আজকাল সকাল হলেই দ্যুতির মনটা কেমন যেন দুঃখে ভরে ওঠে। স্বামী দেবাশীষের সঙ্গে সারাদিন খিটির মিটির লেগেই আছে। শুধু সামনা-সামনি নয়, ফোনেও। এটা নয়, ওটা নয়, সেটা নয় -- সারা দিন ধরে শুধু অভিযোগ আর অভিযোগ। সব করেও মন পাওয়া যায় না লোকটার। মাঝেমধ্যে মনে হয় যেন সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে বিবাগী হয়ে যায়। কিন্তু কেন ছাড়বেই বা কেন? যে বাড়িটা সে এত বছর ধরে সুন্দর করে নিজে যত্ন নিয়ে গুছিয়েছে, সেই বাড়ি ছেড়ে সে নিজেই বা চলে যাবে কেন! তার নিজের সেই বাড়ির প্রতি যে মোহ বা টান সে তো অন্য কারো নেই, আর হবেও না। তা হলে সেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াটা কোনো সমাধানই নয় আর সে কথা উঠছে না। তাই একদিন দ্যুতি ঠিক করল যে, নাহ্! এভাবে হবে না। অন্য কোন পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু পদ্ধতিটা যে ঠিক কি, তা সে ভেবে বের করতে পারল না।
একদিন অফিসে বসে দ্যুতির মাথায় খেলে গেল এক ভয়ংকর আইডিয়া। এটা বহুবার তার সিনিয়র এর কাছ থেকে শুনেছে। তার সিনিয়রের বন্ধুর মা নাকি তাঁর বৌমার ওপর ভারি অত্যাচার করতেন। বৌমা
সারাদিন কাজের শেষে খেটেখুটে বাড়িতে এলেই তাকে দিয়ে রান্না করানো থেকে আরম্ভ করে
হাজার একখানা কাজ ধরিয়ে দিতেন। এটা করো, ওটা করো, সেটা করো -- মশারি টাঙিয়ে দাও, খাবার বেড়ে দাও, খাইয়ে দাও, কাপড় ধুয়ে মেলে দাও -- এসব রোজ লেগেই ছিল। আর নেওয়া যাচ্ছিল না। একদিন হলো কি, সেই বৌমা তার স্বামীর সাথে
সড় করে ঠিক করল যে সে মদ খাওয়ার অভিনয় করবে। তাতে যদি শাশুড়ি ভয়ে এসবে ক্ষান্ত দেন! একটা ক্ষীণ
আশা।
যেমন ভাবা তেমন কাজ।
একদিন বাড়ি ফিরতেই শাশুড়ি বৌমাকে কিছু ফরমায়েশ
করতেই বৌমা শাশুড়িকে মাতালের মত হাল্কা করে কথা জড়িয়ে আর টেনে বলল যে,
-- এই শালা চুপ... একদম চুপ! আজকে আমি ঘুমাবো আর তুই
মশারি টাঙিয়ে দিবি। আর হ্যাঁ, বালিশগুলোতে তোর মাথার তেলচিটে গন্ধ...আমাদের গুলোকেও তো ছাড়িস নি...সব
বালিশ ধরে নতুন করে ওয়াড় পরিয়ে বিছানায় এনে সাজিয়ে রেখে যাবি। ওয়াড়গুলো এখানে
রাখলাম। দেখে নে। আমার খাবার রেডি ক'রে ডাইনিং টেবিলে রাখ। আমি চান করে আসছি। খাবার যেন গরম থাকে, বুঝলি!
শাশুড়ি উত্তর দেবেন
কি, চক্ষু ছানাবড়া!! বৌমার এ কি রূপ! মনে হচ্ছে খোকার বাবার আত্মা
বৌমা-কে ভর করেছে! ও ও ঠিক ও রকম করে কথা বলত, যেদিন পেটে দু পাত্তর পড়ত!
নিজের ছেলেকে গিয়ে
বললেন:
-- হ্যাঁ রে খোকা, মনে হচ্ছে তোর বাবা বৌমাকে ভর করেছে... ,নইলে বাড়ির বৌ, মদ গিলে বাড়ি ঢোকে! একটা ওঝা
টোঝা...
ছেলেও বলল
-- ঊফ মা! ছেড়ে দাও না! ওর সঙ্গে তুমিও কি পাগল হলে? দেখছই তো নেশা চড়ে গ্যাছে।
বেশি কিছু বলো না আবার, ক্ষেপে গিয়ে যদি এখন মারধর করে বসে তাহলে কি হবে বল দেখি! তোমার তো বয়স
হচ্ছে বলো? যা বলছে শুনে নাও না, একদিন। ওতো রোজই তোমার কথা শুনে। তুমি যেন না হয় একদিন শুনবে।
-- হা ঈশ্বর! আমার কপালে শেষে এই ছিল!
মা কান্নাকাটি জুড়ে
দিল। কিন্তু কাঁদতে কাঁদতেও দেখা গেল যে বৌমা যা যা বলেছে ভয়ের চোটে শাশুড়ি- মা
কিন্তু সবটাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। কোথাও একটু ভুলচুক হলো না। বৌমা খাবার
টেবিলে এসে অবাক, সব পুরো টিভি সিরিয়ালের সেটের মত সুন্দর করে সাজানো! আবার অভিনয় করে শাশুড়ির
কাছে এসে বলল,
-- দোস্ত... তুই আমার, ডার্লিং...... সন্টু মোনা মা। (বলে শাশুড়ি-মায়ের নাক টেনে ধরে আদর করে
দিল)। কাল থেকে সব রোজা রকমভাবেই করে রাখবি, কেমন? রোজ যেন এক কথা বলতে না হয়!
এই বলে বৌমা খেতে বসে গেল।
এখন দ্যুতির মুশকিল
হলো দ্যুতি তো আর সেই বৌমার মত অভিনয়ে তুখোড় নয় !ওসব ও পারবে কিনা খুব সন্দেহ আছে। বরং
সত্যি মদ খেলে আর চাপ থকে না। তাই অফিস থেকে ফেরার পথে একটা মদের বোতল কিনে নিয়ে
এলো। তারপর ঘন্টা দু'য়েকের মধ্যে সেই মদের বোতল চোঁ চোঁ করে উড়িয়ে দিল, আর মনে মনে বলতে লাগলো,
এইবারে যাদু দেখবি
খেল
দ্যুতি এখন রাজধানী
মেল।
কিন্তু সোফা থেকে উঠতে
গিয়ে দ্যুতির এ কি অবস্থা! পাঞ্জাব মেল তো দূর, লোকাল ট্রেনেরও অধম! উঠে দাঁড়াতেই পারছে
না। টাল খেয়ে যাচ্ছে। হাঁটার-ই তাল থাকছে না, তা অন্য কাউকে আর কি ধমকাবে! কি করবে আর কি না করবে -- নিজের মাথা আর কাজ
করছিল না, এতটাই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় দ্যুতি। কিন্তু কিছুতেই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ
ফিরে পাচ্ছে না সে, সবটাই তখন হারিয়েছে। দেবাশীষ -কে শিক্ষা দেয়া গেল চুলোয়। সামনেই বিছানা
ছিল। তাতে ধপাস করে পড়ে, গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল দ্যুতি। তার ফেভারিট হবি টা চাগাড় দিয়ে উঠলো
-- ঘুম, একরাশ ঘুম যেন তাকে চার দিক থেকে অজগরের মত পেঁচিয়ে জড়িয়ে ধরল।
ইতিমধ্যে যাকে
শিক্ষা দেবে বলে দ্যুতি ঠিক করেছিল, সেই দেবাশীষ, অফিস থেকে এসে বলল
--কি গো, তোমার কি হল? তুমি শুয়ে পড়লে যে বড় ? খেতে টেতে দাও....
দ্যুতি বলল
-- চেঁচিও না, বুঝলে যেমন রাস্তায় পড়ে আছি পড়ে থাকতে দাও। তুমি বাড়ি যাও, আমি সকালে যাব।
দেবাশীষ চমকে তাকিয়ে দেখে বুঝল, যে দ্যুতি ফুল আউট। বুঝিয়ে বলতে গেল্,
-- আরে রাস্তায় কেন পড়ে থাকবে তুমি? তুমি বাড়িতে তো....
বিছানায় শুয়ে আছ...
-- ও তাই? তাহলে আমি রাস্তায় নয়? এটা বিছানা বুঝি?
-- বাড়িতে... হ্যাঁ তুমি বাড়িতে, বিছানায়। ঠিক আছে তুমি বিশ্রাম নাও আমি
হাত-পা ধুয়ে নিজের খাবার নিজে করে নিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়ছি।
-- ওক্কে বস্ স স ... তাই করো... কিন্তু যাওয়ার আগে আমার ফোনটা
আমার হাতে দিয়ে দিও তো...
-- কেন ফোন নিয়ে কি হবে, এখন?
-- টয়লেটে যাবো তো তাই জন্য চাইছি।
-- টয়লেটে ফোন নিয়ে গিয়ে কি করবে? তোমার কি হয়েছে বলো তো? মদ খেয়েছো ঠিক আছে, কিন্তু বাজে বকছ কেন?
-- বাজে বক্ছি? আমি বাজে বকছি? তুমি রোজ বাজে বক, আমি বাজে বকছি তো বেশ করছি। ফোনটা দাও...
-- আরে বাবা ফোন নিয়ে টয়লেটে যাবে নাকি!
-- এখান থেকে টয়লেট টা ঠিক কোথায় বুঝতে পারছি না তো... তাই জন্য।
বাড়ির কোন ঘরে আছি, সেটাও ঠিক মনে পড়ছে না। তুমি আমার ফোনটা দাও। আমি গুগল করে দেখে নিচ্ছি।
-- গুগল ম্যাপে বাড়ির টয়লেট!!!
-- আরে হ্যাঁ আমি গুগল ম্যাপে একটু দেখে নেব যে টয়লেট যেতে গেলে
কোন দিক দিয়ে যেতে হবে, কতটা দূরে আর ক' মিনিট-ই বা লাগবে...
-- আরে চলো, অত কত্তে হবে না...ওঠো, আমি তোমায় পৌঁছে দিচ্ছি...
-- এই শোনো! ডোন্ট টাচ মি....আর বাজে কথা বলো না... এটা নারী
স্বাধীনতার যুগ। আ'ম আ ফ্রি ঊয়োম্যান্....ডোন্ট নিড য়োর ফা** হেল্প! আমি নিজে এখান থেকে
টয়লেট যেতে পারবো না, কে বললো তোমাকে? নিশ্চয়ই পারব।...আই ক্যান ডু ইট্...তুমি শুধু আমার ফোনটা দাও...এটুকু
উপকার তো করো... আর তা ও যদি না পারো, তাহলে বলে দাও যে এ ও তোমার সামর্থে কুলোবে না... ঠিক যেমন করে রোজ বাজারটা
পর্যন্ত করো না, সেই আমাকেই করতে হয়।
-- আরে তুমি ঠিক নেই...
-- তোমাকে অত ভাবতে হবে না। আমাকে কত যেন হেল্প করে! তুমি আমাকে
নিয়ে যাবে টয়লেটে, তা-ও আবার অচেনা জায়গায়, অচেনা বাড়িতে... আমি গুগল ম্যাপ দেখে সব ঠিক করে নেব। তুমি বরং নিজের
চরকায় তেল দাও। য়ু নেভার হ্যাড বিন আ ম্যান এনাফ!!! তবু আমি ছিলাম বলে এ যাত্রা ত'রে গেলে...
নিজের বাড়িকে যে
সজ্ঞানে 'অচেনা জায়গা' বলে গুগল ম্যাপে টয়লেট খুঁজছে, তাকে আর কি বলা যেতে পারে! তার ওপর আবার সোজা 'মর্দাঙ্গী কো ললকার দিয়া, ইয়ার!" ফলে অনুকম্পার
কোনো স্থান-ই সেখানে নেই।
দেবাশীষ আর কথা বাড়লো
না। বুঝল, ব্যাপারটা খুব খারাপ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। যাকে বলে তার বউ এখন 'পেঁচো মাতাল' -- যত ঘাঁটাবে ততই বিপদ। জীবনের অনেক নীতিশিক্ষার
মধ্যে একটি হল যে, পাগল এবং মাতালদের সঙ্গে বেশি কথা বলতে নেই। আর এখানে ওর বউ তো এখন একাধারে
পাগল এবং মাতাল। সুতরাং আজ থাক.... কাল সকাল বেলা আবার দেখা যাবে।
দেবাশীষ বালিশ বগলে করে বেডরুম ছেড়ে ড্রয়িং রুমে শুতে চলে গেল। মনে মনে বলল,
-- গো টু হেল্!
দ্যুতি মিচকি হেসে বলল,
-- দেখ কেমন লাগে....!
--------------শেষ-----------
.png)
No comments:
Post a Comment