Thursday, 21 March 2024

আরেক মদ্যপদলোপী:

আজকাল সকাল হলেই দ্যুতির মনটা কেমন যেন দুঃখে ভরে ওঠে। স্বামী দেবাশীষের সঙ্গে সারাদিন খিটির মিটির লেগেই আছে। শুধু সামনা-সামনি নয়, ফোনেও। এটা নয়, ওটা নয়, সেটা নয় -- সারা দিন ধরে শুধু অভিযোগ আর অভিযোগ। সব করেও মন পাওয়া যায় না লোকটার। মাঝেমধ্যে মনে হয় যেন সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে বিবাগী হয়ে যায়। কিন্তু কেন ছাড়বেই বা কেন? যে বাড়িটা সে এত বছর ধরে সুন্দর করে নিজে যত্ন নিয়ে গুছিয়েছে, সেই বাড়ি ছেড়ে সে নিজেই বা চলে যাবে কেন! তার নিজের সেই বাড়ির প্রতি যে মোহ বা টান সে তো অন্য কারো নেই, আর হবেও না। তা হলে সেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াটা কোনো সমাধানই নয় আর সে কথা উঠছে না। তাই একদিন দ্যুতি ঠিক করল যে, নাহ্! এভাবে হবে না। অন্য কোন পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু পদ্ধতিটা যে ঠিক কি, তা সে ভেবে বের করতে পারল না।


একদিন অফিসে বসে দ্যুতির মাথায় খেলে গেল এক ভয়ংকর আইডিয়া। এটা বহুবার তার সিনিয়র এর কাছ থেকে শুনেছে। তার সিনিয়রের বন্ধুর মা নাকি তাঁর বৌমার ওপর ভারি অত্যাচার করতেন। বৌমা সারাদিন কাজের শেষে খেটেখুটে বাড়িতে এলেই তাকে দিয়ে রান্না করানো থেকে আরম্ভ করে হাজার একখানা কাজ ধরিয়ে দিতেন। এটা করো, ওটা করো, সেটা করো -- মশারি টাঙিয়ে দাও, খাবার বেড়ে দাও, খাইয়ে দাও, কাপড় ধুয়ে মেলে দাও -- এসব রোজ লেগেই ছিল। আর নেওয়া যাচ্ছিল না। একদিন হলো কি, সেই বৌমা তার স্বামীর সাথে সড় করে ঠিক করল যে সে মদ খাওয়ার অভিনয় করবে। তাতে যদি শাশুড়ি ভয়ে এসবে ক্ষান্ত দেন! একটা ক্ষীণ আশা।
যেমন ভাবা তেমন কাজ।
একদিন বাড়ি ফিরতেই শাশুড়ি বৌমাকে কিছু ফরমায়েশ করতেই বৌমা শাশুড়িকে মাতালের মত হাল্কা করে কথা জড়িয়ে আর টেনে বলল যে,

-- এই শালা চুপ... একদম চুপ! আজকে আমি ঘুমাবো আর তুই মশারি টাঙিয়ে দিবি। আর হ্যাঁ, বালিশগুলোতে তোর মাথার তেলচিটে গন্ধ...আমাদের গুলোকেও তো ছাড়িস নি...সব বালিশ ধরে নতুন করে ওয়াড় পরিয়ে বিছানায় এনে সাজিয়ে রেখে যাবি। ওয়াড়গুলো এখানে রাখলাম। দেখে নে। আমার খাবার রেডি ক'রে ডাইনিং টেবিলে রাখ। আমি চান করে আসছি। খাবার যেন গরম থাকে, বুঝলি!


শাশুড়ি উত্তর দেবেন কি, চক্ষু ছানাবড়া!! বৌমার এ কি রূপ! মনে হচ্ছে খোকার বাবার আত্মা বৌমা-কে ভর করেছে! ও ও ঠিক ও রকম করে কথা বলত, যেদিন পেটে দু পাত্তর পড়ত!

নিজের ছেলেকে গিয়ে বললেন:
-- হ্যাঁ রে খোকা, মনে হচ্ছে তোর বাবা বৌমাকে ভর করেছে... ,নইলে বাড়ির বৌ, মদ গিলে বাড়ি ঢোকে! একটা ওঝা টোঝা...

ছেলেও বলল
-- ঊফ মা! ছেড়ে দাও না! ওর সঙ্গে তুমিও কি পাগল হলে? দেখছই তো নেশা চড়ে গ্যাছে। বেশি কিছু বলো না আবার, ক্ষেপে গিয়ে যদি এখন মারধর করে বসে তাহলে কি হবে বল দেখি! তোমার তো বয়স হচ্ছে বলো? যা বলছে শুনে নাও না, একদিন। ওতো রোজই তোমার কথা শুনে। তুমি যেন না হয় একদিন শুনবে।

-- হা ঈশ্বর! আমার কপালে শেষে এই ছিল!

মা কান্নাকাটি জুড়ে দিল। কিন্তু কাঁদতে কাঁদতেও দেখা গেল যে বৌমা যা যা বলেছে ভয়ের চোটে শাশুড়ি- মা কিন্তু সবটাই অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। কোথাও একটু ভুলচুক হলো না। বৌমা খাবার টেবিলে এসে অবাক, সব পুরো টিভি সিরিয়ালের সেটের মত সুন্দর করে সাজানো! আবার অভিনয় করে শাশুড়ির কাছে এসে বলল,

-- দোস্ত... তুই আমার, ডার্লিং...... সন্টু মোনা মা। (বলে শাশুড়ি-মায়ের নাক টেনে ধরে আদর করে দিল)। কাল থেকে সব রোজা রকমভাবেই করে রাখবি, কেমন? রোজ যেন এক কথা বলতে না হয়!

এই বলে বৌমা খেতে বসে গেল।

এখন দ্যুতির মুশকিল হলো দ্যুতি তো আর সেই বৌমার মত অভিনয়ে তুখোড় নয় !ওসব ও পারবে কিনা খুব সন্দেহ আছে। বরং সত্যি মদ খেলে আর চাপ থকে না। তাই অফিস থেকে ফেরার পথে একটা মদের বোতল কিনে নিয়ে এলো। তারপর ঘন্টা দু'য়েকের মধ্যে সেই মদের বোতল চোঁ চোঁ করে উড়িয়ে দিল, আর মনে মনে বলতে লাগলো,

এইবারে যাদু দেখবি খেল
দ্যুতি এখন রাজধানী মেল।

কিন্তু সোফা থেকে উঠতে গিয়ে দ্যুতির এ কি অবস্থা! পাঞ্জাব মেল তো দূর, লোকাল ট্রেনেরও অধম! উঠে দাঁড়াতেই পারছে না। টাল খেয়ে যাচ্ছে। হাঁটার-ই তাল থাকছে না, তা অন্য কাউকে আর কি ধমকাবে! কি করবে আর কি না করবে -- নিজের মাথা আর কাজ করছিল না, এতটাই নেশাগ্রস্ত অবস্থায় দ্যুতি। কিন্তু কিছুতেই নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাচ্ছে না সে, সবটাই তখন হারিয়েছে। দেবাশীষ -কে শিক্ষা দেয়া গেল চুলোয়। সামনেই বিছানা ছিল। তাতে ধপাস করে পড়ে, গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল দ্যুতি। তার ফেভারিট হবি টা চাগাড় দিয়ে উঠলো -- ঘুম, একরাশ ঘুম যেন তাকে চার দিক থেকে অজগরের মত পেঁচিয়ে জড়িয়ে ধরল।

ইতিমধ্যে যাকে শিক্ষা দেবে বলে দ্যুতি ঠিক করেছিল, সেই দেবাশীষ, অফিস থেকে এসে বলল
--কি গো, তোমার কি হল? তুমি শুয়ে পড়লে যে বড় ?
খেতে টেতে দাও....
দ্যুতি বলল
-- চেঁচিও না, বুঝলে যেমন রাস্তায় পড়ে আছি পড়ে থাকতে দাও। তুমি বাড়ি যাও, আমি সকালে যাব।

দেবাশীষ চমকে তাকিয়ে দেখে বুঝল, যে দ্যুতি ফুল আউটবুঝিয়ে বলতে গেল্,
-- আরে রাস্তায় কেন পড়ে থাকবে তুমি? তুমি বাড়িতে তো.... বিছানায় শুয়ে আছ...

-- ও তাই?  তাহলে আমি রাস্তায় নয়?
এটা বিছানা বুঝি?
-- বাড়িতে... হ্যাঁ তুমি বাড়িতে, বিছানায়। ঠিক আছে তুমি বিশ্রাম নাও আমি হাত-পা ধুয়ে নিজের খাবার নিজে করে নিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়ছি।

-- ওক্কে বস্ স স ... তাই করো... কিন্তু যাওয়ার আগে আমার ফোনটা আমার হাতে দিয়ে দিও তো...

-- কেন ফোন নিয়ে কি হবে, এখন?

-- টয়লেটে যাবো তো তাই জন্য চাইছি।

-- টয়লেটে ফোন নিয়ে গিয়ে কি করবে? তোমার কি হয়েছে বলো তো? মদ খেয়েছো ঠিক আছে, কিন্তু বাজে বকছ কেন?

‌-- বাজে বক্ছি? আমি বাজে বকছি? তুমি রোজ বাজে বক, আমি বাজে বকছি তো বেশ করছি। ফোনটা দাও...

-- আরে বাবা ফোন নিয়ে টয়লেটে যাবে নাকি!

-- এখান থেকে টয়লেট টা ঠিক কোথায় বুঝতে পারছি না তো... তাই জন্য। বাড়ির কোন ঘরে আছি, সেটাও ঠিক মনে পড়ছে না। তুমি আমার ফোনটা দাও। আমি গুগল করে দেখে নিচ্ছি।

-- গুগল ম্যাপে বাড়ির টয়লেট!!!

-- আরে হ্যাঁ আমি গুগল ম্যাপে একটু দেখে নেব যে টয়লেট যেতে গেলে কোন দিক দিয়ে যেতে হবে, কতটা দূরে আর ক' মিনিট-ই বা লাগবে...

-- আরে চলো, অত কত্তে হবে না...ওঠো, আমি তোমায় পৌঁছে দিচ্ছি...

-- এই শোনো! ডোন্ট টাচ মি....আর বাজে কথা বলো না... এটা নারী স্বাধীনতার যুগ। আ'ম আ ফ্রি ঊয়োম্যান্....ডোন্ট নিড য়োর ফা** হেল্প! আমি নিজে এখান থেকে টয়লেট যেতে পারবো না, কে বললো তোমাকে? নিশ্চয়ই পারব।...আই ক্যান ডু ইট্...তুমি শুধু আমার ফোনটা দাও...এটুকু উপকার তো করো... আর তা ও যদি না পারো, তাহলে বলে দাও যে এ ও তোমার সামর্থে কুলোবে না... ঠিক যেমন করে রোজ বাজারটা পর্যন্ত করো না, সেই আমাকেই করতে হয়।

-- আরে তুমি ঠিক নেই...

-- তোমাকে অত ভাবতে হবে না। আমাকে কত যেন হেল্প করে! তুমি আমাকে নিয়ে যাবে টয়লেটে, তা-ও আবার অচেনা জায়গায়, অচেনা বাড়িতে... আমি গুগল ম্যাপ দেখে সব ঠিক করে নেব। তুমি বরং নিজের চরকায় তেল দাও। য়ু নেভার হ্যাড বিন আ ম্যান এনাফ!!! তবু আমি ছিলাম বলে এ যাত্রা ত'রে গেলে...


নিজের বাড়িকে যে সজ্ঞানে 'অচেনা জায়গা' বলে গুগল ম্যাপে টয়লেট খুঁজছে, তাকে আর কি বলা যেতে পারে! তার ওপর আবার সোজা 'মর্দাঙ্গী কো ললকার দিয়া, ইয়ার!" ফলে অনুকম্পার কোনো স্থান-ই সেখানে নেই।

দেবাশীষ আর কথা বাড়লো না। বুঝল, ব্যাপারটা খুব খারাপ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। যাকে বলে তার বউ এখন 'পেঁচো মাতাল' -- যত ঘাঁটাবে ততই বিপদ। জীবনের অনেক নীতিশিক্ষার মধ্যে একটি হল যে, পাগল এবং মাতালদের সঙ্গে বেশি কথা বলতে নেই। আর এখানে ওর বউ তো এখন একাধারে পাগল এবং মাতাল। সুতরাং আজ থাক.... কাল সকাল বেলা আবার দেখা যাবে।

দেবাশীষ বালিশ বগলে করে বেডরুম ছেড়ে ড্রয়িং রুমে শুতে চলে গেল। মনে মনে বলল,
-- গো টু হেল্!


দ্যুতি মিচকি হেসে বলল,
-- দেখ কেমন লাগে....!

--------------শেষ-----------

Tuesday, 12 March 2024

মদ্যপদলোপী:

ফ্ল্যাট কালচারে আমরা এখনও ঠিক খাপ খাওয়াতে পারি নি। সতেরো বছর হতে চলল এখানে এসেছি, তা-ও। ঘোঁটবাজি, অন্যের বাড়িতে কি হচ্ছে, পরস্ত্রী-কাতরতা কোনোটাই তাই বাদ নেই।  মাচা, বা দাওয়া তো নেই, ল্যান্ডলাইন টেলিফোন থেকে মোবাইলে 5জি নেট ওয়ার্কের মতই সে সব আপগ্রেডেড হয়েছে | বাড়ির জানলা থেকে গলা বাড়িয়ে পাড়ার দোকানে হাঁক দিয়ে “ পাঁচু দু-প্যাকেট ফিলিটার উইলস দিয়ে যা| আর খাতায় লিখে রাখবি” --  এই জমিদারী প্রথা ছেড়ে এখন ফোন করলেই সব দোরগোড়ায় হাজির | আমরা সাধারণ মধ্যবিত্ত তো! তাই ক্লাবহাউস থাকা সত্ত্বেও ঝাউতলাকে বেছে নিয়েছি | 


ঐ ঝাউতলায় মশার কামড়কে বীরদর্পে উপেক্ষা করা হয় | প্রবল শৈত্যপ্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয় সম্পর্কের উষ্ণতার দেওয়ালে | আর সবথেকে বড় কথা– এই ঝাউতলা হল নিরাপদ কনফেশন বক্স | এখান থেকে কোনো কথা বাইরে লিক হয় না। বাড়ির স্ত্রী-রাও জানতে পারে না যে এই ঝাউতলার স্থানমাহাত্মে তাঁদের স্বামীরা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে কি রকম মহাপুরুষের রূপ ধারণ করেন! 


এই সব যুগপুরুষের মধ্যে অভিলাস-দা একজন | জীবন বীমা কোম্পানির বড় পোস্টে চাকরী করেন ৷ ওনার সুনাম আছে যে চোখে রে-ব্যান চড়িয়ে, বাড়ি থেকে ভাত আর ট্যাংরা মাছের ঝোল খেয়ে, বেলা সাড়ে বারোটা নাগাদ অফিসের উদ্দেশ্যে বের হন; আর সাড়ে তিনটে চারটের মধ্যেই ব্যাক | আর গুন বলতে মানবজন্মের ষড়রিপুর  মধ্যে একটি প্রবলভাবে বিদ্যমান – লুকিয়ে চুরিয়ে একটু মেয়েদের ঝিংকু ছবি দেখেন | কিন্তু লোকে আর যাই ই বলুক না কেন, রঙীন সুরাপান উনি করেন না। রাশিয়া-উদ্ভূত স্বচ্ছ-টি হলে, মাঝে মধ্যে চেখে দেখেন | কিংবা সেই বৃদ্ধ সাধু সেজে দিলে রিফ্যুজ করেন না। 


আর তাতেই হল বিপত্তি | 


ঝাউতলায় বেশ দুঃখী মুখে সর্বহারার মত একা বসেছিলেন অভিলাস-দা | জীবনের সব মোহ-মায়া থেকে যেন মুক্ত হয়েছেন। তবে মোবাইল ফোনটা কাছেই আছে | কিছু গোপন ভিডিও দেখে যদি মানবজীবনের প্রতি আবার আকৃষ্ট হন, সেই প্ৰচণ্ড প্রচেষ্টা | 


কি হয়েছে জানতে চাওয়ার সাথে সাথে এক হৃদয়বিদারক কাহিনী | সূত্রপাত সপ্তাহখানেক আগে –


কোনো এক শুভানুধ্যায়ী অভিলাসদাকে  স্ন্যিরনফ নামক একটি স্বচ্ছ কড়া পানীয়ের বোতল উপহার দেন। বাড়িতে ওনার স্ত্রী পান করাকে পৃথিবীতে মানুষ্যকৃত সর্ববৃহৎ ক্রাইম বলে মনে করেন ৷ অভিলাস দা একবার হোমিওপ্যাথি ওষুধ খাওয়ার পর স্ত্রীকে সোহাগ করতে গিয়ে ফুল কেস খেয়েছিলেন | ওনার মুখনিসৃত সুবাস অ্যালকোহলের গন্ধসমৃদ্ধ বলে ডিভোর্স হওয়ার জোগাড় | পরে সেই ওষুধের শিশি থেকে ওষুধ সেবন করে স্ত্রীকে চুম্বনোদ্দত হতে গিয়ে

'মিনসের ঢং দেখ না!!!'  বলে বলে বিবিধ বাক্যবানে জর্জরিত হয়ে সমস্যার সমাধান ঘটান | কিন্তু এবারে ব্যাপারটা একেবারেই হাড় হিম করা। 


অভিলাসদা উপহার পেয়ে মনে মনে খুশি হলেন  বটে কিন্তু সঙ্কট হল মালের বোতল লুকোবেন কোথায় | স্ত্রী এর চোখ এড়িয়ে রাখা সম্ভবই নয় | শকুনের দৃষ্টি | তখন মনে পড়ল ইস্কুলে পড়া একটা ইংরেজী গোয়েন্দা গল্পের কথা - সেখানে যেটা খোঁজার জন্য সবাই তোলপাড় করে ফেলেছিল সারা বাড়ি, কিন্তু পায়নি, সেটা ছিল সবার চোখের সামনে, সর্বক্ষণ | বিছানার ওপর এমনি ফেলে রাখা | মানবজাতির স্বভাব বুঝে বুদ্ধিমান অপরাধী জিনিসটিকে না লুকিয়ে সবার চোখের সামনে এমন গুরুত্বহীন ভাবে, অবহেলা ভরে রেখেছেন যে তা কারোর দৃষ্টি আকর্ষণ করবে না। আর হলও তাই | কেউ লক্ষ্য করল না জিনিসটিকে| অভিলাস দা কপি-পেস্ট মারল।  দেখল সামনেই একটা ইয়া ঢাউস জিনিসপত্র ভর্তি বিগ শপার। সেটা ওর স্ত্রী এর সঙ্গে আগামী উইকএন্ডে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হবে | এর থেকে মালের বোতল লুকোনোর নিরাপদ জায়গা আর হয় না কি! শুধু বেরোনোর আগে সরিয়ে নেওয়া, ব্যাস ! তবু সাবধানের মার নেই | তাই জিজ্ঞেস করে নিল 

  • এটা কিসের ব্যাগ?

  • ও ওটা? ওটা ও বাড়িতে যাবে ! বললাম তো কাল।

  • ও হ্যাঁ হ্যাঁ, ভুলে গিয়েছিলাম, …

  • হঠাত্...?

  • এত জিনিস! আর তো জায়গাই নেই !

  • ওই গোছাতে আমার প্রান বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়

  • সব বের করে আর একবার গোছালে পারতে…

  • রক্ষে কর… যা আছে ওরকমই নিয়ে চলে যাব। বরং মুখটা একটু বেঁধে দিও 

  • বেশ দেব… যাওয়ার আগেই বাঁধব যদি কিছু নেওয়ার বা বের করার থাকে…

  • না…সব হয়ে গ্যাচে আর ওসব হ্যাপা নিতে পারব না

  • ঠিক আছে… তুমি ভেব না অত… আমি সময় বুঝে সব করে দেব ‘খন…


 তুমি বন্ধু কালা পাখি আমি যেন কি

সাদা সাদা কালা কালা রঙ জমেছে… হুঁহু হুঁহু…


এখানে অ্যারিস্টট্লের থিওরী অনুসারে অভিলাসদার 'ট্র্যাজিক-ফ্ল' হল- ক্রসচেক করে মালের বোতল ওই বিগশপারেই গুঁজল | ওপরে তোয়ালে ঢাকা | 


তার একদিন পরে ভরদুক্কুর বেলায় বৌদির ফোন অভিলাসদাকে, কাঁদতে কাঁদতে

- তুমি এত নোংরা? ছিঃ… এত পাপ তোমার মনে? আমার নিজের ওপর ঘেন্না লাগছে

- আরে কি…কি হয়েছে?

অভিলাসদা ভাবল এই রে, কোনোক্রমে কোথা থেকে লুকোনো ঝিংকু ছবি দেখে ফেলল না কি রে!

- কি হয়েছে | ন্যাকামী… ভাজা মাছ যেন উল্টে খেতেই জান না |

  • কি যে বলছ… জান আমি ভাজা মাছ খাই না , হয় ঝোল না হয় ঝাল

  • আর সঙ্গে কি… মদ???

  • (** মেরেছে রে!) কিছু একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে আমি আসছি

  • তোমাকে আর কষ্ট করে আসতে হবে না… আমি চললুম

  • আরে দাঁড়াও…

  • দাঁড়িয়ে কি হবে? আগেরবারে হোমিওপ্যাথি শিশিতে ওষুধ ছিল… এখন কি গোটা আস্ত মদের বোতলে ওষুধ থাকে?

  • (লে হালুয়া মদের বোতল!!! ওই বিগ শপারে রাখাটা-ই উচিত হয় নি...যাক বাবা, তাহলে দুষ্টু ছবি নয়্...মদের বোতল্)....না মানে…ইয়ে...

  • চুপ একদম চুপ

ফোন কেটে গেল | কলব্যাক করতে সেই রহস্যময়ী নারীর কন্ঠ দিস ফোন ইজ স্যুইচড অফ। প্লিজ ট্রাই আফটার সামটাইম |


বাইকটা যেন উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে বাড়ি পৌঁছাল অভিলাস দা | ট্রলিব্যাগ গুছিয়ে বৌদি সোফায় বসে | গৃহত্যাগী যাওয়ার জন্য প্রস্তুত| অভিলাস দা লক্ষ্য করে দেখল, সব আছে,  কিন্তু সেই বিগশপারটা নেই।চারিদিকে তাকাতে তাকাতে বলল, 

  • আচ্ছা ! কি হয়েছে… তুমি তো জান আমি মদ ছুঁই ও না…

  • বাজে কথা মিথ্যে কথা 

  • আমাকে বোতলটা দাও আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি…

  • কাল দুপুরে ঝন্টু এসেছিল… ব্যাগ গোছানোই ছিল। মুখটা বেঁধে ওইই বলল , “ দিদি আমি স্কুটি তে করে নিয়ে চলে যাই”...তাই, বোতল নেই। 

তারপর যা ঘটেছে তা শুনে অভিলাস-দার চক্ষু ছানাবড়া|

সেই বিগশপার নাকি ঝন্টুর হাত থেকে সোজা গিয়ে পড়ে শাশুড়ী মায়ের হাতে | ব্যাগ থেকে বোতল পেয়ে উনি চিন্তায় পড়ে যান | শ্রদ্ধেয় শ্বশুরমশাই কে গিয়ে বলেন

  • মেয়েটা এত ভাল যে আমাদের নিজের কষ্টের কথা কিছু জানায়ই না | আমাদের জামাইও তাই | বড্ড ভাল মানুষ |

  • কেন.. কি হল ওদের

  • দেখ না জামাইটা আমাদের বোতল বোতল কড়া কড়া ওষুধ খাচ্ছে 

  • তুমি কি করে জানলে

  • খুকু একটা ব্যাগে কিছু জিনিস পাঠিয়েছে | ভুল করে তার সঙ্গে ওষুধ্টা চলে এসেছে | 

  • খুকুকে বলেছ?

  • না তোমাকে বললাম … বুঝতে পারছি না ঠিক, যে কি বলব?

  • কই ওষুধটা দেখি

শাশুড়ী তাঁর স্বামীকে বোতলটি দিলেন |

শ্বশুর মশাই তাঁর পাওয়ার গ্লাস চোখে লাগিয়ে দেখলেন লেবেলের গায়ে উজ্জ্বল রৌপ্যাক্ষরে লেখা

“স্ন্যিরনফ" 

আর তার নিচে 

"প্রিয়িয়াম ভোদকা”

শ্বশুর মশাই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চশমা  খুলে শ্বাশুড়ীকে বললেন,

- জামাই আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেচে গো

- কেনো গা, কি হয়েচে?

- জামাই আমাদের নটমহাগুরু গিরীশ বাবু হয়েছেন

- মানে?

- মানে আর কি? কিছু না গিরীশ বাবুর মত অভিনয়্, তাঁর মতই শখ্, আহ্লাদ, নেশা...এ ওষুধ শুনেছি ফ্রিজে রাখতে হয়...যাও তুলে রেখে দাও...আর খুকু-কে ফোন করে বলে দাও, জামাই বাবাজীবন যেন অকারণে ব্যস্ত না হয়ে পড়েন...ওষুধ খাওয়ার সময়ে খুঁজে না পেলে তো মুশকিল...বোলো আমাদের জিম্মায় ওষুধ সুরক্ষিত আছে...তবে একেবারে না চললে, হয় এসে নিয়ে যায় যেন্, আর না হলে নতুন একটা ফাইল যেন কিনে নেয়!

- আচ্ছা, বলে দিচ্ছি..তা হ্যাঁ গা, ওষুধ্টার নাম কি?

- ভোদ্কা…

- অ:...তাই বলে দেব'খন


সব শুনে অর্ক বলল,

- উফ পুরো 'বামাল'। বামাল সমাস জান? 

- কি?

- বা: কি মাল! -- বিস্ময়কর সমাস...অবার এভাবেও ভাঙা যায় যে ,-- ব্যাগের ভেতরে মাল

- এটা কি সমাস্?

- মদ্যপদলোপী তথপুরুষ

- তাতে কি?

- কি আবার...ঠিক হয়েছে, সব জায়্গায় মিথ্যে বললে ঠাকোর এরকমই পাপ দেন্…

- কি করেছি আমি?  

- তুমি আমাদের সবাইকে খাওয়াবে বললে, তারপর বললে বৌদি নাকি বারণ করেছেন্... এ সব মিথ্যের পাপ যাবে কোথায়! দেখ কেমন লাগে!! কতবার বলেছি, মাল তো তুমি খাও না, বোতল পেলে আমাদের দিয়ে দেবে, যারা খাই-টাই...আর খেলে তুমি আর কত খাবে, ম্যাক্সিমাম দু'ছিপি...? সে তো এমনিই তলানিতে পড়ে ই থাকে... কেন বেকার রিক্স নিতে গেলে…? 

- তোকে দেব বোতল!! একাই একবেলায় টেনে মেরে দিবি, আর কেউ পাবে!!!

- ...আমাকে বিশ্বাস না হয়, তরুন-দা কে দিও…

- সে ও তো একই গল্প... একবার দিলাম্... পুরো টা এক রাতে উড়িয়ে দিয়ে বলল, "এ ই তোদের ভোড্কা? ছ্যা:!!! ...এর থেকে বাংলা ভাল..."

তরুন দা ছ্যাঁক করে তেলেবেগুনে হয়ে বলল

- বলব না তো কি, শালা চিনি গোলা মাল...মদ আবার অত মিষ্টি হয়্…

- ওটাই অ্যাবসোলুটের ফ্লেভার...তোমার মত বাংলা খাওয়া লোকের কাছে এ সবের কোনো কদর নেই…

- যা বোঝ না, তা নিয়ে তর্ক কোরো না...তুমি জান পশ্চিমবঙ্গের মাসিক অর্থ্নৈতিক আয়ের সিংহ্ভাগ আব্গারি দপ্তর থেকে আসে?


ব্যাপারটা ভাল দিকে গড়াচ্ছে না দেখে প্রসুন জানতে চাইল,


- বৌদি এখন কোথায়? এখানে না ওখানে?

- ওখানেই আছে...কিছুতেই ফিরতে চাইছে না…

- সে কি গো, তা হলে?

- দেখি.. কানের একটা অর্ডার দিয়েছি, সেটা নিয়ে গেলে যদি বরফ গলে…

কৌশিক টিপ্পনি কেটে বলল্...

- মাইরি দাদা...বরফ গলাতে যে সোনা লাগে, জান্লাম

- কারোর সিরিয়াস সমস্যা কে এত লাইট করে নিস না... 

- আরে ওর কথা ছাড় না দাদা? আর শ্বশুর মশাই...? 

অভিলাস দা কিছু বলার আগেই কমল দা বলে উঠ্লেন্,

- দেখো বাপু আবার শ্বশুরমশাই-কে 'একটু চেখে দেখুন না, বলে যেন খাইয়ে দিও না। তোমাকে বিশ্বাস নেই... দুগ্গা ঠাকুর আনতে গিয়ে তো লরি তে দিব্বি চোঁ করে রামের নিপ-টা মেরে দিলে, উল্টো দিকে ঘুরে, ভেবেছ আমি দেখি নি!


আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম। প্রদীপ্ত শ্লোগান দিল,

জয় শ্রী রাম !!!!


অভিলাসদা নিজেও হেসে ফেলে বলল

- কাদের বলছি! 


-- আর্য চ্যাটার্জী