সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। এক কথায় দিয়ে দিলেন। বললাম,
- অনেক আশা করেছিলাম যে একবার ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’- র বিলম্বিত বিস্তার শুনতে পাব।
- পৌলমী বেছে দিয়েছিল আমাদের সৌমিত্র-দার প্রিয় কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত। আর বার বার বলে দিয়েছিল, আমাদের পূর্ন স্বাধীনতা আছে অন্য আরো কিছু বেছে নেওয়ার, কিন্তু তা যেন আনন্দের হয়। সবকিছু আনন্দঘন হোক। কোনো শোকের রেশ যেন না থাকে।
বললেন, পন্ডিত তন্ময় বোস।
সেই খেই ধরেই তেজেন্দ্রনারায়ণ মশাই বললেন,
- আসলে এমন আমুদে মানুষ হিলেন, প্রাণশক্তিতে ভরপুর, যে দুঃখ ব্যাপারটাই ওনাকে সাজে না। এই দেখুন না, সেই ওনার হাত ধরেই আজ ন’মাস পরে দু’জনে স্টেজের আলোয় উদ্ভাসিত হলাম।
আমি ‘ফেরা’-র পথে হিসেব কষতে লাগলাম, সে দিনের জমা-খরচ। মেলাতে পারলাম না। মাত্র একশো টাকার বিনিময়ে কি নিয়ে ফিরছি।
নাকের বদলে নরুণ তো নয়! শুধুই অপার্থিব টাক-ডুমা-ডুম-ডুম।




