Monday, 29 June 2020

সমাপতন...

পাঁচ-ফুট ন’ইঞ্চি উচ্চতা। সালকিয়ার বাইরের ঘরের দেওয়ালের গায়ে তাঁর আপাদমস্তক live-size পোস্টার, পৃথিবী কাঁপানো ‘bad’ এর পোশাক আঁটা। বাড়িতে যে-ই আসত, ঢুকেই উল্টোদিকের দেওয়ালের আমার greatest possession দেখে চমকে যেত। সারা দেওয়ালে নানান ক্লিপিং আর পোস্টারের মধ্য এটাই ছিল আমার সবথেকে মূল্যবান ‘ব্যাঙের আধুলি’। আমাদের রক্ষণশীল বাড়িতে, আমি সেই সামাজিকভাবে গেঁজে যাওয়া কুলাঙ্গার, যে ‘Thriller’, ‘Beat it’, ‘Bad’, ‘Bille Jean’, ‘In the Closet’, ‘The way you make me feel’ – এই সব কে সঙ্গীতের মূল মার্গ বলে ধরে চলেছিলাম। যখন কমপ্ল্যান খাওয়ার কথা, তখন গুলে খাচ্ছিলাম, একজন অত্যন্ত খারাপ দেখতে কালো আফ্রো-আমেরিকান পাঁচ বছর বয়েস থেকে কি করে একা নিজের স্টেজ প্রেজেন্স দিয়ে লাইমলাইট শুষে নিতে পারেন, আর সারা পৃথিবী কেঁপে ওঠে তাঁর নিত্য নতুন ভঙ্গীমায়। স্মার্টনেস আর স্টাইল কাকে বলে শেখার, একটা গান গাইতে গাইতে অভিনয় কাকে বলে, শেখার।

সাহস ছিল কারো, একটা হাতে গ্লাভ পরে স্টেজে নেমে পড়ার, বা ফিতে ছাড়া পা গলানো বুট পরে ফেলার, বা ট্রাউজারের নিচেটা গোড়ালীর ওপরে করে ইচ্ছে করে ছোট করে কাটানোর, যাতে সাদা মোজা-দুটো দেখা যায়? দেখেছে আগে কেউ কোনোদিন হাওয়ায় index finger ছোঁড়ার আগে সেটাকে কেমন করে পাকিয়ে ঘুরিয়ে ছুঁড়তে হয়?
...তাও আবার যাতে মিস না হয়ে যায়, তাই তার মাথায় অকারণে একটা লিঊকোপ্লাস্টের ব্যান্ডেজ বাঁধা। পাগলামী কি করে পাগল করে, শেখার।


ছেলেদের মধ্যে জামা খুলে শরীর দেখানোর প্রচলন কিছু নতুন নয়। কিন্তু তার উদ্দেশ্য একটাই, নিজের পেশী প্রদর্শন। কিন্তু এনার হাড়-পাঁজরা ছাড়া কিছুই নেই। তবু দেখাতেন। স্টেজে জামা ছিঁড়ে। তাতে যা পাওয়ার আর স্টাইল, সেটা করতে  খান-ভাইদের, হৃত্বিক রোশন-কে বা টাইগার শ্রফ-কে এখনো বেশ কয়েকবার জন্ম নিতে হবে। সাতচল্লিশ কেজির ফেদার ওয়েট সুপার স্টার ব্রুস-লি ছাড়া আমি ওই দর্প আর কারোর মধ্যে দেখি নি। ব্রুস-লির চেহারাও কিন্তু দেখনীয় ছিল, কারণ ওই প্যাংলা শরীরেই ‘মন্দিরের অনেক কাজ’। কিন্তু এনার বুকের রিব কেজ হারমোনিয়ামের রিডের মত, অনায়াসে গোনা যায়। তা নিয়ে গান গাইতে গাইতে স্ট্রিপ আর ওই মুখভঙ্গী করে কি করে একজন অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান ও রূপবান পুরুষের পৌরুষে আঘাত হেনে তার হিংসার কারণ হওয়া যায়, সব আলো-কে নিজের ওপর কেন্দ্রিভূত করিয়ে, শেখার। 

সময় করে একবার দেখবেন, Dirty Diana আর Come Together. বাজি ধরে বলতে পারি, যে লুকিয়ে লুকিয়ে একবার হলেও আপনি চেষ্টা করবেনই। স্বীকার না করলে আলাদা কথা! স্টেজ কে প্রাণ দিয়ে ভাল না বাসলে, গানের প্রতিটি শব্দ এবং এমন কি শব্দের মাঝে পড়ে থাকা স্পেস কে উপলব্ধি না করলে,  ও জিনিস বেরোয় না। ইভ টিজিং আসলে কি, সেই পাঠ ও আমি প্রথম পাই ‘The Way You Make Me Feel’ দেখে। ‘Beat It’ এর ভিডিও তে আনা হল আমেরিকার রাস্তার আসল গ্যাংস্টার-দের। ‘Bad’-এও তাই। কেউ কোনোদিন ভেবেছিল? এভাবে?

 ‘নাম কেনো বলছেন, বোদনাম বলুন... সোত্তি কোথা করুন... নাম হলে বোদনাম ভি হোয়’।
তাই এনাকে নিয়ে অনেক ‘ডিস্পুট’ – ছেলে ছিলেন না মেয়ে, সেস্ক চেঞ্জ করেছিলেন কি না, হঠাৎ ফসসা হলেন কি করে, হোমো ছিলেন কি না, বিলিয়ন ডলারের সাম্রাজ্যে ছোটদের ভালবাসতে গিয়ে child abuse স্ক্যাণ্ডেলে জড়িয়ে পড়া, ইত্যাদি অনেক কেচ্ছা-কেলেংকারী। 
অথচ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, যিনি যখন হয়েছেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে রয়্যাল ফ্যামিলি, ফ্রান্সের তাবড় তাবড় মানুষ তাঁর  সঙ্গে দেখা করতে পাগল। লিজ টেলরের মত দাপুটে অভিনেত্রী, আর ্লেডি ডায়ানা তাঁর পরম বন্ধু। জেলে দেখা করতে গেলেন বিদ্রোহী নেলসন ম্যাণ্ডেলার সঙ্গে। ্ম্যাণ্ডেলা ছাড়া পেয়ে দেখা করতে এলেন তাঁর  সঙ্গে। 
শুনেছি মারা যাবার পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শবদেহ থেকে তাঁর অনুগামীরা চুল-দাড়ি উপড়ে নেয়, স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দেবে বলে। আমেরিকা সেই ভ্রান্ত পথে হাঁটেনি। সিএন এন দেখালো একটা টোটাল ফ্রেঞ্জিড আম জনতা সারা আমেরিকা জুড়ে, তাঁর  অকস্মাৎ মৃত্যুতে। হেলিকপ্টারে এ-ওয়ান সিকিওরিটি দিতেই হল তাঁকে, মৃত্যুর পরেও। কি এমন করতেন তিনি? নাচতেন আর গাইতেন। মিঠুন, প্রভুদেবা, হৃত্বিক, জাস্টিন টিম্বারলেক বা গোবিন্দা, কেউই তাঁর সেই বেসিক প্যাটার্ন ভেঙে নতুন কিছু আজও দেখাতে পারেন নি। তাঁরা ওই ভাঙিয়েই চালাচ্ছেন, স্টারডমের অনেকটাই। 
 আমার না হয় রুচী বড় ‘কু’। কিন্তু পৃথিবী শুদ্দু সব্বাই মেনে নিয়েছিলেন যে পৃথিবীর মাটিতে দাঁড়িয়ে চাঁদে হাঁটা (moonwalk) এক তিনিই প্রথম করে দেখালেন ও শেখালেন (Billy Jean, Motown Video)। প্রথম যাঁরা চাঁদে জমি কিনলেন, এই ব্যক্তি তাঁদের মধ্যে একজন। তাঁর 
Single LP ‘Thriller’ এক দিনে যা বিক্রি হল, বা সেই আলবামের আজ পর্যন্ত মোট বিক্রির সংখ্যা, কোনো রেকর্ডই আজ-ও কেউ ভাঙতে পারেন নি। জীবনে একটা গ্র্যামী পেলে একজনের সারা জীবন বর্তে যায়। সেখানে একরাতে একসাথে ‘Thriller’(Best Pop) ‘Billi Jean’ (Best RnB) ‘Beat It’( Best Rock) পেল আট আটখানা গ্র্যামী। সে রেকর্ড ভাঙার সাধ্যও আজও কারো হল না। 
 সমাজের হেন স্তর ছিল না, যেখানে এই ব্যক্তিটির নাম গিয়ে পৌঁছায়-নি। কেন, তা আমি বলতে পারব না। তিন দিন আগে এক অদ্ভুত সমাপতন থেকে নিজেকে এড়িয়ে, নিজের অনুভূতি-কে অনেকটা ছাঁকনি-তে ছেঁকে তবে জর্জ মাইকেল-এর মত একজন মনের মানুষের জন্মদিনের উদ্দেশ্যে একটা ব্লগ না লিখে থাকতে পারি নি। কিন্তু যাঁর থেকে সেদিন নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে, নিজের ওপর অনেকটা নিয়ন্ত্রণ টেনে এনে আজ এই ছড়ানো ছেটানো লেখা টা লিখলাম, এবং যার ফলে আমার musical taste নিয়ে অনেকের-ই মনে প্রশ্ন-চিহ্ন জাগবে, তিনি কিন্তু খাতায় কলমে সারা দুনিয়ার কাছে এক ম্যাজিকাল কিংবদন্তী।  আমার মনের কাছেও...মাইকেল জোসেফ জ্যাকসন।
জর্জ মাইকেলের জন্মদিন, মাইকেল জ্যাকসনের মৃত্যুদিন-ও বটে। ২৫শে জুন।
 

1 comment:

Roopkotha Choopkotha said...

সংগীত তোর ধমনী তে। প্রকৃত সাবলীল শিক্ষা খুলেছে জ্ঞানের চোখ, ভরেছে ভান্ডার। সহজ মনে দাগ কেটেছে জীবনের ছোট বড় জানা অজানা কথা। যত্ন করে মনে রেখেও দিয়েছিস। এই সৃষ্টি গুলো তারই পরিচয়।