আগের দিন থেকে তোড়জোড়। আগের বারের রথ টা মোটেও ভাল ছিল না। একে একতলা, তায় আবার দু-দুটো চাকা ভেঙ্গেই গেল। এবারে প্ল্যান তিনতলা রথের। বাবা অনেক করে বোঝালেন আমাকে, তিনতলা রথের কিন্তু ব্যালেন্সে সমস্যা হবে, উলটে পড়ে যেতে পারে, টানতে গিয়ে। কিন্তু কে কার কথা শোনে। রথ যখন নতুন, জগন্নাথের সেট-ও নতুন চাই। ওই একচালার জগন্নাথ-ও চলবে না। আলাদা আলাদা চাই। তিন থাকে তিনজন বসবেন।
রথের দিন সকাল বেলায় রথ কিনতে যাওয়া মানে বোকামো। আগের দিন ভাল গুলো বিক্রি হয়ে যায়। পড়ে থাকে সব ডিফেকটিভ পিস গুলো। ফুটপাথের দোকানদার গছিয়ে দিয়ে খালাস। আর তার টিকির দেখা পাওয়া যাবে না, কয়েক ঘন্টা পরেই। তাই আগের দিন সন্ধ্যেবেলাতেই সব সারা হল। তখন ছাঁটা মিছরির (যা এখন মৌরীর সঙ্গে মিশিয়ে মাউথ-ফ্রেশনার হিসেবে আজকাল দেওয়া হয়) এত চল ছিল না। বাতাসা, (গুড়ের বা চিনির), এমনি ভাঙ্গা মিছরি বা নকুলদানা, এই ছিল প্রসাদ। মুড়কী-ও রাখত কেউ কেউ।আমরা মিছরি দিতাম। কেনা হল, রথ, জগন্নাথের সেট, রঙ বেরঙ্-এর মার্বেল পেপার, গঁদের আঠা, ডেণড্রাইট আঠা। আমার মনে খুব আনন্দ প্রথম তিনতলা রথ পেয়েছি, সামনে আবার দুটো সাদা ঘোড়া লাগানো, পাতলা টিনের পাত দিয়ে। রথ চললেই সেই ঘড়ঘড়ানীতে ঘোড়াগুলো এমন কেঁপে কেঁপে উঠছে, যেন তাদের-ও প্রাণ আছে। বাজার থেকে ফিরতে একটু বেশি-ই সন্ধ্যে হয়ে গেল। রথের দিন হাফ ছুটি। তাই ইস্কুলেও যেতে হবে। পড়াশোনা করতে বসতে তাই বাধ্য। পড়তে বসলেও মন কি আর বসে। খালি নানা ছুতোয় উঠে শোয়ার ঘরের এক কোনে থাকা রথটাকে একবার করে দেখে আসা, আর কল্পনা করা, কাল কি কি দিয়ে কিভাবে সেই রথ কে সাজিয়ে, বাকি সবার রথের থেকে বেশি সুন্দর করে তুলতে পারা যায়। মা আমার বারংবার ওঠা দেখে রেগে গিয়ে বলল, বেশি বাড়াবাড়ি করলে কাল আর রথ টানতে দেওয়া হবে না। ভয়ের চোটে, সব পড়া খুব তাড়াতাড়ি শেষ করে খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লাম। চোখ বুজে মটকা মেরে ছিলাম অনেকক্ষণ। আমার স্বপ্নরথ – সবাই হাততালি দিচ্ছে, এত সুন্দর সাজানো হয়েছে। কেউ প্রণামী হিসেবে চার-আনা, আট-আনা দিচ্ছে না। হয় একটাকা না হয় দু টাকা। বার বার মিছরি প্রসাদ শেষ হয়ে যাচ্ছে, আবার বাড়ি গিয়ে আনতে হচ্ছে। কখন আমার মটকা মারা স্বপ্নের সঙ্গে ঘুমের স্বপ্ন এক হয়ে গেল জানতে পারি নি। সকালে উঠে আবার পড়া। মন নেই। তবুও নম নম করে যতটা হয়। নতুন জগন্নাথ-দের খবরের কাগজে মোড়া। সেই যে বাজারে সন্ধ্যের আলো আঁধারী-তে একবার দেখতে পেয়েছিলাম, আর সুযোগ হয় নি। মা-কে বলতেই বলল, কোথায় ভেঙে-চুরে যাবে! একদম ইস্কুল থেকে ফিরে এসে খুলিস।
বেলুড়ে আমরা যে বাড়িতে থাকতাম, তার পিছন দিকে একটা বড় বাগান ছিল। কলকে, টগর, জবা, বাহারে, লতানে অনেক রকমের গাছ ছিল। পাড়ায় অন্য কোথাও গাছ বলতে সেরকম কিছু ছিল না। সেই সবের ডাল-পাতা-ফুল দিয়ে আমি রথ সাজাতাম বাবার সাহায্যে। বাবাও ইস্কুল শিক্ষক। ছুটি নেই। আরোই যেতে হবে। মা-কে তাই বলে গেলাম, সেদিন যেন পাড়ার কেউ আমাদের বাড়ির গাছের ডাল-পাতা-ফুল কিছু যেন নিয়ে যেতে না পারে, লক্ষ্য রাখতে।
ইস্কুলে সেদিন আর কিছুই হল না সেরকম। শুধু শুধু যাওয়া। ফেরার পথে বৃষ্টি শুরু হল, আকাশ কালো করে। উফ! ভগবান, আজই এত বৃষ্টি কোথা থেকে এল! থামিয়ে দাও! দেখ, তোমারি আমার নতুন কেনা রথে চাপা হবে না! বিশ্বকর্মা পুজোর দিন-ও তুমি এরকম করেছিলে। একডজন ঘুড়ি আর দু সপ্তাহ ধরে কাচ গুঁড়িয়ে হাজার মাঞ্জা দিয়ে, সারাদিন বসেই থাকতে হল, গালে হাত দিয়ে। যতটুকু বৃষ্টি থেমেছিল, একফোঁটা হাওয়া ছিল না কোনো দিকে। ঠুনকি মেরে হাতে ব্যাথা হয়ে গেলেও ঘুড়ি আর বাড়াই গেল না। তে-দিয়ে সোজা কলকাঠি ধনুক হয়ে গেলেও চিত খেয়ে খেয়ে পড়ে গেল। সেরকম করে রথযাত্রা টা দয়া করে পণ্ড কোরো না! – এই সব বলতে বলতে বাড়ি পৌঁছে গেলাম।
মা বাগানের গাছপালা থেকে যা যা সম্ভব, রথ সাজাতে সবই যোগাড় করে রেখেছে। বাবার আসতে তখনো দেরী আছে। কোনোমতে নাকে মুখে গুঁজে আঠা আর মার্বেল পেপার নিয়ে বসলাম। এবারে এমন ঘেরা ঘিরব যে পাশ থেকে কেউ দেখতেই পাবে না! কাগজ লাগানো তখন প্রায় শেষের দিকে। বাবা এসে হাজির। সাদা ক্রচেট সুতো (আসল উচ্চারণ ‘ক্রশে’) দিয়ে ডাল-পালা-ফুল বেঁধে রথের চারিদিক সাজানো হল। বেশ বাহারে হয়েছে কিন্তু। কিন্তু বাবা খুব বিরক্ত হলেন। এমন কাগজ দিয়ে চারিদিক মোড়া হয়েছে যে দেবতারা অন্ধকারের মধ্যে। দেখাই যাচ্ছে না। বেশি সামনে আনলে আবার মূর্তি উলটে যাওয়ার ভয়। কিন্তু কি করা যায়! তখন তো কোথায় সহজলভ্য এল-ই-ডি! বাবা তখন সব মূর্তির কোমরে সুতো পেঁচিয়ে সামনের দুপাশের থামের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে দিলেন। এর পড়ে যাওয়ার ভয় রইল না। অত গাছ গাছালির ভারে টানার সময়ে রথ যাতে নিজেই না উলটে যায়, তাই ঘুড়ির কল খাটানোর মত তে-কোনা করে দড়ি বাঁধা হল। বার বার মনে করিয়ে দেওয়া হল, যে কোনো অবস্থাতেই যেন রথের দড়ি মাটিতে না পড়ে। সে বড় অমঙ্গলে কান্ড। বিশ্রামের সময়ে দড়ি কে আলতো করে পেঁচিয়ে যেন রথের ওপর রাখা হয়। প্রসাদের বাটি হল পিতলের। পুরী থেকেই আনা। মাঝখানে শ্রী বিষ্ণুর পদযুগল খোদাই করা। তাতে দেওয়া হল মিছরি। উফ! আমি ভাবতেই পারছিলাম না যে ওটা আমার রথ। বাইরে বেরোলে, হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে যাবে। সবার কেমন লাগল তার প্রতিফলন হবে মিছরি প্রসাদ কত তাড়াতাড়ি শেষ হয়।
বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। আকাশ যেন শরৎ-কাল। রাস্তায় নামল রথ, অনেকের রথের সঙ্গে। মামু বলে আমাদের বন্ধুদের এক মামা প্রত্যেকবারে ইয়াবড় এক রথ নিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে দেন সবার। আর গোল্ডির রথ ছিল লোহার, চাকা ছিল সাইকেলের বিয়ারং এর। ওদের নিজেদের লোহার কারখানা। আমি জানতাম এই দুজন-কে টেক্কা আমার রথ দিতে পারবে না। শুধু আগের বারের মত রথের চাকা ভেঙে না যায়। আর ঠাকুর-রা যেন অনেক প্রণামী পান। ওই প্রণামী যত উঠবে সব আট-আনায় ভাঙ্গিয়ে কাল সকালে ইস্কুলে যাওয়ার সময়ে কালি মন্দিরের সামনে বসা সব ভিখিরীকে যেন বিলিয়ে দিতে পারি। হে ভগবান, এবার যেন সবাই পায়, কেউ যেন বাদ না যায়!
1 comment:
Ses holo na to....
Post a Comment