১৯৮৭
মাছ ধরার নেশা তখন। সাইকেল
চালিয়ে ছাগলছানার প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে সাংঘাতিক দুর্ঘটনা ঘটানোর পরে তা থেকে মাস খানেক
পরে সুস্থ হলাম যখন, তখন আমাকে সেই নেশা থেকে নিরস্ত করার জন্য ছিপ দিয়ে মাছ-ধরাকেই
অল্টারনেটিভ হিসেবে বেছে দেওয়া হয়েছিল। প্রথমে
দড়িতে শামুক ভেঙে বেঁধে ঝুলিয়ে পুকুরের পাড়ে কাঁকড়া ধরা দিয়ে শিক্ষানবিশী। তারপর ছিপ,
ডোর (মাছ ধরার ছিপের বিশেষ সুতো, টোপ, ফাতনা, বঁড়শী, সীসা ইত্যাদি কারিগরী বিষয় নিয়ে
হাতেনাতে চর্চা। এসব কোনো বই পড়ে বা গুগল করে অথবা গাঁটের পয়সা খসিয়ে অনলাইনে ক্লাস
করে শেখা যাবে না আজ-ও। আর পড়ার বই এর বাইরে এ সব বিদ্যা আমাকে আমার জীবনের বৃহত্তর
ক্ষেত্রে কত জায়গায় যে বাঁচিয়ে দিয়েছে তা আমি গুনে বলতে পারব না। হয়ত সরাসরি ভাবে এই
শিক্ষার প্রভাবের মাত্রা আমি ব্যাখ্যা করে বলতে পারব না বটে, কিন্তু উদাহরণ স্বরূপ
বলতে পারি, স্থৈর্য, অভ্যাস, প্রতিবর্ত ক্রিয়া, সাহস এসবই মাছ ধরা থেকে শিখেছি। একটা
ট্যাংরা মাছ, বা কৈ মাছ ছিপে পড়লে তাকে বঁড়শী থেকে হাত দিয়ে ছাড়াতে বেশ বেগ পেতে হয়।
কাঁটা মেরে দিতে পারে যে কোনো ন্যানোসেকেণ্ডে। আবার শোল মাছ ধরার জন্য জ্যান্ত কেঁচো
ধরে তাকে কেটে টোপ হিসেবে দেওয়ার ফলে শেষমেষ একটা আস্ত সাপ বঁড়শিতে উঠলে কি বিপত্তি হয়
তা যাদের কপালে হয়েছে তারাই জানে।
একটা গ্রামে-র একটা সাধারণ
মাঝারী পুকুরে যত রকমের মাছ হয় তার মধ্যে দু’ধরনের মাছ ছিপে ধরতে পারি নি কোনোদিন
–এক, ফলুই মাছ আর দুই, মৌরলা মাছ। ফলুই মাছ আপনার সামনে দঙ্গল বেঁধে শুধুমাত্র দুটো
চোখ সমুদ্রের হাঙরের পাখনার মত জলের ওপর জাগিয়ে রেখে বীরদর্পে ঘুরে বেড়াবে, কিন্তু
ধরতি পারবেক লাই। আর মৌরালা মাছেরা এতই ছোট যে তাদের বঁড়শি দিয়ে ধরা যায় না, কারণ অত
সূক্ষ্ম বঁড়শি তৈরী যদিও করা যায়, কিন্তু না তাকে ডোরে বাঁধা সম্ভব, না তার হাঁ-এর
যোগ্য প্রায়-আনুবীক্ষনীক আটার গুলির টোপ বানানো সম্ভব। একমাত্র উপায় জাল দিয়ে ধরা। সে-ও খুব কঠিন। আগে জানতাম না।
প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই একজন
অত্যন্ত ক্রুর, হিংস্র, প্রতিশোধস্পৃহা যুক্ত, হিংসাপরায়ণ, জিঘাংশু খুনী বাস করে। তা
মাঝে মধ্যে সব শিক্ষা-দীক্ষা সামাজিক রীতি-নীতি-কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে নিজের আদি জৈবিক
প্রবৃত্তির নিবৃত্তি সাধনে আমাদের মাথার ভেতর তান্ডব নৃত্য করে। আমার মধ্যে সেই আনন্দের
সঞ্চার হয়েছিল, যেদিন জানলাম, পরদিন সকালে মামারবাড়ির পুকুরে মৌরলা মাছ ধরা হবে। আমি
যে মৌরলা মাছ খেতে তখন খুব ভালবাসতাম তা নয়। আনন্দ হল এই ভেবে যে, “এইবারে বাছাধন যাবি
কোথায় তোরা! আমার ছিপে একটা দু’টো করে ধরা দিলে তোদের বংশ উজাড় হত না। দেখ এখন! পালানোর
পথ পাবি না! হুঁ হুঁ!!”
পরদিন জানলাম, মৌরলা মাছ ধরতে
আগে ‘পুকুর ছানতে’ হবে। সকাল আটটার মধ্যে। বেশি বেলা হলে, মিশন আবোর্ট। লোকে চা ছাঁকে,
দুধ ছাঁকে, বালি ছানে; কিন্তু পুকুর ছানবে সে তো কোনোদিন শুনি নি। আর কি দিয়ে বা ছানবে,
অত বড় ছাঁকনি বা চালনি কোথায়? বেলা গড়ালেও নাকি আবার অসুবিধা, তখন ঠিক করে ছানা যাবে
না।
বড়মামাকে জিজ্ঞেস করলাম। বলল,
-
ধুর পাগলা, তুই
মাছই খাস না, অত জেনে কি হবে? তার থেকে লক্ষ্য রাখবি যে জেলেরা ওই ল্যাঙোটের ভাঁজে
ভাঁজে পাকা রুই নিয়ে লুকিয়ে রাখছে কি না।
-
ওই অত ছোট ল্যাঙোটের মধ্যে? এ আবার সম্ভব নাকি…!
-
হ্যাঁ রে ওরা
পারে…ভাল করে লক্ষ্য রাখবি।
-
আরে ধরে লুকিয়ে
রাখলে তো ছটফট করবে, আমরা সবাই বুঝতে পারব।
-
না রে, ওরা এমন
টান দিয়ে বেঁধে রাখে যে মাছ আর নড়ে না। আর এমন কায়দায় বেঁধে রাখে যে শরীরের সঙ্গে মিশে
থাকে।
যে সব জেলেরা
মাছ ধরতে এসেছিল সেদিন, তাদের বয়েস বাইশ থেকে তিরিশের মধ্যে। গায়ের রঙ, এখনকার শহুরে
ভাষায় ‘কফি মোকা’। টান টান চেহারা। পেশির বাহুল্য নেই কিন্তু পেশির নৈপুন্যের ছাপ ভরপুর,
পা থেকে কাঁধ অবধি। ভাঙা চোয়াল। সারা শরীরে এক ফোঁটা মেদ নেই। চামড়া এমন সুন্দর যে
সূর্যের আলো-ও পিছলে পড়ে যাবে যেন। আমার সেদিন ওদের দেখে সত্যি বলতে সদ্য পড়ে শেষ করা
‘অমর চিত্র কথা’ সিরিজের ‘একলব্য’-র কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল। বড়মামা যা-ই বলুক না কেন,
ওরা ওসব চুরি টুরি করতে পারে না।
মনে পুকুর
ছেনে ফেলা নিয়ে যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল তার উত্তর পেলাম ছোট মাইমা-র কাছে। মাইমা বলল,
-
মৌরলা মাছ ধরতে
মশারির মত সূক্ষ্ম জাল লাগে। সেই জালের সুতোর জোর কম। পুকরের বড় মাছেরা ওই জাল ছিঁড়ে
দেবে তো।তাই আগে কয়েক দফায় বিভিন্ন সাইজের বড় মোটা জাল দিয়ে তুলনায় বড় মাছদের আলাদা
করে নেওয়া হবে।
-
আলাদা করে তুলে
নিলে তো ওরা সব মরেই যাবে।
-
না না, তোলা হবে
না, পুকরের এক কোনে কোনঠাসা করে পুকরের জলের মধ্যেই আটকে রাখা হবে বড় মাছেদের। তখন
বাকি পুকুরে শুধু পড়ে থাকবে মৌরলা মাছ। তখন মিহি জাল দিয়ে সারা পুকুরে এক দিক থেকে
আর এক দিকে জেলেরা ঘাই দিয়ে দিয়ে সব মৌরলাগুলোকে জালে তুলবে। বুঝলি?
-
বুঝলাম।
-
এবার দেখ।
-
আচ্ছা।
আমি পুকুরের
অন্য পাড়ে গিয়ে বসলাম একা দেখতে, যে পদ্ধতিটা মাইমার বলা কথার সঙ্গে মেলে কি না।
হুবহু মিলে
গেল। চার জন জেলে মিলে পুকুরটাকে তোলপাড় করে ফেলল, প্রায় আধঘন্টা ধরে। তারপর আরও আধঘন্টা,
মৌরলাদের নির্বংশ করতে পুকুর থেকে। সব ব্যাটা জালে আটক!!!
আলুমিনিয়ামের
হাঁড়িতে অতি ক্ষুদ্র কালো কালো সহস্র বিন্দু ডিজাইন করা তাল তাল রূপো ঝরতে লাগল যেন।
কালো বিন্দু গুলো মৌরলার চোখ। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম, জেলেদের পাশে বসে। ওদের
গায়ের আঁশটে পাঁশুটে গন্ধে সবাই যখন নিরাপদ দূরত্বে, আমার বাহ্যিক জ্ঞান লোপ পেয়েছে।
আমি দেখতে লাগলাম, থরে থরে জ্যান্ত মৌরলা মাছেদের কেমন নির্দয়ভাবে দাঁড়িপাল্লায় তুলে
ওজন করে তারপরে হাঁড়িতে ভরে দেওয়া হচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতে ওই জেলেদের মধ্যে একটি ছেলে
চার –পাঁচ বছর বয়েস হবে, আমাকে এসে বলল,
-
আমাকে পইসা দে
না র্যা…শনপাবড়ি খাব।
আমি থতমত
খেয়ে ঘোর থেকে বেরিয়ে বললাম,
-
আমার কাছে তো
পয়সা নেই।
বাচ্চাটার
বাবা বাচ্চাটাকে বলল,
-
এই ভাগ এহান থিয়েন…সারাদিন
শুধু পইসা পইসা…(আমার দিকে তাকিয়ে) তুমি কিচু মনে কোরো না গো বাবু…
-
না মানে আমার
কাছে সত্যিই নেই…দাঁড়াও বড় মাইমা কে বলছি, দিতে।
জেলে টা
আমাকে আস্তে আস্তে বলল,
-
একদম বুলো না
বাবু, আমাকে আর ডাকবেক লাই, থাইলে আর। আরে আমার কাসেও সত্যি-ই পয়সা লাই…নইলে আমি তো
দি দিতুম…এই ইখান থিয়েন ভাগের মাচ লিয়ে বাজারে গিয়ে বেচলে পইসা পাব। তহুন অরে খাইয়ে
দিমু…তুমি ভেব লা অত।
আমি খুব কষ্ট পেলাম মনে মনে।
আমার ক্ষমতা কত ক্ষুদ্র আর সীমিত বলে। একটু পিছনে এসে দাঁড়ালাম।
এ কি!!!! জেলেটার ল্যাঙটের
পিছনে একটা মাছের ল্যাজের অংশ বেরিয়ে! বড়মামা ঠিকই বলেছিল…যাই বলে দিই। ধরিয়ে দিই লোকটাকে।
আমাদের সকলের সামনে দিয়ে চুরি! মামদোবাজি!
পরক্ষণেই চোখ পড়ে গেল বাচ্চাটার চোখের দিকে। ওর করুণ অভুক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে আমার আর কাউকে কারোর কাছে ধরানোর রইল না। আমি ততদিনে জানতাম, রোগা লিকলিকে চেহারায় বিশাল একটা ভুঁড়ি মারাত্মক অপুষ্টির জানান দেয়।আমি কাউকে কিছু বললাম না। মনে হতে লাগল, আমি যেন বর্ণপরিচয়ের মাসীর মত চুরিকে আস্কারা দিচ্ছি। কিন্তু নিজেই সেই যুক্তি ধুয়ে মুছে দিলাম, কারণ আমার সামনে বাড়ির বড়রা মাছ দাঁড়িপাল্লায় ওজনের সময়ে বার বার বলে গিয়েছেন, পাল্লায় ব্যালেন্সের সমস্যা আছে। জেলে বেচারা সামনে দেখিয়ে দিয়েছে যে সে সব কিছু নেই। তাতেও বলা হয়েছে, ওদের নাকি আঙুলের কসরৎ আছে। মাঝে মাঝে মাছ ওজন হচ্ছে না কি সোনা, বোঝা যাচ্ছিল না, এমনই চুলচেরা করে মাপতে বাধ্য করা হচ্ছিল জেলেদের। আমরা যতই নাকি নজর রাখি না কেন, ওরা নাকি ওজনে চুরি করবেই। সব দেখে কেমন মায়া হল। ল্যাঙটে লুকোনো রুইমাছটা যেন আমার ওই বাচ্চাটিকে দেওয়া খাবার, এই ভেবে আমি ওখান থেকে সরে গেলাম। আমার মৌরলা মাছ ধরা দেখার উৎসাহে বেশ ভাঁটা পড়ল। আর কিছু, জানা, দেখা বা শেখার ইচ্ছে রইল না।
সেদিন দুপুরের খাবারের পাতে
অনেক কিছুর সঙ্গে মৌরলা মাছের ঝাল রান্না হয়েছিল। সবাই জানে আমি মাছ ধরি, কিন্তু খেতে
খুব একটা পছন্দ করি না। কিন্তু সেদিন চেয়ে নিলাম। বুড়ি দিদার হাতের রান্না নিয়ে কিছু
বলার নেই। যে কোনো প্রফেশনাল শেফ বাঙালী রান্নায় ডাহা ফেল মেরে যাবে ওনার কাছে, সে
শুক্তো থেকে আমড়ার চাটনি পায়েস অব্দি, যা ই হোক না কেন। সেদিন অবশ্যই ছিল মৌরলা মাছের
ঝাল। স্বাভাবিক ভাবে, এই মাছের ভাজা, চচ্চড়ি বা চাটনি উপাদেয় বলে জানতাম। কিন্তু সেদিন
যখন প্রথম ‘মৌরলা মাছের ঝালদে’ চেখে দেখলাম, অনন্য অনুভূতি। সামান্য একটা তিতকুটে ভাব
আছে, কারণ, জানলাম, মৌরলা মাছের পিত্তি গালা যায় না, এতই ছোট।
প্রথম মৌরলা খাবার চেষ্টার
কারণ ছিল ওই শিশুটির চোখ। আমাকে যে পুষ্টিকর ভাল খাবার খাওয়ানোর জন্য আদরের আকারে অনুনয়
বিনয় মামার বাড়িতে করা হত, অথচ আমি গর্বের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করতাম, তা অন্য এক জনের
কাছে স্বপ্ন, এই ভেবে সেদিন চেটেপুটে খেলাম।
দিদা ফোকলা দাঁতে হেসে বলল,
-
মৌরালা কেমন লাগল?
-
ভাল।
-
চোখের জ্যোতি
বাড়ে…
সত্যি-ই আমার অন্তর্দৃষ্টি খুলে গিয়েছিল সেদিন।
২০২২
গত
সপ্তাহে খুব ব্যস্ততার মধ্যে তারা কাকীমা (আমার মাসতুতো শ্যালীকার শ্বাশুড়ি মাতা, তাহলে
বুঝুন যে আমার খাদ্যরসিকতা কোন স্তরে গিয়ে পৌঁছেছে) যখন আমাকে বললেন,
-
যাবার পথে আমার
সঙ্গে একবার দেখা করে যাবে। তোমার জন্য মৌরলা মাছ রাখা আছে।
অন্তর্দৃষ্টি-তে
পলক পড়ে সে মহাপ্রস্থানের পথে গমন করবে।

