আমাদের গাইড আমাদের ছেড়ে যখন চলে গেলেন, আমাদের বুভুক্ষু পেটে সকলের বাই উঠল ছবি তোলার। সময় কম। তাতে কি! পোজ় দিতে কি সময় লাগে নাকি!
এটা আমার কথা নয়, যদিও। কারণ আমার ছবি কেউ তুলতে চাইলে সবথেকে মুশকিলে পড়ি, এই ‘দ্যি আর্ট অফ স্ট্রাইকিং আ পোজ়ʼ, নিয়ে। পৃথিবীতে সব থেকে কঠিন বস্তুর মধ্যে এটা একটা। আর তার ওপরে যদি কেউ বলে যে “ভাল করে একটা পোজ দাও তো!” ব্যাস, তাহলে তো হল আর কি, আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়।
নিজের এই দূর্বলতা উপলব্ধি করে, বহুদিন আগে থেকে ক্যামেরার সামনের দিকের থেকে পিছনের দিকে থাকাটা শ্রেয় মনে হয়েছে। ওই পিছন দিকটা অনেকটাই নিরাপদ। ছবি কেমন তুলি, সেটা পরের কথা, কিন্তু পোজ় তো দিতে হয় না, অন্তত:। বরং উল্টাটা – পোজ় দিইয়ে নিতে পারি, তাঁকে বা তাঁদের দিয়ে, ক্যামেরার সামনে যিনি বা যাঁরা থাকেন। আমার অঙ্গুলীহেলনে তিনি বা তাঁরা ওঠেন-বসেন, নড়েন-চড়েন। বাংলায় বলতে গেলে, “ডিফারেন্ট ফিলিং”!
এটুকু অনস্বীকার্য যে সেদিন ওই সময়ে যে আলো আর ব্যাকগ্রাউন্ড নালন্দার আকাশ ও পূন্যভূমিতে পাওয়া গিয়েছিল, তা যে কোনো অ্যামেচার ছবিতুলিয়ের কাছে পরম প্রাপ্তি। প্রাকৃতিক আলোর কোনো বিকল্প ফ়টোগ্রাফ়িতে নেই। তাই খচাখচ ছবি উঠতে লাগল, ক্যামেরায় এবং মোবাইল ক্যামেরায়।
ফটো ক্যুইনের লেটেস্ট পোজ হল একটি গ্রুপে একজন হাফ আকাশের দিকে তাকিয়ে আড়িতে ইন্ডেক্স ফিংগার দিয়ে কিছু একটা দেখাচ্ছে, সুচিত্রা সেনের মত হাফ দাঁত বের করে হেসে। আর বাকিরা সেই অ্যাঙ্গেলে বিভিন্ন রকম বিস্ময়ের অভিব্যক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে। আসলে কিন্তু যেদিকে তাকিয়ে আছে সেদিকে কিচ্ছু নেই, দেখার ও দেখানোর মত। সবটাই পোজ়। ছবি তোলার স্ৱার্থে। একে বলে ডেডিকেশন। এবারে ছবিতুলিয়ের চাপ টা ভাবুন! সাবজেক্ট যদি এরকম ডেডিকেটেড হয়, আর ছবি যদি ফ্লপ হয় তাহলে আর কি… হেঁ হেঁ হেঁ!
আমি বিশ্বাস করি যে সব মানুষই কোনো না কোনো প্রতিভা নিয়ে জন্মান। দুঃখের বিষয় সে সব প্রতিভা সে ভাবে সমাজ-স্বীকৃত নয় | যেমন কিছু মানুষ থাকেন যাঁরা ঈশ্বরদত্ত সেই প্রতিভা নিয়ে জন্মান, যাঁদের কাছে পোজ় দেওয়াটা জল-ভাত। তার জন্য কোনোদিন কোনো আলাদা ট্রেনিং বা কোর্স করতে হয় নি। এ জন্য সমাজে স্ৱীকৃত না হলেও, চদ্দিকে বেশ সুনাম আছে। আর আমরা গর্বিত যে আমাদের দলে সে রকম একজন আছেন, যাঁর ওপরে এই ব্যাপারে সব্বার অন্ধ ভরসা। ভালবেসে সবাই তাঁর নাম রেখেছেন “ফ়টো ক্যুইন”। আর তিনি এটা বললেই, বলেন,
“ইচ্ছে সবার হয়, বদনাম হয় শুধু আমার”!
তখন মনে হয় ʼজয় বাবা ফেলুনাথʼ-এর ডায়ালগ-টা উল্ট ফ্লিপ করে দিয়ে বলি,
-- "বোদনাম কেনো বোলাচেন, নাম বলুন, শোত্যি কোথা কোরুন। বদনাম হোলে, নাম ভি হোবে।”
সুতরাং, তাঁর এই ʼবোদনামʼ-এর তোড়ে, দেদার খিদের পেটে ফ়টো তোলাটা আর ʼবাইʼ রইল না, শিল্পে পরিণত হল।
ধন্যবাদ আলো ও ব্যাকগ্রাউণ্ড-কে – যে কোনো পদিপিসি বা কাত্তিক-দার ছবি রমরমিয়ে এমন উঠতে থাকল, যে বাপরে, আনায়াসে মধু সাপ্রে বা মিলিন্দ সোমন বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। শুধু একটাই ওয়ার্নিং দিতে হল বার বার সবাইকে – “ভুঁড়িটা শ্ৱাস বন্ধ করে টেনে ঢুকিয়ে নাও”। কারণ ওটা কোমানোর মত ফ়টো এডিটর বা হ্যাকস আমার জানা নেই।
পালা করে ছবি তোলা হচ্ছিল। এবারে বুলবুলি আর গৌতমের ছবি তোলার পালা। অনেক ক্যামেরা রেডি। কিন্তু কিছুতেই দুʼজনকে বাগে আনা যাচ্ছে না। দুজনের কেউ না কেউ ছবি বিগড়ে দিচ্ছে। কিন্তু যত দোষ নন্দ ঘোষ। সব দোষ বুলবুলির। ʼশোলেʼ-র বাসন্তির মত অকারণে নাকি বাজে বকে। তাই যতবার গৌতম বুলবুলিকে কোনো এক নির্দিষ্ট দিকে তাকাতে বলছে, সে দিকে তার খেয়াল নেই, বকেই চলেছে। তবে ছবি উঠল। আর তার পরেই নালন্দার লেকচার পডিয়ামে যেন বাজ পড়ল! হঠাৎ বুলবুলি ওই বাজ্খাঁই গলায় জোরে বলে উঠল,
- এই দেখো গৌতম আমাকে ʼবোকাছেলেʼ বলছে।
আর বিশেষ শব্দটি যেন হাইলাইটেড হয়ে নালন্দার লেকচার হলের দেওয়ালে প্রতিধ্ৱনিত হতে থাকল।
আশেপাশে যে যেখানে ছিল নালন্দায় খোদিত স্ট্যাচুর মত স্থবীর হয়ে গেল। যে সমস্ত ছোটরা আমাদের সঙ্গে ছিল, তারা ছ্যাঁকা লাগার মত ছিটকে সরে গেল। একদম সামনে ছিল বেচারা নীল। শান্ত-শিষ্ট ছাত্র। যাদবপুরে পড়ে। অজানা কিছু নেই। সব জানে ও বোঝে। সে বেচারা একদম সামনে পড়ে গিয়ে পালানোর পথ পেল না। তাই ঘটনা ঘটার সাথে সাথে যেন ও কিছুই শোনে নি, এরকম ভাব করে আকাশে পাখি বা মেঘ বা অন্য কিছু খুঁজতে লাগল, যার কোনোটাই আদতে আকাশে নেই। এই অপ্রত্যাশিত বাগাঢ়্ম্বরে স্ট্যাচুত্য ভাঙতে বেশ খানিক্ষণ সময় লাগল।
তবে ভাগ্যিস এই বুলবুলি উবাচের আগে ওদের ছবিটা তোলা হয়ে গিয়েছিল। কারণ বুলবুলির এই সরল উক্তি এবং তা জনসমক্ষে ঘোষণা করে ফেলা গৌতমের মোটেই পছন্দ হয়নি। সে অপমানিত বোধ করেছে। আর নিজের এ হেন উক্তিতে অস্বস্তি পাওয়া তো দূর, গৌতম বেশ ক্ষুব্ধ হল। ও যে এরকম ভাষা ব্যবহার করেছে নিজের স্ত্রীর প্রতি সেই নিয়ে কিন্তু ওর কোন আক্ষেপ নেই। বরং ওদের এই কানেকানে মধুর প্রাইভেট কথোপকথন বুলবুলি পাবলিক করে দেওয়ায় গৌতম বিশেষভাবে বিরক্ত হল। পারলে যেন ওখানেই বুলবুলিকে ধরে দুʼঘা দিয়ে দেয়। আমি গৌতমকে বকেঝকে ওখান থেকে সরালাম।
কিন্তু তার রেশ কাটাতে অনেক সময় লাগল। বাসে নালন্দা থেকে হোটেলে ফেরার সময়ে আবার সেটা নিয়ে বাধল। মিহির-দা ও বউদি রয়েছেন, সেখানে এ সব কি! ছি ছি! স্নেহতুল্য ভ্রাতৃবধূর মুখে বস্তির ভাষা!
কিন্তু কে আর বলে যে, ওই ভাষা তো আর বুলবুলি বলে নি, বলেছে গৌতম।
বুলবুলি শুধু রিপিট মেরেছিল।
ব্যাকসীটে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম প্রায়। সেই অবস্থায় ছিট্কে চলে যাওয়া দুই জেন জ়ি এর কথোপকথন:
- মিস করলি
- কি
- বোম্ব্শেল
- মানে
- আরে বুলবুলি আন্টিকে গৌতম আঙ্কল ʼবোকাছেলেʼ বলেছে। সেটা বুলবুলি আন্টি সবার সামনে বলে দিয়েছে।
- ওহ!! তো?
-আরে ওটাই তো মজা।
- কি আবার মজা!!! বলে ফেলেছে তো ফেলেছে! তুই এটা নিয়ে কি বেকার খুজ্লি করছিস! মাইন্ড ইয়োর ওন বিজ়নেস।
তবে এটা আমারো মনে হয়েছে যে জেন জ়ি আমাদের থেকে অনেক বেশি ভাল। স্ট্রেট, আর প্রিভেসি-কে ভীষণ সম্মান দেয়। পাতি ঘোঁটবাজ নয়। ওদের মনে হয় there are much better things to do in life than ঘোঁটাfy.
It’s even better to sleep than talking about something that gets us nowhere.
(নালন্দা পরের পর্বে শেষ)
কিন্তু কে আর বলে যে, ওই ভাষা তো আর বুলবুলি বলে নি, বলেছে গৌতম।
বুলবুলি শুধু রিপিট মেরেছিল।
ব্যাকসীটে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম প্রায়। সেই অবস্থায় ছিট্কে চলে যাওয়া দুই জ়েন ওয়াই এর কথোপকথন:
- মিস করলি
- কি
- বোম্ব্শেল
- মানে
- আরে বুলবুলি আন্টি কে গৌতম আঙ্কল ʼবোকাছেলেʼ বলেছে। সেটা বুলবুলি আন্টি সবার সামনে বলে দিয়েছে।
- ওহ!! তো?
-আরে ওটাই তো মজা।
- কি আবার মজা!!! বলে ফেলেছে তো ফেলেছে! তুই এটা নিয়ে কি বেকার খুজ্লি করছিস! মাইন্ড ইয়োর ওন বিজ়নেস।
তবে এটা আমারো মনে হয়েছে যে জ়েন ওয়াই আমাদের থেকে অনেক বেশি ভাল, স্ট্রেট, আর প্রিভেসি-কে ভীষণ সম্মান দেয়। পাতি ঘোঁটবাজ নয়। ওদের মনে হয় there are much better things to do in life than ঘোঁটাfy.
It’s even better to sleep than talking about something that gets us nowhere.
(নালন্দা পরের পর্বে শেষ)




