অনেকদিন
ধরেই শুনি আমার এক অতি আপন মানুষের কাছ থেকে, যে তার এক ক্লাসমেট ছিলেন যিনি পড়াশোনাতে
তুখোড় আবার সবাই যখন খুব মন দিয়ে প্র্যাক্টিক্যালের যাবতীয় কাজকর্ম ভাগাভাগী করে নিচ্ছেন,
সেখানে কোন উৎপাত না করে, পরের পর গান শুনিয়ে গিয়েছেন বন্ধুদের। ভাবতাম, এরকম তো আকচারই
হয়। প্রত্যেক গ্রুপেই এরকম এক-দু জন থাকেন যাঁরা গান বাজনা ভালবাসেন। শ্রীকান্ত আচার্য,
চন্দ্রবিন্দু, রূপম ইসলামের কেরিয়ার গ্রাফও অনেকটা এরকম-ই। বন্ধুদের ডেকে ডেকে শোনাতেন,
কেউ শুনতে রাজী হত না। কিন্তু এখানে যাঁর কথা বলব বলে বসেছি, তাঁর অন্ততঃ ভাগ্য এতটা
খারাপ ছিল না। কারণ, তিনি কোনোদিন সে সব তোয়াক্কাই করেন নি। নিজের গানের প্রতি ভালবাসাকে
চরিতার্থ করার জন্য পথ খুঁজে গিয়েছেন, এবং পেয়েছেন ও। কোথাও কোনোদিন তাঁর তারকা হয়ে
ওঠার বাসনা ছিল না, বলে প্রকাশ।
স্নিগ্ধদেব
সেনগুপ্ত। পেশায় সরকারী কর্মচারী। প্রথম দেখলাম তাঁকে, স্টেজে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের
ডঃ ত্রিগুণা সেন অডিটোরিয়ামে। নিজেই চেয়ার টেবিল সরাচ্ছেন, এদিক ওদিক সবার মাঝে ঘুরে
বেড়াচ্ছেন, যখন স্টেজে নেই। আবার হঠাৎ করে এমন গান গেয়ে উঠছেন, যার পরে হাততালি দিতেও
ভুলে যাচ্ছিলাম।
শুনলাম
তাঁর দ্বিতীয় মিউজিক এলবাম রিলিজ়ড হল, শ্রীনিবাস মিউজিক-এর তরফ থেকে। মাত্র চারটি
গান। নজরুলগীতি। স্বর্গীয় মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়-কে উৎসর্গ করেছেন তিনি। অসাধারণ বক্তা-ও
স্নিগ্ধদেব। তাঁকে উৎসর্গ করাটাও তাঁর ধৃষ্টতা মনে হয়েছে এটা বলেই তিনি প্রায় সব শ্রোতার-ই
মন জয় করে নিয়েছেন বলে মনে হয়।
অনুষ্ঠানের
প্রথম ভাগে, অফিসিয়াল সিডি রিলিজ়ড হল বিভিন্ন তারকাদের হাত ধরে, যাঁদের মধ্যে স্বর্গীয়
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কন্যা-ও ছিলেন। আমি ঠিক সবাই-কে যদিও চিনি না, তবে তাঁদের
বক্তব্য পেশ করার সময়ে তাঁদের কণ্ঠের বাস আর টিম্বার-ই বলে দিচ্ছিল, সাধারণ বাক্য বের
হলেই যদি এমন হয়, তবে এঁরা যখন সুরে গাইবেন তখন কেমন হবে।
সেদিক
থেকে দেখতে গেলে স্নিগ্ধদেবের কণ্ঠে খানিকটা ক্যাকোফোনি বা নেসাল টোন থাকলেও, তিনি
উচ্চগ্রামে অত্যন্ত সাবলীল, যা খুব কম মানুষ স্টেজে পারেন।গায়কী খুবই ভিন্ন। সব পেরিয়ে
গানের প্রথম দুটি লাইন গেয়ে তারপর থেমে গিয়ে যে বৈঠকী মেজাজে কথা বলছিলেন, তা তাঁর
আসল গায়ক হিসেবে জাত বুঝিয়ে দেয় – এটা তাঁর কাছে কেমন জানি না, তবে কোথাও মনে হল, তিনি শুধুই
গাইতে এসেছেন। সময় খুব কম, আরো যেন শুনতে পেলে ভাল হত। একমাত্র গায়ক এবং শ্রোতা দু-পক্ষই
যদি গানে ভেসে যান, তাহলেই একমাত্র এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সৃষ্টি হয় সেই স্বর্গীয়
মাধুর্যের।
সিডি-টা
এখনো শুনে উঠতে পারি নি –
কারন কাল প্রাক-নববর্ষের সন্ধ্যার এই মোহ থেকে বেরতে চাই না। ভয় হচ্ছে, যদি মোহ কেটে
যায়। আজকাল-কার মিউসিক্যাল এরেঞ্জমেন্ট-কে সত্যিই ভয় পাই। কাল-ও হয়েছে। যিনি তবলায়
সঙ্গত করছিলেন, তিনি গানের spirit না বুঝেই কখনো খুব রঙ্গীন করে তোলার চেষ্টা করেছেন
গানগুলোকে। হাততালি পেয়েছেন। স্নিধদেব-ও প্রশংসা-র চোখে তাকিয়েছেন তাঁর সঙ্গতের তারিফ
করে। কিন্তু গানের প্রাণ নষ্ট হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই।
তবে
এই সব লেখার মানে কাউকে ছোটো করা নয়। আরো বড় করে তাঁদের পাওয়ার একটা খুব ছোট চেষ্টা
হয়ত।
লেখাটা
এখানেই শেষ হয়ে যেত, যদি না কালকের তিনটি গানের ‘অনুরণন’ এখনও কানে বেজে যেতঃ
১। সামনেও পথ পিছনেও পথ
২। কেমন করে লুটিয়ে আছি পায়ের পাতার ধুলোর
মত
৩। আগুন আগুন
ইচ্ছে হচ্ছিল ওই তিনটি গানই শুধু উনি গেয়েই
যান।

No comments:
Post a Comment