Sunday, 19 March 2023

বিল্টুর ডায়েরী: পঞ্চম পর্ব: শব্দভেদী

গত দু'বছরে যা চলল, তাতে পুরো সব বদলে গেল। নিউ নর্মালে আমি আর পল্টু খানিকটা ব‌ড় হয়েছি, আর বাবা-মা আরো খিট্খিটে। বাড়িটা অনেকটা মিলিটারী ক্যাম্পের মত। সারাদিন একটা হাই এলার্ট জোন! তবে পল্টুর কাছে সব জব্দ!! এখন বেশ কথা ফুটেছে তো মুখে। আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় যে পল্টুর মাথার মধ্যে কি আছে যদি জানা যেত! সবাই যেমন আমার ওপরে চোটপাট করে পার পেয়ে যায়, পল্টু সুদে-আসলে বদলা নিয়ে নেয়। আমাকে কঠিন কঠিন প্রশ্ন করা! ওইসব কায়দা বেরিয়ে যায় যদি পল্টুকে এই সমস্ত প্রশ্ন করা হয়। আমি যে কেন পল্টুর মত হয়ে উঠতে পারিনা! কি কথাবার্তা! সোজাসুজি যা মনে হয়, তাই-ই বলে দেয় সবার মুখের ওপর। আমি অনেক বার চেষ্টা করেছি. কিন্তু ওর মত পারি তো নি-ই, উল্টে চড়-থাপ্পড়-বকুনি খেয়ে গিয়েছি - বাবা-মা-দাদু-দিম্মা, স্কুলের টিচার, বাড়ির টিচার, এমনকি পাড়ার কাকু কাকীমা -সবার কাছে। ও বললে তখন কেউ কিছু বলে না। কারণ সবাই জানে যে পল্টুকে কিছু বললে মুখে এমন ঝামা ঘষে দেবে না, যে রাতের ঘুম ছুটে যাবে৷ এই তো সেদিন আমাদের দু’জনকে বাড়িতে পড়াতে এসেছিলেন বল্লরী ম্যাডাম। তার আগের দিনই পল্টুর রেজাল্ট বেরিয়েছে। বাংলায় খুব খারাপ ফল করেছে পল্টু। ম্যাডাম বলছিলেন

- পল্টু বাংলাটা একটু ভালো করে পড়ো, তবে না ভালো রেজাল্ট করতে পারবে! আর পরের দিন থেকে আমরা বাংলাটা আরো বেশি করে প্র্যাকটিস করব। আরো অনেক বেশি করে লিখতে হবে আর পড়তে হবে। যত বেশি পড়বে, লিখবে, তত বাংলার ওপর দখল বাড়বে। না পড়লে-লিখলে কি করে হবে? 

- আমি তো না প‌ড়ে লিখে-ই ছোটবেলা থেকে বাঙলা বলি শুধু, অত প্র্যাকটিস করে কি হবে! 

- শুধু বলতে পারলেই তো আর হবে না, পড়তে-লিখতে জানতে হবে তো! না হলে তো শেখাই হবে না, তাই না!

- যদি আমার বাবা-মা তোমাকে তার আগেই তোমাকে ছাড়িয়ে দেয়? 

নিরুত্তাপ ভাবে একটা ‘ঙ’- র ওপর পেন্সিল বোলাতে বোলাতে পল্টু বলল।  অ্যাটম বোমা ফাটার পরে হিরোশিমা-নাগাসাকি তে ঠিক এরকম সাইলেন্স ছিল বলে কালকেই পড়ছিলাম একটা বই-এ। ম্যাডাম বোধ হয় এতটার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। অবাক হয়ে থতমত খেয়ে হাঁ হয়ে গিয়েছেন। কি বলবেন কিছুই ভেবে পেলেন না। তারপর খানিকটা নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে গলা খাঁকরিয়ে বললেন 

- না, হঠাৎ আমাকে ছাড়িয়ে দেবেন কেন, তোমার বাবা-মা? 

পল্টুর সোজা উত্তর -

- ছাড়াবে না তো কি!! তুমি এতদিন ধরে আমাকে পড়ালে… কোনো লাভ হল কি! এই তো রেজাল্ট। দোষটা কার, আমার না তোমার?

আবার কিছুক্ষণ সব নিস্তব্ধ ৷ আমার হাসি পাচ্ছে ৷ কিন্তু চেপে রেখেছি ৷ ম্যাডাম বেশ অস্বস্তিতে, বুঝতে পারলাম। কিন্তু উনি খুব ভাল, অন্য কেউ হলে এত ক্ষণে দক্ষযজ্ঞ বেধে যেত! খুব মজা করে ম্যা'ম বললেন, 

- পল্টু… তোকে নিয়ে পারা যায় না। খালি পাকা পাকা কথা! 

- আজ আমাকে ইংলিশ ক্লাসেও ম্যাম পানিশমেনট দিয়েছে ৷

- দিয়েছে নয় দিয়েছেন বলতে হয়! না হলে লোকে ভাববে তোমায় ভাল করে কিছু শেখানো হয় না।

- হয় না তো! কই তোমাকে তো আপনি আপনি করে কথা বলিনা। 

- উফ পল্টু তোর সাথে আমি কথায় পেরে উঠব না … তুই বরং নাম্বার টেবলটা পড়ে ফেল একবার ৷ একটু পরে লিখতে দেব ৷

- আজ আর লিখতে পারব না গো…

- কেন কি হয়েছে?

- পায়ে ব্যাথা করছে ৷ 

- পায়ের সঙ্গে হাতের কি?

- মাথার সঙ্গে হাতের থাকলে পায়ের সঙ্গেও হাতের আছে...

- মানে?

- সেই সেদিন তোমাকে বললাম একটা আরশোলার ছবি এঁকে দিতে , তুমি বললে তোমার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে… অন্যদিন… আর কোথাও ব্যাথা হলে তো কন্সেনট্রেট করা যায় না ৷ মা ও তাই বলে...

- বেশ সে না হয় হল। কিন্তু ইংরেজি পরীক্ষায় তোকে এত করে avoid স্পেলিং টা ভাল করে মন দিয়ে লিখতে বলে দিলাম, সেই ভুল করে এলি… uvoid লিখে এলি ৷ কি করে avoid এ u আসে তা ভগবান জানে!

- হাতের ফাঁক গলে u- টা পড়ে গেল। কন্ট্রোল করতে পারলাম না।

- Whaaaaatttt? u টা পড়ে গেল.... just ?কন্ট্রোল করতে পারলি না...

- না গো… এমনি এমনি নয়.. তুমি ভাব...umbrella তে u ....আমব্রেলা...হলে আভয়েড এও u হওয়া উচিত ৷ দুটোর উচ্চারণ ই তো 'আ' দিয়ে শুরু। আমার হাত দিয়ে তাই গলে পড়ে গেল!!

ম্যাম তো হেসে উঠলেন ৷ কিন্তু পল্টু কথাটা তো কিছু ভুল বলেনি। নিয়ম হলে একরকম হোক। বড়দের এই এক সমস্যা লজিক্যাল কিছু বললে যখন আর কিছু উত্তর পায় না তখন হয় এরকম বোকার মত হেসে ওঠে না হলে হঠাৎ অকারণে রেগে যায়। সব সময় ছোট বলে আন্ডার -এসটিমেট করা ঠিক নয়। 

সেদিন পল্টুকে দিয়ে ম্যাম আর কিছু লেখানোর সাহস করলেন না। তার ভিক্টিম হলাম আমি। কুড়িটা প্রবলেম সামস করতে হল ৷ বেগার খাটনি। আমার পরীক্ষার তো একেই কোনো শেষ নেই তার মধ্যে আবার নিয়মের বাড়াবাড়ি, সেও নিজেদের সুবিধে মত ৷ এই যে কাল যখন সারাদিন ধরে মাসীর বাড়ি গিয়ে এত খাওয়া দাওয়া হল, তখন যেন এটা আমাদের কর্তব্য  আর আজ আমি একটু ভিডিও কলে কুশাগ্র -র সঙ্গে কথা বলব যখন বললাম তখন নাকি...মা কি যেন একটা বলল – ও হ্যাঁ… মনে পড়েছে… আমার নাকি 'ফুর্তির প্রাণ গাড়ের মাঠ' | এর মানে আমি জানি না ৷ তবে মা প্রায়ই এই কথাটা সবাইকে বলে ৷ দাঁতে দাঁত চেপে ৷ আমি একদিন আমার স্কুলের বন্ধুকে সে কথা বলতে গিয়েছিলাম ৷ তা ওর মা পাশেই ছিল ৷ সোজা উঠে এসে আমাকে এক থাপ্পড় ৷ 

-যত সব বাজে ডেঁপো ছেলের সঙ্গে মিশছে আমার ছেলেটা ৷ বস্তির লোকে ভরে গেছে স্কুল টা ৷

আমার ভীষণ রাগ হল ৷ বললাম

-এভাবে বলবেন না… এই কথাটা আমার মায়ের কাছ থেকে শেখা… মা রেগে গেলে বলে, আমাকে আর বাবাকে৷

-দারুন …. বাড়িতে নিজের মা-ই যদি এই ভাষা বলেন তা হলে তোমার তো কোনোই দোষ নেই ৷ 

ভাষা মানে ল্যাঙ্গুয়েজ…ভেবে-ই পেলাম না... কি এমন বললাম রে বাবা!

বাড়িতে এসে বাবা মা দুজনকেই বললাম থাপ্পড় খাওয়ার কথাটা ৷ মা তো ক্ষেপে আগুন | বলেছিল পরদিনই প্রিন্সিপ্যালের সঙ্গে দেখা করে একটা সল্যুশন বের করবে ৷ এভাবে কেউ কারোর গায়ে কি করে হাত তুলতে পারে, সে রকম কোনো কারণ ছাড়াই!!! 

কিন্তু বাবার হঠাৎ কি মনে হল! বলল, 

- বিল্টু তুই exactly কি বলেছিলি…

- ওই মা আমাকে তোমাকে আনন্দ করতে দেখলেই রেগে গিয়ে যেটা বলে, সেটা ৷

- বুঝলাম… মা কি বলে…

- কি আবার… ওই যে 'ফুর্তির প্রান গাড়ের মাঠ' না কি যেন!!!

- কিসের মাঠ ? 

- গাড়ের….

বাবা পুরো চুপ। মা কোথা থেকে ছুটে এসে আবার আমাকে এক থাপ্পড় ৷ বাবা আটকাতে গিয়েছিল ৷ তার আগেই ব্যাটম্যানের মত ঝড়াৎ করে মা এসে দিয়ে দিল ৷

- কথার ছিরি দেখ ছেলের… বলবেই তো বস্তিছাপ…

আমি জোরে কেঁদে ফেলে বলেছিলাম

-নিজে যখন বল তখন কোনো দোষ হয় না। আমি বললেই সবাই মিলে শুধু মার আর বস্তির ছেলে বস্তির ছেলে…

মা আবার চিৎকার করে তেড়ে আসছিল, বাবা নেহাত আটকাল বলে ৷

- আ হা! মেরো না ওকে... ও কি আর অত বুঝে বলেছে!

-তুমি চুপ কর, একদম তোমার প্রশ্রয় পেয়ে-ই একদম মাথায় উঠেছে!! কে বলেছে যেখানে সেখানে অত জ্ঞান ফলাতে! 

(আমার দিকে) ওরে ছাগল!!! কথাটা গড়ের মাঠ… গড়...গড়… আর … (বাবার দিকে তাকিয়ে) মিচকে মিচকে না হেসে ছেলেকে বোঝাও না…!!!

বাবা হাসি থামিয়ে হঠাৎ সোজা হয়ে উঠে বসে খুব গম্ভীর হয়ে মা কে জিজ্ঞাসা করল,

-বোঝাবো? … এইটা…. ছেলেকে…? মানে,.... এর মানে সমেত?

-তোমরা না just incorrigible… যা পার কর…! গোল্লায় যাক সব…

মা গটমট করে পাশের ঘরে চলে গেল ৷ আমি হতভম্ভ হয়ে বাবার দিকে তাকালাম ৷ বাবা খুব সিরিয়াস হয়ে গিয়ে বলতে শুরু করল ৷

-শোনো বিল্টু,  বাংলায় ‘গড়’ মানে fort বা কেল্লা… আবার ‘ গড় ' করা মানে প্রণাম করা… 

-সোনার কেল্লার মত কেল্লা?

-হ্যাঁ ৷ যেমন চিতোরের কেল্লার নামই চিত্তুর গড় ৷ কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম… ফোর্ট মানে কেল্লা বা গড় … তাই তার পাশের মাঠের নাম তাই গড়ের মাঠ৷

-আর গাড় মানে?

দেখলাম বাবা কেমন সিঁটিয়ে গেল...

-হ্যাঁ…ওটার মানে হল গিয়ে…ইয়ে মানে…it’s a slang…খুব খারাপ একটা গালাগালি...

-তাই নাকি… তবে যে ড্রাইভার কাকু সেদিন কাকে একটা লাঠি দেখিয়ে রেগে গিয়ে একটা লোককে বলল 'তোমার গাড়ে পুঁতে দেব'!!!…আমি ভাবলাম বোধ হয় যাকে বলছে তার কোনো মাঠ-টাঠ আছে, আর সেখানে পোঁতার কথা বলছে৷ মা-ও তো রেগে গেলেই বলে… 'সখের প্রাণ গাড়ের মাঠ '…আমিও তাই রেগে গিয়ে বলেছি ৷

- অ্যাকচুয়ালী... homophones তো...তোর কোনো দোষ নেই… অত কথায় দরকার নেই। এখন জানলি তো যে এটা একটা slang ? তাহলে আর বলবি না ৷ ব্যাস্....। 

- কিন্তু বাবা....

- আর এটা নিয়ে কোনো কথা নয়...

এই যে এই যে…জাস্ট এটাই!!!! বিপদ বুঝলেই মা-এর ঐ 'তর্ক কোরো না' বা 'এটা নিয়ে আর কোনো কথা নয়’ mode গুলো খুব বিরক্তিকর ৷ এখন দেখছি বাবাও আলাদা কিছু নয়। বোধ হয় মায়ের সঙ্গে থাকতে থাকতে ও রকমই হয়ে গ্যাছে।  কাল রাতেই কুশাগ্র র সঙ্গে একটু Video call কল করব বলে পার্মিশন চাইতে এক গাদা জ্ঞান শুনলাম্, অকারণে... নাকি লেট আওয়ার্স -এ allowed নয় । সঙ্গে ফ্রি হল,

- সময় নষ্ট করার একটা লিমিট থাকে...এ-ই কাল সারাদিন মাসির বাড়িতে কেটে গেল...

- আরে ভাই! আমি বলেছিলাম নাকি যেতে? আমি তো কাল মাসির বাড়ি যেতে চাইনি ৷ তোমরাই নিয়ে গেছ৷ এখন তাহলে কেন বলছ যে আমি সময় নষ্ট করেছি! ... 

বলতেই আর যাবি কোথায়!! নে এখন! সারা সপ্তাহের প্রত্যেক ঘন্টা ধরে ধরে ফিরিস্তি, যে আমি কোথায়-কখন-কিভাবে সময় নষ্ট করেছি। সময় নষ্ট মানে কিন্তু পড়াশোনা বাদ দিয়ে সব কিছু। মানে দাঁত মাজা বা ডিনার, প্রাইভেট - টিউটরদের সাথে পড়া, আর গিটারের স্যার তো স্যার-ই নন, উনি বাজান কম, বলেন বেশি। এমন কি স্কুল বাসের ট্রাফিক জ্যামে আটকে যাওয়াও যেন আমারই দোষ! জ্যাম যখন ছিল, সেই সময়ে বাইরের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে না থেকে বা বন্ধুদের সঙ্গে হুল্লোড়ে না মেতে, কেন আমি হিস্ট্রির চ্যাপটারগুলো গল্পের বই-এর মতো পড়ে ফেললাম না! আসলে ব্যাপারটা হল গিয়ে, সব দোষ আমার, আর নিজেরা ধোয়া তুলসী পাতা!!!

আমাদের কাজের সময়ে যখন নিজেদের ফুর্তির জন্য আমাদের ইচ্ছের না থাকলেও জোর করে করিয়ে নেয়, তার বেলা! তখন, কিন্তু "অ্যাডজাস্ট করতে শেখ, না হলে ভবিষ্যতে চলবে কি করে!"

তখন নিজের মাথার চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।

তবে ইচ্ছে করছে যে বাবাকে একবার বলব, গড়ের মাঠে আমাকে আর পল্টুকে একবার নিয়ে যেতে।



No comments: