Saturday, 3 February 2024

ম্যাস্টরমশাই: পর্ব ৯


 - আরে, ইসমাইল না! 

- হ্যাঁ স্যার, আমি ইসমাইল… আপনার মনে আছে? 

পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো।  তারপর আমার হাত ধরে টেনে গলির মধ্যে ঢেকে ঢুকিয়ে নিয়ে গিয়ে বলল,

- স্যার একটা কথা বলব? কিছু মনে করবেন না তো?

- না, বল না, কি বলবি? 

- মানে বলছিলাম কি যে, যেখানে সেখানে আমার সাথে যেখানে সেখানে পাব্লিক প্লেসে এরকম ভাবে কথা বলবেন না…

- কেন কি সমস্যা? 

- স্যার আমি তো আর ভালো ছেলে নই... আমার এলাকায় খুব বদনাম আছে। 

- হ্যাঁ জানি।  কিন্তু তার সাথে আমার কি সম্পর্ক? তুই আমার ছাত্র ছিলি, ছাত্রই থাকবি আর আমি তোর শিক্ক্ষ্ক।  তাতে তোর নামে বা বদনামে কি যায় আসে?

- না স্যার আমার সাথে কথা বললে আপনারও বদনাম হবে! 

- হ্যাঁ: আমার আবার বদনাম। আমাদের স্কুলটাই এমনিতে বদনামের। সুতরাং এই স্কুলে যারা পড়ায় তাদের তো বদনামের ভাগ নিতেই হয়। 

- না স্যার এই স্কুলটা ছিল বলে, আপনার মতো স্যারেরা ছিলেন বলে আজও কিছু শিখেছি…

- শিখেছিস আবার কিরে? তুই তো মাধ্যমিক পরীক্ষাটাও দিলিনা। টেস্টে ফেল করলি... 

- আশিস বাবু আমাকে অংকে শূন্য দিল কেন? আমি সাত পাতা লিখেছিলাম। জ্যামিতি এঁকেছিলাম্...তা ও

- তারপর থেকে তুই এলি না, হঠাৎকোথায় ভ্যানিশ হয়ে গেলি।  আমি আর হেডমাস্টারমশাই তোর বাড়িতেও গিয়েছিলাম।  অনেক করে বললাম। অন্তত মাধ্যমিক টা দে তো তুই শুনলি না।  তারপর তোর মা বললেন তুই স্কুল-এ ফেল করার পর থেকে আর ওখানে থাকিস না। 

- হ্যাঁ স্যার আমি আর ওখানে থাকি না।  আমার আম্মা বদনাম হবে, পুলিশ অত্যাচার করবে, তাই জন্য আমি ওখান থেকে ছেড়ে চলে এসেছি। 

- কেন

- স্যার ক্লাস এইট থেকেই ভালো কিছু করতাম না, এখনো করিনা। যেটা করি সেটা আপনাকে বলার মত নয়। আর আপনি সব জানেন স্যার, অমকে এটা নিয়ে কিছু বলবেন না, প্লিজ্! 

- তার মানে তুই এখোনো খারাপ কাজ করৈ চলেছিস্।

- কাজের স্যার ভাল খারাপ কিছু হয় না...আমি ভিক্ক্ষে করি না, খেটে রোজ্গার করি...কিন্তু আমাদের ব্যবসাতেও ওসুল আছে জানেন তো? 

- তাই, সেটা কি...?

- জুবান…আমরা যাকে একবার কথা দিই সেই কথার নড়চড় হয় না। কথা মানে কথা, কোর্টের স্ট্যাম্প পেপারে লেখার থেকেও বেশি। কারণ আমাদের লাইনে কথার ওপর এক একটা জান…


মনে পড়ে গেল আমি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে জয়েন করার কিছুকাল পরে একদিনের ঘটনা। 

তখন আমি যে স্কুলে পড়াই তাতে আড়াইশো মতো ছাত্র পড়াশোনা করত। আর তার বেশিরভাগই ওই হতদরিদ্র। অন্যান্য তথাকথিত ভাল স্কুল-সমাজ-বাড়ি-পরিবেশ যাদেরকে  খারাপ ছেলে বলে দাগিয়ে দিয়েছে, যাদের আর জীবনে কোনদিন কিছু হবে না বলে তাদের মনে বিশ্বাস জন্মে দিয়েছে, যাদের জীবনে শুধু অন্ধকারই অন্ধকার, তাদেরকে কাছে টেনে এনে, ভালোবেসে শিক্ষা দিয়ে, মাধ্যমিক পাশ করানো হচ্ছে সর্বোচ্চ পর্বতশিখর জয়ের মত। এইটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে এখানে ঐ বৃহত্তর ভারতে একজন বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই হয়ে শিক্ষক রূপ ধারণ করে উন্নাসিক হয়ে থাকলে, কোনো কাজই করা যাবে না। পিছিয়ে পড়া একটা ছেলেকেও মানুষ করতে পারব না।  কারণ ঐ ছেলেদের কাছ থেকে ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট আশা করা তো দূর তারা কোন মতে টেনে-টুনে থার্ড ডিভিশনে মাধ্যমিক টুকু পাশ করলে আমাদের মন ভরে যায়। শুনতে যতটা সহজ, বাস্তবে ততটা নয়। আড়ালে থাকে অসম্ভব জেদ আর ধৈর্য -- যাদের দ্বারা কিস্সু হবে না বলে জানে, তাদের দিয়ে কিছু করিয়ে নেওয়া, তাদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও। 


হ্যাঁ যেদিনের কথা বলছিলাম সেদিন আমাদের স্কুলের শারীর শিক্ষার শিক্ষক প্রতুল কোলে বাবু আসেননি।  আমার যেহেতু এনসিসি (স্কুল্-কলেজ লেভেলে মিলিটারী ট্রেনিং বিশেষ) ছিল আর আমি শারীর শিক্ষা নিয়ে অনেক কাজ করেছি সেন্ট জন’স স্যাম্বুলেন্স ব্রিগেড থেকে আমি ডিপ্লোমাধারী -- সেই সব শুনে বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক মহাশয় প্রতুলবাবুর জায়গায় অনেক দায়িত্ব আমার হাতে সঁপে দিয়েছিলেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ছাত্ররা আমাকে ভালবাসতে শুরু করেছিল। সুযোগ পেলেই তাদেরকে নিয়ে মাঠে গিয়ে পি-টি বা প্যারেড করাতাম, কিরকম ভাবে ডিসিপ্লিনড হতে হয় সেটা শেখাতাম, আর মাঠে শেখানো ছিল একদম মিলিটারী মেজাজে। সেইরকমই একদিন যখন ভরপুর মাঠে ক্লাস টেন-কে প্যারেড করাচ্ছি, হঠাৎ অনেক পুলিশ ঢুকে পড়ল। দেখলাম,  স্কুলের বাইরে,  বাজারের দিকে, পাঁচিলের ওপাশে সবদিক থেকে পুলিশ ঘেরাও করে ফেলল পুরো স্কুল কম্পাউন্ডটা। তারপর থানার ওসি সোজা হেড মাস্টার মশায়ের ঘরে ঢুকলেন এবং কথাবার্তা বলতে শুরু করলেন। আমি আমার কাজ করে চলেছি।  

-- এক দো তিন, এক বলার পর পা মাটিতে শব্দ করে ঠুকতে হবে, আর এত্জনের পায়ের একটা শব্দ হবে...'ধপ্'...এক ফোঁটা আগে পরে হলেই...প্যারেড সাওধান্!!!!.

নিমাই-দা এসে বলল,

-- যান, আপনার ডাক পড়্রেছে, কোতায় চাগরি কত্তে এয়েচ এবরে হাড়ে হাড়ে বুজবে... ছাত্তরদের পেতি বেশি দরদ একেবারে উথলে উঠচে যেন! 

-- কি ব্যাপার? কি হয়েছে নিমাই-দা...?

-- কিচ্ছু হয় লি গো...তুমি শুধু ঐ সব হাড় বজ্জাত্, বেজন্মা ছেলি গুলারে পোস্যয় দি যাও…

-- নিমাই-দা এরা আমাদের ছাত্র, সন্তানের মত...। তাদের সম্পর্কে এ কি ভাষা? 

-- ওই হল, আসল কতা বাবা ... সন্তানের মত...সন্তান তো আর লয়...ছাত্তর ছাত্তর কোচ্চ...তোমারই ছেরাদ্দ না করিয়ে দেয়...তোমার অত কি হে? পরের ছেলি পরমানন্দ, যত গাদায় যায় তত…

-- আ: নিমাই দা! 

ঘটনা হল:  

আমাদের নবম শ্রেণীর ছাত্র ইসমাইল দুটো মার্ডার কেস আর বেশ কিছু নীতি বহির্ভূত কাজকর্মে অলরেডি যুক্ত হয়ে পড়েছে।  তাকে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজে মরছে, কিন্তু কিছুতেই বাগে পাচ্ছে না। লক্ষ্য করা গিয়েছে যে ইসমাইল রেগুলারলি স্কুলে আসে। তাই ওকে ওখান থেকেই তোলা হবে। 


হেড্মাস্টারমশাই আমাকে  জিজ্ঞাসা করলেন

- এত বড়  সমস্যা!!!  কি করা যায়, বলো....

 আমি বললাম 

- প্রথমত:,  পুলিশ যদি এভাবে স্কুল কম্পাউন্ড থেকে স্কুল চলাকালিন ছাত্রকে তুলে নিয়ে যায়, সেটা কিন্তু স্কুলের পক্ষে খুবই অসম্মানজনক ব্যাপার।  এমনিতেই স্কুলটির অকারণ বদনাম! তার মধ্যে আবার যদি একদম স্কুলের মধ্য থেকে পুলিশ ছাত্র তুলে নিয়ে যায়, পরে কিন্তু আমাদের বেশ বেগ পেতে হবে... 

- হুমম...ঠিকই বলছ্...

- আর দ্বিতীয়ত:  এখন আমার ক্লাস করছে ইসমাইল।  ওনার কাছে ওয়ারেন্ট থাকতেই পারে! কিন্তু তা সত্ত্বেও স্কুলের ক্লাস থেকে কিভাবে একজন নাবালক কে পুলিশ তুলে নিয়ে যেতে পারে এ সম্পর্কে আমার বিশেষ জানা নেই। তবে সবথেকে ভালো হয় যে স্কুল শেষ হোক... আর তো মাত্র দুটো পিরিয়ড বাকি আজ... তারপর স্কুল ছুটি হলে ইসমাইল যখন স্কুল থেকে রাস্তায় বেরোবে, তখন যেন পুলিশ ওকে ধরে। তার আগে নয়। স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়ার পরে যে কোনো ছাত্র স্কুল কম্পাউণ্ডের বাইরে, মুক্ত। তার পরে আইনত: ছাত্রের দায় স্কুলের থাকে না।  স্কুলের রেজিস্টারে ও আজ কিন্তু ও নথিভুক্ত, উপস্থিত ছাত্র হিসেবে।  ক্লাস টিচার হিসেবে এবং হেডমাস্টার হিসেবে আমরা কি ইসমাইলকে পুলিশের হাতে হ্যান্ডওভার করে দিতে পারি? এটা কি একটা নাবালকের প্রতি অবিচার হয় না, যে সে পড়তে এসেছিল আর আমরা তাকে পুলিশের হাতে তুলে দিলাম...

ওসি বললেন,

- আপনার বয়স অল্প ভালো ভালো কথাই বলছেন। আইন-ফাইন... কিন্তু আমাদের দেশটা ঠিক কিরকম ভাবে চলে  নিশ্চয়ই আপনার আইডিয়া আছে। এই সমস্ত ক্রিমিনাল কে যদি স্কুল পোষে তাহলে কিন্তু আমরা সেই স্কুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি। বিশেষত: আমাদের কাজে যে সমস্ত শিক্ষকরা বাগড়া দেবেন তাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায়...


- আপনি একটা দায়িত্বশীল পদে বসে একটা স্কুলে হেডমাস্টার এবং মাস্টারমশাইকে ভয় দেখাচ্ছেন্, এ তো ভাল কথা নয় ... যে ছাত্রটির কথা বলছেন সেই ছাত্রটি সম্পর্কে স্কুল বিশেষ কিছু জানে না... অন্য সবার মত সে এক্জন সাধারণ ছাত্র।  সে একজন ক্রিমিনাল এটা আমদের জানা নেই। 

- আরে স্যার আমরা তো বলছি এই দেখুন অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট আছে...

- আমি কিন্তু আপনার কথা একবারও অবিশ্বাস করিনি, যে আপনার কাছে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট নেই, বা ওকে আপনি ধরতে পারেন না, দেশের প্রতি দায়িত্বশীল হতে পারেন না, এসব কথা আমি কিন্তু একবারও বলিনি।  আমি যা বলতে চাইছি তা হল আপনারও ভাবা উচিত,  যে একটা স্কুল থেকে একটি বাচ্চাকে তুলে নিয়ে গেলে স্কুলের বাকি ছাত্রদের মানসিক অবস্থা কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছাতে পারে! আপনি যেমন আপনার থানা নিয়ে ভাবছেন, আমরা ভাবছি আমাদের স্কুল নিয়ে। আপনি ঠিক যেরকম ভাবে যতটা পুলিশ, আমরা ঠিক সেরকম ভাবে ততটাই আবার শিক্ষক। আমি ধরে নিলাম্, আমাদের ছাত্রটির বিচারে জেল হলো। এখন জেলকে যেন কি বলে?   হ্যাঁ, সংশোধনাগার।  সেখানে গিয়ে একজন ক্রিমিনাল কিন্তু পুনর্বাসিত হয় মূল্যবোধ ও শিক্ষার জন্য, সংশোধিত হওয়ার উদ্দেশ্যে। জেলের থেকে স্কুলটা সংশোধিত হওয়ার কি একটা বেটার জায়গা নয়? আর রইল পড়েও শাস্তির কথা, সে যদি ওর প্রাপ্য হয় নিশ্চয়ই ও শাস্তি পাবে আইনানুগ ভাবেই পাবে। কিন্তু স্কুল তো সেই শাস্তির হাতে  তুলে দেওযার জায়্গা নয়। স্কুলের কাজ নয় তো ছাত্রকে আইনত্: শাস্তি পাওয়ার দিকে ঠেলে দেওয়া।  স্কুলের কাজ তাকে সঠিক মূল্যবোধে মানুষ করা....

- আরে স্যার এমন মূল্যবোধে মানুষ করলেন যে শালা ক্রিমিনাল হয়ে গেল! মানুষ খুন করে দিচ্ছে, হ্যাঁ!

- মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ, এটা আপনার থানা নয়, স্কুলের হেড্মাস্টারের ঘর্...আর আপনার ওই ক্রিমিনালটি কোথাও একটা শিক্ষিত হওয়ার লোভে নিয়মিত স্কুলে আসে... আপনি জানেন, আমাদের ফুটবল টীম ডিস্ট্রিক্ট চ্যাম্পিয়ন! আর ইসমাইল সেই টিমের ক্যাপ্টেন!  আপনি জানেন, আমাদের স্কুলের সরস্বতী পুজো হয় সেই সরস্বতী পুজোয় প্রথম যখন ইসমাইল কমিটিতে ঢোকে তখন বলে,

"স্যার আমরা শুধু স্কুলের ছাত্ররাই খাওয়া-দাওয়া করব? সঙ্গে যদি আমাদের আশেপাশের আরো কিছু গরিব ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা আমার বন্ধুবান্ধবরা খাওয়া-দাওয়া করে তাহলে পুজোটা আরো বড় হয়।"

আর এই ছেলেকে আপনি বলছেন ক্রিমিনাল। এই মানবিক বোধ বা শিক্ষা কিন্তু ও স্কুল থেকে পেয়েছে। এই স্কুলকে ও যতটা ভালবাসে, ততটা ভালোবাসা কিন্তু একজন খুব ভালো মানের ছাত্রের কাছ থেকে পাই নি। সুতরাং স্কুল ওকে ক্রিমিনাল তৈরি করেনি। ওকে ক্রিমিনাল তৈরি করেছে সমাজ। 

- ও আপনি তো জ্ঞানী ব্যক্তি অনেক জ্ঞান দিচ্ছেন...ক্রিমিনাল কে প্রোটেক্ট করছেন।

- আচ্ছা, ও যেখানে থাকে, সেটা তো আপনার এলাকার মধ্যে পড়ে, তাই না? আপনি কেন মানুষ করতে পারেন নি, ওকে? উচিত শিক্ষা দিয়ে?

- এঐ মাস্টার, তোমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে এমন হাম্পু দেব না...

হেড মাস্টারমশাই হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন 

- আপনি আমার বিদ্যালয়ের শিক্ষককে এইভাবে বলতে পারেন না।  আপনার যদি ইসমাইলকে ধরার হয়, আপনার এই বন্দুকধারী স্কুল পুলিশদেরকে এক্ষুনি স্কুল থেকে চলে যেতে বলুন।  ছুটি হলে তারপর আপনারা স্কুলের বাইরে ওকে নিয়ে যা করার করুন। আমরা ওকে কোনোভাবেই স্কুলের তরফ থেকে ইসমাইল-কে আপনার হাতে তুলে দিতে নারাজ। 

- এরপর স্কুল থেকে যদি ও  পালিয়ে যায় তাহলে কিন্তু তার দায় আপনাদের নিতে হবে।  পারবেন তো? তখন কিন্তু ক্রিমিনাল কে হেল্প করার চক্করে দুজনে ফেঁসে যাবেন। আমি কিন্তু ছাড়বো না... সামনে ফল ঝুলছে পেড়ে নিয়ে চলে যেতাম...

- শুনুন ওসি সাহেব! সে ফল ঝুলুক আর ফুল-ই ঝুলুক পাড়ার দায়িত্ব আপনার।  আর মগডাল থেকে ফল-ফুল পাড়তে গেলে গাছে ওঠাটা শেখা খুব জরুরী।  আমাদের এখানে এসেছেন , একটু চা খেয়ে যান্...নিমাই....  

- না:  যা খাবার, খাওয়া হয়ে গেছে। তাহলে আপনি ছাড়বেন না?  

- না

- এটাই শেষ কথা?

- ...শেষ কথা

- তবে আর সময় নষ্ট করে লাভ কি! আচ্ছা একবার ওর সাথে কথা বলা যেতে পারে স্যার? 

- না যেতে পারে না

- ঠিক আছে তাহলে আমরা এখন চলি.... আর সবাই-কে বলি বাইরে ঘিরে রাখতে, ছুটি হলে তুলে নেবে।

- ঠিক...আসুন...নমস্কার...


ইসমাইল তখনও মাঠে প্যারেডের লাইনে দাঁড়িয়ে। সেই যে "প্যারেড সাবধান!" বলে চলে এসেছি, ঠিক সেই সাবধান অবস্থাতেই।


নিচে মাঠে নেমে পুরো ক্লাসটা শেষ করলাম। শেষ হওয়ার সাথে সাথে ইসমাইল আমার কাছে এসে বলল, - স্যার বেঁচে থাকার জন্য যা করতে হয় তার সাথে স্কুলে পড়ার সত্যিই কোনো সম্পর্ক নেই। পুলিশকে কেন এসেছে আমি জানি। আর মনে রাখবেন ইসমাইলকে ধরা এত সহজ নয়। 


এই বলে ও ক্লাসে চলে গেল। আমি প্রমাদ গুণলাম। মুখে যাই-ই বলি না কেন্, ভয় তো করছিল। কাঁটার মত শক্ত হয়ে আছি,  ছুটি হলেই কি না কি হবে, কে জানে! 

চারিদিকে পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ! সময় পেয়ে নিজেদের সাজিয়ে আরও নিশ্ছিদ্র করে তোলা হল, পুলিশের ব্যুহ।

ছুটি হতে আর পনেরো মিনিট বাকি। 

হঠাৎ পাশেই গোরাবাবুর বাজারে একটা বোম পড়ার শব্দ হলো। পঞ্চানন তলা রোড বন্ধ হয়ে গেল।  যে সমস্ত পুলিশ আমাদের স্কুলটাকে ঘিরে ছিল তাদের বেশিরভাগ অংশই বাজারটাকে ঘিরে ফেলল। আর যখন পুলিশ এরকম বিভ্রান্ত হয়ে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না, আর ওসির অর্ডারের অপেক্ষায়, ততক্ষণে দেখলাম ইসমাইল কোথা থেকে দৌড়ে এসে এক লাফে আমাদের স্কুলের ঠিক পিছন দিকে প্রায় আট ফুট পাঁচিলটা টপকে নিমেষের মধ্যে দু-ফুট চওড়া নর্দমা-গলির মধ্যে দিয়ে হাওয়া হয়ে গেল। কর্পূর যেমন উবে যায়্, অনেকটা সে রকম্। দুজন পুলিশদেখতে পেয়ে বন্দুক তাক করতে করতে সে উধাও..

ওসি এসে বললেন 

- হলো তো? আপনাদের জন্যই পুরো কাজটা করতে পারলাম না। এবার  চলুন থানায় চলুন।  আপনাদের জন্য পালানোর সুযোগ পেল আজ্।  আপনারা পালানোটাকে প্রশ্রয় দিলেন।  

দেখলাম লোকাল রাজনৈতিক  যিনি নেতা ছিলেন তিনি বোম পড়ার সঙ্গে সঙ্গে খবর পেয়ে স্কুলে চলে এসছেন।

স্কুলে ঢুকেই বললেন 

- আরে সাহেব কি ব্যাপার, আপনি এখানে?

ওসি তখন বললেন 

- ওফ আপনি খবর পেয়ে গ্যাচেন্?  আরে এই ছোটখাটো ব্যাপারে আপনি আবার কেন নাক গলাতে এলেন্?


- আমারই তো  নাক্...কোথায় গলাবো....কখন গলাবো, সেটা আমার ব্যাপার।  আপনাকে বারবার বলেছিলাম যে আমার ওয়ার্ডে ঢুকে কিন্তু ভ্যানতারা কষবেন না... এখানে  ঢুকলেন তো বটেই, সঙ্গে আবার স্কুলে ফোর্স নিয়ে... আপনি জানেন আমি ডিএমকে রিপোর্ট করলে আপনার কি অবস্থা হতে পারে? আপনি ক্রিমিনাল কে ধরার আর জায়গা পেলেন না?  স্কুল থেকে?  লজ্জা করেনা আপনাদের...?

- এর থেকে সহজ রাস্তা ছিল না তো স্যার, আপনি জানেন না ইসমাইলকে ধরা...

- আরে রাখুন এত মাস ধরে একজ্ন ক্রিমিনালের এগেন্স্টে পকেটে ওয়ারেন্ট নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন... অ্যাদ্দিন ধরে  অন্য কোথাও থেকে তাকে  ধরা যাচ্ছিল না? মরতে এখানেই?  কি করেন সারাদিন? 

- আরি স্যারেরা যদি বাগড়া না দিতেন ইসমাইলকে এমনিই টপাস করে ধরে ফেলতাম!  কিছু মনে করবেন না স্যার্... ঐ স্কুলের স্যারেরা কিন্তু ক্রিমিনাল কে প্রশ্রয় দিচ্ছেন...

- আপনি বুঝে কথা বলুন ওসি সাহেব।  এই স্কুলের হেডমাস্টারমশাই এখানকার সম্মানীয় ব্যক্তি!  আর এই যিনি নতুন জয়েন করেছেন, তাঁর দুর্ভাগ্য যে ওনার মত মানুষ এইরকম একটা স্কুলে পোস্টিং পেলেন! কাকে কোন সম্মানটুকু কোথায় কখন দিতে হয় সে শিক্ষা আপনার না থাকলেও, আমার আছে। বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না। এখান থেকে আসুন।









- বেশ আপনি যখন বলছেন, আমরা এখন এলাম। দেখি কি করা যায়।  ইসমাইলকে আমরা ধরবোই স্যার্! আপনি কিচ্ছু করতে পারবেন না।

- অন্যায় করলে তো ধরাই আপনাদের কাজ...কিন্তু স্কুল থেকে নয়। আর ধরব ধরব করে অত ঢাক পেটানোর কি আছে।

- ওকে একবার বাগে পাই, ছাল ছাড়িয়ে নেব।  

- জানি...এটাই আশা করেছিলাম, আপনার মত লোকেরাই মানুষকে আসল ক্রিমিন্যালে পরিণত করে... আপনার বিচার ব্যবস্থা ইসমাইলকে আরো বড় একটা ক্রিমিনালে পরিণত করবে, এটাই ভবিতব্য্।  বরং আমাদের হাতে ছেড়ে দিলেই ও আর জীবনে কোন অপরাধ করত না। তবে হ্যাঁ,  দেশের আইন আছে সেই আইন অনুযায়ী যদি আমাদের সেখানে একটু স্থান দিতেন ও সুবিচার করার, তাহলে আমরা নিজেরাই ওর সাথে কথা বলে ওকে শান্ত করতে পারতাম বলে বিশ্বাস। 

******

হ্যাঁ... এত বড় ঘটনাটা মাথার মধ্যে ফ্ল্যাশব্যাকে পুরোটা খেলে গেল! ইসমাইল সামনে দাঁড়িয়ে। মাঝে দশ বছর পেরিয়ে গ্যাছে। 

- কি রে কিছু বলবি?  

- অ্যাঁ? হ্যাঁ স্যার, যা বলছিলাম.... আমার সাথে ওরকম যেখানে সেখানে দেখা হলে কথা বলবেন না। আপনাকে আমার মোবাইল নাম্বার দিয়ে রাখছি। যদি কোনদিন কোথাও কিছু সমস্যা হয়, যদি কোনদিন আপনার কোন সমস্যা হয়, শুধু একবার ইসমাইলকে জানাবেন। তারপর বাকিটা আমি আমার মত করে বুঝে নেব। 

- দ্যাখ্, ইসমাইল আমি হচ্ছি সাধারণ শিক্ষক। কি আর সম্স্যায় পড়্ব বল তো? বরং স্কুল্-টা বড়  সমস্য্যয় আছে। হু হু করে ছাত্র কমে যাচ্ছে...হাতের ফাঁক দিয়ে জল গলে চলে যাওয়ার মত্। 

- এখন কত জন ছাত্র?

- বিরাশি জন

- এক্শ বিরাশি জন্?

- না রে, শুধু বিরাশি…

- কি বলছেন স্যার্!! 

- হ্যাঁ রে, তোদের পাড়া থেকে কিছু ছেলে এনে যদি আমার স্কুলে ভর্তি করতিস, তাহলে বড় ভালো হতো! জানিস তো? যে স্কুলটাকে বুকে করে আগলে এতখানি পথ চলে এলাম যে স্কুলটাই আজ তামাদি হতে চলেছে। উঠে যাবে হয়তো। কেউ তো আর পড়তে আসে না।  সরকার এটাকে গোডাউন করে দিয়েছে…

- লে...হ্যাঁ স্যার... শুনেছি বটে... কিন্তু কি করি বলুন তো?  এখন সবাই ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতে চায়।  আমাদের সরকারি স্কুলে আর কেউ আসতে চায় না। 

- ঠিকই বলেছিস...তুই-ই বা কি করবি? এটা শহরের চাহিদা...এই করতে করতে শিক্ষার মান যে কোথায় নেমে গিয়েছে তার বলার কথা নয়। তার ওপর আবার এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র্ররা বলতে লজ্জা পায় যে তারা এই স্কুলের ছাত্র ছিল্। যখন অন্য সব স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, সেখান থেকে আমাদের স্কুল জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল্, কিন্তু এখন আর তারা সে সব স্বীকার করে না রে! 

- কি বলছেন স্যার্, এসব...হ্যাঁ রে সেদিন তোদের বন্ধু সন্টুর সাথে দেখা হয়েছিল। 

- সন্টু? 

- আরে হ্যাঁরে সন্টু.... মনে নেই রোগা মত, চোখ দুটো ভাসা ভাসা, ঝাঁকড়া চুল্.. 

- সন্টু...সন্টু...ও ও.... হ্যাঁ হ্যাঁ স্যার মনে পড়েছে...রামানন্দ স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল্...কেলাস ইটে এসে ভর্তি হল...এখানে…

- ঠিক 

- এখন কি করে জানেন? 

- হ্যাঁ জানি।  চুটিয়ে প্রাইভেট টিউশন পড়ায়। 

- সনটু পেরাইভেট পড়ায়্, বলেন কি স্যার? আমরা ওকে রামফেলু বলে রাগাতাম্...হা হা হা হা...সে এখন পেরাইভেট পড়াচ্ছে। 

- আর সব বড় বড় স্কুলের ছেলেমেয়েরা ওর ছাত্র-ছাত্রী, বুঝ্লি।  ওকে বলছিলাম যে তুই বলনা বাবা-মায়েদের যে এদের বাড়ির ছেলে মেয়েগুলোকে আমাদের স্কুলে পাঠাতে। তাতে ও কি বলল জানিস?

 - কি বলল স্যার্?

- বলল্, ব্যাপারটা হচ্ছে আমি কোনদিন বলি না যে আমি ওই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। হায়ার সেকেন্ডারিটা তো খুব বড় স্কুলে পড়েছি, তো সকলকে সেই স্কুলের নামটাই বলি, যে আমি ওই স্কুলের ছাত্র। আমি পারব ন স্যার্।  বুঝতেই পারছেন স্যার, পেটের তাগিদ্। আমার অনেক কষ্টে তৈরী করা বাজারটাই চলে যাবে। আমি যদি এই স্কুলের ছাত্র বলে নিজের পরিচয় দিই, তাহলে কাল থেকে আমি আর আমার ব্যবসাটা টিকিয়ে রাখতে পারবো না। সবই তো বোঝেন, স্যার, কি বলি বলুন তো আপনাকে! 

হেসে বললাম, হ্যাঁ রে, বুঝি!

- এটাই শিক্ষিত লোক্দের থিকে আমাদের পার্থক্য স্যার! বুক ঠুকে বলে যাব্, আমি এ ই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। লাইফে যা কিছু ভাল করেছি, সব আমাকে এই স্কুল শিখিয়েছে।... তবু এত করে বলছেন যখন স্যার দেখব কিন্তু কোন গ্যারান্টি দিতে পারছি না। 

হাসলাম 

- তবে একটা কথা বলে যাচ্ছি যে কোন প্রবলেম হলে, এই স্কুলের বাইরে,আপনার কোন পার্সোনাল অফিসিয়াল যদি প্রবলেম হয় শুধু আমাকে একবার খবর দেবেন। বাকি আমি বুঝে লিব। 

- লিব বলে কিছু হয় না, নেব্...আর বললাম না, তোদের সবাইকে ভালো শিক্ষাই দিয়েছি। কিন্তু নেওয়ায় অনেক ফারাক থেকে গ্যাছে...সমাজে যে ক্রিমিন্যাল সে বুক ঠুকে নিজের অস্তিত্বের সত্যিটা বলে, আর যে শিক্ষিত, সে নিজের অস্তিত্বের সত্যিকে স্বীকার করতে লজ্জা পায়। আমার জন্য যখন ভালো করতে চাইছিস, তখন খারাপ কিছু শেখায় নি। কি বলিস ইসমাইল? 

মাথা চুলকে লজ্জা পেয়ে, ইসমাইল বললো কি যে বলেন স্যার...যে সনমান আপনি সেদিন প্যারেডের লাইনে আপনি আমায় দিয়েছিলেন্, আমি ভুলি নি। পরে সব শুনেছি স্যার্…

- তোকে ও সব কে বলল?

- ওই শুয়ারের্…

- আ:...ইসমাইল্!!!!

- সরি স্যার্...ওই ওসি টা...আমাকে পরে ধরে চার দিন কাসট্ডি তে রেখে মাল টেনে আমার ওপর যখন টরচার করছিল্, এক্টু পিন মারতেই সব বলে দিল স্যার্, ভড় ভড় করে...আপনার আর হেড্স্যারের নামে খারাপ কথা বলেছিল, সেদিন ওর মুখে থুকে দিয়েছিলাম্। তারপর জেল হল্। দুবছরের্।  বেরিয়ে তক্কে তক্কে ছিলাম্...এক্দিন রাতে সেকেণ্ড বিরিজের নিচে একা পেলাম্...পুরো পৈতে কাট্…

- পৈতে কাট, মানে?

- মানে আর আপনাকে বুঝ্তে হবে না…

- না বল্…

- মানে স্যার সামনের দিকে কাঁধ থেকে কোমর পর্য্ন্ত কোনাকুনি ছুরি দিয়ে চিরে আবার পিঠের দিকে কোমর থেকে কাঁধ ওব্দি...দাগ টেনে মিলিয়ে দেওয়া। শুনেছি পোস্ট মট্নে ডোম কে সে রকম কোনো কাজ-ই করতে হয় নি।

আমি পাথরের মত ঠাণ্ডা...আবছা শুনতে পেলাম, ইসমাইল বলছে, 

- আচ্ছা স্যার চলি তাহলে... আমার সাথে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে কিন্তু আপনার প্রবলেম হবে আগেই বলেছি। 

সব ঝাপসা। টলে পড়ে যাচ্ছিলাম। একজন অচেনা সাইকেল আরোহী পাশ দিয়ে যাচ্ছিল্, ধরে ফেলল। 

- দাদা, ভর সোন্দেবেলাতে ই টাল খেয়ে যাচ্চেন তো...বাকি রাত কাটবে তো…


সম্বিত ফিরে আসতে বাড়ি ফিরলাম। হাতে-মুখে জল দিয়ে পোশাক বদ্লানোর সময়ে আয়্নার সামনে নিজের গায়ের পৈতে টা দেখে গা কেঁপে উঠল।

কিছুদিন খোলাই থাক,বরং...গা থেকে খুলে রাখলাম।


Friday, 2 February 2024

ম্যাস্টরমশাই : পর্ব ৫


-আপনি কানে দুল পরে ক্লাসে যান?

-হ্যাঁ, কেন বলুন তো? 

-এটা ঠিক স্কুল শিক্ষকদের মানায় না …আপনাকে স্কুলে ছেলেরা মানে?

-একদিন ক্লাসে এসে স্বচক্ষে দেখে যান না! 

- না না এসব একেবারে অনুচিত। এসব কিন্তু শিক্ষকদের আদপেই মানায় না। 

-যদি শিক্ষা বিভাগের বিভিন্ন আধিকারিকরা স্বয়ং হাতে পাথর দেওয়া আংটি পরে থাকতে পারেন, গলায় সোনার চেন-ও, তাহলে আমার শিক্ষক হয়ে কানে দুল পরা কি ভাবে ভুল, ঠিক বুঝতে পারলাম না।

-মানে? 

-মানে তো খুব পরিষ্কার। 

-আপনাদের মত শিক্ষকদের জন্য আজ শিক্ষকদের এত বদনাম। শিক্ষকতা স্টাইল –মারার বিষয় নয়। ঐতিহ্য নষ্ট করছেন আপনি। ওই জন্যই আপনাদের বিদ্যালয়ে ছাত্র হয় না…এসব বখে যাওয়া মাস্টার দেখলে কোন গার্জিয়েন আর ছেলে-কে পাঠাবেন!


-আসলে কি জানেন, আপনারা সমাজকে ভাবতে বাধ্য করেছেন, যে শিক্ষক মানেই গরীব…ছেঁড়া ধুতি, ছেঁড়া ছাতা…জাগতিক ভোগ বিলাস থেকে অনেক দূরের মানুষ…প্রায় সন্ন্যাসী, বিয়ে করে  সন্তান থাকা সত্ত্বেও, সারা দেশের মেধাবী ও অমেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের দেশে-বিদেশে বিভিন্ন স্তরে প্রতিষ্ঠিত করা সত্ত্বেও তাঁরা চিরগরীব থাকবেন। সঙ্গে ভুলেছেন, ভারতীয় পুরুষদের কানের দুল বা কুণ্ডল পরার ঐতিহ্যকে। আপনি জানেন ‘কুণ্ডল’ কিসের প্রতীক? প্রজ্ঞা, বিদ্যা, শৌর্য, জ্ঞান ও দৃঢ়তার। 


-ও সব জ্ঞানের কথা রাখুন। কানে দুল পরে গ্যাঁজাড়ে আর হোমোসেক্সুয়াল-রা। ব্যাণ্ড মিউজিক করতে গেলে,  বা র‍্যাপ-ট্যাপ গাইতে গেলে লোকে ওসব পরে। তা বলে শিক্ষক!! 


-পাশ্চাত্যে মজেছেন। সে এক কানে দুল এবং তা-ও সাংকেতিক। সে সংকেতের যা ভাষা তা আপনার বোধগম্য হবে না। আপনি শুধু পাশ্চাত্যের পদলেহন-কারী দাসানুদাস হয়েই থাকুন। যা সবাই দেখায়, তাতেই মজে থাকুন। জানেন তারা কেন কানে দুল পরেন? কারণ ভোগবিলাসের চূড়ান্ত সীমায় সম্পৃক্ত হলে তাঁদের প্রাচ্য, বিশেষতঃ ভারতীয় সংস্কৃতি, টানে। পুরাণ-বেদ-উপনিষদ, সেই প্রাচীন, কিন্তু অতি-আধুনিক দর্শন দ্বারা তাঁরা উদবুদ্ধ হন। সেখানে কুণ্ডলধারণ মোক্ষলাভের বা salvation-এর চিহ্ন বিশেষ। সুতরাং শিক্ষক হয়ে যদি কানে দুল পরে থাকি, তা প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের ধারক ও বাহক হিসেবে  এবং এর সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চাই স্টাইল স্টেটমেন্ট-কে। আর শিক্ষকতার জীবন ও আদর্শ বেছে নিয়েছি মানে আমাকে আজীবন গরীব থাকতে হবে এরকম ধারণা একেবারেই ভুল। বরং আমাদের ছাত্ররা আসলটা জানুক, শিখুক। স্মার্ট হোক। আমি সেই আধুনিক শিক্ষক রূপে লড়াই করতে প্রস্তুত যেখানে শুধু বিদ্যা-বুদ্ধিতে নয়, স্মার্টনেসেও আমাকে একজন ছাত্র সত্যিকারের মূল্যবোধ নিয়ে আইডিওলাইজ করবে। শিক্ষকরা অবদমিত জাতীয় স্টার, যাদের প্রকৃত মূল্য এখনো দেশের মানুষ ঠিক বুঝে উঠতে পারেন নি। ‘পথের পাঁচালী’-র পাঠশালায় তুলসী চক্রবর্তীতে আটকে আছেন। এদিকে সব বদলে গিয়ে যুগ চলে এসেছে, ‘তারে জমিন পর’-এর নিকুম্ভ স্যার-দের। বর্তমান সমাজে নিকুম্ভ-স্যারদের খুব দরকার, কি বাবা-মা-অভিভাবক, কি ছাত্রছাত্রী, সবার জন্য, যিনি আধুনিকতার মোড়কে পরিবেশন করবেন ভারতীয় ভাবধারা, সব দিক অক্ষুন্ন রেখে। 


- ওসব সিনেমায় হয়। শিক্ষকদের অনেক স্যাকরিফাইস করতে হয়, তবে তিনি শিক্ষক হয়ে ওঠেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা ভাবুন?


- …নিশ্চয়ই। উনি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, নারীশিক্ষার ওপর জোর দিয়েছিলেন, কলকাতা থেকে যার শুরু, সমাজকে আলো দেখানোর উদ্দেশ্যে। আর সেই কলকাতা থেকে আজ শুরু হয়েছে যাত্রা, সরকারী বিদ্যালয়গুলোকে ধীরে ধীরে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়ার। আমাদের এই বিদ্যালয়ে, যেখানে আমি শিক্ষকতা করি, সেখানে,  কি কি সমস্যা, আমাদের উন্নতির জন্য কি কি প্রয়োজন, কি ভাবে স্ট্রাটেজী বদলে কিছু ছাত্র আনা যায়, তা নিয়ে সদর অফিস থেকে কোনো একজন প্রতিনিধি আমাদের বিদ্যালয়ে গত বাইশ বছরে একবারও আসেন নি। শেষ একটা প্রায়-না-পড়তে-পারার-মত অর্ডার পাওয়া গিয়েছিল ডি-আই মহাশয়ের তরফ থেকে, যে এই ইস্কুলটাই তুলে দেওয়া হোক। 


এক কাজ করুন…আপনি একদিন আমাদের বিদ্যালয়ে আসুন, আমন্ত্রণ রইল। বিদ্যাসাগর মশাই-এর কাছ থেকে একজন শিক্ষক হওয়ার জন্য যা শিখেছি তা আপনাকে প্রদর্শনের অপেক্ষায় রইলাম। 


- এর সঙ্গে কানের দুলের কি সম্পর্ক? উনি কানে দুল পরতেন নাকি!


- না উনি নিজে পরতেন না। অন্য কেউ পরত বলে কোনোদিন বাগড়া দিয়েছেন বা তাঁদের অশিক্ষিত বখে যাওয়া বলে দেগে দিয়েছেন বলেও শুনি নি। তবে দু’টো সম্পর্ক আছে। ওই যে আগেই বললাম, পুরাণ ও বেদ থেকে জানা যায়, তৎকালীন সময় থেকে ‘কুণ্ডল’ ছিল পুরুষের অন্যতম ভূষণ। কর্ণের কবচ-কুণ্ডলের কথা নিশ্চয়ই শুনেছেন। আর একটা কথা আমি আজকালকার যুগের শিক্ষক হয়ে বলতে চাই নি, কারণ আমি নিজে জাতি ও বর্ণভেদে বিশ্বাস করি না।  সব ভেদাভেদ লোপ পাক বললেই তো হল না, এস-সি/এস-টি/ওবিসি কোটা উলটে বুঝিয়ে দেয় সর্বস্তরে কোয়ালিটি কম্প্রোমাইজ করে, যে ভেদাভেদ আছে, থাকবে। আমি শিক্ষক হিসেবে এ সব গ্লানি মুছে যাক, চাইলেই তো হবে না! কিন্তু সে দিক থেকে দেখতে গেলে কি জানেন, আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাসে ও সমাজের কাছে আমি সেই একজন একজন হিন্দু ব্রাহ্মণ। আর উপনয়ণের সবথেকে বড় রীতি হল কান-বিঁধানো ও কুণ্ডল ধারণ, যা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী ব্যতীত সারা ভারত তথা পৃথিবীব্যাপী প্রচলিত। আমি শিক্ষক ও ধার্মিক বটে। সঙ্গে এও বলে রাখি, পরে কানের দুল নিয়ে আরো কিছু বলে আঘাত দিতে এলে আগে একটু পড়াশোনা করে আসবেন, নাহলে ফেঁসে যেতে পারেন। কারণ আপনি আমার ধর্মে আঘাত করছেন বলে আমি প্রতিবাদ জানাতেই পারি। ‘কর্ণভেদ সংস্কার’ ভারতীয় হিন্দুধর্মের  বিভিন্ন জাতির মধ্যে একটি বিরাট প্রচলিত উৎসব বিশেষ। ব্রাহ্মণ যখন উপনয়ণের মাধ্যমে দ্বিজ ধারণ করেন, তখন এই সংস্কারের রূপায়ণ বাধ্যতামূলক, জানবেন। 


দ্বিতীয়তঃ, যদি ফ্যাশন বা স্টাইল স্টেটমেন্ট বলেন, তাহলে বলব, কোনটা শালীন আর কোনটা অশালীন তা বিচার করার দায়িত্ব কার? এই যে অনেক শিক্ষক দিব্বি বুকের দুটো বোতাম খুলে ঘুরে বেড়ান, তখন কিছু হয় না। আমার নিজের চোখে দেখা যে প্রবীন শিক্ষক ছাত্রকে শাস্তিস্বরূপ  তাঁর খালি গায়ে মাসাজ করাচ্ছেন। ভাবুন, একজন শিক্ষিকা কি এটা পারবেন করতে, কোনোদিন? হাসবেন না। এখনো কোনো শিক্ষিকা লো-কাট আপার উইয়ার পরলে, বা ধোপদুরস্ত সেজে থাকলে (বুকের দুটো বোতাম খুলে ঘোরার মত কুরুচি কোনো শিক্ষিকার নেই) এক্ষুনি সবার মাথা ঘুরে যাবে, এমনকি অশালীন হওয়ার দায়ে কোর্টের চক্কর কাটতেও হতে পারে। দক্ষিন চব্বিশ পরগনার বাখরাহাট গার্লস হাই স্কুলের শিক্ষিকা সালোয়ার কামিজ পরে বিদ্যালয়ে যেতেন। সালোয়ার কামিজ নাকি অশালীন, তাই তুলকালাম হল। আইনি মারপ্যাঁচে গেল, কোর্ট অব্দি। উনিও হাল ছাড়েন নি। লড়ে জিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ঘুচিয়ে দিয়েছেন, আপনাদের মত কূপমণ্ডুকদের মরাল পোলিসিং। এখন হাজারে হাজারে শিক্ষিকা ওই পোশাকে স্কুলে যান। সময় বদলাচ্ছে ময়াই! তাকিয়ে দেখুন।


ধরা যাক ‘তারে জমিন পর’ এর নিকুম্ভ স্যার (আমির খান) ওরকম হেয়ার স্টাইল এর সঙ্গে যদি কানে দুল-ও পরতেন, তখন আম-জনতা দিব্যি মেনে নিত। মনে হত, এই তো…বাহ! যদি সরকারী বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একটু এরকম ঝাঁ-চকচকে হতেন! আধুনিক শিক্ষকের ঠিক এরকমই হওয়া উচিত। আপনিও সেই হাওয়ার ব্যতিক্রম নন। কিন্তু উলটে সরকারী স্কুল গুলোকে অক্সিজেন দেওয়ার বদলে ভুল ফোকাস নিয়ে এভাবেই বরং শিক্ষকরা খারাপ ও অযোগ্য বলে নানা ভাবে প্রচার করে তাঁদের অপমান করতে থাকুন, যাতে জনমানসে দাগ আরও গভীর হয় এবং শহরাঞ্চলে ছেলেমেয়েরা প্রাঈভেট স্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়, যেখানে এটা পরীক্ষিত সত্য, বিদ্যা-বুদ্ধিতে সরকারী শিক্ষক-শিক্ষিকারা অনেক বেশি এগিয়ে। শহরে না হয় প্রাইভেট স্কুলের রমরমা। ৭৫-৮০ শতাংশ সাধারণ মানুষ কিন্তু সরকারী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ওপর নির্ভরশীল। তাহলে কি বেশিরভাগ শহরের ছেলেমেয়েরাই মানুষ হচ্ছে, আর বিদেশে যাচ্ছে? ঠিক করে তথ্য খুঁজুন, দেখবেন ধারণা বদলে যাবে। শহরের ছেলেমেয়েদের সুযোগ অনেক বেশি, জনঘনত্ব অনেক বেশি। আনুপাতিক হিসেবে পাওয়া সুযোগের উচিত ব্যবহার তারা করতে পারছে না। সেই তুলনায় বৃহত্তর গ্রামাঞ্চলে অত্যন্ত কম সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও শতকরা ও আনুপাতিক হারে অনেক বেশি সংখ্যক ছেলেমেয়ে দিব্যি সাফল্যের সঙ্গে মানুষ হচ্ছে। 


যে শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্র-ছাত্রীদের শাসন করা যাবে না, কাউকে স্নেহ বশত: মারা -ধরা-বকা যাবে না, সেখানে প্রত্যেক শিক্ষক-শিক্ষিকা-কে এমনভাবে ব্যক্তিত্ব তৈরী করতে হবে, যে তাঁর চেহারা, মানসিক গঠন ও কথাবার্তাতেই সবাই যেন বুঝে যান যে তিনিও শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি কমপ্লিট প্যাকেজ। তাঁকে পেরিয়ে কিছু করাটা বেশ মুশকিলের। পার্সোনালিটী দিয়ে জিতে নিতে হবে, সবটা। সেটা কিভাবে নির্ধারিত হবে তা প্রত্যেকের ক্ষেত্রে আলাদা হতেই পারে, এবং তা একান্ত ব্যক্তিগত, কিন্তু কুরুচিপূর্ণ নয়।  


তাই সবাইকে অনুরোধ,  শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে নো-পাঙ্গা!


তাঁরা অন্ততঃ আপনার থেকে অনেক বেশি সমাজ সচেতন। আর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পোশাক নিয়ন্ত্রণ আপনার দায়িত্বের মধ্যে আদৌ পড়ে কি? যা যা পড়ে, তা-ই আগে ঠিক করে করে উঠুন, দেখুন, শহরের ধুঁকতে থাকা সরকারী স্কুল গুলোকে আসলে কিভাবে চাঙ্গা করা যায়। দাবী জানান সবাই মিলে, শহরের সমস্ত বাংলা মাধ্যম স্কুলে  ইংরেজি মাধ্যম বাধ্যতামূলকভাবে চালু করা হোক। সারা বছরে মাথা পিছু ৫০০ টাকার বেশি লাগার কথা নয়। বই-খাতা-পোশাক (জুতো সমেত) সব সমগ্র শিক্ষা মিশন দেয়। মিড-ডে-মিল আছে। নবম শ্রেণি-তে উঠলে সাইকেল। কন্যাশ্রী প্রকল্প। দেবে কোনো প্রাইভেট স্কুল? আর দিলেও ঘুরিয়ে তার বিশগুণ টাকা আপনার আমার কাছ থেকে নিয়ে নেবে।


আপনি পুরুষ হিসেবে এই প্রোজেক্টে সফল হলে, আমি বখে যাওয়া আধুনিক শিক্ষকদের তরফ থেকে মিনে করা সোনার কানের দুল আপনাকে উপহার দেব, আপনার পৌরুষের সাফল্য-স্বরূপ, সঙ্গে একটা ট্যাটু, ফ্রি। 


বিঃদ্রঃ 

আমার এক বন্ধু বিদ্যালয় প্রধান। ইচ্ছে থাকলেও কান বিঁধোতে পারছে না, ইমেজ ধরে রাখার জন্য। আমাদের ইমেজ লেন্সের রিয়াল ইমেজ। ফোকাল লেন্থের মধ্যেই থাকি কি না।আয়নায় যে ইমেজ তৈরী হয় তা ভার্চুয়াল। টিচার্স রক, ম্যান!!! সো জাস্ট চিলের পিঠে চেপে চিল! ততঃক্ষণ সবাই ভাবুক, Shelley আর Keats-এর  রোমান্টিক রোমহর্ষক রোমন্থনে চিল-দের (skylarks) মধ্যে কি অপার উড়াণ অনন্য বিভিন্নতায় লুক্কায়িত ছিল!!!