(দ্বিতীয় পর্বের পর)...
পরদিন সকালে আমার বাড়িতে ফোন এল, সব ঠিক ঠাক আছে কি না। আমি জানতে চাইলাম বিয়ে-টা সুষ্ঠ ভাবে হয়েছে কি না। পোকে জানাল,
-সব ছক উলটে গেছে। সর্ব্বমঙ্গলা
মন্দিরের তালা খুলিয়ে কোনোমতে বিয়ে দেওয়া গেছে। কিন্তু দাদার বাড়ির সেফ হাউসে আর যাওয়া
যাবে না। পুলিশ অলরেডি খুঁজে গিয়েছে। আর এক দাদা-র বাড়িতে ব্যাক আপ ব্যবস্থা করেছিলাম,
কিন্তু সে দাদা-ও এখন আর রাজী নয়, বেঁকে বসেছে। কোথাও আর লুকিয়ে থাকার জায়গা নেই।কি
করি বলত?
-বর-বৌ কে কোনো ভাবে বরের
বাড়িতে এনে তোলার ব্যবস্থা কর। এভাবে পালিয়ে বেড়ালে রিস্ক বেশি। পুলিশ কোনোভাবে তুললে
দু’জন কে আলাদা করে দিয়ে আলাদা পলিটিক্যাল গেম খেলবে,
ফাঁসব আমরা সবাই। তার থেকে অনেক বেশি বুদ্ধিমানের কাজ হবে,পুলিশের জাল এড়িয়ে কোনোরকমে
বাড়িতে এসে ঢুকে পড়া, কারণ সেটা এখন নীতার শ্বশুরবাড়ি। সেখানে দাঁড়িয়ে এখন নীতা সকলের
ঢাল হিসেবে কাজ করবে।
-আচ্ছা, দাঁড়া, কথা বলি
তবে বর-বউ এর সঙ্গে। কি বলে ওরা ফোন করে জানাব।
পরিস্থিতি বেশ জটিল। কাকু
পুরো শক্তি উজাড় করে পুলিশ-কে দিয়ে চিরুনী তল্লাশি চালু করলেন। পোকে যেহেতু বর-বউ এর
সঙ্গে ছিল, ও বেচারা পড়ল গিয়ে পুলিশের কু-নজরে। যত নষ্টের গোড়া নাকি পোকে-ই।
পরের দিন, সারাদিন বাড়িতে
কাটালাম, একটা ফোনের অপেক্ষায়। সেই ফোন এল না। চিন্তা বাড়ল। কোনো খবর নেই কোনো দিক
থেকেই।
তার পরের দিন আবার বেরোতে
পারলাম না। ফোনের সামনে বসে রইলাম। বেলা বা্রোটা নাগাদ সবুরে মেওয়া ফলল। ফোন-টা আসতেই
ছোঁ মেরে তুলে নিলাম। উল্টোদিকে পোকের গলাঃ
-
আধঘন্টার মধ্যে
বারোয়ারীতলায় পৌঁছোচ্ছে বর-বউ। তোরা আয়.। কিচ্ছু করতে হবে না তোদের। শুধু থাকবি। বাড়িতে
কোনোমতে ঢুকিয়ে দেওয়া, এটাই একমাত্র অব্জেকটিভ। যে যা বাজে কথা বলবে, খিস্তি করবে,
কোনো recatকরবি না কেউ। বাড়িতে ঢুকতে হবে, যে ভাবেই হোক। ওদের সব বুঝিয়ে বলে দিয়েছি।
-
বলে দিয়েছিস
মানে…? তূই আসছিস না?
-
মাথা খারাপ
নাকি! পুলিশ আমাকে পেলে এখন ছিঁডে খাবে। আমি আন্ডারগ্রাউণ্ড হলাম। চিন্তা করিস না।
এখান থেকে আশা করি আমাদের আর লাগবে না। নীতা ও বন্ধু এখান থেকে সব সামলে নেবে বলেছে।
শুধু চুপচাপ পাশে থাক। যেখানে যতটুকু কাজে লাগতে পারিস। মনে হয় না তার খুব একটা আর
প্রয়োজন হবে।
-
আচ্ছা বেশ।
পৌঁছালাম বারোয়ারীতলায়।
দেখলাম সব কেমন অদ্ভুতভাবে নিঝুম হয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেই এক পশলা বৃষ্টি হওয়ার ফলে,
সব স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে ভিজে আছে। গুমট বেড়েছে। বটগাছের নীচে বসে থাকতে থাকতে টেনশন বাড়ছিল।
তাই আবার কামিনী স্কুল-লেনের গলির মুখে বাগের মুদিখানার দোকানের সামনের চাতালে বসে
বিড়ি টানতে লাগলাম। সবে মনে মনে একটা সিচুয়েশন তৈরী করেছি, সামনে একটা হলুদ ট্যাক্সি
এসে দাঁড়াল।
তা থেকে নামল কনের সাজে
নীতা আর বরের সাজে বন্ধু। কি যে অপূর্ব লাগছিল দু-জন-কে, কি বলব।
কিন্তু তখন সেন্টু খাওয়ানোর
টাইম নেই।বললাম,
-তাড়াতাড়ি চ’…।
-হ্যাঁ চল।
বন্ধুদের বাড়ির সামনে আসতেই
দেখি, বন্ধুর মা আর বোন দরজা ধরে দাঁড়িয়ে। বউ-কে ঢুকতে দেবে না কিছুতেই।
বিয়েবাড়িতে শ্বসুরবাড়িতে
বউ প্রথমবার এলে, এটা একটা খেলার মত, বউ ঢুকতে চাইবে কিন্তু তাকে ঢুকতে দেওয়া হবে না।
অবশেষে, যারা পথ আটকিয়েছে তাদের টাকা পয়সা ঘুষ-টুস দিয়ে তবে শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশের
রীতি। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যাপারটা আর খেলা রইল না। রীতিমত চ্যালেঞ্জিং পর্যায়ে চলে
গেল। ওদের কিছুতেই ঢুকতে দেওয়া হবে না বাড়িতে। প্রায় পনেরো-কুড়ি মিনিটের পরে যা কিছু
উগরে দেওয়ার দেওয়া হল। ক্ষোভ স্তিমীত হতে বন্ধুর বাবা হস্তক্ষেপ করলেন এবং উনি খুব
কম কথার মানুষ আর একগুঁয়ে। হস্তক্ষেপ বলে হস্তক্ষেপ! সোজা নীতার হাত ধরে বললেন,
-
চল তো দেখি,
অনেক হয়েছে…
সোজা ঘরের ভিতরে প্রবেশ।
সামনের ঘরের মধ্যে সবাই দাঁড়িয়ে। নীতা সকলের দিকে হাত জোড় করে বলল,
-আমি কিচ্ছু চাই না, শুধু
একসঙ্গে সবাইকে নিয়ে আনন্দে থাকতে চাই, আর সে জন্য গুরুজনদের আশির্বাদ ছাড়া আমরা সুখে
শান্তিতে থাকব কি করে? দয়া করে আমাকে আপনাদের পরিবারে স্থান দিন, আপনাদের একজন করে
নিন, দেখবেন, ঠকাব না।
এরপর আর কি বলতে পারে একজন
একা ওই বয়েসের মেয়ে? সকলেই একটু একটু করে নরম হলেন। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
পুলিশ এসে আরও একবার সরল-কে
জটিল করে তোলার চেষ্টা করবে ভেবেছিলাম, মানসিক ভাবে প্রস্তুত ও ছিলাম। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে
আর এল না।
চিন্তা রয়ে গেল পোকে কে
নিয়ে। কোথায় কি ভাবে গা ঢাকা দিয়েছে কে জানে।
বিকেলে বন্ধুর সঙ্গে দেখা
করলাম। শুনলাম ওর কাছ থেকে যে বর্ধ্মানে পুলিশ দারুণ ভাবে খুঁজেছে ওদের। নেহাত পোকের
নেটওয়ার্ক খুব পোক্ত ছিল বলে বার তিনেক ধরা পড়ার হাত থেকে বেঁচেছে। পোকে আর ও মিলে
ঠিক করে তারপর যে পুলিশের নাকের ডগায় থাকলে সেখানে খানাতল্লাশি কম হবে। তাই ওরা লুকিয়ে
ভোরের ট্রেনে এসে পৌঁছায় হাওড়ায়, সেখান থেকে সোজা শিয়ালদা। প্যালেস হোটেলে থেকে সেদিন
এই বিয়ে খাতায় কলমে আইনি ভাবে রেজিস্টার করে ফেলা হয়। তখন আগে থেকে নোটিশ দেওয়ার এত
জটিল ঝামেলা ছিল না। তারপর দিন বাড়ি।
কিন্তু পোকে-কে নিয়ে কি করা যাবে? ও কোথায়?
বন্ধু বলল,
-ছেড়ে দে…সময় বুঝে ঠিক ফিরে আসবে।
-আরে কোথায় কিভাবে আছে জানা দরকার।
-কোনো দরকার নেই…ঠিক চলে
আসবে। যেখানেই থাকুক না কেন, ঠিক-ই থাকবে।
যেমন কথা তেমনি কাজ।
দু’দিন নিরুদ্দেশ থাকার পর বাবু ফিরলেন পাড়ায়।
শিবপুরে ওদের আর একটা বাড়ি আছে। সেখানে গা-ঢাকা দিয়ে
ছিল। কিন্তু পুলিশ খবর পায় এবং নানা রকম ভাবে ওকে তাড়া করে বেড়ায়। শেষে স্থানীয় রাজনৈতিক
দাদাদের আশীর্বাদ ও ভালবাসায় পুলিশ-কে ম্যানেজ করা যায়। তাঁরা সবাই গ্রীন সিগন্যাল
দেওয়ার পর পোকের অজ্ঞাতবাস শেষ হয়।
সেই হাসিমুখে দাঁত বের
করে পোকে বলল,
-
পুরো বিয়ের
খরচটা বাঁচিয়ে নিলি। আমি-ও ভাবছি এরকম কিছু একটা করব।
আমি বললাম,
-এর পরেও?
পোকে বলল,
-কেমন একটা বেশ ক্ষত্রিয় ক্ষত্রিয় ব্যাপার আছে, মহাভারতের
মত…ওরকম ম্যাদামারা বিয়ে করে কি হবে…! শাদী হো তো এইস্যা! রূদ্ধ্বশ্বাস…
আর করলও তাই। পালাল একদিন।
আবার শিয়ালদায় রেজিস্ট্রেশন, অন্যতম সাক্ষী সেবারে
আমি। আর চুটিয়ে খাওয়া-দাওয়া হল সেদিন নিমতার এক ফ্ল্যাটে।
আমাদের সকলের ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, প্রাপ্ত-বয়স্ক-ও
বটে অনেকেই। তারপর কি হয় আমাদের, বাবা-মা হিসেবে, দেখা যাক…এদের জেনারেশনে আবার ব্রেক-আপ পার্টি আর সেলিব্রেশন একটা ন্যাচারাল ব্যাপার…তাই আর এই পুরো গল্পের নীতিবাক্য খুঁজে পেলাম না…
একটাই লাইন মনে পড়ল,নাকখত-এর মডার্ন্ বাংলা স্টাইলঃ
“নাকে নাক ঘষে দে’না…টুম্পা”।
