Friday, 1 October 2021

রবিমামা ও অযান্ত্রিক

আমরা তখন বেলুড়ের বাড়িতে থাকতাম। তখন ছোট। অত বুঝতাম না। ভাবতাম আমাদেরই বাড়ি। আসলে আমার বাবা-র বড়মামার বাড়ি।সালকিয়ার পৈতৃক ভিটে ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ার ফলে তিনি সেখান থেকে চলে গিয়ে বেলুড়ে এই বাড়িটি করেন। আমি বাবার বড়মামা-কে বড়দাদু বলে ডাকতাম।তিনি নিজে বেশ নামকরা ধন্বন্তরী চিকিৎসক হিসেবে স্থানীয় অঞ্চলে বেশ সুখ্যাতি ও শ্রদ্ধা অর্জন করেন। কিন্তু আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই ফুসফুসের নানা রোগে জর্জরীত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন।ওনার ছেলে, আমার বড়কাকু, ও পুত্রবধূ কাকীমা সরকারী হাসপাতালের অন্যতম মেধাবী চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন এবং ওনার জামাতা, আমার পিসেমশাই, লণ্ডন-ফেরৎ কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে খাস কলকাতায় বিশেষ প্রতিপত্তি লাভ করেন। ফলে তাঁদের কেউ-ই বেলুড়ের বাড়িতে আসতে নারাজ। বড়দাদু-কে বেলুড়ের বাড়ি থেকে নিয়ে চলে যাওয়া হয় কলকাতায়।ফলে বেলুড়ের বাড়িতে কেউ তখন থাকত না। আমার বাবা-কে এই মামা-রা সবাই মিলে মানুষ করেন কারণ আমার ঠাকুরদা-ঠাকুরমা দু-জনেই বাবার কৈশোরে গত হন। বাবার দাদামশায় শ্রী ও ড. জীবানন্দ মুখার্জী (তিনিও পেশায় সালকিয়ার নামকরা চিকিৎসক ছিলেন) আমার বাবা কে তাঁর মামারবাড়িতে বড় করে তোলেন এবং বাকি তিন পুত্র সন্তানের সাথে নিজের একমাত্র কন্যার (আমার ঠাকুরমা)প্রাপ্য ভাগ হিসেবে সালকিয়ার বাড়ির সমান চারভাগ করে আমার বাবা-কে একভাগ দিয়ে যান।

বেলুড়ের বাড়ি ওই ভাবে ফাঁকা হয়ে যাওয়ার ফলে আমার বাবাকে সেই বাড়ির তত্ত্বাবধানে নিযুক্ত করা হয় আমরা তখন বেলুড়ের বাড়িতে চলে আসি। আমি তখন কিন্ডারগার্টেনে পড়ি। তবে অত বড় বাড়ি!সামনে উঠোন, বাগান! কিন্তু, বড়দাদু সুস্থ হয়ে ওখানে ফিরত এলেই আমাদের চলে যেতে হবে আবার। তখন ছোট তো। ওই বাড়িটাকেই নিজের বলে মন হত। ওই বাড়ির পাঁচিল, দেওয়াল, ফাঁক ফোঁকর, জানলা দরজা, ছাদ, বারান্দা-র প্রতিটি ইঁটে আজ ও লেখা আছে আমার শিশু থেকে কিশোর হয়ে ওঠার গল্প।

মাসে একদিন বাবা বণ্ডেলের বাড়িতে যেতেন। সেখানেই বড়দাদুর শ্বশুরবাড়ি।বড়দাদু-র চিকিৎসার সুবিধার জন্য তাঁকে ওকানেই রাখা হয়েছিল।  আর সদ্য বিলেত ফেরৎ মেয়ে-জামাইও, আমার পিসীমা ও পিসেমশাই  সেই বাড়িতেই থাকেন। আমি ভাবতাম বাবা বোধহয় মামা-মামীকাকে প্রত্যেক মাসে একবার করে দেখতে যেতেন। একদিন সত্যিটা জানলাম,যে ফি-মাসে দেখতে যাওয়ার আসল  কারণ-টা হল, আমাদের ওই বেলুড়ের বাড়িতে থাকার জন্য ভাড়া দিতে হত প্রতিমাসে, বড়দিদা অর্থাৎ বাবার বড়মামীমা-কে। প্রতি মাসের ইলেক্ট্রিক বিল এর রিসিপ্ট কপি আর ওই ভাড়াটুকু পৌঁছে দেওয়ার জন্য বাবা সেখানে যেতেন। আমি ও অনেকবার গিয়েছি। হাওড়া থেকে লাল রঙের ডবল-ডেকার ১০ নং রুটের বাসে চড়ে। আমরা নামতাম বালীগঞ্জ ফাঁড়িতে।তারপর হাতে টানা রিক্সায় করে বণ্ডেল গেটের সেই চারতলা পেল্লায় বাড়ি, যার প্রতি খাপে লুকিয়ে আছে উন্নাসিকতা ও বৈভব। সিঁটিয়ে থাকতাম। বেলুড় বাজারের গলিতে থাকা নর্দমা থেকে তোলা বল নিয়ে ফুটবল-ক্রিকেট খেলা আমি, পাতি নাম-না-জানা সরকারী স্কুলের পাতি মেধার ছাত্র, যেন এক শূন্য সেখানে। দক্ষিণ কলকাতার গ্ল্যামারে আড়াল পড়ে যেত আমি যা যা পারি। সেই বাড়ির ভোল্টেজ খুব হাই। শক লাগত,প্রতিপদে এলিটিস্ট সমভিব্যবহারে। লেখাপড়াও যে গ্ল্যামারাস হতে পারে সেখানেই প্রথম শিখেছিলাম কাছে। একটা সময়ে নেশা চেপে গিয়েছিল। শক নিয়ে নিয়ে দেখার আর শেখার। আর সেই প্রত্যেকটি করুণার-পাত্র হয়ে ওঠা ঘটনা আমার মধ্যে অজান্তে, নিভৃতে পুঁতে দিইয়েছিল আত্মসম্মান ও ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার বীজ।আমি চির-কৃতজ্ঞ আমার গুরুজনদের কাছে, আমাকে ও আমার বাবাকে প্রতি পদে সামনা-সামনি বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য যে আমরা তাঁদের করুণা ও কৃপার পাত্র মাত্র, যা আমরা কোনোদিনই ছিলাম না, এবং সেই অনুভূতির সুখে তাঁরা আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়েছিলেন, অকারণ দম্ভ ও গর্বে।

 

এর ফাঁকে বড়দাদু একদিন চলে গেলেন ইহলোক ত্যাগ করে।বড়দিদা একা আর কি করে বেলুড়ের বাড়িতে এসে থাকেন! তাই তিনি কখনো ছেলের কাছে, কখনো মেয়ের কাছে থাকলেন। আর ঠিক হল বেলুড়ের বাড়ি বিক্রি করে দেওয়া হবে। আশানুরূপ মুল্যে কেউ কিনতে রাজি না হওয়া পর্যন্ত আমরা সেখানে যেমন ভাড়াটে হিসেবে ছিলাম তেমনটা থাকতে পারি। কিন্তু সেরকম বিক্রির কোনো উদ্যোগ দেখা গেল না। ফলে বড়দিদা ছেলেমেয়ের কাছে থাকার পরেও বাবার ভরসায় প্রায়ই বেলুড়ের বাড়িতে এসে থাকতেন। বিষয়-সম্পত্তি-সোনা-দানা নিয়ে ওনার বিচার চুলচেরা হলেও, আপাত কঠিন মানুষটির মধ্যে খুব নরম অতি সজ্জন একজন মানুষ বাস করতেন। খুব কাছ থেকে না মিশলে সেই তাঁর মধ্যে  অন্তর্লীন সেই মানুষের নাগাল পাওয়া দুরূহ ছিল। তাস-লুডো-দাবা তিনটেই ওনার কাছে শেখা। দাবার ঘুঁটির অভাবে মেঝেতে ছক কেটে সুপুরীর টুকরো আর ভাঙা চক দিয়ে বাঘবন্দী খেলাও ওনার কাছে শেখা। গাছে পেয়ারা পাড়তে উস্কানী, ফুল দিয়ে রথ সাজানোর হইচই সব, বড়দিদা। কিছু যে নিজের হাতে সেভাবে করে সাহায্য করতেন তা নয়, তবে কথার মধ্যে এমন একটা মায়া-মমতা ছিল যা কথায় প্রকাশ করা কঠিন, আর সেটাকে ঊপেক্ষা করাও খুব কঠিন। সেই স্পর্শ আমাকে দিয়ে অনেক কিছু অজান্তে শিখিয়ে করিয়ে নিয়েছে।

যখন বড়দিদা বেলুড়ের বাড়িতে এসে থাকতেন, ওনার ছেলে-পুত্রবধূ, মেয়ে-জামাই-নাতনীরা সবাই মাঝে মাঝে আসতেন। সহজ কথায় আমার কাকু-কাকিমা, পিসীমা-পিসেমশাই তাঁদের মেয়েরা বেলুড়ের বাড়িতে আসা শুরু করলেন।

বেলুড়ের বাড়ির পাশেই ছিল জে-বি-ইন্ডাস্ট্রী। পেল্লায় মাঠ। পেল্লায় আধুনিক কারখানা। পাশেই ছোট একটা বাড়ি। আমরা বিনুকাকু-দের বাড়ি বলে জানতাম। জাতে গুজরাতী ব্রাহ্মণ, তাই  আদ্যন্ত নিরামিষভোজী ও সন্ধ্যে সাতটায় রাত্রি আহার সম্পন্নপূর্বক শয়ণ।

বড়দাদু একটা দারুণ কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। পাঁঊরুটী খেয়ে বাড়ি তৈরী করার বাইরেও কিনে ফেলেছিলেন পরিবারের প্রথম গাড়ি। সেও আবার বিলিতি। যেমন আমরা উত্তম কুমারের সিনেমায় দেখে থাকি।(বিঃদ্রঃ দেয়া-নেয়া”)। তখনকার যুগে গাড়ি, তা-ও আবার বিলিতী, মোক্ষম ব্যাপার। লাখে একজনের হয়ত বা। তা তিনি অসুস্থ হওয়ার পর সে গাড়ি পড়েই রইল। চালাবে কে? তার কপালে জায়গা হল ওই জে-বি ইন্ডাস্ট্রীর একটা গাছের তলা।আস্তে আস্তে ক্ষয় হতে লাগল। পরিত্যক্ত গাড়ির মত হয়ে গেল তার অবয়ব। বিলেত ফেরৎ পিসেমশাই ওই আদ্যিকালের গাড়িকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। নিজে একটি অ্যাম্বাসাডর কিনলেন। তাঁর প্র্যাকটিস তখন মধ্যগগনে। 

ইতিমধ্যে রাণাঘাট থেকে কলকাতায় ট্রান্সফার হয়ে এলেন বড়কাকু ও কাকীমা। বড়কাকু-কাকীমার মূল্যবোধ অতুলনীয়। কে কি বলবেন জানি না এই লেখা পড়ে, কারণ কোনো ব্যক্তি-ই তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে সবার কাছে ভাল ছিলেন এমনটা জানা নেই। বড়কাকু-কাকীমা যেহেতু সরকারী চাকরী করেন, এবং ওরকম তাবড় ডাক্তার হয়েও কোনোদিন প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন নি, তাই তাঁদের নতুন গাড়ি কেনার সামর্থ্য ছিল না। তাই বড়াকাকু নিজের বাবার গাড়িটাকেই চাঙ্গা করতে বদ্ধপরিকর হলেন। অনেক গাড়ির ডাক্তার এলেন, গেলেন। কেউ কিস্যু করতে পারলেন না। একজন  তো বলেই গেলেন,

-ওজন দরে স্ক্র্যাপ করে বেচলে খবর দেবেন। ভাল দাম পাইয়ে দেব।

বড়কাকু রেগে কাঁই।

সিনে আবির্ভাব হল রবি্মামার। বড়কাকুর বড় শালা। মানে কাকীমার বড় ভাই। কালীঘাটের মন্দিরের ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে পুরোণো বাড়ি। অবিবাহিত। পেশা ওকালতি। চেক হাফ শার্টের বুকের বোতাম খোলা থাকত। আর খুব ঘামতেন। আস্তে কথা বলতে পারতেন না। আন্তরিকতা কি, পাঁচ মিনিটে বুঝিয়ে দিতেন। আর শিশু-কিশোর পেলে তো বাকি বড়দের সঙ্গে ওনার কোনো যোগাযোগ রাখার প্রয়োজন আছে বলে মনে হত না।

এই যে রবিবারে বড়দিদার কাছে সবাই আসতে লাগল, রবিমামাও আসতে লাগলেন। আমাকে বললেন,

-চ তো দেখি, গাড়িটা নাকি কিলোদরে বেচতে হবে?

মাঠে গেলাম রবি কাকুর সঙ্গে।

-গাড়ির চাবি কার কাছে?

-বাবার কাছে।

-নিয়ে আয় দেখি ছুট্টে।

-কেন কি করবে?

-তুই আগে নিয়ে আয় না!

নিয়ে এসে দিলাম।রবিকাকু গাড়ির দরজা খুলে চাবিটা ঘোরালো। একটা জগদ্দল পাথরের ফাটলে চাবি গুঁজে ঘোরালে যা ফল হয়, তা থেকে আলাদা কিছু হল না। বনেট খোলা হল। দশ মিনিট ধরে কি সব দেখল।

-ছমাসের মধ্যে এই গাড়ি কলকাতার রাস্তায় যদি না চালিয়েছি, আমার নাম রবি মুখুজ্জে নয়।

বলে কি রে! মনে মনে ভাবলাম।

বাবা আর বড়কাকুকে ডেকে রবিমামা কি সব বলল। যা বুঝলাম, মাঠে ফ্রি অ্যাকসেস আর একটা গাড়ি পর্যন্ত ইলেক্ট্রিকের লাইন, আলো জ্বালাবার জন্য রবিমামার লাগবে।

এর পর শুরু হল উকিলের মোটর অভিযান, নিস্তব্ধে, নিভৃতে। অপেক্ষায় থাকতাম --রবিবারে রবি্মামা। অনেক রবিবার আসতেন না উনি। কিন্তু যেদিনই আসতেন, বিশেষ কোনো কথা না বাড়িয়ে সোজা মাঠে। একটা সময় এল আমার পাড়ার বন্ধুরা এই গাড়ি নিয়ে ঠাট্টা-হাসাহাসি করত।আমি কোনোদিন এই নিয়ে কোনো তর্ক-বিতর্কে যাই নি। মনে মনে বলতাম --একদিন এই মাঠেই এই বিলিতি গাড়িতে তোদের চাপিয়ে নিয়ে দেখিয়ে দেবে রবিমামা।জানিস তো না, সুপারম্যান, সুপারহিরো। তখন বুঝবি!

গাড়ির বনেট খুলে কি সব বের করত আবার মোবিল-টবিল মাখিয়ে পুরে দিত। একাই। তারপর তো খাকি রঙের একটা তেরপল পেতে প্রায়ই গাড়ির নিচে ঢুকে যেত, একটা ১০০ ওয়াটের বাল্ব জ্বালিয়ে।বেরিয়ে থাকত শুধু পা-দু-টো।একদিন কি একটা করতে গিয়ে চোখের পাশে কালো মবিল পড়ে গেল। চোখটা জাস্ট বেঁচে গিয়েছিল। দুর্ঘটনা ঘটতে পারত, বড় রকমের। বড়কাকু খুব বকল, বাবাও। কে কার কথা শোনে। পরের রোববার হাজির আর একটা লোককে সঙ্গে নি নিয়ে। তখন সকাল দশটা।

বড়কাকু বাবা-কে বলল,

-   কি করি বলত কিছুতেই শুনবে না।

রবিমামা ঠাণ্ডা গলায় বলল,

-   আজই শেষ, স্বাধীন। না পারলে আর ওই গাড়িতে হাত দেব না আমি। দেখো। 

-    কি এমন করেছেন, যে আজই শেষ, দেখে তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

রবিমামা শুধু মিচকি হাসলেন।

সবে রথ পেরিয়েছে। তার পরের রোববার সেদিন। ভিজে ঘাসের মধ্যে সেই বিখ্যাত তেরপল পেতে গাড়ির তলায় ঢোকার আগে সকাল সাড়ে দশটায় রবিমামা বললেন,

-   আজ সূর্যাস্ত অব্দি টাইম, বুঝলি?

আরো দু তিন জন লোক যোগাড় লাগল। সবার আগে বদলানো হল চাকাগুলো। একটা আলাদা ম্যাটাডোরে অনেক জিনিষ এসেছিল সেদিন। গিয়ারবক্স নামানো হল, তাকে ঠিক করা হল। আবার তাকে যথাস্থানে পরে দেওয়া হল।ফ্যুয়েল ঢালা হল। ডিজেল। কুড়ি লিটারের জ্যারিকেন, ফাঁক। আর ও অনেক কিছুই ঠিক করা হল, কিন্তু সেগুলো খুব ভারী কিছু ছিল না। বিকেলে চারটা নাগাদ ঝির ঝির করে বৃষ্টি শুরু হল। রবিমামা গাড়ির নীচে প্রায় পুরোটা ঢুকে গিয়ে বলল

-   গাড়িতে চাবিটা লাগিয়ে স্টার্ট দে।

-   আমি কি গাড়ি চালাতে পারি না কি!

-   তুই দে না!গিয়ারে হাত দিবি না, শুধু চাবিটা ঘুরিয়ে স্টার্ট দিবি। ওকে?

-   ওকে।

আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। ড্রাইভিং সীটে বসে একটা বিলীতি গাড়িতে স্টার্ট দিচ্ছি। আজকের ভাষায়, Just felt out of the world, when I shoved it in right away…It was cool…  Man!”

দরদর করে ঘামছি আমি। উত্তেজনায় হাত পা সিঁটিয়ে গিয়েছে। হাত কাঁপছে চাবিটা ঘোরাতে।

সাথে যে লোকটা এসেছিল, তাকে দম ঘোরাতে বলা হল। (সে যুগের গাড়ির ইমার্জেন্সী স্টার্ট গাড়ির সামনে দম দিয়ে দেওয়া হত। অনেকটা গ্রামাফোন রেকর্ড বা জেনারেটর চালু করার মত।)

আমার দম বন্ধ।

চাবী ঘোরালাম।

হোঁক করে একটা শব্দ হয়ে থেমে গেল।

-চাবিটা ঘুরিয়ে ছেড়ে দিবি না, কান মুলে ধরে থাক

রবিমামা চিৎকার করে বলল।

আবার ঘুরিয়ে ধরে রইলাম

হোঁকহঁওওওওওওওকগোঁওওওওওওওওওওওওওক-করে কেমন নেতিয়ে পড়ল গাড়িটা।

-আবার দম দাও করিম ভাই

করিম ভাই এর বয়েস চল্লিশের কাছাকাছি। পান খেয়ে সব দাঁত লাল

-   লিজিয়ে দাদা

বলে এমন দম ঘোরাতে লাগল যে চার্লি চ্যাপলিন ও হার মেনে যাবেন।

-   নে।আবার স্টার্ট দে

চাবি ঘুরিয়ে ধরে থাকার তিন সেকেণ্ড পরেই গাড়ির স্টার্ট আর থামল না।

ভরররররররর!!!! সদ্যোজাত শিশুর কান্নার মত!!!!

-নেমে আয়

রবিমামা বেরোলেন গাড়ির নীচ থেকে।

আমি নামলাম গাড়ি থেকে।

আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

-   তোকে ছাড়া হত না, জানিস। বন্ধুদের ডাক, দেখুক ওরা তুই কি করেছিস

শুনেছি আমার বাবার দিকের পরিবারে যাঁরা যাঁরা ডাক্তার হয়েছেন , তাঁরা সবাই প্রায় মড়া মানুষ-কে বাঁচিয়ে রাখার যোগ্যতা রাখতেন ও রাখেন।

কিন্তু সেদিন যা ঘটল, তা মড়া মানুষ বাঁচানোর থেকেও কঠিন ছিল।

বন্ধুরা যখন সেদিনের joyride নিচ্ছিল, আমার গর্বে বুক ভরে গিয়েছিল --রবিমামা ও গাড়ি কেউ ই আমাকে ছোট হতে দেয় নি, কারোর কাছে।

কিন্তু আঘাত লেগেছিল কৈশোরের সারল্যে,বড় আঘাত বেশ -- বেলুড়ের বাড়ির মত গাড়ীটাও আমাদের ছিল না

   

No comments: