গত চার পাঁচ দিন হল যখন তখন বিদ্যুৎ থাকছে না। ঘেমে জল হয়ে যাচ্ছি ৷ একফোঁটা হাওয়া থাকা তো দূর, আমার বিশ্বাস সূর্য কোনো কারণে পৃথিবীর দিকে খানিকটা হলেও এগিয়ে এসেছো আমার স্ত্রী গিয়েছেন বেড়াতে ৷ আমার স্কুল ছুটি ৷ ছেলের কলেজও৷ দুজনে তাই বেরিয়ে পড়ার প্ল্যান করলাম। নন্দনে 'লাভ ম্যারেজ' নামক একটি বাংলা কমেডি চলছে ৷ পঞ্চাশ টাকায় শীতাতপ- এ (হ্যাঁ ঠিকই পড়েছেন: 'শী-তা-ত-প' : শীত + আতপ, "আতপ" মানে "উত্তাপ"; কথাটা 'শীততাপ' মানে , 'শীত+তাপ' নয় , আর সেটা এক্কেবারে ভুল) বসে আমেজে এর থেকে এই গরমে আর কি এন্টারটেইনমেন্ট হতে পারে!
আমাদের ছোটবেলা থেকে বড় হয়ে ওঠার গল্পটা আমাদের ছেলে-মেয়েদের থেকে বেশ আলাদাই ৷ অনেক দিন পরে এমন একটা ছবি দেখে এলাম যা আমাদের ছোটবেলাকে অনেকখানি নাড়া দিয়ে গেল ৷ আগে বেশ কিছু বাংলা ছবি আমরা দেখেছি যেখানে আমাদের ছোটবেলা নিয়ে, আমাদের কৈশোর, আমাদের কলেজ লাইফ নিয়ে তৈরি ৷ সেগুলো আমাদেরকে বেশ ভাবায়, আমাদের অতীতকে নিয়ে ভাবার সুযোগ দেয়, সেই সময়ের বন্ধু যাঁরা ছিলেন এবং যাঁরা আজীবন বন্ধু থেকে গিয়েছেন , তাঁদের সকলের কাছে সেই সব কমেডি বেশ ছাপ রেখে যাবে ৷ সঙ্গে যোগ হল এইটি - নাম "লাভ ম্যারেজ" এবং সেখানে ছবির মূল অভিনেতা হিসেবে অঙ্কুশকে পেলাম আবার ৷ সে একজন অভিনেতা হিসেবে খুবই under rated বলে আমি মনে করি ৷ খুব জোরালো অভিনেতা, খুব সাবলীল, অসাধারণ টাইমিং এর জ্ঞান এবং আগে বিভিন্ন কম্বিনেশনে আমি যেখানে যেখানে অঙ্কুশকে বিভিন্ন কমেডিতে দেখেছি সেখানে অঙ্কুশ খুবই ভাল করেছে বলে আমার মনে হয়েছে| অভিনয়ের ধারা সেটা তার একেবারে নিজস্ব এবং সেটার সাথে অন্য কারোর কোনরকম ধারার মিল আছে বলে মনে হয় না। কাউকে নকল করার চেষ্টাও নেই । কমেডির ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা হল যে কোনো পুরনো লেজেন্ডারি অভিনেতাদের ছায়া থেকে বেরোনো বেশ কঠিন। কিছু করলেই মনে হয়, এটা ওনার মত হয়ে গেল, বিশেষত যেমন উৎপল দত্তের একটা ডায়লগ বলার স্টাইল আছে, রবি ঘোষ, জহর রায়, চিন্ময়,ভানু বন্দোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্তী - এঁদের সকলের একটা নিজস্বতা ছিল এবং আমি দেখেছি পরের প্রজন্মের কমেডিয়ানদের মধ্যে এনাদের কোন না কোন একজন-দুজন বা তিনজনের কম্বিনেশনে একটা ইনফ্লুয়েন্স কিন্তু কাজ করতেই থাকে। অদ্ভুতভাবে অঙ্কুশের অভিনয় কিন্তু সেখান থেকে একেবারেই মুক্ত।
অঙ্কুশের সম্পর্কে একটু বেশিই বলা হয়ে যাচ্ছে তার কারণ আমি অনেকদিন পরে একটা ভালো বাংলা কমেডি কালকে দেখে এলাম যেখানে আমি বুঝতেই পারলাম না যে সময়টা কিভাবে কেটে গেল। আর আমার সাথে ছিল আমার ছেলে...কমেডি-খোর্। সে-ও কিন্তু খুব উপভোগ করেছে। এই ছবিটি সকল বয়সে দর্শকের জন্য একসাথে বসে উপভোগ করার মত একটা ছবি। নি:সন্দেহে ছবিটি একটি অসাধারণ কমেডি এবং আমার ধারণা যদি সবাই এই ছবিটি গিয়ে দেখেন তাহলে বুঝতে পারবেন যে বাংলা সিনেমায় কমেডি হিসেবে এই ছবিটি কিন্তু মনে রাখার মত একটি জায়গা তৈরি করেই নেবে। আমরা যখনই কোন কমিক ছবি দেখতে বসি, সেই ঘুরে ফিরে, বসন্ত বিলাপ বা সাড়ে চুয়াত্তর। অধুনা কমেডিগুলোর মধ্যে কাছে হাতে গোনা কিছু চয়েসেস রয়েছে, আর নাম বলছি না। এই কমেডিটি সেই লেভেলের একটি কমেডি তৈরি হয়েছে যা অল-টাইম-ফেভারিত প্লে-লিস্টে ঢুকে যেতেই পারে। বর্তমান চিন্তা ভাবনা তার সাথে আমাদের পুরনো দিনের মানুষদেরকে উইথ ডিউ রেসপেক্ট সেখানে টেনে আনা এবং গল্পটাকে একটা সুগঠিত রূপ দিয়ে একটা কমেডিতে বাঁধা বেশ কঠিন কাজ ছিল।
সোহাগ সেন জাস্ট অনবদ্য্, 'বম্মা' চরিত্রে। রঞ্জিত মল্লিক আর অপরাজিতা আঢ্য দু-জনই পরিণত অভিনেতা। ওইন্দ্রিলা সেনও বেশ ভাল, তবে ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে থাকলে একমাত্র ওনারই। পদ্মনাভ দাশগুপ্তবাবুর প্রশংসা না করে পারছি না ।অসাধারণ স্ক্রিপ লিখেছেন। অসাধারণ পারশেপশান দিয়ে সেই স্ক্রিপ্টকে ঠিকঠাকভাবে এক্সিকিউট করার দায়িত্ব ছিল অভিনেতাদের এবং তাঁরা প্রত্যেকে অসামান্য পরিশ্রম করে সেই স্ক্রিপটিকে একটি সুন্দর রূপ দিয়েছেন যা আমাদের মনকে ছুঁয়ে গেছে, হৃদয়কে ছুঁয়ে গেছে এবং আমরা কোনরকম ভাবনা চিন্তা ছাড়াই প্রাণ্খুলে হেসেছি। সবথেকে বড় কথা এটা যে একটা গোটা কমেডি ছবির মধ্যে সেই অর্থে কোন ভাঁড়ামো নেই, কোন আতিশয্য নেই, যা দিয়ে মানুষকে সুড়সুড়ি দিয়ে হাসাতে হচ্ছে। এখানে পুরো জিনিসটা একটা স্বাভাবিক, স্বচ্ছন্দ ও নির্লিপ্ত রূপে গেছে। সামাজিক মেসেজ যেটা রয়েছে সেটা খুব লেটেন্ট বাট ভেরি ভেরি পাওয়ারফুল। আর সেই সামগ্রিক মালা গাঁথার মূল কারিগর প্রেমেন্দু বিকাশ চাকী মহাশয়কে জানাই শুভেচ্ছা, আবারও, (নন্দনের সামনে একবার জানিয়েছি)।
এবার সোজা চলে যাই ছোটবেলার কথায়। সিনেমাটির ভূয়সি প্রশংসা যে করলাম তার কারণ যে আমার একদম ছোটবেলার বন্ধু দেবনাথ চট্টোপাধ্যায়ের তাতে রয়েছে, তা কিন্তু নয়। ঘটনাচক্রে ও এটার একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেবনাথের সাথে অন্তরঙ্গতা এমন বয়স থেকে যে সেটা এখানে বলা খুব একটা সুচারু হবে না। আমার ছেলে আমাকে জিজ্ঞাসা করছিল যে "দেবনাথ কাকু তোমার ঠিক কি রকম বন্ধু, কবেকার বন্ধু?" তা আমি উত্তরে ওকে একটাই কথা বলেছিলাম, নন্দনে ঢোকার আগে যে, "দেবনাথ কাকু আমার সেই বয়সের, সেই সময়ের বন্ধু যখন আমরা বাংলা গালাগালগুলো মানে না বুঝেই একসঙ্গে শিখে একে অপরের ওপর প্রয়োগ করতে শুরু করেছি। দেবু যেভাবে আজকে খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই জায়গায় পৌঁছেছে তার মধ্যে রয়েছে প্রচন্ড রিস্ক নেওয়ার ক্ষমতা আর অভিনয় নামক বস্তুটির প্রতি অকুন্ঠ ভালবাসা ও ডেডিকেশন। এই ছ্বিতে যে চরিত্রে সে অভিনয় করেছে সেটা হচ্ছে সে মূল চরিত্র বকাই এর মামা ও গল্পের মূল সূত্রধার। সিনেমা শেষ হওয়ার পরে দেখি দেবু ছ্বিটির অন্যান্য কলাকুশলীদের নিয়ে নন্দনের বাইরে ফ্যান্-ফলোয়ার বাড়াতে দাঁড়িয়ে। চারিদিকে ভিড়। সৌভাগ্যক্রমে অনেক দিন বাদে দেখা।
ডাক দিলাম: - নানু (দেবনাথের ডাক নাম্) !!!!!!!
একডাকে কান এঁটোকরা হাসি নিয়ে এগিয়ে এসে নানু বলল্:
- আরে বলু (আমার ডাকনাম্) !!!
অত ব্যস্ততার মধ্যে, অত ফ্যান ফলোয়ার্সদের মধ্যে আমাকে দেখার সাথে সাথে ও যেভাবে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল, আমি আবার আমার পুরনো শৈশবে ফেরত গেলাম। বেলুড়ের বাড়ির সুখস্মৃতি বলতে আমাদের একসাথে নর্দমার পাঁক থেকে বল তুলে খেলা আর সেই বল মেরে হারিয়ে দিলে, তা নিয়ে জামা ছেঁড়াছিঁড়ির পর্যায়ে মারপিঠ্! পরদিন সকাল হলে আবার ভাব হয়ে যেত! 'সরি' বলারও দরকার হয় নি, এখনো!
অসাধারণ কাজ হয়েছে, নানু! চালিয়ে যা তুই। তোর কাজ আরো ব্যাপ্ত হোক আর আমরা সবাই সেই আনন্দ ভাগ করে চেটেপুটে খাই।


.jpeg)

No comments:
Post a Comment