Wednesday, 25 March 2020

চর্মসার

কথা যেদিন মুখের থেকেও বড়,

দৃষ্টি যেদিন চোখের থেকে,

সত্যি যেদিন হ্যালুসিনেশন,

আমি চামড়া শুকোই গঙ্গার কাদা মেখে...

Tuesday, 10 March 2020

বিল্বমঙ্গল কাব্য...Just নাড়িয়ে দিল...


মঙ্গলকাব্য নিয়ে আলাদা করে বলতে গেলে তা নেহাতই ছেলেমানুষী মনে হবে। তাই সে সব প্রশ্নে না গিয়ে সোজা কথায় আসি।

দেবশঙ্কর হালদার দেবশঙ্কর হালদার দেবশঙ্কর হালদার! একটা প্রতিধ্বনী!নাটকের রেশ তো থেকে যায়, ভাল হলে। কিন্তু যাঁদের হাত ধরে তা থেকে যায়, তাঁরা বড় পরিচিত হতে হতে থাকেন যাঁরা নিয়মিত নাটক দেখেন বা চর্চা করেন, তাঁদের হাত ধরে।  নাচনী দেখে এককালে মুগ্ধ হয়েছিলাম। আজ আবার।

এই সেদিন ফুড়ুৎ দেখে এলাম! তারপরেই বিল্বমঙ্গল কাব্য। আকাদেমী-তে আমার প্রিয় আসন হল এম ২৮। পুরো স্টেজ-টা একটা চৌকো ফ্রেমের মত লাগে। ঘাড় ঘোরাতে হয় না। শুধু চোখের মণি ঘোরে। সেখান থেকে দেখলাম একটা মানুষ কি অনায়াসে সবটুকু, নিজের শরীর মন এমনকি নিজের নিঃশ্বাস-ও ঊজাড় করে নিখুঁত ভাবে অভিনয় করে যেতে পারেন।

অভিনয়ের অভিব্যক্তি এতটাই গভীর যে দর্শক খুব ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফেরার আগে যদি entertainment চেয়ে কিচ্ছু না জেনেই নেহাত নাটক দেখতে ঢুকেছেন, তিনি-ও বিল্বমঙ্গল-এর সঙ্গে empathetic বা সমানুভূতির মোহে নিজেকে জড়িয়ে ফেলতে বাধ্য।

মঙ্গলকাব্যের মধ্যে ঠিক যা যা যে ভাবে থাকা উচিত ছিল, সব সমেত, অনবদ্য।

সব দেখে মনে হল,সাধারণ মানুষ জানে যে প্রেমের শেষ কথা শরৎচন্দ্রের দেবদাস। তবে আমরা কতটুকুই বা জানি, বুঝি, প্রেম ও তার পীড়া সম্পর্কে, যেখানে প্রকাশ্যে দেখানো হচ্ছে, তাঁর প্রেয়সী ভিন্ন অন্য নারীর প্রতি দেহজ সম্পর্কে  যেখানে আসক্ত, এবং সেই কারণে তিনি নিজের প্রেমের প্রতি একনিষ্ঠ থাকতে নিজের চোখ অন্য নারী, যাঁর প্রতি তিনি আসক্ত হয়ে পড়ছেন, তাঁর মাথার চুলের কাঁটা দিয়ে নিজের চোখ দুটি ফুঁড়ে নিজেকে অন্ধ করে দিচ্ছেন, যাতে তাঁর মনের মানুষ ভিন্ন অন্য কারো প্রতি তিনি জৈবীক-রূপে আসক্ত হন? এ কি গ্রীক ট্র্যাজেডী! কি classical!

কোন পুরুষের এই চিরন্তন আভ্যন্তরীন টানাপোড়েন ও বহুগামীতাকে তিনি যে ভাবে আয়ত্ত্বে এনে নিশ্চল থাকছেন, তাঁর প্রেয়সীর প্রতি, বিগত যৌবন হয়েও, তা বড়ই হৃদয়বিদারক।

আর আরও কঠিন, এই অনুভূতিকে প্রকৃত আকৃতি-প্রকৃতি দিয়ে রক্ত-মাংসে একটা নিছক স্টেজ শো-এ অন্য দিকে বসা সকল দর্শক-কে অনুধাবন করিয়ে কাঁদানো।

আমার এই নাটক-টি নিয়ে এর বিশেষ কিছু বলার নেই। মঙ্গল হোক সবার, প্রকৃত প্রেমের হাত ধরে সবাী মোক্ষ লাভ করুন! সকলে আশীর্বাদধন্য হোন, সনাতন প্রেমের। তবেই না আত্মা আপনার ঋদ্ধ হবে...কামনায় বাসনায়, নিজের সংক্ষিপ্ত জীবনের সার্থকতায়..

ঊজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়-কে ধন্যবাদ না জানালেই নয়, এই বিশাল জাগতিক ও মহাজাগতিক ভাবনাকে, মানুষের বিশ্বাস-কে একটা কয়েক ফুট বাই কয়েক ফুট মঞ্চে, দুই-ঘন্টা দশ মিনিটের সীমায় সমাহিত করার মত এক অসম্ভব কাজ কে নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করার জন্য।

সন্ধ্যা-২ঃ টুনিতে টুনটুনালো...


অনেকবছরের সুপ্ত ইচ্ছা ছিল যে, ফুড়ুৎ নাটকটি দেখব। উপেন্দ্রকিশোরের  টুনটুনির গল্প সর্বজনবিদিত। কিন্তু ওই প্রকারের গল্পকে দীর্ঘায়ীত করে কি করে নাট্যরূপ দেওয়া যায়, তা দেখার এবং শেখার। নাট্যকার ও পরিচালক রাজা ভট্টাচার্য কি ভাবে দেবশঙ্কর হালদারের মত তাবড় অভিনেতাকে দিয়ে এই সূক্ষ্ম কাজটি করিয়ে নিলেন, তা দেখার জন্য মন বেশ ব্যাকুল হয়ে থাকত। কাগজে এই নাটকের অভিনয়ের বিজ্ঞাপন দেখলেই মন আনচান করে উঠত, কিন্তু বাস্তবের জাঁতাকলে পড়ে এরকম রূপকথার নাট্যরূপ চাক্ষুষ করা স্বপ্নই থেকে গিয়েছিল।

সুযোগ হল। সেই সন্ধ্যায় আলাদা পাওনা হল, চন্দ্রিল ভট্টাচার্য-কে অপ্রত্যাশিত ভাবে পাওয়া। রাজা ভট্টাচার্যের ছোটদের নাটকের বই প্রকাশ উপলক্ষে। চন্দ্রিলের অসাধারণ বাচনভঙ্গী ও সাহিত্য-কে সমাজবদ্ধ করে যে ককটেল -পারঙ্গমতা নিবেদন করলেন, তা আবার প্রশংসিত হল।

নাটক শুরু হল। যে হাস্যরসের অভিঘাত নিয়ে তা শুরু হল, তা সরাসরি এক হবুচন্দ্র-গবুচন্দ্রের জগতে নিয়ে চলে গেল। হাস্যরস থেকে মাঝে মধ্যেই মন্থিত হতে লাগল, তীব্র শ্লেষের কশাঘাত। এই আঘাতে মূর্ছিত দর্শকবৃন্দও তালে তাল দিতে লাগলেন, বার বার করতালিতে।

আস্তে আস্তে খুব-চেনা ও জানা গল্প গিলতে লাগল আমাদের সব ইন্দ্রিয়-কে। দেবশঙ্কর হালদার দেখিয়ে দিলেন, তিনি কেন বাংলা থিয়েটারের দেবাদিদেব হয়ে বসে আছেন। অসাধারণ improvisation, স্টেজে। তা-ও অবর্ণনীয় ক্ষিপ্রতায়। তবে তাঁর সহঅভিনেতারাও সেখানে সমান তালে অভিনয় করে গেলেন।

একটা সময়ের পরে  নাটকের এক-ই রকমের চলনে আর টুনটুনির মাত্রাতিরিক্ত গানের প্রকোপে অনেকটা একঘেয়েমী ও শূন্যতা তৈরী হয়। ফলে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকার একটা ছন্দপতন ঘটে। আমরা অপেক্ষা করতে থাকি, কখন রাজার নাক কাটা যাবে,  গল্পটা শেষ হবে।

চন্দ্রিল নাটক শুরু হওয়ার আগে, দুটি মূল্যবান কথা বলেছিলেন, নাটকটি সম্পর্কেঃ
১। সবাই অপেক্ষা করে থাকবেন, কখন দেবশঙ্কর হালদার অবতীর্ণ হবেন, অথচ ইনিই যে সেই তিনি বোঝা যাবে না।
২। আমরা নাটক দেখতে এলেই, যতই হাসির হোক না কেন, খুব ভারী করে দেখতে অভ্যস্ত। ফলে এই ধরণের নাটকের শুধুমাত্র বিনোদনমূলক হাস্যরস দর্শকদের কাছে অধরাই থেকে যায়।

তবে হ্যাঁ, সন্ধ্যেটা কেমন ফুড়ুৎ করেই উড়ে গেল

পুনশ্চঃ-

রাজা ভট্টাচার্য যে বই-টি এই নাটকের সুযোগে প্রকাশ করলেন, অব গোলি খা, তাতে যে নাটকগুলি আছে, সবই ছোটদের জন্য। কিন্তু সেখানে এত দিকের এত রকমের শিশুসাহিত্যের allusion যে আজকের শিশুরা এর হাস্যরস বুঝেই উঠতে পারবে না, যদি না শিশুসাহিত্য রীতিমত গুলে খাওয়া থাকে। অনেক বিক্ষিপ্ত বিষয়-কে একসুতোয় বাঁধার চেষ্টা নিয়মানুগ ভাবে সফল। কিন্তু শিশু-কিশোর পাঠকদের কাছে তা কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। চন্দ্রবিন্দু-র গান শুনে বুঝতে গেলে, তার রসাস্বাদন করতে হলে যেমন একটা সাংস্কৃতিক ভাবধারাসম্পর্কে সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে, তেমন রাজা ভট্টাচার্যের নাটকগুলিতে, চিন্তার স্বাধীনতা থাকলেও তাকে উড়তে হলে উপযুক্ত বিদ্যার হাওয়া ডানার নিচে থাকা আবশ্যিক।