কিছু সত্য থাকে সব সময়ই অপ্রিয় হয় সে রকমই এই সত্য সকলের কাছে প্রিয় নাও হতে পারে। কিন্তু সত্য তো সত্যই। তা জানতে দোষ কি?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল নন্-ইউরোপীয়ান হিসেবে সাহিত্য-কীর্তিতে দেশের প্রথম নোবেল ৷ অবশ্যই গর্বের। সে গর্বকে খর্ব করার জন্য এই লেখা নয় ৷ তবে তাঁর নোবেল পাওয়ার পিছনে যে মানুষটির অক্লান্ত পরিশ্রম ছিল, যাঁর জন্য আসলে প্রথম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পাওয়ার প্রশ্ন ওঠে, যাঁর জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম প্রথম ভারতবর্ষ পেরিয়ে সাগর পারের ইংল্যান্ডে গিয়ে ইংরেজদের কাছে পরিচিত হয়, তিনি আর কেউ নন - আমাদের গর্বের আর একজন মানুষ, যাঁকে নিয়ে চর্চার বড়ই অভাব বটে, সেই সুকুমার রায়, আর সেই আক্ষেপে এই লেখা।
ঘটনা হলো এই যে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন ব্যবসায়ী। তাঁদের ছিল প্রিন্টিং হাউস বা প্রেস৷ সেই প্রেসকে আরো উন্নত মানের করার জন্য উপেন্দ্রকিশোর চাইলেন, যে তাঁর সুপুত্র সুকুমার একদম খোদ বিলেত গিয়ে প্রিন্টিং টেকনোলজি নিয়ে পড়াশোনা করুক৷ আসল ফোকাস পাশ্চাত্যের চালু হওয়া তৎকালীন লেটেস্ট প্রিন্টিং টেকনোলজি হাফটোন কে রপ্ত করে (হাফটোন: অনেকগুলো ডটের সমাহারে একটা গোটা আস্ত ছবি তৈরি করে ফেলা যায় অনেক কম কালি খরচ করে)।
সুকুমার পাড়ি দিলেন লন্ডনের উদ্দেশ্যে। আর ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভাঙ্গে। উনি সেখানে গিয়েই একটা লিটারারি ক্লাব গঠন করে ফেললেন ৷ তৎকালীন লন্ডনের প্রথিতযশা সাহিত্যিক, কবি এবং বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে তাঁর ওঠাবসা ছিল। এনারা একসাথে বসে সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা তর্ক-বিতর্ক করতেন৷ এই সাহিত্য সভাতেই যখন বাংলা সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনার সুযোগ এল তখন সুকুমার সে সুযোগ হেলায় হারান নি। বেঙ্গল রেনেসাঁ-র ঢেউ-কে আছড়ে ফেললেন ইংল্যাণ্ডের হৃদ্পিণ্ডে, রবীন্দ্রনাথের কাজ দিয়ে ৷ যখন বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করা হতো, তখন সুকুমার রায় নিজের নাম বা তাঁর বাবার নাম বলেননি। সেখানে তিনি মেলে ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথের নাম৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি ধরনের কাজ করেন, তাঁর জীবনের ফিলোজফি কি, তাঁর লেখার মধ্যে কি অমূল্য ধনরাজি লুক্কায়িত আছে, সেই সমস্ত কিন্তু সুকুমার রায়ই চোস্ত ইংরেজিতে ইংরেজদের শোনাতেন ৷
এটা একেবারেই ভুল ধারণা যে আমাদের ব্রিটিশ সরকার রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়ে, তাঁকে জেনে নোবেল কমিটিকে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের নাম সুপারিশ করেছিলেন৷ না।এক্কেবারেই, না। ইংল্যান্ডের লোক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে পরিচিত হয় সুকুমার রায়ের হাত ধরে। আর এ কথা অনেকেই জানেন না। না আছে সে ই মানুষটিকে এই নোবেল প্রাপ্তির জন্য ন্য়ূনতম সম্মান দেওয়ার কোনো ন্যূনতম উদ্যোগ। অবাক হতে হয়!
সুকুমার রায় 1911 সালের শরৎকালে ইংল্যান্ডে আসেন এবং প্রথমে 21 ক্রোমওয়েল রোডে নর্থব্রুক সোসাইটিতে বসবাস করেন। তিনি লন্ডন কাউন্টি কাউন্সিল দ্বারা পরিচালিত বোল্ট স্ট্রিটের লন্ডন স্কুল অফ ফটো এনগ্রেভিং এবং লিথোগ্রাফিতে মুদ্রণ অধ্যয়ন করেন এবং তারপর ম্যানচেস্টারে যান এবং ম্যানচেস্টার স্কুল অফ টেকনোলজিতে অধ্যয়ন করেন। বলাই বাহুল্য যে, তিনি লন্ডনের স্কুল অফ ফটো-এনগ্রেভিং অ্যান্ড লিথোগ্রাফিতে ইংল্যান্ডে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, এবং ভারতে ফটোগ্রাফি এবং লিথোগ্রাফির অগ্রদূত ছিলেন। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন তিনি নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার আগে রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা নিয়ে লেক্চারও দিয়েছিলেন। সুকুমার চিত্রকর হিসেবে বিশেষ প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। একজন প্রযুক্তিবিদ হিসাবে, তিনি হাফটোন ব্লকমেকিংয়ের নতুন পদ্ধতিও তৈরি করেছিলেন এবং এই বিষয়ে প্রযুক্তিগত নিবন্ধগুলি ইংল্যান্ডের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল। পেনরোজ অ্যানুয়াল সুকুমার রায়ের দুটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। ইউনাইটেড কিংডমে থাকাকালীন, তিনি 1912 সালে রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটিতে যোগদান করেন এবং 1922 সালে সেখান থেকে ফেলোশিপ লাভ করে আমৃত্যু তার সদস্য ছিলেন।
1912 সালে সুকুমার সেখানে থাকাকালীন রবীন্দ্রনাথ লন্ডনে যান। সুকুমার এমনিতেই রবীন্দ্রনাথের অন্ধ ভক্ত ছিলেন, সঙ্গে পিতা উপেন্দ্রকিশোরের কাছের বন্ধু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের লণ্ডনে আসা তাঁকে আরো উদ্বুদ্ধ করে। সুকুমার রায়ের রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা নিয়ে লণ্ডনে দেওয়া লেকচারগুলো সেখানে আলাদা মাত্রা তৈরী করে।রবীন্দ্রনাথের কাজ সম্পর্কে পাশ্চাত্যের মানুষরা জানলেন, শুনলেন। তাঁর প্রেম ও ঈশ্বরচিন্তা যখন উপলব্ধি করলেন ইংরেজরা, তখন তাঁদের মুগ্ধতার শেষ রইলো না। কিন্তু বিশ্ব সাহিত্যে বাংলার তো আর আলাদা করে তো কোন স্থান নেই তাই জন্য নোবেল পেতে প্রয়োজন হয়ে পড়ল গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার৷
যেহেতু ইংরেজিতে অনুদিত কাব্যগ্রন্থটি একদম ইংরেজদের পড়ার জন্য তৈরি করা হবে সেহেতু বাংলা গীতাঞ্জলির সমস্ত কবিতা কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ইংরেজি ট্রান্সলেশন এ রাখলেন না ৷ বাছাই করা কিছু শ্রেষ্ঠ কবিতা অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ থেকে গ্রহণ করা হলো নতুন ইংরেজী গীতাঞ্জলির জন্য ৷ মূল বাংলা গীতাঞ্জলি-র সঙ্গে ইংরেজী গীতাঞ্জলির অনেকটাই ফারাক। এটিতে মূল বাংলা গীতাঞ্জলি থেকে 53টি কবিতার অনুবাদ রয়েছে, সেইসাথে 50টি কবিতা যা তাঁর নাটক অচলায়তন থেকে এবং আটটি কবিতার বই - প্রধানত গীতিমাল্য (17টি কবিতা), নৈবেদ্য (15টি কবিতা) এবং খেয়া (11টি কবিতা)।
রবীন্দ্রনাথ যে খুব ভাল ইংরেজি লিখতে পারতেন তা নয় ৷ সেক্ষেত্রে তাঁর বাংলা কবিতা গুলির ইংরেজি তর্জমা করার জন্য, সেন্স আর গভীর গূঢ় অর্থকে ট্রান্সলেশনে ধরে রাখার জন্য দু-এক জন বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ মানুষদের সহায়তা নিতেই হল । তাঁদের মধ্যে কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস একজন ৷ ইংরেজী গীতাঞ্জলির মুখবন্ধ ইয়েটস এর-ই লেখা।
সাহিত্য-কীর্তিতে নন-ইউরোপীয়ান প্রথম প্রবাদ পুরুষ হিসেবে নোবেল পাওয়ার কৃতিত্ব অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৷ কিন্তু বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে বাংলা সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথ-কে পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্ব কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নিজের নয়। ঠিক যেমন করে স্বামী বিবেকানন্দ একসময় হিন্দু ধর্মকে একটি ফিলোজফি-মাত্র রূপে শিকাগোর ধর্ম মহাসভার মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে হিন্দু ধর্মের স্থান করে দেন, ঠিক সে রকম ভাবেই যদি বাংলা সাহিত্যকে রবীন্দ্রনাথের কাজের আলোচনার মাধ্যমে বিশ্বের দরবারে প্রথম যদি কেউ পৌঁছে দিয়ে থাকেন, তিনি হলেন সুকুমার রায় ৷
গত 13ই অক্টোবর, 2023-শে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার ১১০ বছর কাটলো ৷ সেই প্রসঙ্গে তাঁর এই নোবেল প্রাপ্তির কৃতিত্বের কোনো ভাগই কি সুকুমার রায়ের উপর বর্তায় না? নাকি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রিতে ডবল অনার্স থাকার জন্য তিনি কোনোদিনই সাহিত্যক্ষেত্রে কল্কে পাবেন না, একজন শুধু ননসেন্স কমেডিয়ান হয়ে ই থেকে যাবেন!
.png)



