Sunday, 25 April 2021

অধরার দৃশ্যকল্প -- 'কারুবাসনা'-য়


জীবনানন্দ দাশ - নামটা শুনলেই কি কি মনে হয় সাধারণ মানুষের? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরে আধুনিক বাংলা কবিতার আগুনপাখি, আর ট্রামে চাপা পড়ে মৃত্যু? বার বার কবিতায় পাওয়া যায় মৃত্যুর দ্যোতনা- কালপেঁচায়। বার বার মন হতে চায় পাখি, গাংচিলের রূপ ধরে। এই সব metaphor বড় সাধারণ নয়। আধুনিকতা কোথাও কোথাও তাই এমন বিমূর্ত হয়ে ওঠে যে সাধারণ পাঠক আর তার কূল-কিনারা পান না। উপমা কোন ধানসিঁড়ি বেয়ে আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে, তার কোনো ঠিক-ঠিকানা থাকে না, কারণ সেই সিঁড়ি ভাঙা বড় কঠিন, তার প্রতি ধাপে লুকিয়ে আছে অপার সৌন্দর্য, যা এক চরম না পাওয়া কে ব্যাখ্যা করে, অথবা সেই আপাত সৌন্দর্যের আড়ালে থাকে নির্মম বাস্তব যা গভীর satire ba irony দিয়ে মোড়া। সহজ কথায়, জেমস জয়েসের 'ইউলিসিস' যেমন আজও মানুষের কাছে সম্পূর্ণতা নিয়ে ধরা পড়েনি, ঠিক জীবনানন্দ ও একই রকম ভাবে সম্পুর্ণ রূপে অধরা থেকে গিয়েছেন। কবিতার মান কে তিনি এতটাই উঁচু মানে বেঁধেছেন, যে সেখানে পৌঁছে তার যথাযথ ব্যবচ্ছেদপূর্বক অনুধাবন করা কষ্টসাধ্য-ই নয় অসম্ভব-ও। অধরা। 


জীবনানন্দের কাব্যমনন ও তাঁর কবিতার কাব্যগুণ এতই বহুচর্চিত যে তাঁর লেখা গদ্য, বিশেষতঃ উপন্যাস, নিয়ে চর্চার খুব অভাব। অনেক বাঙালী জানেন কি না সন্দেহ, যে তিনি বেশ কিছু উপন্যাস লিখে গিয়েছেন। সে সব উপন্যাসে আছে টা কি! আসলে entertainment value বলতে যা বোঝায়, তা এসবে পাবেন না। যা পাওয়া যাবে তা হল, অপার অশেষ বেদনা ও এক কবি মননের চিরন্তন crises, যে সে যা চায় তা পায় না। প্রতিটি উপন্যাসের পাতায় পাতায় ঠাসা কষ্ট, শোক, বেদনা। একঘেয়ে লাগে না। যা হয় তা হল, নেওয়া যায় না, পাঠকের হৃদয় এই বেদনার একটানা অভিঘাত নিতে প্রস্তুত নন। সামাজিক ভাবে কষ্ট কে ফুটিয়ে তুলে পাঠক কে কাঁদিয়ে দিতে শরৎচন্দ্রের ওপর কেউ ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ যেখানে যা বেদনা ও আর্তির কথা বলেছেন, তা সামাজিকই হোক বা ব্যক্তিগত তার মধ্যে এক স্বর্গীয় অবশ্যম্ভাবীতা রয়েছে, যা বেদনা কেও মায়াবী করে তোলে। কিন্তু এ কেমন বেদনা, যা জীবনানন্দ তাঁর উপন্যাসগুলো কে ভরিয়ে তুললেন, অতি সাধারণ মানুষের অসাধারণ সারস্বত আশির্বাদকে তুলে ধরতে গিয়ে! তল পাওয়া যায় না, মার্গ পাওয়া যায় না। শুধু মুচড়ে ওঠে হৃদয়, এত নিঃশব্দে মানুষ এত কষ্ট-ও পেতে পারে! কিন্তু সেই কষ্ট তাকে শাণিত করে, হারে না সে। দুর্বোধ্য হতে হতে অজেয় হয়ে যায়। 


২০১৫ সালের ২২ অগাস্টে প্রথম শো হয় জীবনানন্দ দাশের 'কারুবাসনা' (A Quest for Aesthetics)। অনেকের বিশ্বাস এটা জীবনানন্দের autobiography। 'পঞ্চম বৈদিক' এই অসাধারণ উপন্যাস-কে কি করে নাট্যরূপে স্টেজে বাঁধল, তা দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলাম। এই নাটকের শো বড় একটা হয় না। কোভিড পরিস্থিতি আনলকড হওয়ার সুবাদে আমি আর আমার ছেলে মিলে দেখতে গেলাম অর্পিতা ঘোষের নির্দেশনায়, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের মঞ্চ নির্মাণ ও সজ্জায়, জীবনানন্দের লেখা, পূর্বে জয় গোস্বামী আর সেদিন শ্রীজাতর মঞ্চে উপস্থিতিতে অনির্বান ভট্টাচার্য ও সুজন মুখোপাধ্যায় অভিনীত 'কারুবাসনা'। 


'পঞ্চম বৈদিক' চিরকালই উন্নাসিক। আমার বাবা বলেন, শম্ভু মিত্রের কঠোর নিয়মানুবর্তীতার কারণে এটা হয়েছে। দলের আভন্তরীণ নিয়মানুবর্তীতা যে কঠিন মার্কেটিং এ আর্টিফিসিয়াল ডিমাণ্ড তৈরীতে ফোকাস করে ফেলেছে, লোক দেখিয়ে, সেটা হাড়ে হাড়ে অনুভব করলাম। প্রথম ধাপ, একদিন আগে থেকে একটা টিকিট নেই টিকিট নেই হাহাকার। সুজনের মাধ্যমে টিকিট রাখা হল। শো এর আগে গিয়েও দেখা গেল, দিব্যি টিকিট বিকোচ্ছে, কাউন্টার থেকে। 'Third Bell'-এ 'পঞ্চম বৈদিক' টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা রাখে না, কারণ, ওদের টিকিট অত সস্তা নয়, যে বাড়ি বসে পেয়ে যাবে। দ্বিতীয় ধাপে আরও স্পষ্ট হল, marketing strategy কাকে বলেঃ


তিনটের সময়ে শো শুরু হওয়ার কথা। তিনটে দশে, অর্ধেক হল খালি, লোক তখনো টিকিট কেটে ঢুকছে। ঘোষণা হল, "বাইরের গেটে এত দর্শক যে ঢুকতে সমস্যা হচ্ছে। তাই আরও আধঘন্টা সময় চেয়ে নিচ্ছি।" এই সময় চাওয়ায় কোনো খেদ বা গ্লানি নেই। 'পঞ্চম বৈদিক' বলে কথা! তাদের এটা সাজে। আমি আর আমার ছেলে বাইরের প্রবেশ পথে গিয়ে দেখলাম, কুল্লে আট-দশ জন হবে। আর বাইরে টিকিট কাউন্টারে বেশ ভিড়। বুঝলাম, উদ্দেশ্য বিক্রির target ছোঁয়া, আসলে। তাই নাটকের আগেই নাটক। 


শো শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাহিত হলাম হেম আর কল্যাণীর তিন বছরের বিয়ে হওয়া দাম্পত্য জীবনের জটিলতায়। কবি হেমের রোজগারপত্তর কিছু নেই। একমাত্র রোজগেরে হলেন বাবা। পিসিমা আছেন। কল্যাণী আর হেমের সম্পর্কে হিমশীতলতা। কল্যানী এক গেলাস দুধের জন্য লোভী ও স্বার্থপর। সেখানে স্বামীসেবা হাস্যকর। মাঝে মাঝে উচ্চশিক্ষিত হেম কলকাতায় কাজ খুঁজতে গিয়ে পুরোনো বই-এর রাজ্যে ডুবে যায়। তিন চার দিনের জন্য বাড়ি এসেছে বলে গ্রামে ফিরে আর ফিরতে চায় না কলকাতায়। তার একটাই বাসনা, সে শুধু লিখবে আর লিখবে। ফাঁকা দিগন্তবিস্তৃত মাঠের মাঝখানে থাকবে তার কুটীর। পাশ দিয়ে বয়ে যাবে নদী, ইছামতী, কর্ণফুলী বা মেঘনা। সোনালী ধানের মাঠে ছুটবে সে। গোধূলি আকাশে দেখবে দাঁড়কাকদের বাড়ি ফেরা। এসবের মাঝে হেমের মনে হয়ঃ 



‘‘সব কাজ তুচ্ছ হয়— পণ্ড মনে হয়…।’’

আমরা বুঝে উঠতে পারি না, একটা উপন্যাসে এত কাব্যগুণ-ও থাকতে পারে। অবিশ্বাস্য লাগে যখন শব্দসজ্জা আমাদের শরবিদ্ধ করেঃ 

‘‘সব চিন্তা— প্রার্থনার সকল সময়/ শূন্য মনে হয়,/ শূন্য মনে হয়…।’’


আলো অন্ধকারের খেলায় জেগে থাকে শুধু নানান আকারের কালো কালো বাক্স। যারা দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের অসাধারণ সিনোগ্রাফি-কে দিতে থাকে রঙ ও রূপ। তাদের গায়ে আঁকা হতে থাকে কল্পনার ধারালো শব্দ, প্রতিনিয়ত, অথবা শব্দের আদলে বিমূর্ত চিত্রকল্প।


সব হেম এঁকে চলে, লিখে চলে, জীবনকে কিভাবে বাগে আনবে বুঝতে পারে না, কারণ তার কবিসত্ত্বা লাগামছাড়া, বাঁধনহীন। আর সেই crises কে মাত্রা দেয় তার আর এক অন্তরাত্মা। লড়াই চলে দু'য়ের। আপসহীন লড়াই।


কবির জীবন পলায়ণের জীবন। তাই সমস্ত কিছু, যা বলতে ইচ্ছে হয় না, করতে ইচ্ছে হয় না- সেগুলোকে আঁকড়ে থেকে চলাকেই জীবন বলে মেনে নিতে হবে। এহেন অপ্রেম-কে বইতে বইতে বাড়তি হয়ে পড়ে সে। জন্ম নেয় আর এক অন্তজঃ হেম। দুজনে দুজনকে কাটতে কাটতে কবিতার প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে হেমের সবটুকু, সে ফুরিয়ে যেতে চায়। পিঠোপিঠি বসে, মুখোমুখি দাঁড়ায়, হামাগুড়ি দেয়, বাক্সগুলো হয়ে ওঠে চিন্তার, কল্পনার এক একটা খোপ, তারা আঁচড় কেটে বেরিয়ে আসতে চায়, পারে না। তারা নড়ে চড়ে, হাত বদলায়, স্টেজে নিরন্তর বদলাতে থাকে তাদের সত্ত্বাও, কখনো মন, কখনো আসবাব, কখনো নায়কের পৃথক দুই সত্ত্বার মাঝে সেতু। 



আলো-অন্ধকারে যাই— মাথার ভিতরে/ স্বপ্ন নয়, কোন এক বোধ কাজ করে;/ স্বপ্ন নয়— শান্তি নয়— ভালবাসা নয়,/ হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়। 


নেমে আসে কবি, বুকের মাঝে। আগে জয় গোস্বমী করতেন। শারীরিক কারণে এখন আর পারেন না। জায়গা নিয়েছেন শ্রীজাত। মনে হয় যেন তিলে তিলে রিলে রেসের ব্যাটন হাত ঘুরে পোঁছাচ্ছে পরের প্রজন্মে। 


যে অপ্রেম কবির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে কবিতাকে কেড়ে নেয়, তা হেম কে ডানা মেলা পাখি করে দেয়। বাতাসে সাঁতার দিতে দিতে লোপাট হয়ে যেতে চায়। কারণ সমাজ সংসারে সে নিরাশ্রয়। প্রতিটা সিঁড়িতে পিছলে পড়তে পড়তে তার মনে ভাবনা আসে যে কবিতাই তার যত নষ্টের মূলে। কবিতাই তাকে শেষ করে দিয়েছে। 

তার কারুবাসনা তাকে তার জীবনকে ভরিয়েছে ছাই-কালি-ধূলির শূন্যতায়।


— ‘‘একটা জীবন পোড়ে কেবল পোড়ে/ আর যেন তার কাজ ছিল না কোনও।’’


হেম বিলীন হতে চায় কারুপ্রেমীর যন্ত্রণা নিয়ে। কিন্তু দিচ্ছে কে, যেতে। উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে হেমের কাকারা, জীবন যাঁদের কাছে অসামান্য পুরস্কার। জীবনবোধের উল্টোপিঠ ও পাঠঃ


"পৃথিবীকে যদি উপভোগ করতে চাও, তা হলে সৃষ্টির ভিতরকার অক্লান্ত সুবিধাবাদ ও আত্মপরতাকে মনপ্রাণ দিয়ে গ্রহণ করতে শেখো।’’


গভীর অন্তঃক্ষরণের বিন্দু বিন্দু মিলিয়ে জেগে ওঠে আয়নাঃ কারুশিল্প প্রতিবিম্বিত হয়, সামনে দাঁড়ালেই, ট্রামের ঘন্টি বাজতে বাজতে মিলিয়ে যায়, এক শৈল্পীক অন্ধকারের নিস্তব্ধতায়। মুক্ত হয় সব কিছু। 


মজার ব্যাপার, এই শেষ দেখতে দেখতে মনে হল, ঔপন্যাসিক জীবনানন্দ রচনার সময়ে জানতেন না, ট্রামের ঘণ্টি তাঁর নিজেরই মৃত্যুর দ্যোতক।


জীবনানন্দের সঙ্গে নাটককে ঋদ্ধ করতে মিশেছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী। আর আছে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের থিয়েটার জুড়ে যে নাট্যরূপ, সেটিও।


নাটক বাঁধলেই তো হল না! তাকে স্টেজে সেই মাপে অভিনয় করে দেখাতে হবে। সত্যি বলতে কি একেবারে অনাড়ম্বর, উত্থান-পতনহীন এই নাটকটিকে গোগ্রাসে গেলালেন দর্শক দের টানা দু-ঘন্টা ধরে, নাটকটির প্রতেক অভিনেতা, সে হেম আর তার কাউন্টার সেলফ, বাবা, কল্যানী, পিসিমা, কাকা যিনি-ই হোন না কেন! চোখ মন কোনোটাই ফেরানো গেল না। দর্শক নির্বাক হয়ে গোগ্রাসে গলাধঃকরণ করতে লাগল, প্রতিটি দৃশ্য, তার বিন্যাস, সংলাপ ও উপস্থাপনা। ফিসিক্যাল ফিটনেস কোন পর্যায়ে থাকলে এই ধরণের নাটকের নায়ক হয়ে ওঠা যায়, তা দেখে শেখা উচিত অনির্বাণ আর সুজনের কাছ থেকে। কল্পনার জগৎ-কে কী অবলীলায় ও সাবলীল ভাবে এক প্রায় মুক্ত ও আধুনিক কিন্তু ধ্রূপদী নৃত্যশিল্পের পর্যায়ে তুলে ফেলা যায়, তা দেখে মুগ্ধ হতে হয়। ব্যক্তির আয়না হয়ে ওঠা আর এক ব্যক্তি হয়ে ওঠা স্টেজে, খুব সহজ কাজ নয়। এক সময়ে গুলিয়ে যায়, মিশে যায় ব্যক্তি আর আয়না পৃথক থেকেও। আমরা, দর্শক-রা ধাঁধায় পড়ে যাই, কোনটা আসল হেম আর কোনটাই বা তার আয়না। হেম-কে তার বাবা-ই একমাত্র বোঝেন। তার অন্তর্দ্বন্দ্ব-কে অনুধাবন করেন। কোথাও বোঝা যায়, বাবার পাকা দাড়ি-গোঁফ শুধু বাবার বাস্তবে পূর্ণতার লক্ষণমাত্র। অনেক আঘাত মেরে ফেলেছে বাবার মধ্যে-র বিশাল কাব্য-কে। হেম বয়ে চলেছে সেই জিনতত্ত্বের উত্তরাধিকার, তার স্বাতন্ত্র ও স্বাধীনতা নিয়ে। 



-- ...পায়ে হেঁটে ফিরবে আবার। শরীরের ভেতর যত না কষ্ট, আত্মার দিক দিয়ে তার চেয়ে ঢের বেশি অপচয়; কেন এই অপচয় করবে তুমি?'

- - তা না হলে কি করব?

-- তা তুমি জান। আমার সন্তান হয়ে যখন জন্মেছ তখন অনেক বেদনা বইতে হবে তোমাকে। কিন্তু প্রাণ যাতে চিমসে হয়ে যায়, ক্ষুদ্র হয়ে পড়ে, এমন কোনো জিনিস কোরো না তুমি। বেদনা ও সংকীর্ণতা এক জিনিস নয়। যে কোনো কাজে বা চিন্তায় জীবনের প্রসার নষ্ট হয়। তার থেকে নিজেকে গুছিয়ে নিও। বরং বাড়িতেই চলে আসবে আবার, কি আর করবে! পনেরো টাকার টিউশনের জন্য, টিউশনের টাকার প্রতিটি কানাকড়ি বাঁচানোর জন্য হ্যারিসন রোড থেকে চেতলায় হেঁটে যাওয়া-আসা -- জীবনে এত বড় শকুন কোনোদিন সাজতে যেও না তুমি।


কি অমোঘ শিক্ষা বাবার, ছেলেকে। অপত্য স্নেহ-বেদনার টানা পোড়েনে কি মাপের সমতা সমঝোতা। 

যখন একই ঝোঁকে জীবনে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কথা চলে আসেঃ 

-- কলকাতায় তোমার কোনো বন্ধু বান্ধব নেই?

-- বছরের পর বছর ক্রমেই কমে যাচ্ছে।

-- কেন?

-- মতিগতির পার্থক্য বেড়ে যাচ্ছে হয়ত --


-- তারা হয়ত সাংসারিক সফলতা লাভ করেছে।

-- হ্যাঁ কেউ করেছে। কেউ চেষ্টায় আছে।

-- যাদের সঙ্গে থাকতে, কলেজে পড়তে, তারা আজ ট্রামে করে সেক্রেটারিয়েটে যায় আর তুমি ঘোরো ফুটপাতে?

-- অনেকটা তাই।

-- অবিশ্যি এতে ব্যাথা পাওয়ার-ই তো কথা।

-- না সেক্রেটারিয়েট আর এমন ----- কি জিনিস, সেখানে ঢুকতে না পেরে খুব বঞ্চিত হলাম এ-কথা অবিশ্যি মনে করি না।

-- নিজের মনকে হয়ত সান্ত্বনা দাও, এই ভেবে যে পার্টি-পলিটিক্স ঢের বড় জিনিস। সেখানে সকলের অবাধ প্রবেশ। হয়ত কোনো এক ভবিষ্যতে সেখানে নেতা হয়ে বসবে।

-- না অতদূর ভাবি না।

-- খানিকটা ভাবো নিশ্চয়ই, ভাবাই স্বাভাবিক। জীবনের আরাম ও বিলাসের জিনিসগুলো যাদের হাত থেকে ফস্কে গেছে, অবশেষে তারা ত্যাগ ও মহিমার অকৃত্রিম ভক্ত হয়ে ওঠে, না হলে দাঁড়াবে কোথায় বল? ঐশ্বররয যাকে নিষ্ঠুরভাবে প্রবঞ্চিত করে, ঐকান্তিক অশ্রু দিয়ে ত্যাগকে পূজা করবার শক্তি তার যেমন হয়, আর কারু তেমন হয় না।

সন্তানের পার্থিব সাফল্যের বাইরে গিয়ে মনে হয় না কি পিতা এখানে পুত্রকে এক অমোঘ যথার্থ চিরকালীন শিক্ষাদানে রতঃ 

এই মোহ-মায়া বিহীন ত্যাগের-ই নাম, 'কারুবাসনা'!

কার্টেন কল-এ নাটকের বার্তার সঙ্গে দলের হাবভাব কিছুই মিলল না। সবার মধ্যে ঝরে পড়ছে, অস্মিতা ও অহঙ্কার। কেন বা কি জন্য, তা আমার কাছে অজানাই থেকে গেল। যা বলছেন আর যা করছেন, দুয়ের মধ্যে অলোকবর্ষের ফারাক। কষ্ট সেটাই, এবং সেটা অনেকটাই।

































Friday, 23 April 2021

দু-মুখো

 এ বাবা! না, না! আমি একেবারেই কোনো রাজনৈতিক বিষয়ে প্রবেশ করার প্রতিপাদ্য হিসেবে এমন একটি নামকরণ বেছে নিই নি। এই কথার প্রাথমিক অবতারণার কারণ হল, মানুষ এখন নিঃসন্দেহে judgemental হয়ে পড়েছে। এটা আমাদের দোষ নয়। পরিস্থিতি আমাদের বাধ্য করেছে, নিজের জ্ঞানগম্মি পাশে সরিয়ে রেখে চটজলদি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে। তাতে দু'টি চরম সুবিধা আছেঃ প্রথমতঃ সমস্যার তাৎক্ষণিক দ্রুত সমাধান হয়, দূরবর্তী ফলাফল ব্যতিরেকে, আর মূলতঃ এই ধরণের সিদ্ধান্তে একটা herd immunity তৈরি হয় যেখান থেকে প্রান্তিক কয়েকটি মুষ্টিমেয় মানুষ কি বললেন, তাতে বৃহত্তর সমাজের কি-ই বা যায় আসে! তাঁরা কাঁঠালের আঠা, লাগ্লে পরে ছাড়েন না, এমন শালা পিরীতি, সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে...তাদের কিলিয়ে just পকা পক পাকিয়ে দিলেই হল!


ব্যাপারটা ভারী ও নগ্ন হয়ে যাচ্ছে। ফিলজফিক্যাল আলোচনার গভীরে প্রবেশ করার মত জটিলতার সৃষ্টি হতে চলেছে।কিন্তু বিষয়টি আদপেই একেবারে ভিন্ন, সরল এবং অতি সাধারণ। কেউ অন্য কোনও যোগাযোগ খুঁজে পেলে, তা কাকতালীয় ও ব্যক্তিগত। Infotainment না কি  entertainment আপনার 'একান্ত আপন' হাতে! 


সেদিন শেষ স্কুলে যেতে হবে। আবার কোভিড ১৯ এর প্রকোপে সরকার বাহাদুর আমাদের রাজ্যে বিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ ঘোষণা করেছেন। পাহাড়-প্রমাণ কাজ জমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। বেতনের রিক্যুইসিশন-ও জমা করা হয় নি। আমার ছেলের এদিকে ক্লাস টুয়েলভের বোর্ড প্র‍্যাক্টিক্যাল পরীক্ষা। কোভিড থেকে তাকে দূরে রাখার প্রয়াসে আমি-ই দায়িত্ব নিয়েছি গাড়ি করে তাকে দিয়ে ও নিয়ে আসার। সুতরাং সেই সকালে মরার সময়-ও নেই। মৃত্যু এলেও তাকে একটু দেরীতে আসতে বললে ভাল হয়। ওয়ান ওয়ের চক্করে না ফাঁসার জন্য গাড়ি নিয়ে আকাদেমি অফ ফাইন আর্টস থেকে একটু বিড়লা তারামণ্ডলেরও দিকে এগিয়ে গিয়ে এলিয়ট পার্কের গেটের সামনে এমার্জেন্সী লাইট জ্বালিয়ে 'নো-পার্কিং' এ দাঁড়িয়ে আছি। স্থির বিশ্বাস যে ছেলে আমার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে চলেই আসবে, রোজ যেমন আসে। চেনা ছক। কিন্তু সেদিন যে কি হল...কুড়ি মিনিট কেটে গেল আসে আর না। গাড়ির মধ্যে গরমে স্টীমড হওয়ার থেকে একটু বাইরে এসে নেমে দাঁড়ালাম। বাইরেটা বেশ আরামদায়ক, আর পুলিশ এসে ছবি তুলে নিঃশব্দে কেস দিয়ে দেওয়ার আগে আমি অন্ততঃ দেখতে পাব, ও কথা বলতে পারব। সত্যি কথা বললে ও দোষ স্বীকার করে নিলে, বেশিরভাগ সময়ে ওনারা ছেড়েই দেন। আমার শিক্ষকতার প্রোফাইল অব্দি যেতে হয় না। সময় যেন আর কাটে না। এতটাই অস্হির হয়ে আছি যে গান শোনা বা ওয়েব সিরিজ দেখে খানিকটা সময় কাটিয়ে দেওয়ার মত মানসিক অবস্থা নেই। সিগারেট খেতেও আজকাল আর ভাল লাগে না। বার দুয়েক ছেলের ফোনে ফোন করলাম। একবার 'স্যুইচড অফ' আর দ্বিতীয় বার বেজেই গেল, প্রভু তুললেন না। ওনাদের যেন স্মার্টফোন টা দেওয়াই হয়েছে ফোন হিসেবে ব্যবহারটুকু বাদ দিয়ে। 


এই রকম মাথা গরম অবস্থায় সামনে এক মহাপুরুষের আবির্ভাব! 

- জ্য় ভোলেনাথ...হমে দো রুপিয়া দে দে বেটা!


এমন হঠাত করে হাঁক পেড়েছে, চমকে উঠেছি। পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে দশ টাকা দিতে যাব, দেখি নেই। একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে বললাম, চল্লিশ টাকা ফেরত দিতে। ওব্বাবা! সে পঞ্চাশ টাকা নোট নিয়ে বাঁ-হাত বের করতেই দেখি, হাতে একটা জ্যান্ত সাপ জড়ানো আর তার মুখে বাবাজী টাকার নোট ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে আমাকে ভয় দেখানোর জন্য সাপটাকে হঠাত আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে কি না,

- বোল বেটা, জয় শিব শম্ভু।




আমি নেহাতই এই শিবঠাকুরের চেলা বলে নিজেকে মানি বলে এই দেবতার প্রতি আমার দূর্বলতার সুবাদে দু'টাকার বদলে দশ টাকা দিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু এই সাধু আমাকে ভয় দেখিয়ে গোটা পঞ্চাশ টাকাটাই আত্মসাৎ করতে চাইছে। মেজাজ এমনিতেই খাপ্পা ছিল। চোখ বন্ধ করে সাপজড়ানো হাতটাকে আমার দিকে এগিয়ে দিতেই, খপাত! বাবাজি-র হাত থেকে সাপ কেড়ে নিয়ে সোজা গাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। বাবাজি অবাক। কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্থবীর, ছবির মত। 


- বেটা ওয়াপিস দে দো! খিলৌনা নেহি হ্যায়! ডস দেঙ্গে তো মর জাওগে। জহরিলা হ্যায়!


ল্যাজ তো নেই, যে দিকের মুখ বন্ধ, সেই দিক ধরে ঝুলিয়ে দিলাম। আর মুখের দিক চেপে ধরে একটা গেঁট। ম্যাজিকের মত সম্মোহিত হয়ে দেখতে লাগল বাবাজি। 


ছোটবেলায় মামার বাড়িতে ছোটমামা আর সন্তোষ দা শিখিয়েছিল সাপ কেমন করে ধরতে হয়। লুকিয়ে লুকিয়ে ধরতাম। নিজের রিফ্লেক্স ঠিক রাখার অব্যর্থ অভ্যাস। বাবাজি তো আর বোঝে নি, যে খাপে খাপ হয়ে যাবে। তাও আবার দু-মুখো বেলে সাপ। সাপুড়ে-রা খেলা দেখাতে এলে যে গুলোর গায়ে গেঁট বেঁধে ঝুলিয়ে দিলে অজগরের মত ওরা নিজেরাই খুলে নিতে পারত। শিরদাঁড়ায় খুব জোর। তবে না আছে ফনা, না আছে বিষ। এদের গা-ও অন্য সাপেদের মত অতটা ঠাণ্ডা হয় না। 




গেঁট খুলতেই আড়াই-ফুটি মোটা দড়ির মত হাতে পাকিয়ে বললাম,

- চল পুলিশের কাছে।


ব্যক্তিগত ভাবে সাপ রাখা অপরাধের মধ্যে পড়ে। বনদপ্তরের সম্পত্তি এরা সব। আমরা কোথাও দেখতে পেলে, বন দপ্তরকে যেন খবর দিই, ওদের মেরে না ফেলে। দপ্তর থেকে লোক এসে ওদের নিয়ে যত্নের সঙ্গে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দেন। মনে রাখবেন। সাপ বর্তমানে endangered। এরা শেষ হয়ে গেলে আর আলোপ্যাথিক ওষুধ পাবেন না। ওদের বাঁচান, নিজেরা বাঁচুন। 


যাক গিয়ে। বাবাজি তো থরথর করে কাঁপে। আর বলে,

- দে দিজিয়ে বাবা! গলতি হো গ্যয়া! প্রভু আপ কা ভ্লা করেগা! 

- আমাকে ভয় দেখাচ্ছিলে কেন!

বাবাজি চোখের ইশারা করতেই দেখি একটা গেরুয়া পরিহিত ছেলে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। বয়েস, আমার ছেলের বয়সীই হবে, বা একটু ছোট।


- এ  কে?

- মেরা লড়কা হ্যয়।

- আমারো ছেলে এর ই মত।

- বহুত বড়া বনেগা আপকা লড়কা। বাহার বিদেশ যায়গা! 

সাপটা ফিরত দিয়ে বললাম,

- আবার বাজে বকছ কেন! 

- দো দিন সে ভুখা হুঁ। দোনো হি। কালিঘাট প্যায়দল যা রাহা হূঁ। অগর কুছ খানে কো মিল যায়ে তো। আপ মিল গয়ে। 

- দেখতেই পাচ্ছি, আমাকেই সাপ দিয়ে খাইয়ে দিচ্ছিলে এক্ষুণি।

- হম আপসে ঝুট নেহি বোলেঙ্গে। হম ইহাঁ কল্কত্তা সে চলেঙ্গে হরদুয়ার। আপকা বেটা ঔর আপ কে লিয়ে দুয়া মাঙেঙ্গে।... আপ ইয়ে রুদ্রাক্ষ রখ লিজিয়ে। আপকে বেটে কে লিয়ে। ইসসে উসকা ভলা হোগা।

- রুদ্রাক্ষ কি প্লাস্টিকের!

- আপকা বিসওয়াস যো ভি হো, ইসকো খোনা মত। গরীব সন্ত আপ কে লিয়ে জরুর দুয়া মাঙেঙ্গে।




কি জানি রুদ্রাক্ষ-টা হাতে নিয়ে মনে হল, নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী অনেক মানুষকে যতটা পারি সাহায্য করার চেষ্টা করি, এরা তো আমার কাছে সরাসরি সাহায্যই চাইছে, আর প্রাণভরা আশীর্বাদও করছে। 


দু-মুখো সাপ আর দু'সাধুর কপালে জুটল দু'শো টাকার নোট।

তাই নিয়েই ওরা নাচতে নাচতে চলে গেল।


দূর থেকে দিনের বেলার ফ্রেমে যেন ধরা পড়ল, সত্যজিৎ রায়ের 'মহাপুরুষ' ছবির শেষ দৃশ্যটুকু।