Sunday, 28 May 2023

Tea- 20

The wind is blowing hard
There is nothing left to sweep away
Every bit of creation
Is down to the ground
All those are left are:
Dust muck trashes debris
Trunks branches bones
And a few memories
In the minds of Time and satellites 
Saved in black holes
The only music 
That God can hear is
Of the air passing through
The skull of a crocodile
Like the first vuvuzela
He, already too tired of prayers,
Is lulled off to sleep
--
The poem is over now
It is tea-time now 
With some mocha cookies
Topped with chocolate chips 
Cored with liquid black chocolate.

Sunday, 21 May 2023

নটসূর্য অহীন্দ্র চৌধুরী - কিছু কথা

 


যখনই বিভিন্ন জায়গায় আমরা ঘুরতে যাই আমরা অনেক পুরনো বাড়ি দেখতে পাই । সত্যিই সেগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম হলেও কোন কারনে সেগুলো খুবই অবহেলিত - যেমন এখানে আমরা দেখব একটি বাড়ির ছবি এবং তার ভিডিও যেটিকে অবিলম্বে আমাদের একটি অমূল্য সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত করে সরকারিভাবে হয় একটা মিউজিয়ামে বা অন্ততঃপক্ষে হেরিটেজ বিল্ডিং এর সম্মান দিয়ে যথাযথভাবে সংরক্ষিত করা উচিত৷


বাড়িটি হল নটসূর্য অহীন্দ্র চৌধুরীর বাড়ি, নদীয়া জেলার শান্তিপুরে৷ শান্তিপুরের বাগ-আছড়ায়। বাড়িটির ভগ্নপ্রায় দশা আপনারা ছবিতেই দেখতে পাচ্ছেন৷ এই বাড়িটির ছবি আমাকে তুলে এনে দিয়েছেন আমার অত্যন্ত কাছের পরিচিত বহুদিনের বন্ধু সঞ্জয় মালাকার। তিনি পেশায় যাদুকর। তাঁর কাছ থেকে আমি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকি কারণ তিনি পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় তাঁর পেশার দরুন ঘুরে বেড়ান এবং যেটুকু সময় তিনি পান, তাঁর পেশার বাইরে, সেটুকু তিনি সেই জায়গাটির ইতিহাস এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন, যতটা পারেন৷ 

এই অহীন্দ্র চৌধুরী কে ছিলেন কেনই বা হঠাৎ তাঁর বাড়ির সংরক্ষনের এরকম প্রস্তাব - এ সমস্ত তথ্য উইকিপিডিয়াতে আপনারা পেয়েই যাবেন৷ সে নিয়ে চচ্চড়ি পাকানোর কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আমার উদ্দেশ্য যে কথা বিশেষ কেউ জানে না, সে সব নিয়ে। যেমন শুরুতেই বলি, অহীন্দ্র চৌধুরীকে ‘নটসূর্য’ উপাধীতে ভূষিত করেন শ্রীরামকৃষ্ণদেব স্বয়ং। 


অহীন্দ্র চৌধুরী সম্পর্কে গল্প শুনে আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম এই কারণে যে নদীয়ার শান্তিপুরের বাগ-আছড়ায় যেখানে তিনি থাকতেন সেখানে আসলে সঞ্জয় মালাকার মহাশয়ের পিতৃদেব এবং তাঁর পূর্বপুরুষরাও থাকতেন৷ অহীন্দ্র চৌধুরী যখন কলকাতা থেকে বাড়ি ফিরতেন, গ্রামের পথে সঞ্জয়ের ঠাকুরদার সাথে প্রায়ই দেখা হত৷ সঞ্জয়ের ঠাকুরদার সঙ্গে তাঁর ছেলেবেলা থেকেই বিশেষ পরিচয় ছিল৷ তাঁর সাথে তাই দেখা হলে সঞ্জয়ের ঠাকুরদাকে চায়ে নিমন্ত্রণ করা বা তাস খেলতে ডাকা ছিল অহীন্দ্র চৌধুরীর এক স্বাভাবিক অভ্যাস। 

যখন দু তিন সপ্তাহ অন্তর এই শান্তিপুরের বাড়িতে অহীন্দ্র চৌধুরী  ফিরতেন, তিনি সেই লোকালয়ের ছেলেদের খেলার জন্য প্রত্যেকবার কলকাতা থেকে ফুটবল কিনে নিয়ে আসতেন।  সেই বলের মান ছিল আন্তর্জাতিক। গ্রামের ছেলেদের কাছে এ ধরণের বল পাওয়া ছিল স্ব্প্ন।  আর আনতেন যখন, তখন একটা দুটো নয়, অন্তত্: দশটা।  ছেলেরা ওনার গাড়ি দেখতে পেলেই তার পিছনে পিছনে ছুটত আর অহীন্দ্র চৌধুরী একটা একটা করে বল ফেলে দিতে থাকতেন। 

এই গল্প থেকে  আমরা অহীন্দ্র চৌধুরী নামক ব্যক্তিটির একটা পরিচয় পাই যে তিনি অত বড় মাপের মানুষ হয়েও কিন্তু তাঁর সাথে মাটির যোগাযোগ কোনদিনই ছিন্ন হয়নি এবং তিনিও কোনদিনই নিজের মাতৃভূমিকে অবঞ্গা করে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেননি। অঢেল অর্থ উপার্জন করেও যে দু-হাতে টাকা খরচ করতেন তা কিন্তু নয়। বরং উল্টোটাই শোনা যায় – কৃপণ না হলেও, ঘোর মিতব্যয়ী ছিলেন। আর সেই মিতব্যয়ীতা নিয়ে তাঁর বেশ প্রচ্ছন্ন আত্মম্ভরীতাও ছিল। 

সেই আত্মম্ভরিতার মূল্য কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে একটি বড় আঁচড় কেটে গেছে। সেই আঁচড়ের দাগ সারা জীবনে আর মেলায় নি। এই গল্প আমার ফ্রেন্ড্-ফিলোসফার্-গাইড ও গুরুদেবসম অনিন্দ্য রায়-এর কাছ থেকে শোনা। 

ছেলে ইউনিভার্সিটিতে কলকাতায় পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে এবং তা ও ট্রামে বাদুড়-ঝোলা অবস্থায়। এ দৃশ্য চোখে পড়ে অহীন্দ্র চৌধুরীর একজন খুব কাছের মানুষ ও তখনকার বিখ্যাত নট নির্মলেন্দু লাহিড়ীর। তিনি এসে অহীন্দ্র চৌধুরী-কে বলেন যে,

- আপনার ছেলে পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে এভাবে ট্রামে-বাসে বাদুড়-ঝুলে...লোকে কি বলবে!!! আপনি একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারতেন, অনায়াসে... আপনার গাড়িটাই তো দিয়ে দিতে পারতেন যাতে সে সুষ্ঠভাবে তার পরীক্ষাটা দেওয়ার জন্য পৌঁছতে পারে। আপনার তো টাকার কোন অভাব নেই। এইটুকু করলে কি আর হত!!! নিজের ছেলের জন্যই তো.....!!!!

অহীন্দ্র চৌধুরীর তখন বিরাট সম্পত্তি। কলকাতার বুকে সাত-আটটা বাড়ি। সঙ্গে নদীয়াতে অত বড় বাড়ি, অনেক জমি ও বিরাট প্রতিপত্তি।

কিন্তু অহীন্দ্র চৌধুরী তখন বলেন যে
- ও আগে নিজে মানুষ হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াক তারপরে এই সমস্ত বড়লোকি চাল দেখাবে!!!

এই বলে তিনি নিজের ছেলেকে কোনরকম সাহায্য থেকে বঞ্চিত করেন সেই মুহূর্তে।

ভবিষ্যতে সেই ছেলে নিজের যোগ্যতায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে বিলেত যাত্রা করেন ও সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। সেখান থেকে তিনি তাঁর বাবার সঙ্গে আর কোনো রকম সম্পর্ক রাখেন না। তা সত্ত্বেও তিনি মাঝেমধ্যে নিজের বাবা অহীন্দ্র চৌধুরীকে বিলেতে থাকা অবস্থায় যে সমস্ত গাড়ি এবং বাড়ি কিনতেন সে সবের ছবি পাঠাতেন। অহীন্দ্র চৌধুরীর কন্যাসমা ছিলেন তখনকার দাপুটে অভিনেত্রী সরযূ দেবী। তিনি 'শাজাহান' নাটকে শাজাহানের কন্যা জাহানারা-র ভূমিকায় অভিনয় করতেন্। মঞ্চে যেমন সরযূ দেবী শাজাহানের কণ্যার ভূমিকায় অভিনয় করতেন্, বাস্তবেও অহীন্দ্র চৌধুরী তাঁকে নিজের কণ্যার স্থানেই বসিয়েছিলেন। এক্দিন সরযূ দেবী অহীন্দ্র চৌধুরীর জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে চেতলার বাড়িতে হাজির। গিয়ে দেখেন অহীন্দ্র চৌধুরী সারা গাল ভেসে যাচ্ছে চোখের জলে, আর হাতে রয়েছে কিছু ছ্বি।

- কি হয়েছে বাবা?
- তোমার দাদা বিলেত থেকে আমাকে পাঠিয়েছেন...দ্যাখো....

ছবিগুলি নিয়ে সরযূ দেবী দেখেন যে অহীন্দ্র চৌধুরীর ছেলে তাঁর বিলেতে কেনা গাড়ি এবং বাড়ির ছ্বি বাবা অহীন্দ্র চৌধুরীকে পাঠিয়েছেন্। সেই দেখে অহীন্দ্র চৌধুরী হাউ হাউ করে কাঁদছেন।
- এ আমি কি করলাম মা!!! এতটা কঠোর তিনি নিজের সন্তানের প্রতি না হলেও পারতাম। আমি তোমার দাদা-কে জানিয়েছি যে আমি অনুতপ্ত... কিন্তু তা-ও আমার সাথে ঐ ছবি পাঠিয়ে অপমান করা ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক সে রাখে না।
- আপনি পিতা হিসেবে আপনার কর্তব্য করেছেন্, বাবা, বাকিটা দাদা সন্তান হিসেবে কি করবেন্, তাঁর ব্যাপার্...
- না রে মা...আমি বাবা হিসেবে সেদিন ঠিক করিনি....

সেই উপলব্ধি সত্ত্বেও তাঁর সন্তান আর তাঁর কাছে ফেরত আসেননি।

অহীন্দ্র চৌধুরী সম্পর্কে বলতে গেলে তার অভিনয় নিয়ে কথা বলবো না এ তো হতে পারে না। 1921 সালে “সোল অফ আ স্লেভ” ছবিতে তাঁর প্রথম অভিনেতা-নির্দেশক হিসেবে আত্মপ্রকাশ।  এই ছবি নির্মানের জন্য তিনি তাঁর বন্ধু এম্. মুখার্জীর সঙ্গে একটি প্রোডাকশান হাউস, ফটোপ্লে সিন্ডিকেট্, খোলেন।   সোল অফ আ স্লেভ সম্ভবত: ফটোপ্লে সিন্ডিকেটটের প্রথম ও শেষ ছবি। এই ছবির পরে আর ঐ ফটোপ্লে সিন্ডিকেট-এর কথা কোনোদিন শোনা যায় নি। 

এরপরে আসলে তিনি যেখান থেকে নাম করেন সেটা হচ্ছে যে অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনা এবং প্রযোজনায় ‘কর্ণার্জুন’-এর মাধ্যমে।  

সাল ১৯২৩।একটি কাকতালীয় ঘটনা ঘটে গেল। অহীন্দ্র চৌধুরীর থেকে দু’বছরের বড় ও পরে বিখ্যাত অভিনেতা হিসেবে নামকরা দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও অহীন্দ্র চৌধুরী নিজে একই দিনে, একই নাটকে প্রথম আত্মপ্রকাশ করলেন। বাংলার দুই তারকার এরকম একসাথে একই মঞ্চে আত্মপ্রকাশ একটি বিরল ঘটনা। 

দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকার হাত ছিল দারুণ। অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁকে দিয়েছিলেন কর্ণার্জুনে মঞ্চসজ্জার কাজ। একদিন হঠাত বিকর্ণের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করতেন তিনি শেষ মুহূর্তে ডোবালেন।  অপরেশচন্দ্রর মাথায় হাত। দুর্গাদাস তখন অপরেশচন্দ্র-কে বলেন,
-আমি একটু চেষ্টা করে দেখব?
-তোমার সাহস তো কম নয়, এরকম সময়ে আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছ....!!!
- আগগে, ঠাট্টা করছি না...আমি রোজ মহলায় থাকি তো,পাশে বসে বসে দেখি,শিখি,  তাই এ নাটকের পুরোটাই আমার মুখস্থ...আমি যে কোনো চরিত্রে অভিনয় করতে পারি...
- বল কি হে....কই দেখি...বিকর্ণ করে দেখাও...

ওইটুকু চরিত্রে দুর্গাদাস এমন অভিনয় করে দেখালেন যে অপরেশচন্দ্র মুগ্ধ। ভাবলেন এত্দিন তিনি একে দেখতে পান নি কেন!!!!
স্টার থিয়েটারে সেই রাতে মঞ্চের অভিনেতা হিসেবে  আছড়ে পড়লেন বাংলার দুই তারকা: প্রথম অভিনয়েই কিস্তিমাত। দু-জনকেই আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি।
অর্জুনের ভূমিকায় অহীন্দ্র চৌধুরী, বিকর্ণের ভূমিকায় দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।
আর কর্ণের চরিত্রে অভিনয় করতেন তত্কালীন দাপুটে অভিনেতা তিনকড়ি চক্রবর্তী।
পরে দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়োজন অনুসারে কখনো কর্ণ কখনো অর্জুন – দুটি ভূমিকাতেই অভিনয় করে দারুণ খ্যাতি লাভ করেন। 

এর বাইরে দু’জনের অভিনয়ের ফলে মার-কাটারী জনপ্রিয় হয়েছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘শাজাহান’ নাটকটি যেখানে তিনি নাম ভূমিকায় অভিনয় করতেন। ঔরঙ্গজেবের ভূমিকায় অভিনয় করতেন সেই দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। 

এই শাজাহান চরিত্রে যখন তিনি অভিনয় করছেন সেই সময়ের একটি গল্প বলা যাক যে কি মাপের অভিনেতা ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী। ‘শাজাহান’ নাটকের শেষ দৃশ্য যেখানে কারাগারে  শাজাহান বন্দী এবং ঔরঙ্গজেব তাঁর পিতার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছেন --  তিনি যা করেছেন তার জন্য তিনি অনুতপ্ত।  দুজনের খুব কেঁদেছেন দুজনকে জড়িয়ে ধরে। তারপরে শাজাহান তো চিরকালই নরম হৃদয়ের মানুষ ছিলেন। তিনি পুত্রকে ক্ষমা করলেন। নাটক শেষ হল। তখন অহীন্দ্র চৌধুরী গটগটিয়ে গ্রীন রুমের দিকে হেঁটে চলে গেলেন। চেয়ারে বসে মেক্-আপ না তুলেই বললেন
- লাইটম্যান কে ডাক্... 
চারিদিকে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। 
অহীন্দ্র চৌধুরীকে সমস্ত নাট্য জগতের মানুষরা ‘বাবা’ বলে ডাকতেন। লাইটম্যান এলেন, কাঁপতে কাঁপতে।  এসে বললেন, 
- বাবা ডেকেছেন?
- বাঁ চোখের ওপরে লাইটের শেড্-টা পড়ল কেন?
- বাঁ চোখের ওপরে শেড্....!!!  এ হতে পারে না বাবা... হতেই পারে না.... আমি নিজে সব চেক করেছি...বারবার
- তুমি ভালো করে গিয়ে দেখো। ভুল তো কিছু একটা হয়েছে। আমি কি না হলে মিথ্যা কথা বলছি!!! আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমাকে জানাও, যে ঠিক কি হয়েছিল!
- আচ্ছা, বলছেন যখন, দেখছি....
লাইট-ম্যান কিছুক্ষণ বাদে ফিরত এলেন। ফিরে এসে বললেন্, 
- বাবা আপনি ঠিকই বলেছিলেন...লাইটের কাচের উপরে বাঁদিকে একটা হালকা স্ক্র্যাচ পড়েছে... সেই শেডটাই হয়তো আপনার চোখের ওপরে গিয়ে পড়েছে....। 
- বেশ...এর পরেরবার থেকে অভিনয়ের আগে এই সমস্ত স্ক্র্যাচ যদি ঠিক মত চেক না কর তাহলে তোমার মাইনেতে স্ক্র্যাচ পড়বে।
লাইট্ ম্যান পরে বলেছিলেন 
- পঁচিশ বছর ধরে আলো করছি... কিন্তু আমার জীবনে এইরকম আলোর সেন্স, স্টেজে অভিনয় করতে করতে আমি একমাত্র ওই বাবাকেই দেখেছি। 

অহীন্দ্র চৌধুরী তৎকালীন সময়ে সৎ আয়কর-দাতা ছিলেন। আগেই বলেছি যে তিনি নিজে খুব কৃপণ না হলেও মিতব্যায়ী ছিলেন। ডেইলি বেসিসে সে সমস্ত কর্মচারীদের পেমেন্ট দিতেন এবং ভাউচারে সই করিয়ে নিয়মমাফিক তৎকালীন যুগে নিয়মিত আয়কর দিতেন। তিনি কোথাও  ফ্রি-তে কাজ করতেন না। তখনকার যুগে যদি হঠাৎ কোনো শিল্পী মারা যান তাহলে তাঁর স্মৃতিতে ও পরিবারের সাহায্যের জন্য ‘বেনিফিট নাইট’ আয়োজন করা হত। ঘটনা হল ডাকসাইটে নাট্যকার ও অভিনেতা যোগেশ চৌধুরী মারা গেছেন। তাঁর উদ্দেশ্যে আয়োজিত হয়েছে বেনিফিট নাইট্। সেই নাইটকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য একমাত্র ফর্মূলা অহীন্দ্র চৌধুরী-কে হাজির করানো।  তিনি ছাড়া কিন্তু কখনোই টিকিট বিক্রি হবে না। বেনিফিট নাইট লসে চলে যাবে। তখনকার বিখ্যাত শিল্পীরা এই সমস্ত ক্ষেত্রে পারিশ্রমিক নিতেন না। কিন্তু অহীন্দ্র চৌধুরী সেখানেও পারিশ্রমিক নিতেন। আয়োজকদের সাথে এই বেনিফিট নাইনের জন্য তিনি আড়াইশো টাকা নেবেন, রফা হল। এই বেনিফিট নাইটে যোগেশ চৌধুরীর বিধবা স্ত্রী এসেছিলেন। অহীন্দ্র চৌধুরী একটি চিরকুটে তাঁকে গ্রীন রুমে দেখা করার জন্য অনুরোধ পাঠান। তারপর তিনি যখন গ্রীন রুমে এলেন সকলের সামনে তাঁর বিধবা স্ত্রীকে বললেন, 

- যোগেশ-দার মত মানুষের কাছে আমার ঋণের শেষ নেই... আমি অনেক কিছু শিখেছি ওনার কাছ থেকে...কোনো অর্থমূল্য দিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো আমার ধৃষ্টতা হবে...আর তাঁকে নিয়ে আমার কাছে দরাদরি করতে এসেছেন এঁরা....যোগেশ-দার মত শিল্পীর দাম এনারা স্থির করেছেন আড়াইশো টাকা। ওরা আমাকে এটুকুই দিয়েছে। এই বলে আড় চোখে তিনি তাকালেন উদ্যোক্তাদের দিকে। উদ্যোক্তারা লজ্জায় একদম গুটিয়ে পালানোর পথ পায় না। - আমি আমার তরফ থেকে এনাদের হয়ে আপনার হাতে এই সামান্য অর্থ আপনাদের হাতে তুলে দিলাম। উনি অমূল্য... এ কথা বলে একটি খাম তিনি যোগেশ চৌধুরীর স্ত্রী-এর হাতে তুলে দেন। জানা যায় তাতে পাঁচ হাজার টাকা ছিল।


শিশির ভাদুড়ির নাম সবাই শুনেছেন। তিনি ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরীর সমসাময়িক দাপুটে অভিনেতা। সারা বাংলা এনাদের দু’জনের নামে পাগল হয়ে যেত। তখন একটা মজার ব্যাপার ঘটত্: 
অহীন্দ্র চৌধুরী দুটি নাটক একসঙ্গে করতেন: শাজাহান ও মাইকেল মধুসূদন। আবার শিশির ভাদুড়িও ওই দুটি নাটক করতেন : শাজাহান ও মাইকেল মধুসূদন।  দুজনেই এই নাটকজোড়া করেন। আলাদা করো। ব্যাক-টু-ব্যাক ৷ রেশারিশি তো হবেই। সে রেশারিশির অনেকটাই তাঁদের দু’জনার ভক্তবৃন্দের সৃষ্টি। অহীন্দ্র চৌধুরীর দাপটে শিশির ভাদুড়ী সে ভাবে  দর্শক পেতেন না বলে  অহীন্দ্র চৌধুরীর ফ্যানেরা শিশির ভাদুড়ীকে ‘শূন্য প্রেক্ষাগৃহের হালুমবীর’ বলে হাসাহাসি করতেন।  আর শিশির ভাদুড়ীর ফ্যানেরা অহীন্দ্র চৌধুরীকে বলতেন ‘গ্যালারি অ্যাক্টর’। তবে ঐ দুই নাটকের মধ্য শাজাহান চরিত্রে অভিনয় করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন অহীন্দ্র চৌধুরী আর মাইকেলের চরিত্রে অভিনয় করে খ্যাতনামা হন শিশির ভাদুড়ী। অহীন্দ্র চৌধুরীর শাজাহান এমনই বিখ্যাত হয়েছিল যে মেগাফোন কোম্পানী তার অডিও রেকর্ড বের করে। পরে তার ক্যাসেট,এমনকি সিডি -ও, দেখা গিয়েছে। আকাশবানীর আর্কাঈভে সেই অডিও সযত্নে রক্ষিত আছে। বহুবার তা সম্প্রচারিত হয়েছে।
 
আসলে তৎকালীন যুগের বাংলার শিল্পীদের নিজেদের ভিত এমনই শক্ত ছিল যে তাঁরা কেউ কোনোদিন কারো চাটুকরীতা করে উত্থান লাভ করেছিলেন বলে শোনা যায় নি। ফলে  তাঁরা অন্যের অন্যায্য কোনো কথার পরিপ্রেক্ষিতে কাউকে রেয়াত করতেন না।  কাউকে কোন কঠিন কথা শোনাতে পিছপা হতেন না। আর তাতে তাঁদের আত্মসম্মান কোথাও বিকৃত হয়নি। যেমন দুর্গাদাস… (আর একটা খেপে তাঁকে নিয়ে বিশদে গল্প বলা যাবে), 

দুর্গাদাস স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কে বলেছেন যে,
 
- শুনুন...আপনি না থাকলে আপনার চেয়ারের শূন্যস্থান এমনিতেই, না চাইতেই, পূরণ হয়ে যাবে। আমি যেদিন চলে যাব,  সেই শূন্যস্থান কিন্তু আর পূর্ণ হবে না।

এই সমস্ত মাপের মানুষদের আমরা ভুলতে বসেছি।  তাঁদের বাসস্থানগুলি দেখতেই পাচ্ছেন ছবিতে.... কি দুঃখজনক অবস্থার মধ্যে রয়েছে। আমি মনে মনে মাঝেমধ্যে এ সব দেখি শুনি আর ভাবি যে আর স্যার আর্থার কনান ডয়েল একটি কাল্পনিক চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন – শার্লক হোমস। সেই কাল্পনিক চরিত্রকে সম্মান জানানোর জন্য ব্রিটিশরা কিন্তু সত্যিকারের একটি আস্ত বাড়ি তৈরি করে ফেলেছে। সেই অ্যাপার্টমেন্টে শার্লকের সমস্ত জিনিসপত্র থাকে, ঠিক যেরকম আর্থার বর্ণনা করেছেন। আর আমাগো দ্যাশে এত মহীরুহ বাস্তবে থাকা সত্ত্বেও তাঁদের বাসস্থানগুলি ও অমূল্য সৃষ্টিকে রক্ষা ও সংরক্ষণে কি অনীহা ও অবহেলা!  

মুম্বই বেড়াতে গেলে সমস্ত নায়ক-নায়িকা-শিল্পীরা কে কোথায় থাকেন বা থাকতেন তা দেখার জন্য আলাদা করে গাড়ি ভাড়া করা হয়... সে সব না দেখে ফিরে এলে লোকসমাজে মুখ দেখানো যায় না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ঘুরতে আসা ক’জন মানুষকে এই চিত্রকথার অমর মানুষদের বাড়ি দেখাতে নিয়ে যাই, গর্ব করে??? 

বরং বেশিরভাগের ভগ্নদশা দেখে নিয়ে যেতেও লজ্জা হয় ৷ 




                অহিন্দ্র চৌধুরীর বাড়ির ভিডিও (এই লিন্কে ক্লিক করতে হবে)