Saturday, 22 April 2023

Love Marriage 2023

 


গত চার পাঁচ দিন হল যখন তখন বিদ্যুৎ থাকছে না। ঘেমে জল হয়ে যাচ্ছি ৷ একফোঁটা হাওয়া থাকা তো দূর, আমার বিশ্বাস সূর্য কোনো কারণে পৃথিবীর দিকে খানিকটা হলেও এগিয়ে এসেছো আমার স্ত্রী গিয়েছেন বেড়াতে ৷ আমার স্কুল ছুটি ৷ ছেলের কলেজও৷ দুজনে তাই বেরিয়ে পড়ার প্ল্যান করলাম। নন্দনে 'লাভ ম্যারেজ' নামক একটি বাংলা কমেডি চলছে ৷ পঞ্চাশ টাকায় শীতাতপ- এ (হ্যাঁ ঠিকই পড়েছেন: 'শী-তা-ত-প' : শীত + আতপ, "আতপ" মানে "উত্তাপ";  কথাটা 'শীততাপ' মানে , 'শীত+তাপ' নয় , আর সেটা এক্কেবারে ভুল) বসে আমেজে এর থেকে এই গরমে আর কি এন্টারটেইনমেন্ট হতে পারে! 

আমাদের ছোটবেলা থেকে বড় হয়ে ওঠার গল্পটা আমাদের ছেলে-মেয়েদের থেকে বেশ আলাদাই ৷ অনেক দিন পরে এমন একটা ছবি  দেখে এলাম যা আমাদের ছোটবেলাকে অনেকখানি নাড়া দিয়ে গেল ৷ আগে বেশ কিছু বাংলা ছবি আমরা দেখেছি যেখানে আমাদের ছোটবেলা নিয়ে, আমাদের কৈশোর, আমাদের কলেজ লাইফ নিয়ে তৈরি ৷ সেগুলো আমাদেরকে বেশ ভাবায়, আমাদের অতীতকে নিয়ে ভাবার সুযোগ দেয়, সেই সময়ের বন্ধু যাঁরা ছিলেন এবং যাঁরা আজীবন বন্ধু থেকে গিয়েছেন , তাঁদের সকলের কাছে সেই সব কমেডি বেশ ছাপ রেখে যাবে ৷ সঙ্গে যোগ হল এইটি - নাম "লাভ ম্যারেজ" এবং সেখানে ছবির মূল অভিনেতা হিসেবে অঙ্কুশকে পেলাম আবার ৷ সে একজন অভিনেতা হিসেবে খুবই under rated বলে আমি মনে করি ৷ খুব জোরালো অভিনেতা, খুব সাবলীল, অসাধারণ টাইমিং এর জ্ঞান এবং আগে বিভিন্ন কম্বিনেশনে আমি যেখানে যেখানে অঙ্কুশকে বিভিন্ন কমেডিতে দেখেছি সেখানে অঙ্কুশ খুবই ভাল করেছে বলে আমার মনে হয়েছে|   অভিনয়ের ধারা সেটা তার একেবারে নিজস্ব এবং সেটার সাথে অন্য কারোর কোনরকম ধারার মিল আছে বলে মনে হয় না। কাউকে  নকল করার চেষ্টাও নেই ।  কমেডির ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা হল যে কোনো পুরনো লেজেন্ডারি অভিনেতাদের ছায়া থেকে বেরোনো বেশ কঠিন।  কিছু করলেই মনে হয়,  এটা ওনার মত হয়ে গেল, বিশেষত যেমন উৎপল দত্তের একটা ডায়লগ বলার স্টাইল আছে, রবি ঘোষ, জহর রায়, চিন্ময়,ভানু বন্দোপাধ্যায়, তুলসী চক্রবর্তী - এঁদের সকলের একটা নিজস্বতা ছিল এবং আমি দেখেছি পরের প্রজন্মের কমেডিয়ানদের মধ্যে এনাদের কোন না কোন একজন-দুজন বা তিনজনের কম্বিনেশনে একটা ইনফ্লুয়েন্স কিন্তু কাজ করতেই থাকে।  অদ্ভুতভাবে অঙ্কুশের অভিনয় কিন্তু সেখান থেকে একেবারেই মুক্ত। 


অঙ্কুশের সম্পর্কে একটু বেশিই বলা হয়ে যাচ্ছে তার কারণ আমি অনেকদিন পরে একটা ভালো বাংলা কমেডি কালকে দেখে এলাম যেখানে আমি বুঝতেই পারলাম না যে সময়টা কিভাবে কেটে গেল।  আর আমার সাথে ছিল আমার ছেলে...কমেডি-খোর্। সে-ও কিন্তু খুব উপভোগ করেছে।  এই ছবিটি সকল বয়সে দর্শকের জন্য একসাথে বসে উপভোগ করার মত একটা ছবি। নি:সন্দেহে ছবিটি একটি অসাধারণ কমেডি এবং আমার ধারণা যদি সবাই এই ছবিটি গিয়ে দেখেন তাহলে বুঝতে পারবেন যে বাংলা সিনেমায় কমেডি হিসেবে এই ছবিটি কিন্তু মনে রাখার মত একটি জায়গা তৈরি  করেই নেবে। আমরা যখনই কোন কমিক ছবি দেখতে বসি, সেই ঘুরে ফিরে, বসন্ত বিলাপ বা সাড়ে চুয়াত্তর।  অধুনা কমেডিগুলোর মধ্যে কাছে হাতে গোনা কিছু চয়েসেস রয়েছে, আর নাম বলছি না। এই কমেডিটি সেই লেভেলের একটি কমেডি তৈরি হয়েছে যা অল-টাইম-ফেভারিত প্লে-লিস্টে ঢুকে যেতেই পারে। বর্তমান চিন্তা ভাবনা তার সাথে আমাদের পুরনো দিনের মানুষদেরকে উইথ ডিউ রেসপেক্ট সেখানে টেনে আনা এবং গল্পটাকে একটা সুগঠিত রূপ দিয়ে একটা কমেডিতে বাঁধা বেশ কঠিন কাজ ছিল।


 

সোহাগ সেন জাস্ট অনবদ্য্, 'বম্মা' চরিত্রে। রঞ্জিত মল্লিক আর অপরাজিতা আঢ্য দু-জনই পরিণত অভিনেতা। ওইন্দ্রিলা সেনও বেশ ভাল, তবে ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে থাকলে একমাত্র ওনারই। পদ্মনাভ দাশগুপ্তবাবুর প্রশংসা না করে পারছি না ।অসাধারণ স্ক্রিপ লিখেছেন। অসাধারণ পারশেপশান দিয়ে সেই স্ক্রিপ্টকে ঠিকঠাকভাবে এক্সিকিউট করার দায়িত্ব ছিল অভিনেতাদের  এবং তাঁরা প্রত্যেকে অসামান্য পরিশ্রম করে সেই স্ক্রিপটিকে একটি সুন্দর রূপ দিয়েছেন যা আমাদের মনকে ছুঁয়ে গেছে, হৃদয়কে ছুঁয়ে গেছে এবং আমরা কোনরকম ভাবনা চিন্তা ছাড়াই প্রাণ্খুলে হেসেছি।  সবথেকে বড় কথা এটা যে একটা গোটা কমেডি ছবির মধ্যে  সেই অর্থে কোন ভাঁড়ামো নেই, কোন আতিশয্য নেই, যা দিয়ে মানুষকে সুড়সুড়ি দিয়ে হাসাতে হচ্ছে। এখানে পুরো জিনিসটা একটা স্বাভাবিক, স্বচ্ছন্দ ও নির্লিপ্ত রূপে গেছে।   সামাজিক মেসেজ যেটা রয়েছে সেটা খুব লেটেন্ট বাট ভেরি ভেরি পাওয়ারফুল। আর সেই সামগ্রিক মালা গাঁথার মূল কারিগর প্রেমেন্দু বিকাশ চাকী মহাশয়কে জানাই শুভেচ্ছা, আবারও, (নন্দনের সামনে একবার জানিয়েছি)।

 


এবার সোজা চলে যাই ছোটবেলার কথায়। সিনেমাটির ভূয়সি প্রশংসা যে করলাম তার কারণ যে আমার একদম ছোটবেলার বন্ধু দেবনাথ চট্টোপাধ্যায়ের তাতে রয়েছে, তা কিন্তু নয়। ঘটনাচক্রে ও এটার একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ। দেবনাথের  সাথে অন্তরঙ্গতা এমন বয়স থেকে  যে সেটা এখানে বলা খুব একটা সুচারু হবে না। আমার ছেলে আমাকে জিজ্ঞাসা করছিল যে "দেবনাথ কাকু তোমার ঠিক কি রকম বন্ধু, কবেকার বন্ধু?" তা আমি উত্তরে ওকে একটাই কথা বলেছিলাম, নন্দনে ঢোকার আগে যে, "দেবনাথ কাকু আমার সেই বয়সের, সেই সময়ের বন্ধু যখন আমরা বাংলা গালাগালগুলো মানে না বুঝেই একসঙ্গে শিখে একে অপরের ওপর প্রয়োগ করতে শুরু করেছি।  দেবু যেভাবে আজকে খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই জায়গায় পৌঁছেছে তার মধ্যে রয়েছে প্রচন্ড রিস্ক নেওয়ার ক্ষমতা আর অভিনয় নামক বস্তুটির প্রতি অকুন্ঠ ভালবাসা ও ডেডিকেশন।  এই ছ্বিতে যে চরিত্রে সে অভিনয় করেছে সেটা হচ্ছে সে মূল চরিত্র বকাই এর মামা ও গল্পের মূল সূত্রধার।   সিনেমা শেষ হওয়ার পরে দেখি দেবু ছ্বিটির অন্যান্য কলাকুশলীদের নিয়ে নন্দনের বাইরে ফ্যান্-ফলোয়ার বাড়াতে দাঁড়িয়ে। চারিদিকে ভিড়। সৌভাগ্যক্রমে অনেক দিন বাদে দেখা। 

ডাক দিলাম: - নানু (দেবনাথের ডাক নাম্) !!!!!!! 

একডাকে কান এঁটোকরা হাসি নিয়ে এগিয়ে এসে নানু বলল্:

- আরে বলু (আমার ডাকনাম্) !!! 

 

অত ব্যস্ততার মধ্যে, অত ফ্যান ফলোয়ার্সদের মধ্যে আমাকে দেখার সাথে সাথে ও যেভাবে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল,  আমি আবার আমার পুরনো শৈশবে ফেরত গেলাম। বেলুড়ের বাড়ির সুখস্মৃতি বলতে আমাদের একসাথে নর্দমার পাঁক থেকে বল তুলে খেলা আর সেই বল মেরে হারিয়ে দিলে, তা নিয়ে জামা ছেঁড়াছিঁড়ির পর্যায়ে মারপিঠ্! পরদিন সকাল হলে আবার ভাব হয়ে যেত! 'সরি' বলারও দরকার হয় নি, এখনো! 

অসাধারণ কাজ হয়েছে, নানু! চালিয়ে যা তুই।  তোর কাজ আরো ব্যাপ্ত হোক আর আমরা সবাই সেই আনন্দ ভাগ করে চেটেপুটে খাই।

Monday, 10 April 2023

দণ্ডিত যত পক্ষীরাজ


বাখরাহাট কাজবাগানের রাধাকৃষ্ণের মন্দির আর তার মূর্তি - যখন প্রথম সাইকেল চালাতে শিখলাম আর তার পর আস্তে আস্তে বড়রাস্তায় পাড়ি দিলাম, প্রথম বাসরাস্তা ধরে দূরের গন্তব্য স্থির করেছিলাম এই মন্দির ৷ আমার বাবারও খুব প্রিয় জায়গা ৷ যখন আরো ছোট ছিলাম বাবার সঙ্গে রিক্সায় করে প্রথম সেই মন্দিরে যাওয়া ৷ বেশ পুরোনো মন্দির | ধবধবে সাদা ৷ সবে তখন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর গুপি- বাঘায় মজে আছি ৷ তখন এরকম একটা মন্দির ! বেলুড়ের রাসবাড়ির মন্দিরও আমাকে ভীষণ টানে, সেখানকার মূর্তিও ৷ কিন্তু এই কাজবাগান আরও মায়াময় ৷ মন্দিরের ভিতরে গিয়ে ওপর দিকে তাকালে তা এতটাই আকাশচুম্বী আর আরতির পর সব ধোঁয়ায় এমন ঢেকে যেত যে মনে হত এই বুঝি গুপি বাঘা সেখান থেকে মণ্ডা মিঠাই বর্ষাবে ৷ সঙ্গে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি দুটি অনবদ্য আর্টওয়র্ক ৷ দেখলেই কেমন মনের মধ্যে ঠিক ভক্তি নয় এক আশ্চর্য ভাবালুতার সৃষ্টি হয়।


আজ সকালে বাবা মা কে নিয়ে মামার বাড়িতে যাওযার সময়ে রাস্তায় বাবা গোঁ ধরে বসলেন যে কাজবাগানে একবার তিনি যাবেনই।

এমনিতে নববই বছর বয়েসে বাড়িতে জবুথবু হয়ে হাঁটেন, নিয়মিত ইনহেলার ও নেবুলাইজার চলে, কিন্তু মন্দির খোলা পেয়ে তাঁর প্রাণে এমন হিল্লোল উঠল যে সবাইকে তাক লাগিয়ে তরতরিয়ে হেঁটে গিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠে চলে গেলেন মূর্তির একেবারে সামনে ৷ একটুও হাঁপানোর লক্ষণ নেই।

আমিও প্রথমে বেশ গ্যাঁইগুঁই করছিলাম ৷ কিন্তু মন্দিরের ভিতরে ঢুকতে পেয়ে এত বছর পর বেশ লাগল৷ শুধু মন্দিরের রঙটা গোলাপী না করে ধবধবে সাদা রাখলেই যেন ভাল হত। আকাশচুম্বী সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে আর শৈশবের সারল্য নিয়ে সেখান থেকে গুপিবাঘার মিষ্টান্ন বর্ষণ দেখতে পেলাম না ৷ চোখে পড়ল পায়রা আর ঝুল৷ খুব মিস করলাম নিজের শৈশবের সরল মনটাকে ৷

শহরের পাড়াতেই কঠিন৷ তার ওপর আর গণ্ডগ্রাম ৷ সেখানে আবার টেলিভিশন। এক কথায় অকল্পনীয় পুরো গ্রামে একটাই টিভি ছিল ৷ প্রথমে তো মামার বাড়িতে টিভি ছিল না ৷ সুতরাং টিভির কোন অনুষ্ঠান দেখতে গেলে আগে থেকে বলে ঘোষ পাড়াতে গিয়ে একটি বিশেষ বাড়িতে বসে সেখানে টিভি দেখতে হতো।

সেও আবার লুকিয়ে কারণ মামারবাড়ির দাদু মোটেও এসব পছন্দ করতেন না এবং বিশ্বাস করতেন যে টিভি বস্তুটি একজনের বখে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট, কারণ বাবা একদিন যখন প্রসঙ্গক্রমে চার্লি চ্যাপলিনের কথা বলেছিলেন দাদুর কাছে, দাদু বেশ বিরক্তির স্বরে বাবাকে বলেছিলেন
- ওটা একটা ভাঁড়... নাতিকে যেন ওসব ছ্যাবলামো দেখিয়ে আবার বিগড়ে দিও না।
বাবা তর্ক করেন নি উঠে চলে এসেছিলেন।
সে হেন বাড়ির লোকজন ভর সন্ধেবেলায় অন্যের বাড়ি যাবে টিভি দেখতে! ধরা পড়লে ধুন্ধুমার ! কিন্তু বড়মাইমা চিরকালই বাড়িতে এক রেবেল । চুপি চুপি কথাবার্তা বলে সব ঠিক করে রাখত। আমরা কৃষ্ণামাসীর কাছে পড়তে যাচ্ছি এই বলে মাসে এক আধবার সুযোগ পেতাম টিভি দেখতে যাওয়ার ৷ সে যে কেমন অভিজ্ঞতা তা ঠিক বলে বোঝানো শক্ত ৷

আমরা সবাই মিলে জড়ো হয়ে যে টিভিতে অনুষ্ঠান দেখতে যেতাম সেই টিভিটা ছিল তখনকার দিনের সব থেকে ভালো ব্র্যান্ডেড টেলিভিশন যার চারটে পা একটি শাটার এবং তার মধ্যে অবস্থিত একটি বিশাল বড় স্ক্রিনের টিভি যেখান থেকে সাদা কালো ছবি বেরিয়ে আমাদের রঙিন দুনিয়াকে আরো স্বপ্নে জারিয়ে দিত।

আজ আমি প্রায় চার বছর পরে আবার মামার বাড়িতে গেলাম ৷ এমনিতে মাঝে মধ্যেই যাই ৷ কোভিডের জন্য আর বাবা মায়ের শারীরিক অবস্থার কারণে অনেকবছরের গ্যাপ পড়ে গ্যাছে। আর গেলেও কিন্তু সেখানকার পাড়া খুব একটা ঘোরা হয় না ৷ আজ হঠাত পুরনো বাড়ি পুরনো লোক এসব নিয়ে কথা বলতে বলতে জানতে জানতে পারলাম যে, যে সমস্ত জায়গায় জুড়ে আমার শৈশব এবং কৈশোরের অনেকটা , সেসব আছে বটে কিন্তু সবই পোড়ো বাড়িতে পরিণত হয়েছে ৷ প্রায় কেউ থাকে না বললেই চলে এখন এবং সেখানে সাপখোপের বাস ৷
ছেলে, ভাই আর ভাইএর আটবছরের মেয়েকে নিয়ে অভিযানে বেরোলাম ৷ বুমের এমনিতেই পুরনো বাড়িটাড়ি সম্পর্কে বিশেষ উৎসাহ রয়েছে ৷ ওর ওসব দেখলেই মনে হয় এখানে একটা সিনেমার শুটিং করে ফেলি। কি সিনেমা তা ঠিক করে উঠতে পারে না৷ তবে ভাবে এসব ৷ আর আমিও সেই সমস্ত ভাবনা ও কাজকর্মে বিশেষ উৎসাহ ও ইন্ধন দিয়ে থাকি ৷ কতটা কি ভবিষ্যতে করতে পারবে আমি জানিনা ৷ তবে এইসব ব্যাপারে আমার তরফ থেকে ফুসলিয়ে যাওয়ার কোন অন্ত নেই ৷

আমরা যখন ঘোষপাড়ায় গিয়ে পৌঁছলাম, সত্যি বলছি, একটার পর একটা বাড়ি দেখে দিনের বেলাতেই মনে হচ্ছিল শুধু সাক্ষাৎ সাপখোপ কেন দু'একটা জ্যান্ত ভূত বেরিয়ে পড়লেও খুব একটা আশ্চর্য হব না ৷ কিন্তু তার মধ্যে সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় যে অদ্ভুত ভাবে একটি ঘরে তার ভৌতিক অস্তিত্ব নিয়ে সেই টিভিটি রয়ে গিয়েছে।



বেশ কিছু ছবি তুললাম | তারপরে ফেরার পথে ছেলেকে বলছিলাম যে বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে লাইফ স্কিল সম্পর্কে যা কিছু আজকাল অনেক টাকার বিনিময়ে শেখানো হয়, তার বেশিরভাগটাই আমি প্রায় বিনা পয়সায় শিখে ফেলেছিলাম আমার এই মামার বাড়িতে থেকে। মামার বাড়ি আমাকে যা দিয়েছে যা শিখিয়েছে, আমি সে ঋণ কোনোদিন কোনোভাবে শোধ করতে পারব না ৷

এই গ্রামে খুব ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি হিন্দু মুসলিমের সহাবস্থান যেখানে কোনরকম ভেদাভেদ ছাড়াই একে অপরের পাশে এসে দাঁড়ায় ৷ জাত পাতের ছোঁয়াছুঁয়ি ঠেকাঠেকি এসবের কোনো বালাই নেই ৷ আর ভেদাভেদের দাঙ্গা মারপিট এসব যদি কেউ বলে তো তার ছাল তারা নিজেরাই ছাড়িয়ে নেবে। একটা মুদির দোকান ছিল ৷

তার দাওয়ায় বসে অনেক কিছু ৷ দোকানদারের নাম ছিল আবদুলI সেদিন আমার এক লেখক বন্ধু হাবিব ও তার লেখায় লিখেছে যে গ্রামের ওরকম দোকানে ছোটবেলায় জিনিস কিনতে গেলে কম সে কম দুচারটে নেবু নজেন (sweet sour candies বা লেবু লজেনজেস) আবদুলের মত দোকানদাররা দিয়েই দিতেন ৷ হাবিব ওর ছেলেকে নিয়ে সেই আশায় পুরোনো দোকানে যেতে দোকানি আর যখন বিনি পয়সায় নজেন দিল না , হাবিব জিজ্ঞেস করাতে দোকানি বলেছে
- ফ্রিতে কি আর কিছু হয় গো ! হয় না!
আমরা আর সে আশা রাখিনি কারণ সন্টু বলল
- আবদুল মারা গিয়েছে আর সে মারা যেতে দোকানটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বুঝলাম নজেনের দিনও শেষ আর মানুষও ৷ দোকানের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া এক ফালি কাঁচা রাস্তা মিশেছিল এক বিস্তীর্ণ মাঠে৷ মাঠের ওপারে ঠিক কি আছে আমরা কোনোদিন জানতে পারি নি ৷ মাঠ দিয়ে অনেকটা হাঁটলে তবে একটা খাল পড়ত ৷ আমরা ঐ পর্যন্ত গিয়েছি ৷ আমি মজা করে নাম দিয়েছিলাম তেপান্তরের মাঠ ৷ এখন দৃশ্য অনেকটা বদলেছে দেখলাম ৷

আবদুল ছিল জাতিতে মুসলমান ৷ কোনোদিন বুঝি নি যে সেটা একটা সমস্যা হতে পারে ৷ আজ আমার মামাতো ভাই সন্টু প্রসঙ্গত বলছিল যে অমুক জায়গায় কারফিউ আছে ৷ আমি বললাম,
-সে কি রে! আসার সময় তো সারা রাস্তা চলে এলাম মোটামুটি ফাঁকা। শুধু বাখরাহাট বাজার পেরোতে বেশ বেগ পেতে হল ৷ রাস্তায় যা ভিড়! কারফিউটা কোথায় বল দেখি?
ও হেসে বলল
- আরে বাবা সাধারণ মানুষ কি আর এসব চায়! তুমি বোঝনা এসব! জাস্ট লোক দেখানো ব্যাপার! এসব কারফিউ কি!!!! কেউই কিছু মানছে না ৷ আচ্ছা বলতো আজ রোববারের বাজার .... কোথায় মানুষ একটু মটন খাবে, বড় বড় মাছ কিনবে তা নয়...এই সমস্ত কারফিউ টারফিউ সব বেকার ৷ কে এসব মানে !

দেখলাম ভাই কিছু ভুল বলে নি ৷ বিকেলে যখন ফিরছি, রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছে বাখরাহাট বাজারে ৷ আসন্ন পয়লা বৈশাখই হোক বা ঈদ - উপলক্ষ্য তো একটাই - মানববন্ধন ৷ছোটবেলা থেকে যা দেখে এসেছি, তার বিপরীত পথে কিছু মুষ্টিমেয় মানুষ উদ্দেশ্যপ্রনোদিতভাবে জাত- ধর্ম-বর্ণের বিভাজনকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করলেও তারা যে নিদারুণভাবে ব্যর্থ, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিল আজ বিকেলের বাখরাহাট বাজার।

আর আজ আর একটা জিনিস চোখে পড়ল। রেশন দোকানের সামনে প্রায় দেড়শ মানুষের লাইন এবং গ্রামের মানুষের সাথে কথা বলতে গিয়ে বুঝলাম এই লাইন শেষ হতে হতে বিকেল হয়ে যাবে। আমরা শহরে যত উন্নয়ন দরজায় দাঁড়িয়ে আছে বলে দেখতে পাচ্ছি, গ্রামে সে সম্পর্কে সন্দেহ থেকেই যায়। হ্যাঁ তবে অনেক মেঠো রাস্তা কংক্রিটের হয়েছে। বেশ কিছু প্রাথমিক স্কুল দোতলা হয়েছে। কিন্তু মানুষের জীবনের গুণগত মানের কোন উন্নয়ন খুব একটা চোখে পড়লো না ৷

ফিরে আসি পুরনো বাড়িগুলোর কথায়৷ সেই বাড়িগুলোর মালিকরা আজ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছেন ৷ তাঁরা বোধহয় এতটাই প্রতিষ্ঠিত যে পিতৃপুরুষের ভিটে এই জায়গাটুকু নিয়ে কোনো মাথা ব্যথাও নেই ৷

না হলে এরকম একটা বিরাট পড়ে থাকা বাস্তু জমিতে এখনো যে কোন ল্যান্ড- শার্কের চোখ পড়েনি তা অদ্ভুত ৷ তবে মনে হল যে চোখ না পড়ার একমাত্র কারণ হলো বাখরাহাট বাজার থেকে জয়চন্ডীপুরে যে পাঁচ ফুট মাত্র চওড়া রাস্তাটি ঢুকেছে, সেটি। শহরের মানুষকে গ্রামে বসবাসের লোভ ভাল টোপ হলেও সেই ethnic rustic ambience এর প্রাথমিক শর্ত চওড়া রাস্তা যেখান দিয়ে Ambulance Bus বা Fie Brigade এর গাড়ি না যেতে পারলেও Mercedes Benz জাতীয় গাড়ি যাতে চলতে পারে ৷ Thankfully এখানে সে সুযোগ নেই ৷


আমার লেখাটি নস্টালজিয়া থেকে কি করে কখন প্রচ্ছন্ন রাজনীতির আঙিনায় চলে গেল তা ঠিক বলে বোঝাতে পারবো না। কারণ যার হাত ধরে আমি সত্যিকারের মানুষ হয়েছি সেই ছোটমামা ছিল দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ ৷ মামার বাড়িতে সবাই ছিল অত্যন্ত উগ্র কংগ্রেস৷ একমাত্র ছোট মামা কি করে বামপন্থী হয়ে গিয়েছিল কে জানে ৷

ঠিক যেমন করে সাঁতার সাইকেল শিখিয়েছে, ঠিক তেমন করেই কবে কোন অবচেতনে একটা বীজ পুঁতে দিয়ে চলে গেছে যা আমি বোধহয় আর জীবন উপড়ে ফেলতে পারবো না ৷ আর সেটা করতে মার্কস এঙ্গেলস নিয়ে যে খুব মস্তিষ্ক প্রক্ষালন করেছিল, তেমনটা মনে পড়ে না। আর সেই বীজ কখনই রাজনীতির রঙের নয়, সামাজিক মূল্যবোধের, সামাজিক দায়িত্বের ও কর্তব্যের, অন্য মানুষের প্রতি সম্মান বোধের আর মানুষের নিজের অধিকার বোধের, যে জন্য আসলে একসময়ে রাজনীতির জন্ম।

সব থেকে মজার কথা হলো এসব তো আমিও আর কাউকে বলিনি৷ কিন্তু আজকে যখন একজন আমার সঙ্গে .পুরোনো বাড়িগুলো ঘুরে ঘুরে দেখলো তখন ওর মাথায় প্রথম যেটা এলো সেটা হল
- দেশভাগের সময়ে যে গল্পগুলো আছে সেগুলোর একটাকে নিয়ে আমরা কি কাজ করতে পারি না!
আমি বললাম,
- যেমন?

উত্তর পেলাম যে
- যেমন ধর শরদিন্দুর ব্যোমকেশ | সে কি শুধুই একজন গোয়েন্দা? তার দেশ ভক্তি বা সমাজচেতনা অংশ কিন্তু দর্শকদের সামনে মেলে ধরার বহু চেষ্টা হয়েছে ৷ শরদিন্দু কিন্তু সেটা বার বার ব্যোমকেশ চরিত্রের একটি প্রধান স্তম্ভ হিসেবে দেখিয়েছেন ৷ তবে অঞ্জন দওর ব্যোমাকেশকে হুইস্কিও খাইয়ে দেওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গ্যাছে ৷ ব্যোমকেশের থেকে অজিত এবং সত্যবতীর মধ্যে সমাজচেতনা ও দেশভক্তির যে একটা বিশাল শক্তিশালী স্রোত সঞ্চারিত হয়েছিল সেটাকে কোথাও ঠিকঠাক স্পেস নিয়ে মেলে ধরা আর কি! মানে আসল গল্পের ভেতরে আর একটা জোরালো গল্প...


শুনতে শুনতে মনে হল বট গাছের শেকড় যেভাবে বাড়িগুলোকে তিলে তিলে গ্রাস করেছে, বক্তার মস্তিষ্ককেও একটা বটের মতো গাছ কোথাও তিলে তিলে তার শেকড়-বাকড় দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পেঁচিয়ে ধরছে৷ পুকুরের জলের স্থির আয়নাটা উদ্বেলিত হল একটি মাছের ঘাই-এ। চমক ভেঙে উঠতে গিয়ে মাথায় লাগল কলার কাঁদি... সেটা শুভ না অশুভ তা আবার আসন্ন ১৪৩০ বঙ্গাব্দের পাঁজি ঘেঁটে বের করতে হবে...